আবেগের লুকোচুরি, অন্তর্দাহন, অবশেষে ভালবাসায় পরিসমাপ্তি

(১) বর্ণ চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাবার ঘরে বসে আছে। আজ ওর পাঁচ বছরের জীবনে সবচে খুশির দিন। বাবা ওকে নতুন মা এনে দিয়েছে আজ। মুগ্ধও ছেলের পাশে বসে আছে। তবে ওর মনে উত্তেজনার বদলে ভয়। অফিসের আশফাক সাহেবের জোরাজুরিতে আর বর্ণের কথা ভেবে ও কি করে যেন এই অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। আশফাক সাহেবের বড় মেয়ে নীতুকে বিয়ে করে ফেলেছে। বর্ণের জন্মের আট মাসের মাথায় ওর মা কথা মারা যায়। এতটুকুন ছেলেকে মুগ্ধ একাই সামলেছে তবু দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবেনি কখনই। এখনকার যুগে সৎ মায়ের ভালবাসার উপর আস্থা করতে সাহস হয়নি মুগ্ধর। কিন্তু ছেলের জেদ আর আশফাক সাহেবের অসুস্থতার দোহাই তাকে কিছু সময়ের জন্য সাহসী বানিয়ে দিয়েছে।



বর্ণ আনন্দে চকচক চোখ নিয়ে বাবার আরও কাছে ঘেঁষে এলো। এরমধ্যে পঞ্চমবারের মত জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘‘বাবা মা কখন আসবে এ ঘরে?’’ মুগ্ধ ছেলেকে কাছে টেনে বলল, ‘‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে রে ব্যাটা। মেয়েদের ফ্রেশ হতে একটু বেশি সময় লাগে। এছাড়া আজ সারাদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে তোর মাকে।’’
‘‘বাবা আমি ও ঘরে যাই?’’
‘‘উহু। সে তো বলেছেই ফ্রেশ হয়ে এ ঘরেই আসবে।’’
‘‘বাবা আমি মা কে কি বলে ডাকবো? আম্মু, মামনি নাকি আম্মুনি?’’
‘‘তোর কি বলে ডাকতে ইচ্ছে করে?’’
‘‘আমার তো সবগুলোই বলতে ইচ্ছে করে।’’
‘‘হা হা হা, সবগুলো তো একসাথে বলা যায় না ব্যাটা।’’
‘‘তাহলে এখন মা বলেই ডাকি?’’
‘‘আচ্ছা।’’

বাবা ছেলের কথার মাঝেই নীতু ধরাম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। মুগ্ধ আর বর্ণ দুজনই একসাথে তাদের স্বভাবসুলভ নাকের উপর থেকে চশমা ঠেলে দিলো। বর্ণকে দেখিয়ে মুগ্ধ বলল, ‘‘আমার ছেলে বর্ণ। আর বর্ণ ও তোমার...।’’

মুগ্ধকে থামিয়ে দিয়ে নীতু বর্ণের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘‘অ্যান্টি। আমাকে মা বলার চেষ্টা করবে না। আর শুনুন, আপনাকে বিয়ে করতে আমার বিন্দুমাত্রও মোট ছিল না। আমি এমন কোন ফেলনা নই যে আমাকে রেডিমেট বাচ্চাসহ এক ধামড়া লোককে বিয়ে করতে হবে। বাবার ইমোশনাল অত্যাচারের বলি হয়ে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছি। তারমানে এই নয় যে আমি সারাজীবন আপনার সংসারে পড়ে থাকবো। ঠিক এক মাস পর আমি বাড়ি ফিরে যাবো। বাবাকে বলবো, আপনি আমাকে মারধোর করেন। রোজ রাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরেন। আপনার সাথে অনেক চেষ্টা করেও আর থাকা সম্ভব নয় আমার। আপনিও বাবার কাছে এসব স্বীকার করবেন। আর এই ছেলে, তুমিও সাক্ষী দেবে। বলবে এসব সত্যি কথা। বুঝেছো?’’

