গল্পঃ ভালোবাসি তাই

আজ লিফট এ কি হোল??? বিরক্ত মুখে লিফট এর সামনে দাড়িয়ে আছে অপূর্ব। বাসার দারোয়ান কাচুমাচু মুখে বলল স্যার আজ দুপুর থেকেই লিফট এ সমস্যা, লোক এসেছে ঠিক করতে তবে ঘণ্টা খানেক লাগবে। চলুন স্যার আপনাকে উপরে দিয়ে আসি। কেন আমাকে উপরে দিয়ে আসতে হবে কেন???? আমি কি নিজে নিজে যেতে পারি না নাকি???? ধমকে বলল অপুর্ব। আমিই যেতে পারব। দুতলা পর্যন্ত উঠেই হাপিয়ে গেল অপূর্ব। ঠিকই বলেছিল দারোয়ান ওর সাথে এলেই পারত। এম্নিতে এক পায়ে পঙ্গু সে, চলতে হয় স্ক্রাচ এ ভর দিয়ে, তিনতলায় উঠতে উঠতে সে দেখে এক মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নামছে, রাগে পিত্তি জ্বলে গেল অপূর্বর। কেন?? এমন করে তাকাতে হবে কেন?? জীবনে কি কোনদিন স্ক্রাচ এ ভর দেয়া লোক দেখিস নি??? যাই হোক বহু কষ্টে পাঁচতলায় উঠল অপূর্ব। দরজা খুললেন অপূর্বের মা। দরজা খুলেই বলল কি রে তুই এত ঘেমেছিস কেন????

এমনিতেই উত্তর দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল সে। সাথে সাথেই মীম এল অপূর্বের ঘরে, বলল বাবা বাবা আমার রঙ পেন্সিল এনেছ??? না অপূর্বের জবাব। কেন??? সময় পাই নি তাই। সময় পাও নি কেন??? ব্যাস্ত ছিলাম তাই, মীম এখন যাও এই রুম থেকে। মীম নাছোড়বান্দা, আবার জিজ্ঞেস করল বাবা ব্যাস্ত ছিলে কেন???? মিটিং ছিল তাই মীম এখন যাও, আবার মিমের প্রশ্ন মিটিং ছিল কেন??? এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অপূর্ব। প্রচণ্ড ধমক লাগায় মীম কে, বের হও বের হও বলছি এই রুম থেকে, নিজের রুমে যাও এক্ষনি। মীম ভয় পেয়ে কাদতে লাগলো, ছেলের চিৎকার শুনে রেহানা বেগম দৌড়ে এলেন। মীম কে জরিয়ে ধরে বললেন তুই মানুষ নাকি অন্য কিছু??? দিন দিন একটা জানোয়ার এ পরিনত হচ্ছিস। বাচ্চা দের কেউ এভাবে ধমকায়??? মা প্লিজ তুমিঃ ওকে এই মুহূর্তে এখান থেকে নিয়ে যাও। রাতে ভাত খেল না মীম, খেলেন না রেহানা বেগম ও, খাবার টেবিলে বসে একা একাই খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করে উঠে গেল অপূর্ব। তারপর বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট ধরাল সে, আকাশের চাঁদ টাকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে, ঠিক যেন অপূর্বের মতো। রাত বাড়ে, সাথে অপূর্বের নিঃসঙ্গতাও। রাত তিনটার দিকে চুপি চুপি মীম এর ঘরে ঢুকে। আহারে ছোট্ট মেয়েটা আমার!!!!! কি দারুন কষ্টটাই না পেল আজ। আলতো কতে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেল মিমের রুম থেকে।

