গল্প : রং নাম্বার

'স্যার কখনো রং নাম্বারে প্রেম করেছেন?'
আদিবার মুখে হঠাৎ এই ধরনের কথা শুনে চমকে উঠলাম।

আদিবা ক্লাস ফাইভে পড়ে,
তাকে আমি দুই বছর যাবৎ পড়াচ্ছি। পড়াশুনা বাদে কখনো বারতি আলাপ হয় না। তাই প্রথম এমন আজব কথা শুনে কিছুক্ষনের জন্য থমকে গিয়েছিলাম।
'তাই রেগে গিয়ে বললাম 'স্যারের সাথে এসব কি ধরনের ফাজলামো হচ্ছে?'

'আদিবা কিছুটা ভয় পেয়ে কুচকে গেল। আমাতা আমতা করে সে বলল,
- 'না স্যার আসলে গত কালকে টিভি তে রং নাম্বার নামে একটা মুভি হচ্ছিলো তো, সেই মুভির হিরোর সাথে আপনার চেহারা খানিক টা মিল তাই আপনাকে এটা জিজ্ঞাস করলাম।

বুঝলাম আদিবা আমর কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিল তাই ওকে আস্তে করে বললাম,
আচ্ছা ঠিক আছে এখন মন দিয়ে পড়ো।'


রাত নয়টায় টিউশনি শেষ করে রাস্তা দিয়ে হাটছি, কানের মধ্যে শুধু আদিবার কথাটাই বাজছে "স্যার কখনো রং নাম্বারে প্রেম করেছেন?"

দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উদ্দেশহীন ভাবে হাটছি। মনের মধ্যে হাজারো ব্যথা গুলো উকি দিচ্ছে এত বছর পর। মনে পড়ছে জ্যোৎস্না রাত, আকাশের তারা গুনা, রাত জেগে কথার বলার পাগলামি।

'আমি তখন H.S.C প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। কোন এক সকাল বেলা,

ঘুম থেকে উঠেই দেখি Unknown নাম্বারে একটি মেসেজ।

'হ্যালো নিশি এটা'ই কি তোর নাম্বার? আমায় একটা ফোন দে।''

'মেসেজের আগা মাথা কিছু তখন বুঝলাম না, ভাবলাম ভুল নাম্বারে হয় তো চলে এসেছে। কিন্তু কেন জানি কৌতুহল মেটাতে সন্ধ্যা বেলা একট কল দিলাম।
তিন চারবার রিং হবার পরও ফোন রিসিভ না করায় রাগে নাম্বার ডিলেট করে দিলাম।

রাত ১০টায় আবার ওই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। রিসিভ করে বললাম ''হ্যালো কে"??
ওপাশ থেকে উত্তর নেই।
'বার বার হ্যালো হ্যালো করতে করতে যখন কল টা কেটে দিব, তখনি মিষ্টি কন্ঠে একটি মেয়ে বলে উঠলো
"ভাইয়া সরি মেসেজ টা একটা ডিজিট ভুল হয়ে আপনার নাম্বারে চলে এসেছে।
আমি একটু হতভম্ব হয়ে মেয়েটার কথা শুনে যাচ্ছি। যদিও আমি তখন টগবগে তরুন সবে মাত্র S.S.C পাশ করে ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে উঠেছি। তাই ওপাশ থেকে মিষ্টি ভয়েস টা আমাকে কেমন জানি টানছিল। চাচ্ছিলাম মেয়েটার সাথে কথোপকথন যেন একটু দীর্ঘ হয়।
বললাম ' আপনার নাম কি?
- জি আমার নাম মুমতারিন তমা'
- "থাকেন কোথায়?
-" গাজীপুর"
-ঢাকা গাজীপুর?
-হ্যা'
-কোন ক্লাসে পড়েন?
-'ক্লাস টেন।

তখনি বেরসিক ফোন বন্ধ হয়ে গেল, দেখলাম চার্জ শেষ।

সাবস্ক্রাইব করুন:

আবার রাতের বেলা ওই নাম্বার থেকে আবার একটা মেসেজ আসল 'ভাইয়া আপনি কি প্রেম করেন'?
আমি তাৎক্ষনিক রিপ্লাই দিলাম এই বয়সে কেউ প্রেম করে??

