সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পঃ অপূর্নতা



তথাপি আপু যখন ভার্সিটি তে উঠলো তখন আমি ক্লাশ টেনে। আপা আর আমি প্রায়ই এক রুমেই থাকি। আপার বিছানা বারান্দার দরজার পাশটায়। ছোটো বেলা থেকেই দেখে আসছি আপার চঞ্চল স্বভাব। পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, স্কুলের ছেলেরা তো রীতিমতো ভয় পেত আপাকে। ছেসরা বৃত্তিয় কিছু ছেলে ছাড়া খুব একটা প্রেমের প্রস্তাব যদিও আপা পেত না তবে অনেকেই যে আপাকে পছন্দ করতো তা আমি জানি। আপার রনমূর্তিকে আমিও ভয় পেতাম আর সেই সুবোধ ছেলেদের কথা আর নাই বা বললাম। এমনও হয়েছে, আপার হয়তো একজন কে ভালো লেগেছে দেখা গেলো সেই ছেলেটারও আপাকে ভালোলাগে কিন্তু সেই সুবোধ বালকটি আপাকে কিছুই বলতে পারে না। শেষে আপা রেগে গিয়ে এক ধমক দিতেই ছেলে গায়েব। এই পাড়াতে আমি আর তাকে দেখিনি। তবে কলেজে উঠার পর এ স্বভাব অনেকটা কমেছিল।

তথাপি আপা আমার চাচাতো বোন। আমার মেঝ চাচার ছোট মেয়ে। বড় চাচা মেঝ চাচা আর আমাদের পরিবার এক বাড়িতেই থাকি। আমরা তিম বোন, আর তথাপি আপারা দুই বোন। তথাপি আপা যদিও বাড়ির ছোট মেয়ে কিন্তু কিন্তু আমাদের কাছে সে বড় বোনের মত।কেননা ওর বড় যে দুজন আছে।তারা বাসায় থাকে না।একজন বিবাহিত অন্যজন পড়ালেখার জন্য সিলেট থাকে।আমার বোন যদিও তার বড় কিন্তু ক্লাসের দিকে ছোট হওয়াতে ছোট হিসেবেই ধরা হই।অতএব আপা ই এখন বড় মেয়ে। বাড়ির বড় মেয়ে শব্দটা কানে বাজতেই চোখের সামনে যেই চিত্রটা ভেসে উঠে আপা ঠিক তার বিপরিত।

অবশ্য আমরা তাকে বড় বোন হিসাবেই পেয়েছি। রাতে রাগ করে না খেয়ে ঘুমালে মাঝ রাতে আপা নিজে হাতে খাইয়ে দিত। পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়ার সময় মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে আপা চা বানিয়ে আনতো।আপার রনমুর্তি ভয় পেলেও আপার চঞ্চল স্বভাবটা আমার বেশ ভালো লাগতো। আপা বাড়ি না থাকলে বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে। তখন বড়দের মধ্যেও একটা শুন্যতা টের পাই।

ডানপিটে স্বভাবের জন্য আপা পুরো পাড়ায় ফেমাস ছিলো। তবে আমার এই রনচন্ডি আপাও একদিন একজনকে ভালোবাসলো। একটা ডানপিটে, জেদী মেয়েও যে বুকে এতোটা ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে তা আমার ধারনার বাইরে ছিলো। একটা সাধারন চেহারার মাঝারি গরনের একজন মানুষকে আপা ভালোবেসেছিলো। তার ভালবাসার গভিরতা যতবার মাপতে চেয়েছিলাম ততবার প্রশ্ন করেছিলাম কি আছে আকাশ ভাই এর মধ্যে? উত্তরে আপার একটা লাজুক হাসি পেয়েছিলাম। আমার রনচন্ডি আপার এই রুপটা আমি কোনোদিন দেখিনি। কি সুন্দরই না লাগছিলো আপাকে। নিজের পছন্দের মানুষের কথা বলতে গিয়ে সব মেয়েদেরই বোধহয় এভাবে চোখের পাতা নেমে যায়, জোর করে চেপে রাখা হাসি ঠোটের কোনায় লাজুক ভাবে উঁকি দেয়।