আজ সকাল সকাল ই বের হোল অপূর্ব। লিফট ঠিক হয়ে গেছে। লিফট এ তার সাথে ওই মেয়েটাও আছে, আজকেও মেয়েটা হাসছে, মেয়েটা হাসে কেন??? কি সমস্যা???? আর একদিন দেখে নিক, তারপর কষে এক ধমক লাগাবে অপূর্ব। আজ তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে গেল অপূর্ব, অফিসে গিয়েই পিয়ন কে টাকা দিয়ে বলল যাও তো একটা রঙ পেন্সিল এর বক্স কিনে নিয়ে আস, আর শুনসবচেয়ে ভালো তা কিনবে কিন্তু। পিয়ন চলে গেল। দুপুরে খাবার সময় অপূর্ব দেখল তারেক কর্মচারী ( নতুন বিয়ে হয়েছে) বউ নিয়ে এসেছে, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, তার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। অপূর্ব কে সবাই এসব ব্যাপার থেকে দূরে রাখে অবশ্য দোষটা অপূর্বেরই, নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে রাখে ও। রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল, দেখল দারোয়ান কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, এদিকে ওদিকে কি যেন খুজছে। লিফট এ উঠতে গিয়ে দেখে সেই মেয়ে তার আগেই লিফট এ আছে, আজকেও হাসছে, এবং এখনো হাসছে, অপূর্ব মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল কিছু কঠিন কথা শুনানোর। অপূর্ব বলল এই যে শুনুন, মেয়ে অবাক হয়ে বলল আমাকে বলছেন??? জী আপনি ছাড়া তো এই লিফট এ আর কেউ নেই যে তাকে বলবো। জী বলুন। শুরু করল অপূর্ব, আপনার কাছে কি আমাকে সার্কাসের জোঁকার মনে হয়???? একপায়ে খোঁড়া লোক আপনি এর আগে দেখেন নি কখনো???? আমাকে দেখেই হাসতে হয় কেন আপনার???? মানুষের দুর্বলতা নিয়ে মজা করতে ভালো লাগে আপনার???? আপনার সমস্যা কি??? এক নিঃশ্বাসেই কথা গুলো বলল অপূর্ব।

তাকিয়ে দেখে মেয়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। মেয়ে কিছু না বলেই লিফট থেকে বের হয়ে গেল। নিজের মনে একটা প্রশান্তি ভাব নিয়ে বাসায় ঢুকল অপূর্ব। মিমের হাতে রঙ পেন্সিল গুলো দিল সে, খুশি তে মিমের উজ্জ্বল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মনে চাইল জরিয়ে ধরে মেয়েকে একটা চুমু দিতে কিন্তু পরক্ষনেই নিজের আবেগ কে কাবু করল অপূর্ব। মীম খুশি হয়ে অপূর্ব কে জরিয়ে ধরে বলল থ্যাঙ্কস আব্বু। ঠিক আছে ঠিক আছে এখন তোমার ঘরে যাও জবাব অপূর্বের। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিয়ম মতই বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট ধরাল আর ভাবতে লাগলো আজ তাঁরও একটা সংসার থাকতে পারত, ঘরে একটা লক্ষ্মী বউ, যে সন্ধ্যা হলেই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো অপূর্বের বাড়ি ফেরার। ছোট ছোট দুটা ছেলে মেয়ে, যারা ঘরে এলেই বাবা এসেছে বলে চেঁচিয়ে উঠত। হলেও হতে পারত একটা মায়াবী সংসার। কিন্তু না তা হয় নি,কারন সবাই সৌভাগ্যবান হয় নি, কেউ কেউ অপূর্বের মতোও হয়।