ঠিক এভাবেই আমাদের চ্যাটিংয়ে' গল্প শুরু। চার দিন চার রাত শুধু চ্যাটিং চলল।
আস্তে আস্তে ফোনে কথা বলা শুরু হল। সাত দিনের মাথায় বুঝলাম আমারা একে অপর কে ভালবাসি।
সারা দিন রাত ভাবি শুধু মেয়েটি কে নিয়ে। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় মেয়ে টি আমায় ফোন দেয়। রাতে পড়ায় মন বসাতে পারি না, সারা রাত ভরে কথা চলে, আলাপের ফাকে কখন যেন ফজরের আজান দিতে থাকে।
আমরা একে অপরকে আদর করে জান বলে ডাকতাম।
সময় গুলো স্বপ্নে মত কাটছিল।

এমন না যে আমাদের ভুল বুঝাবুঝি হয় নি। একদিন মাঝ রাতে সে আমার কলওয়েটিং পেয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে আমার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম।
যদিও এটা এতদূর থেকে তাকে বুঝানো কষ্টসাধ্য ছিল।

একটা সময় সেই স্বপ্নঘোর কাটতে লাগলো।
পাঁচ মাস প্রেম করার পর মেয়েটি ফ্যামিলি কোন ভাবে ঘটনাটি জেনে যায়। তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেয়। সে লুকিয়ে লুকিয়ে তার মার ফোন দিয়ে মিনিট কয়েক কথা বলত। এই অল্প কথার মাঝেই তার অভিমান ফুটে উঠত, বলত 'তুমি আমায় ঠকাচ্ছ না তো? আসলেই কি সে দিন এত রাতে তোমার বন্ধুর সাথেই কথা বলছিলে?

কিন্তু একদিন তার মার ফোন দিয়ে কথা বলার সময় আবার তার বাবার কাছে ধরা খায়।

সেখানে কি হচ্ছিল সেটা আমার জানার সুযোগ ছিল না।

হাবীবের একটা গান ছিল 'দিন গেল গো তোমার পথ চাহিয়া'
এই গান শুনে শুনে অস্রু বির্সজনে আমার দিন যেতে লাগল।
আমার অপেক্ষার প্রহর আর কাটে না। তার ফোন আসে না, কোন খোঁজ নাই।

সেই গঠনার ১ মাস পর মেয়েটি ফোন আসে কান্না করে বলছে আমায় নিয়ে যাও, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছে। তুমি যদি না আসো আমি আত্মহত্যা করব।'

আমি তখন ঢাকার কিছুই চিনি না। কি করব কিছু বুঝতেছিনা, তাকে বললাম 'জান ধৈর্য্য দর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

হ্যা সব কিছুই ঠিক হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার অনুভুতি গুলো কে হত্যা করে।
'তার বাবা বিয়ে ভেংঙে দিয়েছিল এক শর্তে আমার সাথে কোন রিলেশন রাখা যাবে না।'

মেয়ে টি শেষবারের মত বিদায় নেয়। শত চেষ্টায়ও তাকে বুঝাতে পারিনি।

চিনি না জানি না, কখনো দেখি নি, তবু স্বপ্ন ছিল তাকে ছুঁয়ে দেখব। স্বপ্ন ছিল তার সঙ্গে মিলিত হব। দু'জনে মিলেমিশে হেটে যাব অনেক দূর ।"
কিন্তু তার এই হঠাৎ বিদায় আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।


সম্পর্ক শেষ করে দেবার পরও আমি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি ।

কিন্তু বেশ কয়েক বছরপর তার ফোনে একবার মেসেজ দিয়েছিলাম। সে উত্তর দিয়েছিল "প্লিজ ভাইয়া আপনি আর আমায় মেসেজ দিয়েন না"

মেয়েটি কে আমি কখনো বলতে পারিনি তার ব্রেকআপ করে দেবার যন্ত্রণা থেকে ভাইয়া ডেকে কষ্ট দেবার যন্ত্রণা কত টুকু ছিল।


রাত দুটো। আদিবা দের বাসা থেকে বের হয়েছি অনেক আগেই। এই অন্ধকার মিটিমিটি তারা জ্বলার রাতে খোলা মাঠে আকাশের নিচে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি । ভাবছি,
এই খোলা মাঠ, রাতের আকাশ, ঝলমল তারা গুলো আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতির সাক্ষী ছিল। কোন এক সময় মেয়ে টি বলেছিল আকাশের তারা গুনলে নাকি মন ভাল হয়ে যায়, কিন্তু এখন আকাশের দিকে তাকালে ওই তারা গুলো আমার মন খারাপের কারণ হয়।

সাবস্ক্রাইব করুন:

লেখা : মিয়াদ রহমান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url