টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণঃ ঘুরে আসুন হাওরকন্যা সুনামগঞ্জ থেকে

সুনামগঞ্জকে বলা হয়ে থাকে 'হাওরকন্যা'। আর এসকল হাওর ঘিরে জেলার এই পরিচিতির মূলে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সম্ভাবনাময় জলাভূমি। আর এই টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় 'রামসার সাইট'। আর প্রথমটি হচ্ছে সুন্দরবন। সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে ঘেরা এই টাঙ্গুয়ার হাওর প্রায় ১৭ বছর ধরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। হাওরের সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগও। গাছপালা, মাছ, পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধারে ঘেরা এই হাওর। রূপে-গুণে অনন্য টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের। আর শীতের সময় এখানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ ঘটে।





হাওর বলতে মুলত সুবিশাল গামলা আকৃতির অগভীর জলাভূমিকে বোঝায়। যা বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়ে ঢেউহীন সাগরের আকার ধারণ করে। বছরের প্রায় ৭ মাস হাওরগুলো থাকে পানিতে ডুবে। আবার শীতকাল ও গ্রীষ্মকালে হাওরগুলিকে মনে হবে সীমাহীন প্রান্তর। আর পানি কমে গেলে তখন এসব হাওরের মধ্যে থাকা বিলগুলোর পার জাগে। প্লাবনের ফলে জমে উর্বর পলিমাটি সেখানে কৃষকরা ফলায় ধান। 

সুনামগঞ্জের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপর ও ধরমপাশা উপজেলায় এই হাওরটির অবস্থান। এটা ২টি উপজেলার ৪ ইউনিয়নের মোট ১৮টি মৌজা মিলে তৈরি। এই হাওরটির আয়তন প্রায় ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরটিতে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ১০৯টি বিল রয়েছে। তবে প্রধান বিল সংখ্যা ৫৪টি। এই হাওরটির মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষাকালে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। এখানে ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ এই হাওরের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় মানুষেরা টাঙ্গুয়ার হাওরকে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল বলে থাকেন। হাওরের উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। আর সেখান থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমেছে এই হাওরে।

বর্ষা ও শুকনা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের দুই রূপ দেখা মেলে। বর্ষাকালে দিগন্তবিস্মৃত জলরাশি। আর এই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে করচ ও হিজলগাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রামগুলোকে মনে হয় যেন অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপ। যেন দ্বীপগুলি জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। হাওরের জলে ঢেউয়ের খেলা করে যখন, দর্শনার্থীদের মন ভরে যায় তখন। এখানে আকাশে শুভ্র মেঘের ওড়াউড়ি করতে দেখা যায়। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে হাওরের পানি নীল হয়ে যায়। ছবির মতো মনে হয় তখন পুরো এলাকাকে। তবে শুকনার সময় হাওরে জল কম থাকে। পুরো হাওর অঞ্চলকে চোখের সীমানায় নিয়ে আসতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়াতে এখন বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যে। বিশেষ করে বর্ষার সময় দর্শনার্থীদের জন্যে বেশ কিছু ছোট–বড় নৌকা ভাড়ায় মেলে। আর নৌকাগুলিতে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু আগে যোগাযোগ করা উচিত নৌকাগুলি ভাড়া নিতে। নৌকার পাশাপাশি রয়েছে স্পিডবোটও। তবে স্পিডবোটের ভাড়া বেশি। জোছনা রাতে হাওরে দর্শনার্থীরা নৌকায় নেচে গেয়ে আনন্দ করেন। দিগন্তজোড়া জলরাশি দেখে আপনি দুপুরের পর পরই টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে পারেন। আর নৌকা যতই সামনে এগুতে থাকবে ততই পানি স্বচ্ছ হতে থাকবে। তারপর এক সময় হাওরের তলা পর্যন্ত দেখতে পারবেন। সারা দিন হাওরের বুকে ভ্রমণের পর,  নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত আপনার স্মৃতির পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।


টাংগুয়া ভ্রমণের সতর্কতা ও কিছু পরামর্শঃ

  • হাওর ভ্রমণের পূর্বে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিবেন।
  • হাওরে রওনা হবার আগে তাহিরপুরে থানা থেকে আপনার নিরাপত্তার জন্যে জিডি করে নিবেন।
  • সব সময় যে কোন কিছুর জন্যে দামাদামি করে নিবেন।
  • এখানে একসাথে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে। আর ৪-৫ জন বা ৮-১০ জনের গ্রুপ হলে ভালো। খরচ হবে কম।
  • হাওরে অবস্থানকালে বজ্রপাত হলে নৌকার ছৈয়ের নিচে অবস্থান করুন।
  • কখনোই খাবারের অতিরিক্ত অংশ/উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদি হাওরের পানিতে ফেলবেন না।
  • উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক বা যন্ত্র সাথে নিবেন না।
  • রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো জালাবেন না।
  • হাওরের মাছ, বন্যপ্রাণী কিংবা পাখি ধরা বা এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন কোন কাজ করবেন না।
  • আর সতর্ক থাকবেন হাওরের জলাবনের কোন রুপ ক্ষতিসাধন না করার ব্যপারে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url