সেই ভার্সিটির প্রথম দিনের স্মৃতির ডায়েরী উল্টালো অপূর্ব , স্ক্রাচে ভর দিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই সবাই কেমন ভাবে যেন তাকাল ওর দিকে, ভিশন অস্বস্তি লাগছে অপূর্বর। এরি মধ্যে ওর অস্বস্তি কে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়ে ক্লাসে ঢুকল একটা হুরপরি টাইপের মেয়ে, ক্লাসে যেন সাজ সাজ রব পরে গেল, সবাই কিছু না কিছু করতে চাইছে মেয়েটার জন্য। মেয়েটা এসে তাঁর সামনের বেঞ্চ টা তে বসলো। অপূর্বর হাত পা যেন জমে গেল। সারা ক্লাস আড় চোখে তাকাচ্ছিল মেয়েটার দিকে। সে নিজেও চোখ ফেরাতে পারছিল না যেন। প্রথম দর্শনেই প্রেম যাকে বলে তাই হোল মনে হয় কারন বাসায় গিয়েও এক মুহুরতের জন্য ভুলতে পারল না মেয়েটা কে। ক্লাসে গেলেই চোখ দুটো যেন খুজত ওই মেয়েকে। ভালবেসে ফেলল মেয়েটাকে, কিন্তু চুপি চুপি। এম্নিতে কেউ তেমন মিশত না অপূর্বের সাথে, কোন বন্ধুও হয় নি, এভাবেই কেটে গেল একবছর। ফাস্ট ইয়ারে ভালো রেজাল্ট করে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পেল অপূর্ব। কিন্তু তখনও হুরপরি এর সাথে কথা হয় নি। কিন্তু এখন হুরপরিটার নাম জানে অপূর্ব, তার নাম মিরা। ক্লাসের রানী সে, সবাই যেন ওর ইশারা তে উঠে বসে। কিন্তু অপূর্বের তার সামনে গেলেই হাত পা কাঁপতে থাকে কথা আর কি বলবে, তাই তো এই এক বছরের একবারের জন্যও কথা হয় নি তাদের, আর কখনো হতোও না যদি না সেদিন গ্যাঁড়াকল না বাঁধত।

একদিনের কথা, গাড়ি থেকে নেমে ক্লাসে যাচ্ছিলো, হঠাৎ একজন বলল আজ ক্লাস হবে তিনতলায়। অপূর্ব ভাবল একবার ক্লাসে যাবে না। তারপরেই আবার কি ভেবে যেন ক্লাসে গেল, দোতলা পর্যন্ত ভালই উঠলো কিন্তু তিনতলায় উঠতে গিয়েই ভেজাল বাঁধল, কিভাবে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল অপূর্ব। বই খাতা পড়ল সব সিঁড়িতে আর স্ক্রাচ গিয়ে পড়ল কয়েক সিঁড়ি নিচে। এমন সময় হাত বাড়িয়ে দিল মিরা। টেনে তুলল ওকে, বই খাতা আর স্ক্রাচ এনে দিয়ে বলল আর ইউ অলরাইট???? জী আমি ঠিক আছি বলতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অপূর্ব। থ্যাংকস। ইটস ওকে হেসে মিরা বলল। অপূর্ব চল তোমাকে উপরে দিয়ে আসি, অবাক হয়ে অপূর্ব বলল আপনি আমার নাম জানেন??? মিরা হেসে বলল কি বল এসব কথা তোমাকে চিনব না??? আমরা একি ক্লাসে পড়ি তাছাড়া তুমি তো ক্লাসে ফেমাস গুড বয়। এখন আপনি আপনি করে বলা বন্ধ করো, নয়ত নিজেকে মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। মিরার এই কথা শুনে হেসে ফেলল ওরা দুজনে। চলো ক্লাসে যাই।

সেদিন মিরার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়েছিলো অপূর্ব। এত সুন্দর একটা মেয়ে, আর এত্ত ভালো ব্যাবহার ওর সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুনে। সেদিন থেকে ওদের দুজনের পথচলা শুরু, প্রথমে ক্লাসমেট, তারপরে বন্ধু, তারপরে খুব ভালো বন্ধু। এবং মিরার সব চেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে পরিনত হয়, পুরো ভার্সিটি ওদের এই বন্ধুত্তে অবাক হতো। মিরার পাশে অপূর্ব কে কেমন যেন বেমানান লাগে। সবাই বলত বিউটি এন্ড বিস্ট। কিন্তু মিরা নির্বিকার, এগুলো মাথা ঘামাত না কখনোই। অপূর্ব এই জন্নই ভালোবাসার পাশাপাশি অন্য রকম শ্রদ্ধা করতো মিরা কে। এভাবে কেটে যায় চার টি বছর, দুজনেই অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে উঠে। অপূর্ব ভাবে এবার তো মিরা কে তার মনের কথা না জানালেই নয়, আসছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি মিরা কে জানিয়ে দিবে অপূর্ব। ১৪ই ফেব্রুয়ারির একদিন আগে, মানে ১৩ই ফেব্রুয়ারি কাঁপতে কাঁপতে একটা গোলাপ নিয়ে মিরার কাছে যায় ও। গিয়ে দেখে মিরার এক বন্ধু মিরা কে প্রপোজ করতেই মিরা রেগে আগুন হয়ে বলল এগুলা কি ফাইজলামি???? বন্ধুত্ত টা নষ্ট করতে চাস নাকি??? তাছাড়া আমি যাকে ভালবাসবো তার মধ্যে স্পেশিয়াল কিছু থাকতে হবে, যা তোর মধ্যে নাই।

