একটি মোটর সাইকেল এর গল্প

পাশের বাড়ি রহিমের বাড়ি থেকে, ধোঁয়া আসতেছে,লোকজন দৌড়ে রহিমের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।চারদিকে কোলাহল, "ঐ কে কই আছছ পানি লইয়াই,আগুন লাগজে রে আগুন লাগজে!"

গুরুর খড়ের স্তূপে কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।প্রায় ৩ ঘন্টা পর গ্রামের লোকেরা আগুন নিভালো।রহিম মিয়া সংসারে আজ চিন্তার ভার,সকাল থেকে খাওয়া নেই।কে করলো এই কাজ আরেকটু হলে ত পুরো বাড়িটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

রহিমের বউ বুজতে পারছে এই কাজটি কে করেছে,তার আগের স্বামীর ছেলে অপু।কয়েকদিন ধরে মোটরসাইকেল কিনে দেবার জন্য বায়না ধরেছিল,দুইদিন বাড়িতেও আসে নাই রাগে।এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটায় নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই।

রহিমের বউ হাসনার চোখে ভেসে উঠলো সেই দিন গুলির কথা,তখন অপুর বয়স ৫ বছর,অপুকে রেখে তার বাবা মারা যায়।মারা যাবার পরে চারদিক থেকে নানা কুৎসা রটাতে থাকে গ্রামবাসী।

বদিউল হক মারা যাবার পরে হাসনাকে আবার বিয়ে দিবার জন্য অপুর নানা চাপ দিতে থাকে।হাসনা রাজি হয় না,সে আর সংসার করবে না বলে স্থির করেছিল,একদিন রহিম সাহেব তার নানার কাছে হাসনাকে বিয়ে দেবার জন্য তার সাথে।

অপুর নানা রহিমের চেহেরা ভালো করে চিনেন,এ সেই ছেলে যার সাথে হাসনার ২ বছরের সম্পর্ক ছিল,যার জন্য তরিগরি বিয়ে দিয়ে দেয়,অপুর নানা রহিম কে বলছিল তুমি যদি হাসনারে রাজি করাইতে পার,তাহলে আমার আর বিয়ে দিতে আপত্তি নাই।

প্রায় ৬ বছর পর ঐদিন রহিম, হাসনার সামনে দাঁড়িয়ে বলছিল,"তুমি আমাকে বিয়ে করবে,গরীব হতে পারি,কিন্তু সারাজীবন সুখে রাখব কথা দিলাম!"হাসনা ঐ দিন রহিম কে জিজ্ঞাসা করেছিল,"তুমি বিয়া করো নি?"রহিম ঐদিন বলেছিল,আমি তুমাকে কথা দিয়েছিলাম তুমার মনে আছে কি, বিয়া করলে আমি তুমাকেই করবো।এইবার তুমি না কইরো না!"

হাসনা রহিমের চোখে এখনো ভালোবাসা দেখে রাজি হয়ে যায়,আর শর্ত জুড়ে দেয় তার সন্তান অপুকে বাবার আদরে মানুষ করতে হবে। সেই থেকে আজ ১৬ বছর, অপুকে বাবার বিয়োগ বুজতেই দেই নি।পরে অবশ্য হাসনার আরো দুটি সন্তান হয় কিন্তু রহিম অপুকেই বেশি ভালোবাস তো।

কয়দিন হল অপু কলেজ এ উঠার পর থেকে মোটর সাইকেল এর বায়না ধরতে থাকে।যা ক্রয় করা রহিমের জন্য ছিল অনেক কষ্ট সাধ্য।তাই দিতে পারে নি।আজ বাড়িতে এই ঘটনার পর হাসনার বুজতে দেরি নেই,এই কাজ অপুই করেছে।

সন্ধায় অপু বাড়িতে আসছে,হাসনা অভিমান গুলো লুকিয়ে, অপুকে জিজ্ঞাসা করলো,তোর মোটর সাইকেল কেনার কি দরকার?উত্তরে অপু বলল,আমার সব বন্ধুরা কলেজ এ মোটরসাইকেল নিয়ে যায়,আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে,ওদের অনেক মেয়ে বন্ধু,আমাকে দেখে ঐ মেয়েরাও হাসাহাসি করে,তাই কিনে দেবার জন্য বলেছি!"

আইচ্ছা তুই মোটরসাইকেল পেয়ে যাবি,আমি জানি এটা ঠিক হবে না।তোর আরও দুইটা ভাইয়ের সাথে অন্যায় হবে।তবুও আমরা চাই তুই খুশি থাক হাসনা কথা গুলো বলে ঘরে চলে গেল।

কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও রহিম তার তিনটা গরু বিক্রি করে দেয়,আর একটা জমি ইজারা দিয়ে দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেয়।এইভাবে চলতেছে দিন,অপু মোটরসাইকেল পেয়ে অনেক খুশি।

এভাবে ত্রিশটি রোজা পার হয়ে গেল,ঈদের আগের রাত্রে অপুর মা অপুকে নিয়ে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে।ঈদের দিন সকাল বেলা,অপুকে বলে কয়দিন যেন মোটরসাইকেল নিয়ে না বের হয়।কে শুনে কার কথা ঈদের দিন বিকেল বেলা,পাশের বাড়ির দিহান কে নিয়ে বের হয়ে পরে।অপুর মায়ের অনেক চিন্তা হয় ঐদিন।

অপু মোটরবাইক চালাচ্ছে স্পিড বারাচ্ছে,পাশে দিহান বলছে আস্তে চালা,কিন্তু অপুর ভিতরে কি জানি চলে আসছে মেয়েদের রাস্তায় দেখে,আরো জোরে মোটর বাইক চালাচ্ছে,কিছুই দেখা যাচ্ছে না,হঠাৎ চারদিকের মানুষ তীব্র শব্দ শুনতে পেরে রাস্তার পাশে এসে দেখে মোটর সাইকেল ভেঙে চুড়মাড় হয়ে গেছে।

পাশে রক্ত ঝড়ে পড়তেছে, দুইটা মৃত লাশ পরে আছে পাশে,চেনার কোন উপায় নেই,কয়েকজন মোবাইলে ফটো তুলে ফেসবুকে দিয়ে আত্মীয় দের খুঁজার তালাশ করছে।কেউবা লাশ দেখে দূরে গিয়ে গালি দিতে ভুলে যাচ্ছে না।এইভাবেই একটি মোটর বাইক কেড়ে নিল দুটি পরিবারের ঈদের হাসি,কান্নায় একাকার বাড়িতে।

আমাদের বর্তমান যুবক সমাজে নতুন ট্রেন্ড হয়ে দাড়াইছে মোটরসাইকেল কেনার,অনিয়ন্ত্রিত ভাবে মোটরবাইক চালানোর পরে প্রায় প্রতিদিন ঝড়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ।আমরা যারা মোটরসাইকেল চালাই তারা যেন ট্রাফিক নিয়ম মেনে গতিকে সহনশীল পর্যায়ে রেখে চালায়,"আমাদের মনে একটা দূর্ঘটনা সারাজীবন এর কান্না"।

সাবস্ক্রাইব করুন:

লেখকঃ পরান
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url