‘‘বর্ণ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, বুঝেছি অ্যান্টি।’’
‘‘এইতো গুড বয়। কি যেন নাম তোমার?’’
‘‘বর্ণ, ইংরেজিতে ‘লেটার’। আর বাবার নাম মুগ্ধ।’’
নীতু ভুরু টুরু কুঁচকে বলল, ‘‘ও বাবা নামের কি বাহার। আমি যতদিন থাকবো এসব বাহারি নামে ডাকতে পারবো না। আজ থেকে তুমি বল্টু আর তোমার বাবা মফিজ। বুঝেছো?’’
বর্ণ ফিক করে হেসে বলল, ‘‘বুঝেছি অ্যান্টি।’’
‘‘গুড, আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আমি এখন ঘুমুবো। বল্টু তুমি তোমার বাবার সাথে ঘুমুবে। আমি একা ছাড়া ঘুমুতে পারি না। আর ঘুমের মাঝে আমাকে কখনও ডাকবে না। গুড নাইট।’’
‘‘গুড নাইট অ্যান্টি।’’
নীতু আবারও ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলো। নীতু যাওয়ার সাথেই বর্ণকে কোলে তুলে নিল মুগ্ধ। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘কিরে ব্যাটা মন খারাপ করেছিস?’’

বর্ণ আবারও ফিক করে হেসে বলল, ‘‘না বাবা। বল্টু নামটা তো তোমার মফিজ নামের চেয়ে ভালো।’’
মুগ্ধ ছেলের পেটে আঙুল দিয়ে গুতো মেরে বলল, ‘‘তবে রে দুষ্ট। ওই হিটলার মেয়ের সাইড নিয়ে ফেলেছিস এর মাঝেই? সে তো একমাস পর চলেই যাবে। তখন কি করবি?’’
‘‘হিটলার কি বাবা?’’
‘‘হিটলার হলো তোর ওই দস্যি নতুন মা।’’
‘‘দস্যি কি বাবা?’’
মুগ্ধ ফিসফিস করে বলল,‘‘ হিটলার আর দস্যি মানে হলো ডাইনী। কিন্তু খবরদার ওই মেয়ের সামনে এসব নাম মুখেও আনবি না। তাহলে তোকে আর আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।’’
‘‘হি হি... বাবা মা কে আমার খুউব পছন্দ হয়েছে।’’
‘‘মা বলছিস কেনো? মা বলতে নিষেধ করেছে না?’’
‘‘মার সামনে বলবো না তো।’’
‘‘যখন চলে যাবে তখন কষ্ট পাবি না তো?’’
‘‘উহু, মা তো যাবে না।’’
‘‘কে বলেছে তোকে?’’
‘‘আমি জানি তো। বাবা তোমার কেমন লেগেছে মাকে?’’
‘‘এরকম হিটলারকে ভালো লাগার কিছু আছে নাকি?’’

পাশের ঘরে ঘুমন্ত নীতু জানতেও পারলো না তার জন্য দুটো হৃদয়ের চোরা কুঠুরিতে আকাশ সমান আবেগ আর ভালবাসা জমা হলো রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে।

(২) শুরু হলো নীতু, মুগ্ধ আর বর্ণের এক মাসের অদ্ভুত জীবনের প্রথম সকাল। নীতু ঘুম থেকে উঠে অবাক হলো নিজেকে এ বাড়িতে একা আবিস্কার করে। তারচে বেশি অবাক হলো যখন ডায়নিং টেবিলে পাশাপাশি গ্লাস চাপা দেয়া দুটো চিঠি পেলো। ছেলে যেন পুরোটাই বাবার কার্বন কপি। দুজনই দুঃখ প্রকাশ করেছে তাকে না বলেই অফিস আর স্কুলে চলে যাওয়ার জন্য। কারন তার ঘুম ভাঙানো নিষেধ ছিল। নীতু দেখল টেবিলে ওর জন্য নাস্তা রেডি করা।
দুপুর নাগাদ নীতু বাড়ির এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়িয়েও কোন কাজ পেলোনা। দুটো মানুষ এতটা গোছালো হতে পারে নীতুর জানা ছিলো না। দুপুরের জন্যও রান্না করে ঢেকে রাখা হয়েছে। নীতু আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। ওর ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনের শব্দে।