হঠাত অপূর্বের ভাবনায় বাধা পড়ল, অপূর্বের মা এসে বলল কিরে তুই কি সারা রাত বারান্দাতেই বসে ছিলি নাকি???? অপূর্ব নিজেই অবাক হয়ে যায়, আসলেই তো!!! পুরান কথা ভাবতে ভাবতে যে কখন সকাল হয়ে গিয়েছে টের ই পায় নি। যাই হোক না কেন সময়মত অফিসে যায় অপূর্ব, আবার ফিরেও আসে সময়মত কিন্তু লিফট এ আর সেই মেয়েকে দেখা যায় না।

একদিন বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদুর আগাতেই, পিছন থেকে একটি ডাকে থমকে দাড়ায় অপূর্ব, পিছনে ফিরে দেখে ধমক খাওয়া মেয়েটি, সামনে এগিয়ে এসে বলল ভালো আছেন আপনি??? এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে বলল জি আমি ভালো। মেয়েটি বলল আমার নাম নিশি, আপনি সেদিন আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন, আমি সেদিন কোন জবাব দেই নি, আসল ঘটনা বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিল তাই, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমার জবাব দেয়া দরকার। আমরা আপনাদের বাসার সাত তলায় ভাড়া থাকি এইটুকু তো জানেন নাকি??? জি জানি জবাব অপূর্বের, আপনার মেয়ে মিমের সাথে আমার প্রবল সখ্য, আপনার মেয়ের মতে আপনি হাসতে জানেন না। হয়তবা এজন্যই অন্য কারো হাসিও আপনার সহ্য হয় না। আমি প্রথম দিন হেসেছিলাম কারন সেদিন লিফট নষ্ট ছিল, তাই সিঁড়ি দিয়েই নামতে হয়েছিলো আমাকে,নামার পথে মীম এর সাথে দেখা, ও আমাকে এমন হাসির কথা বলেছিল যে আমি হাসতে বাধ্য হয়েছিলাম,

দ্বিতীয় দিন হেসেছিলাম ঘর থেকেই কারন ছিল আমার বাবার সাদা চুলে উদ্ভট রঙ করানো, আর তৃতীয় বার হাসার কারন ছিল দারোয়ান, আমি গেট দিয়ে ঢুকেই দেখি দারোয়ান ঝিমুচ্ছে, আমি হাউ করে উনাকে ভয় দেখিয়ে হাসতে হাসতে লিফট এ উঠি। আর তারপর যা হোল তা আপনি ভালো জানেন। অপূর্ব সাহেব দুর্বলতা আপনার মনে, সেটা কে ঠিক করুন, নয়তো কেউ হাসলেই আপনার মনে হবে আপনাকে নিয়ে হাসছে। এই কথা বলেই নিশি চলে গেল। এরপর দুদিন দেখা হোল নিশির সাথে, একদিন লিফট এ, অপূর্ব কে দেখে আর উঠলই না লিফট এ, আর একদিন লিফট আ এত মানুষ ছিল যে অপূর্ব কিছু বলতেই পারল না। শেষে উপায় না পেয়ে একদিন মা কে জিজ্ঞেস করল, মা আমাদের সাত তলায় কি নিশি নামের কোন মেয়ে আছে??? হুম আছে তো, আমাদের মীম কেই তো পড়ায়, কেন??? তুই চিনিস নিশি কে??? হ্যাঁ মা চিনি একদিন ধমকে দিয়েছিলাম, তুমি একবার গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে এসো, আর বোলো যে আমি দুঃখিত, আমি এসব পারব না, সাফ জবাব অপূর্বের মার, তুই দিন দিন মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে যাচ্ছিস, আমাকে ধমকাস, মীম কে ধমকাস এখন বাড়ির মানুষগুলো কে পর্যন্ত ছারিস না।