আকাশ ভাইয়ার সাথে আপার পরিচয় ফেসবুকে।অনেক কষ্ট করে আপা তার ভাল লাগার মানুষটিকে খুজে নিয়েছিল।সে থাকত আপার থেকে অনেক দূরে তারপরও সকাল থেকেই আপার ছটফটানি ভাবটা বেড়ে যেত।আকাশ ভাইয়া মেসেজ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা লাজুকতাও যোগ হতো। লাজুক ভাবে উকি দিত আয়নার সামনে,একবার বেনী করতো চুলে, একটু পর চুল খুলে শুধু সামনের কিছু চুল পেচিয়ে রাখত, এভাবে কিছুক্ষন থাকার পর আবার নতুন স্টাইল করত। চোখে কাপাকাপা হাতে আইলাইনার দিত, যেদিন আইলাইনার বাকা হয়ে যেত আপার আফসোস এর সীমা থাকত না। যে আপা কোনো দিন ঠিকমত কালার মেচিং করে জামা পরে নি সেই আপাই আকাশ ভাইয়ার জন্য ছবি তোলার আগে চোখে কাজল দিত, প্রতিবার কাজল দেয়ার সময় তার চোখে পানি আসত বুঝতাম পেন্সিল কাজল এর গুতোয় চোখ যন্ত্রনা করছে তবু আপা কত যত্ন করে সাজছে তার প্রীয় মানুষটার জন্য। শুধু একটাই চাওয়া তার চোখে ভালো লাগুক, লাজুক কন্ঠে একবার সে বলুক " ভালো লাগছে তোমায় "।

আপাকে সারাক্ষনই খুব সুখি সুখি লাগতো৷ সুখি মানুষদের আশে পাশে থাকলে নিজেকেও সুখি সুখি লাগে। তবে হঠাৎ একটা ঝড় উঠলো বাড়িতে।আকাশ ভাইয়া আর আপার কথাটা সবাই যেনে গেলো। খুব ঝড় গেলো আপার ওপর দিয়ে। আকাশ ভাইয়া মেসেজ দেয়া বন্ধ করে দিল।হয়তো আপাই তাকে বলেছিলো কারন আপা জানত চাচা ভাইয়াকেও খারাপ কিছু বলবে।আপার কাছে বড় ভাইয়া ছেলেটার নাম্বার চেয়েছিল।।কিন্তু ভাইয়াকে আড়াল করে আপা পুরো দোষটা নিজের ঘাড়ে নিলো। সবাই জানল যে আকাশ ভাইয়া মোটেও আপাকে পছন্দ করত না, আপাই তাকে পছন্দ করত। বাড়ির সবাই আপার ওপর খুব রাগ দেখালো, চাচা আপার সাথে কথা বন্ধ করে দিলো কেন সে তার চেয়ে ছোট একজনের প্রেমে পড়বে।তাও আবার এত দূরের।চাচা এ ও বলেছে,যদি মানার মত হতো তাহলে মেনে নিত ।
এতো ঝামেলার মধ্যেও আপা ঠিকই লুকিয়ে ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করল।। আপার সাথে অন্য ছেলের রিলেশন আছে বলেই আপা যোগাযোগ বন্ধ করেছিল।তার ওপর দিয়ে এতো ঝড় যাচ্ছিলো তা আকাশ ভাইকেও বুঝতে দিলো না।তাদের যে কদিন কথা বলা বন্ধ ছিল।আকাশ ভাইয়া আমায় মেসেজ দিত।যখনি জিজ্ঞেস করত আপা কেমন আছে?আমি থমকে যেতাম কীভাবে বলি?আপা ভাল নেই একটুও ভাল নেই।।তাও অনেক কষ্টে বলতাম ভাল আছে।

