গল্পঃ বর্ষার জলগুলি

বৃষ্টির পরেও কিছু মেঘ রয়ে গেছে আকাশে। আবার বৃষ্টি হতে পারে। তবে বর্ষা নামের মেয়েটার এসবে খেয়াল নেই। বৃষ্টি হলে সে বৃষ্টিতে ভিজবে। জ্বর এলে জ্বরকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু নিজের প্রকৃতি কখনও পাল্টাবে না।
মোটামুটি সুন্দর চেহারার এই মেয়েকে শহরের রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায়। সে অলিতে-গলিতে ঘুড়ে বেড়ায়। চিনাবাদামের খোসা ফেলে রাস্তায়। দোকানের নাম মনে মনে মুখস্থ করে। রোদ কিংবা চাঁদের আলো দুটোই প্রিয়। পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয়ে গেলেই বা কী না গেলেই বা কী! ওর কিছু যায় আসে না। বেশী ছিঁড়ে গেলে বাসায় গিয়ে পাল্টিয়ে বড়ো বোনের স্যান্ডেল পড়ে বের হয় বোনকে না বলেই। অল্প ছিঁড়লে মুচি খোঁজে রাস্তায় রাস্তায়। অবশ্য বর্ষার মুখস্থ হয়ে গেছে কোথায় কোন মুচিকে পাওয়া যাবে। মুচিদের সাথেও ভালো খাতির ওর।

বৃষ্টিতে বের হলে সমস্যা হয় আমার। অল্পতেই ঠান্ডা লাগে। বৃষ্টি থামার সাথে সাথেই বের হলাম। দেখা হলো বর্ষার সাথে।
''কী খবর বর্ষা? কোথায় যাও?
''এই তো ভাইয়া ঘুরতে বের হলাম! মার্কেটে যাবো। একটা নতুন আইসক্রিমের দোকান খুলেছে। আইসক্রিম খাবো।''
''এই বৃষ্টির দিনে আইসক্রিম? তোমার আম্মু রাগ হয় না? আচ্ছা খেলে না হয়! ঠান্ডা লাগলে?''
''লাগুক না! গলা ব্যাথা হলে খুব ভালো লাগে। তখন কফির টেস্ট অন্য রকম লাগে। আম্মু রাগ হবে ক্যানো? আমি কি কখনও পড়ায় ফাঁকি দেই? আর দিলে রেজাল্ট ভালো হয় কীভাবে? দেখো না, আমি তো সবে এসএসসিতেও গোল্ডেনই পেয়েছি!''
''তা পেয়েছো! তোমার মতো মেধাবী কয়জন হয় বলো? কিন্তু এভাবে ঘুরে বেড়াতে ভয় করে না?''
''না! কে কী করবে? আর করলে করুক না! নতুন একটা অভিজ্ঞতা হবে!''
''কী বলো! ঠিক আছে, তুমি তো এমনই! বাদ দাও। কিন্তু তোমার তো রেজাল্টের খাওয়া এখনও পেলামই না! খাওয়াবা কবে?''
''চলো না ভাইয়া আইসক্রিম খেতে যাই একসাথে? তোমাকে খাওয়াবো।''
বর্ষার রিকশায় উঠতে ভালো লাগে না। সে হাঁটবে। অগত্যা আমিও হাঁটলাম ওর সাথে। মার্কেটে আইসক্রীমের দোকানটা সত্যিই সুন্দর। বর্ষাকে বললাম, ''তুমি টাকা কোথায় পাও এসবের?''
''বাবা দেয়, কখনও মাও দেয়। আমি কিছু চাইলে 'না' বলে না কখনও কেউ।''

সাবস্ক্রাইব করুন:

বর্ষার অদ্ভূত আইসক্রিমে সব ফ্লেভার থাকলো একটু করে। তবে সেই আইসক্রিম না কি হাঁটতে হাঁটতে না খেলে মজা লাগে না। আমরা আইসক্রিম হাতে নিয়ে বের হলাম।
''বর্ষা, তুমি খুব অদ্ভূত, তুমি জানো?''
''হুম, একটু একটু জানি! সবাই বলে। জানো, আমার কোনো কষ্ট নেই। কখনও খারাপও লাগে না। কোনো কষ্ট আমাকে টাচ করে না।''
''তাই? কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের তো এমন হয় না। তুমি অসাধারণ হয়েও খুব সাধারণের মতো কথা বলো, ভালো লাগে।''
বৃষ্টি আবার আসি আসি করছে। সঙ্গে ছাতা নেই। ভিজতে হবে বুঝতে পারছি। হয়তো ঠান্ডা লাগবে, লাগুক! কখনও কখনও অসাধারণ কারো সাথে মিশলে নিজেকেও অসাধারণ লাগে। আমার অমন লাগছে। মনে হচ্ছে আমিও খুব অসাধারণ কেউ!
বৃষ্টি এলো। আইসক্রিম গলে যাচ্ছে পানির ফোঁটার সাথে সাথে। বর্ষা ওর আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে আছে অপার বিস্ময়ে। কি সুন্দর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আইসক্রিমের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে! আমিও ওর মতো হা করে তাকিয়ে আছি ওরই আইসক্রিমের দিকে।
''এ্যাই, তুমি আমার দিকে কি দেখছো ভাইয়া?''
''কিছু না। তোমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে।''
''হি হি হি! তোমারটাও!''
হ্যাঁ আমারটাও গলছে। গলে গলে হাত ভেজাচ্ছে। ঠান্ডা আইসক্রিম হাতে লেগে শিরশির করছে। বর্ষারও কি করছে? ও তো অসাধারণ! যার কান্না নেই, কষ্ট নেই, ব্যাথা নেই! ওর কি শিরশিরি আছে??
''বর্ষা! বৃষ্টিতে তুমি ভিজে যাচ্ছো।''
''আমার ভালো লাগছে ভাইয়া। আমার ভিজতে ভালো লাগে। কেন, তোমার লাগছে না?''

আমার খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টিটা আজীবন হোক। বর্ষা আমার পাশে থাক, আমি হাঁটবো। অনন্তকাল ধরে হাঁটবো। আইসক্রিমটাও অনন্তকাল ধরে গলবে। আমি আনমনা হয়ে যাই ভাবতে ভাবতে। হয়তো খুব অসাধারণ হতে পারি না বলেই বর্ষার মতো নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারি না ক্রমশ কাঁদায় ভরতে থাকা রাস্তায়, হোঁচট খাই।
আশেপাশের মানুষগুলো দোকানের নিচে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে। দেখে ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুইজন হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে দূরত্ব কমে যাওয়াও দেখে উৎসুক লোকজন। হঠাৎ তারা দেখে ফেলে ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরেছে। ধীরে ধীরে হাতে হাতে কাছে আসে তারা।
শুধু সেই দুজনের মাঝে অসাধারণ জনের চোখের পানি কেউ দেখতে পারে না। ঘোর বৃষ্টিতে জলটা হারিয়ে যায়।
আমি অবশ্য বর্ষার চোখের জল অনুভব করতে পারি। হয়তো একজন সাধারণের সঙ্গ পেয়ে পৃথিবীর অসাধারণতম নারীটিও এই মুহুর্তে খুব সাধারণ কেউ!
তার চোখেও ভালবাসা জল এনে দেয়। তার মনেও অনুভূতি আসে, আবেগের জোয়ার ওঠে। আইসক্রিম পুরোপুরি গলে যায়, গলে যায় ধরণীর সব বাঁধাও।

সাবস্ক্রাইব করুন:
by- নিশাত আরেফিন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url