খুব বেশী কাজ না থাকলে বাসায় থাক আজ, আমি একটু তোর খালার বাসায় যাব, তুই তো বললেও কোনদিন জাবি না, তাই তোকে আর আমি সাধবও না, তাছাড়া বিকেলে নিশি মীম কে পরাতে আসলে তুই মাফ চেয়ে নিস, কি থাকবি বাসায় নাকি অফিসে যেতেই হবে??? নাহ থাকব বাসায়, তুমি গিয়ে খালা কে দেখে আস। বিকেলে নিশি মিম কে পরাতে এসে অপূর্ব কে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে অপূর্ব বলে আই এম সরি নিশি, আমি খুব ই দুঃখিত এবং লজ্জিত। মুহূর্তের মধ্যেই নিশি হেসে বলল ইটস ওকে। কেউ সরি বললে আমার তার উপর রাগ থাকে না। অপূর্ব বলে আসলে আমি এমন ছিলাম না, একটা দুর্ঘটনা, আমি জানি অপূর্ব কে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠে নিশি,আপ্নার স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে আপনি এমন তাই না??? আচ্ছা আপনি ২য় বিয়ে করেন না কেন??? একটু হেসে অপূর্ব বলল ২য় বিয়ে????? নিশি বুঝাতে লাগলো দেখুন যা হবার তো হয়েই গিয়েছে, ভাগ্য কে কেউ বদলাতে পারে না, আর তাছাড়া জীবন তা অনেক ছোট মনে হয় যদি পাশে চলার মতো কেউ থাকে, একাকি জীবন দীর্ঘ আর বিষাদময় লাগে। অপূর্ব হেসে বলে তবে আপ্নিএ খুজুন না আমার জন্য একটা মেয়ে, নিশি বলল ব্যাস এইটুকু ব্যাপার???? যদি খুঁজে দেই তবে আমাকে কি দিবেন??? আপনি যা চাইবেন তাই, বলল অপূর্ব। তারপর থেকে শুরু হোল নিশির যন্ত্রণা, কয়েকদিন পর পর এই মেয়ের ছবি ওই মেয়ের বায়ডাটা দিয়ে ঘর ভরে ফেলল।

সাবস্ক্রাইব করুন:

দুজনের মধ্যে ক্লোজনেস বেরে গেল অনেকখানি। বাসার বাইরেও দেখা করেতে লাগলো দুজন প্রত্যেকবার নিশির হাতে কোন না কোন মেয়ের ছবি নয়তো বা সিভি থাকতো, একদিন নিশি রেগে গিয়ে বলল এত মেয়ে দেখালাম আপনাকে আপনার কাউকেই ভালো লাগে নি??? আমার তো মনে হয় আপনি বিয়েই করবেন না, শুধু শুধুই আমাকে খাটাচ্ছেন। যান কাল থেকে আমি আর আসব না, সময়গুলো যেন ভালই যাচ্ছিল অপূর্বের। কিন্তু দুর্ভাগ্য তো পিছু ছাড়ার নয়, সেইদিনের পর থেকে সত্যি সত্যি নিশির আসা বন্ধ হয়ে গেল। ফোনেও যোগাযোগ হয় না, একদিন মার মুখে শুনল নিশির বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। কাউ কে কিছু বলল না অপূর্ব শুধু একটু হাসল, তারপর রাতে খেয়ে দেয়ে পুরান রুটিন মতো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। গত কয়েক সপ্তাহ নিশির কারনে আসা হয় নি এখানে, খাওয়া হয় নি সিগারেট, ভাবা হয় নি পুরান কথা। কিন্তু এইজায়গা ঠিক ই মায়ার টানে, দুর্ভাগ্যের সিঁড়ি দিয়ে টেনে এনেছে অপূর্ব কে। ভাবতে ভাবতে চলে গেল সেই পুরান দিনে যেদিন হাতে একটা গোলাপ নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হয়েছিলো মিরার সামনে, কিন্তু ওইদিন ওই বন্ধু কে যে বকা দিয়েছিল মিরা ওই কথা শুনে অপূর্ব বেচারা ভয়ে চুপ হয়ে গেল, দূরে ছুড়ে ফেলে দিল গোলাপ টা। যাও একটু সাহস সঞ্চয় করেছিল সব গেল, অপূর্ব মধ্যে স্পেশিয়াল তো দুরেই থাক পছন্দ করার মতো কোন কোয়ালিটি নেই। মন থেকে মিরা কে প্রপোজ করার আইডিয়া বাদ দিল অপূর্ব চলে যেতে লাগলো ঠিক এই সময় মিরা ডাক দিল পিছন থেকে, এই অপূর্ব শুনত,অপূর্ব এগিয়ে যেতেই মিরা গলা নামিয়ে বলল কাল কি তুই ফ্রি আছিস???? অপূর্ব বলল হ্যাঁ আছি তো কেন??? তোকে নিয়ে একজায়গায় যাব এইজন্য। কাল তুই ঠিক চারটায় এইখানে থাকিস, তোকে দরকারি কথা বলব। অপূর্ব ঘাম ঝরতে লাগলো, কিসের কথা বলবে মিরা কাল???? অইকথাই নয়তো যা অপূর্ব মিরা কে বলতে চেয়েছিল??? টেনশনে সারা রাত ঘুম হয় না অপূর্বের।