‘‘হ্যালো অ্যান্টি।’’
‘‘কে?’’
‘‘আমি বল্টু।’’
‘‘বল্টু কে?’’
‘‘বল্টু হলো বর্ণ।’’
নীতু হেসে ফেললো।
‘‘অ্যান্টি তুমি খেয়েছো?’’
‘‘হুম খেয়েছি। তুমি কোথায়?’’
‘‘আমি বাবার কাছে। বাবার অফিস ছুটি হলে আমরা বাসায় যাবো। আমি তো একা একা বাসায় যেতে পারি না। তাই তোমার কাছে যেতে পারি নি। তুমি কি ভয় পাচ্ছো? বাবা বলেছে ভুত বলে কিছু নেই।’’
নীতু আবারও হেসে ফেললো।
বিকেলে বাসায় ফিরে মুগ্ধ আর বর্ণ নীতুকে কোনরকম বিরক্ত করা ছাড়াই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকলো। বর্ণ শুধু একবার নীতুর ঘরে উকি মেরে নীতুকে শুয়ে থাকতে দেখে চুপচাপ চলে গিয়েছে। সন্ধ্যের আগে নীতুর ঘুম ভাঙলো বাবা ছেলের হাসির আওয়াজে। নীতু উঠে ও ঘরে গিয়ে দেখলো মুগ্ধ বর্ণকে জড়িয়ে ধরে কাতুকুতু দিচ্ছে। বর্ণ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে বাবার কোলে। নীতুর ঠোঁটের কোনে আপনা আপনিই হাসি চলে এলো। কিন্তু নীতুকে দেখেই দুজন হাসি থামিয়ে নাকের ওপর থেকে চশমা ঠেলে উপরে তুলল।
বর্ণ গুটি গুটি পায়ে হেঁটে টেবিলে ঢেকে রাখা মগ এনে নীতুর হাতে দিয়ে বলল, ‘‘অ্যান্টি তোমার কফি। বাবা আর আমি বানিয়েছি।’’
নীতু বলল, ‘‘তুমি খেয়েছো?’’
‘‘আমি হরলিক্স খেয়েছি। বাচ্চাদের কফি খেতে হয় না।’’
নীতু মিষ্টি করে হেসে কফিতে চুমুক দিয়ে বড় বড় চোখ করে বর্ণর দিকে তাকাতেই ও হেসে বলল, ‘‘আমি তোমার কফিতে আমার হরলিক্স দিয়েছি। কাল রাতে বাবাকে বললে বাবা বুড়ো। তারমানে তো তুমি বড় নও।’’
বর্ণর কথা শুনে টিভি দেখতে থাকা মুগ্ধ জোরে হেসে ফেললো। নীতু রেগে মুগ্ধর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘‘এমন ফিচলেমার্কা হাসি দিয়েই প্রমান করলেন যে কফিতে হরলিক্স মেশানোর আইডিয়া আপনার।’’
‘‘আমার ছেলের মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সে জানে কার হরলিক্স খেয়ে বুদ্ধির বিকাশ ঘটানো জরুরী। তাকে কিছু শিখিয়ে দিতে হয় না।’’
‘‘ওহ আপনি নিজেকে মহাবুদ্ধিমান ভাবেন?’’
‘‘মহাবুদ্ধিমান ভাবি না। বুদ্ধিমান ভাবি।’’
‘‘আপনি মহাবুদ্ধিমান হলে গাধারা সব আত্মাহুতি দেবে লজ্জায়।’’
‘‘আমি তাহলে কি?’’
‘‘আপনি হলেন মফিজ। তা না হলে যে সময় আপনার বিয়ে করা উচিত ছিল সে সময় পার করে ৫ বছর পর বিয়ে করতেন না। এখন তো আপনার ছেলে বড়ই হয়ে গিয়েছে।’’
‘‘মুগ্ধ টিভির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, কেনো বিয়ে করেছি তা তোমার মত মাথামোটা হিটলার মেয়ে কখনই বুঝবে না।’’
‘‘কি বললেন?’’
‘‘বলেছি আজ যেন কি বার? কত তারিখ?’’
‘‘বর্ণকে হাসতে দেখে নীতু জিজ্ঞেস করলো, অ্যাই বল্টু তোমার বাবা কি বলল এইমাত্র?’’
‘‘বাবা বলেছে মাথামোটা হিটলার।’’ একথা বলেই বর্ণ জিভ কামড়ে ধরে বাবার দিকে তাকালো।’’
নীতু কফির মগ বর্ণর হাতে দিয়ে শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে মুগ্ধর আরও সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘কি? আমি মাথামোটা হিটলার? আর আপনি কি? চারচোখা মফিজ একটা।’’