আকাশ ভাইয়া আপার প্রায় ১ বছরের ছোট। বাড়িতে আপার বিয়ের কথা শুরু হতে হতে ভাইয়া নিশ্চয়ই একটা ভালো যায়গায় যেতে পারবে না।।কিন্তু তাও হয়তো আপার পছন্দটা সবাই এভাবে ফেলে দিতে পারবে না হয়তো মেনেও নিবে। আমিও জানতাম সময় এর সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক দিন পর বাড়ির অবস্থাও খানিকটা শান্ত হলো। সবাই ধরে নিলো বাচ্চা মেয়ে ভুল কর ফেলেছে, এমন ভুল উঠতি বয়সের মেয়েরা করেই। ভালোভাবে বুঝালেই ঠিক হয়ে যাবে। হলো ও তাই। সব আগের মতন হয়ে গেলো তবে বাড়ির সবার চখের আড়ালে যে আপা আকাশ ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ রাখত তাও আমার অজানা ছিলোনা। হাজার খারাপ সময়েও আপার মুখে একটা সুখি সুখি ভাব ছিলো, হয়তো এর কারন দূর থেকেই হোক প্রিয় মানুষটা তার পাশেই আছে।

কোনো একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে মন্মালিন্য হয়।আপার মুড দেখেই আমরা বুঝতে পারি হয়তো কিছু একটা হয়েছে।আমার আপু আর বড় চাচার মেয়ে আপাকে বুঝাতে শুরু করে।ভুলে যেতে বলে আকাশ ভাইয়াকে। এও বলে যে আকাশ ভাইয়ার জিএফ আছে।ভাল লাগার কিছু সময় কাটাচ্ছে শুধু আপার সাথে।নইতোবা একটা ছেলে এত রাত জাগে কেনো অহেতুক। আরো নানা ভাবে বুঝানো হল আকাশ ভাইয়া অন্য কারো।। সেইদিন রাতে আপা অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলো। সেদিন রাতেই আপাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। জ্ঞ্যান ফেরার পর আপাকে হাজার প্রশ্ন করার পরও এর কোনো কারন জানা গেলো না। বাড়ি ফেরার পর থেকে লক্ষ্য করলাম আপা কেমন বদলে যেতে শুরু করলো।লকডাওনের কারনে সব কোচিং বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পারার অনেক এইচএসসি পরীক্ষার্থী আপার কাছে পড়তে আসতো।বাড়ির একটু দূরেই দুইবেলা করে পড়াত তাদের।। বাড়ি ফিরেও হয় বই নিয়ে বসতো না হয় অন্য কাজ করতো। একই রুমে থেকেও আপার সাথে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো।তবে আমার সেই ডানপিটে আপা বদলাতে শুরু করলো। অবশ্য পরিবর্তনটা খুবই ধীরে ধীরে হওয়াতে আর এসব নিয়ে আপার ব্যাস্ত হয়ে যাওয়াতে বাড়ির সাবার এই দিকটা তেমন নজরে পরলো না।তবে বাড়ির সবার ধারনা ছিলো যে এই বয়সের মেয়েরা খুব তারাতারিই বদলে যায়। তাদের মধ্যে মেচুরিটি চলে আসে। আমারো তাই ধারনা ছিলো তবে আপার মুখে সেই সুখি সুখি ভাবটা যে নেই তা শুধু আমি বুঝতে পারতাম।

অনেকদিন পর আমি ঢাকায় গেলাম মামার বাসায়। পরে একদিন রাস্তায় আকাশ ভাইয়াকে দেখলাম একটি মেয়ের সাথে। আকাশ ভাইয়া মেয়েটার হাত ধরে রেখেছিলো, দুজন এর মুখেই সেই সুখি সুখি ভাব যা অনেক আগে আপার মুখের দিকে তাকালে দেখা যেত।
বাড়ি ফিরে আপাকে বলবনা ভেবেও বলে ফেললাম "আকাশ ভাইয়াকে দেখলাম জানো, একটা মেয়ের সাথে"। আপা নিজের বই এর থেকে মুখ না তুলেই উত্তর দিলো " আকাশের ভাইয়ার জি এফ আছে জানিস নাহ।।হয়তো তুই ওর জি এফ কেই দেখেছিস"। এমন ভাবে কথা গুলো বলল যেন আকাশ ভাইয়াকে আপা চিনে না। রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া কেউ একজন।