বারান্দায় জেগে থাকে, সকাল হতে না হতেই তাড়াহুড়া লাগিয়ে দেয় অপূর্ব অথচ সময়ের তখনও অনেক বাকী। সময়ের আগে গিয়েই দাড়িয়ে থাকে অপূর্ব, তার প্রায় এক ঘণ্টা পরে আসে মিরা। এসেই বলে কি রে তুই কখন এসেছিস??? অপূর্ব আমতা আমতা করে বলে না মানে ইয়ে একটু আগেই এসে পরেছি, ঘড়ি দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম। মিরা হেসে বলে আচ্ছা ঠিক আছে এখন চল আমার সাথে। সি এন জি নেয় মিরা, সিএন জি গিয়ে পৌঁছায় মিরপুর বেড়িবাঁধ। অপূর্ব অবাক হয়ে বলে কিরে এখানে এনেছিস কেন???? মিরা হেসে বলে ভালোবাসার কথা বলতে। বুকটা ধক করে উঠে অপূর্বর, তবে কি মিরাও????? একটু হাসার চেষ্টা করে অপূর্ব বলে ভালোবাসার কথা বলতে হলে এখানে আসা লাগে নাকি??? মিরা বলে না, তবে ভালোবাসার মানুষটি কে দেখাতে চাই তোকে, তাই নিয়ে এলাম। ঐযে দেখ পালসার বাইক টা তে বসে আছে যে ছেলেটা ওর নাম সুব্রত, ঢাকা মেডিকেল থেকে পরেছে , এখন পুরাদস্তুর ডাক্তার সাহেব আর কি!!! আমাদের সম্পর্ক প্রায় পাঁচ বছরের। অপূর্বের মাথায় যেন কিছুই ঢুকছিল না, ওর কাছে মনে হোল আকাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেছে, চোখ আর নাক জ্বালা করছে যেন এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল ও। সুব্রত কাছে এসেই ভালো আছ অপূর্ব??? মিরার মুখে তোমার নাম শুনতে শুনতে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। অপূর্ব হেসে বলল কই মিরা তো আমাকে কখনোই আপনার কথা বলে নি। এইবার মিরা মুখ খুলল, কি করে বলব, জানিস ই তো আমার ভাইয়াও পরে আমাদের ভার্সিটি তে, যদি কোনদিন ভাইয়া কারো মুখে এই ব্যাপারে কিছু শুনত তবে আমাকে জ্যান্ত মাটিতে পুতে ফেলত, আমার পরিবার এই প্রেম কখনোই মেনে নিবে না, কারন সুব্রত হিন্দু।

কিন্তু এখন আর আমরা আলাদা থাকতে চাইছি না, কারন বাসায় আমার বিয়ের জন্য চাপাচাপি করছে তাই ভেবেছি কোর্ট ম্যারিজ করব, আর তুই থাকবি আমাদের পাশে। কি থাকবি না???? হ্যাঁ অবশ্যই থাকব। আচ্ছা সুব্রত ভাই আমি এখন আসি, আপনারা গল্প করেন, মিরা বলে সেকি!! এখনি চলে জাবি কেন?? আয় একসাথে কিছুক্ষন গল্প করি, অপূর্ব হেসে বলে আজকের দিনটা তো তোদের জন্য, তোরাই এঞ্জয় কর। মিরা জানল না যে অপূর্বের চোখে মিরার সুখ উপচে উপচে পরছে। বিয়ে হয়ে গেল মিরার, পরিবার থেকে বিছিন্ন হোল মিরা, সুব্রতর পরিবার ও মেনে নিল না এই বিয়ে। দুজনে মিলে শুরু করল সংসার, সাথে অপূর্ব, বাসার আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিছানার চাদর পর্যন্ত কিনতে সাহায্য করল অপূর্ব, সুব্রত ডাক্তার ছিল তাই সময় পেত না, কাজেই সংসার গুছানোর সব কাজ মিরা আর অপূর্ব কেই করতে হতো। তিনমাস পরের কথা একদিন এক দুর্ঘটনায় সুব্রত পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, মিরার আর এই পৃথিবীতে কেউ থাকে না, বাবার বাড়িতে কেউ আর মিরাকে গ্রহন করে না, সুব্রত মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে জানতে পারে মিরা গর্ভবতী, পুরো আঁটটা মাস মিরার পাশে ছিল অপূর্ব, যেকোনো দরকারে যে কোন সময়, মিরার এক ফোনে চলে আসতো। দেখাশুনা করতো মিরার, যেন ছায়ার মতো, আর্থিক হোক বা মানুষিক মিরার মাথার উপর ছাদ হয়ে ছিল অপূর্ব। একদিন মিরা বলে অপূর্ব তুই আমার জন্য এত্ত কিছু কেন করছিস???? অপূর্ব হেসে বলে এই জবাব অন্য একদিন দিব। জবাব আর দেয়া হয় নি অপূর্বের তার কিছুদিন পরেই মিরার অবস্থা খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে নিতে হয় মিরা কে, ডাক্তার রা বলে রুগীর অবস্থা ভালো না, সিজার করতে হবে। ওটি তে যাওয়ার আগে মিরা অপূর্ব কে বলা আমি জানি তুই আমার জন্য এসব কেন করেছিস, ভালবাসিস তাই না?? শোন আমি যদি ফিরে আসি আমাকে গ্রহন করবি আমার বাচ্চা সহ???? হুম করব, আমার নাম দিব তোর বাচ্চা কে, তখন সেটা আমাদের বাবু হবে, কাদতে কাদতে বলে অপূর্ব, মিরা কথা রাখে নি। ফিরে আসে নি।