তবে আপা হয়তো জানে না আকাশ ভাইয়ার জন্য লেখা সেই ডাইরিটায় ও যা লেখে তা সবটাই আমি পড়ি। তা না হলে হয়তো আমিও বাড়ির সবার মতন আপার অভিনয়ের আড়ালেই থেকে যেতাম। আপার অভিনয় দক্ষতা দেখে আমি রীতিমতো অবাক। এক সমুদ্রের ঢেউ বুকে নিয়ে কি শান্ত ভাবেই না চলছে আমাদের সামনে। কতো ভালোবাসায়ই না বুকে ধরে রেখেছে আমাদের তিন বোনকে আপা।
 মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে আপার ফুপিয়ে কান্নার শব্দ আমার কানে আসে। একটু নড়াচরার শব্দ শুনলেই সব বন্ধ। আপা কখনো মন খারাপ করে একা বসে থাকে না, কখনো তার চোখে পানি দেখি না, সাবার সাথে হাসিমুখে এখনো পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে তবে আপার ভেতরের ঝড় শুধু আমাকে ছুয়ে যায়। মাঝ রাতে যখন আপার ফোপানোর শব্দ শুনি তখন আপাকে জরিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।
অনেক রাতে যখন ঘুমিয়েছি কিনা দেখতে এসে আপা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন খুব বলতে ইচ্ছা করে আপা,আপারে তুমি আগের মতন হয়ে যাও প্লিজ। যখন রাগ করে রাতে না খেলে আপা খাবার এনে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় তখন আকাশ ভাইয়ার ওপর আমার রাগ হয় প্রচন্ড রাগ হয়। তবে আমার রনচন্ডি আপা এখন খুব শান্ত। যে মেয়ে বাসার একজন লোক অসুস্থ হলেই অস্তির হয়ে যেত।
সেবা দিয়েই অনেকটা সুস্থ করে নিত।।সেই আপার ভিতর টা এখন ক্ষত বিক্ষত কিন্তু কাউকে কিছুই বুঝতে দেয় না।।এসব মেয়েরা হয়তো মনের কথা গোপন করার এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।

পরিশেষঃ আপা প্রায় দু বছর পর এবাড়িতে এলো। আপার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। মেয়ের নাম জারা। জারার বয়স দেড় বছর। সবে হাটা শিখেছে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে পুরো বাড়ি ছোটাছুটি করছে যেমনটা ওর মা একসময় করতো। আপা চাচি আর মার সাথে গল্প করছে। সেই সুখি সুখি ভাবটা আপার মুখে আবার ফিরে এসেছে। কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে আপাকে। দুলাভাই বিকেলেই চলে গেলো।
 তাই রাতে আপা জারাকে নিয়ে আমার রুমে ঘুমাতে এলো। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে ঘুমুতে গেলাম। হঠাৎ মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেংগে গেলো আমার। আপা পাশে নেই। উঠে বারান্দার দরজায় দাড়াতেই দেখলাম আপা বারান্দায় বসে আছে, হাতে সেই ডাইরিটা। চাঁদের আলো এসে আপার গায়ে পড়ছে। আলো আধারে এক ঘোর লাগা পরিবেশ। আমি খাটে ফিরে এলাম। কিছু অপুর্নতা চাঁদের আলোয় মিশে যাক।

আপারা পরদিন বেকেলেই চলে গেলো। দুলাভাই নিতে এসেছিলো। নাহ, আপা ভালোই আছে।সেদিনই ঘর গোছাতে এসে সেই ডাইরিটা পেলাম। শেষ লেখা কাল রাতের "না ভুলেও সুখি হওয়া যায়। সুখি হতে হলে একজনকে মুছে ফেলার প্রয়োজন নেই। আজ তোমায় মনে রেখেও আমি সুখি। কিন্তু তুমি সুখি হয়েছো তো আমায় ভুলে?"

সত্যি আজ আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করে আকাশ ভাইয়ারা সুখি হয় তো?

সাবস্ক্রাইব করুন:

সংগ্রহেঃ করনিয়া সিন তাম
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url