ডাক্তার এসে ছোট্ট মিরা কে অপূর্বের কোলে দিয়ে বলে আমরা দুঃখিত আপনার স্ত্রী কে বাঁচাতে পারি নি, তবে আপনার একটা মেয়ে হয়েছে। চোখ মুছল অপূর্ব, ভোর হয়ে গিয়েছে, চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে, আজ অনেকদিন পর মিরা কে দেখতে ইচ্ছে করছে অপূর্বের, ড্রয়ার খুলে হাত বাড়াতেই দেখল ডাইরি টা কোথাও নেই, পুরা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজল, অফিসেও লোক পাঠিয়ে খুঁজল কিন্তু না কোথাও নেই, মার সাথে রাগারাগি করল, মিমের সাথেও। অফিসেও গেল না, পাগলের মতো হয়ে গেল যেন ডাইরি টার জন্য, আর হবেই না বা কেন ঔ ডাইরিতে যে অপূর্বের সব স্মৃতি লিখা, এমন সময় মিষ্টি নিয়ে ঢুকল নিশি, ঢুকেই বলল মিষ্টি খান আন্টি, পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করেছে, তারপর ঢুকল অপূর্বের ঘরে, তারপর বলল আফসোস আপনার ২য় বিয়ে টা আর দিতে পারলাম না, অপূর্ব হেসে বলে হুম কি আর করা আমার কপাল খারাপ। তো আমি যদি এখন কিছু চাই তবে তো আর পাব না তাই না??? প্রশ্ন নিশির। অপূর্ব বলল পাবে তুমি কি চাও বল??? নিশি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে আমি চাই আপনি মীম কে ভালোবাসার দায়িত্ব হিসেবে নয় ভালবাসা হিসেবে গ্রহন করেন। অপূর্ব চমকে গেল নিশির এই কথায়, কি বলতে চাইছ তুমি নিশি??? দেখুন আমি কি বলতে অথবা বুঝাতে চাইছি আপনি সেটা ভালো করেই বুঝেছেন, মীম একটা ছোট্ট মেয়ে কোন কিছুর কমতি নেই ওর শুধু আপনার ভালবাসা ছাড়া। ওকে সেটা দিন ওর এছাড়া আর কিছুই লাগবে না। আর আমি চাই আপনি আপনার প্রথম বিয়েটা আগে করুন। তুমি কি বলছ এসব তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, বলে অপূর্ব। নিশি হেসে বলে ভালই বুঝেছেন আপনি। এই নিন আপনার ডাইরি।

মাথাটা মুহূর্তেই গরম হয়ে যায় অপূর্বের, রাগে হিতাহিত জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলে অপূর্ব, নিশির গালে এসে ঠাশ করে একটা চড় মারে, নিশি কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলতে থাকে, এটা আমার প্রাপ্য ছিল, না জানিয়ে আপনার ডাইরি পরার পর থেকে কেমন যেন অপরাধ বোধ কাজ করছিল এখন আর সেটা নেই। আমি খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত। মীম কে মিরা আর সুব্রতর অংশ না ভেবে আপনার আর আমার অংশ ভাবুন। এখনো মিরার প্রেমিক হয়েই আছেন মিমের বাবা হতে পারেন নি আপনি। যান মিমের ঘরে গিয়ে দেখুন সে তাঁর ঘরের দেয়াল জুড়ে আপনার ছবি আকার চেষ্টা করেছে, তাঁর মাথায় গিয়ে হাত রাখুন, অপূর্ব আর সহ্য করতে পারে না, মিমের ঘরে গিয়ে দেখে মীম ঘুমাচ্ছে, অপূর্ব ঘুমের মধ্যেই মীম কে কোলে নিয়ে চুমু দিতে থাকে, আর বলতে থাকে ভুল হয়ে গিয়েছে মামুনি তোমাকে আর কষ্ট দিব না, তোমাকে আমার কাছ থেকে আর দূরে রাখবো না, আজ থেকে আমরা বাবা মেয়ে এক সাথে ঘুমাব। বলেই ঘুমের মীম কে কোলে করে নিজের রুমে নিয়ে যায়, বিছানায় শুইয়ে দেয়, তারপর নিশিকে বলে অনেক ধন্যবাদ তোমাকে নিশি, আমি একটু আগে যা করেছি তাঁর জন্য লজ্জিত। কিন্তু তুমি আমার আর আমার মেয়ের জন্য এত টা কেন করলে???? নিশি কিছু না বলে হেসে চলে গেল। কিছুক্ষন পরে অপূর্বের মোবাইলে একটা মেসেজ এল, সেখানে লেখা ছিল আপনি হয়তো বা আমার কথা ভালো ভাবে শুনেন নি, আমি মীম কে মিরা আর সুব্রতর অংশ না ভেবে বলেছি আমার আর আপনার অংশ ভাবতে। আপনি এতই বোকা যে তারপর ও বুঝেন নি, হেবলার মতো প্রশ্ন করেছেন এত কিছু কেন করলাম আপনার জন্য????? কারন ভালোবাসি তাই।

সাবস্ক্রাইব করুন:
by- Farhana Yesmin Bristy
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url