মুগ্ধ টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল। নীতু রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো।’’
(৩)পরের বেশ কয়েকদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলো। নিতুর কথামত বর্ণ আর মুগ্ধ দুজনের কেউই ওকে কোনরকম বিরক্ত করে না। দুজনের এই নির্লিপ্ততা শুরুতে নীতুকে স্বস্তি এনে দিলেও ক্রমশই ওর রাগের কারন হলো। সারাদিন দুহাত গুটিয়ে অথর্বর মত বসে থাকা ছাড়া ওর কোন কাজ নেই। ওর মেজাজ বেশি বিগড়াতো তখন, যখন বাবা ছেলের গুটুর গুটুর গল্প আর পেট ফাটানো হাসির মাঝে নীতু কৌতহলী হয়ে সামনে দাড়াতেই দুজনই চুপ মেরে যেত। এমন ভাব যেন পেটে বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কিছু বেরুবে না। কিন্তু নীতু আড়াল হওয়ামাত্র আবারও হা হা হি হি শুরু হতো।

এরপর এক রাতে নীতু রাগী গলায় ঘোষণা করলো, ‘‘আমি যতদিন এ বাড়িতে আছি কাল থেকে ততদিন পর্যন্ত সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে সব রান্না আমি করবো। বল্টুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবো। আমি টিভি দেখি আর নাই দেখি টিভির রিমোট আমার হাতে থাকবে। তোমাদের দুজনের যত গাটুর গুটুর আলাপ আছে তা শুনি আর নাই শুনি আমার সামনেই হতে হবে। আর বল্টু আজ থেকে তুমি আমার সাথে ঘুমুবে।’’
আধ ঘণ্টার মাঝেই বর্ণ বাবার ঘর থেকে ওর ব্যাগ পোটলা গুছিয়ে লাফাতে লাফাতে নীতুর ঘরে চলে গেলো।

একমাস পূর্তির বাকি দিনগুলো এরপর দ্রুতই কাটতে লাগলো। বাবা ছেলের নির্লিপ্ততার অভিনয়ের আড়ালে জমিয়ে রাখা ভালবাসাগুলো নীতু টের পাচ্ছিলো তারচে দ্রুততায়। এই দুটো মানুষের যত গল্প আর হাসি সবই নীতুকে ঘিরে তা বুঝতে নীতুকে মাঝে মাঝেই দেয়ালে কান পেতে থাকতে হতো। বর্ণ বাবার সাথে কথা বলার সময় নীতুকে যেই মমতা নিয়ে মা বলে ডাকে তার জন্য নীতুর মমতাও জাগ্রত হয়। মুগ্ধর সাথে দিনে একবার গায়ে পড়ে ঝগড়া না করলে নীতুর দিন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। টিভিতে খেলা দেখার সময় সবসময়ের বাবার পক্ষের দলকে সাপোর্ট করা বর্ণ যখন নানান অজুহাতে নীতুর দলে ভীরে, নীতু তখন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বর্ণকে। এইটুকুন বাচ্চা রোজ রাতে যখন ঘুমের ভান করে অপেক্ষায় থাকে নীতু ঘুমিয়ে পড়ার পর তার গায়ে আলতো করে হাত রাখবে, নীতুর চোখে তখন ভালবাসার মেঘেরা ভীর করে।
প্রতিদিন বর্ণকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে অপেক্ষায় থাকা নীতু সকলের মুখে বর্ণর বলা কথা ‘‘আমার মা পৃথিবীর সেরা মা’’ শুনে আক্ষেপ করে নিজের উপর। এই ছোট্ট হৃদয়ে নীতুর জন্য এত ভালবাসা তো নীতু সাথে নিয়েই চলে যাবে তাই ভেবে। অবশেষে তিনজন মানুষের আবেগের লুকোচুরির দিন ফুরিয়ে আসলো। মুগ্ধ পরদিনের বাসের টিকিট কেটে এনে নীতুর হাতে দিল। বর্ষার দিন ছিল। সারারাত বৃষ্টি হলো। প্রবল বর্ষনের সাথে বর্ণ আর মুগ্ধর চোখের জল মিলে মিশে একাকার হল সে রাতে।
চলে যাওয়ার মুহূর্তটা যতটা অস্বস্তিকর হবে বলে নীতু ভেবেছিল তেমন কিছুই হল না। শুধু বাসে উঠতে গিয়ে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখল বর্ণ ঠোঁট কামড়ে ধরে এক হাতে ওর শাড়ির আঁচল খামচি দিয়ে ধরে আছে। মুগ্ধ মৃদু হেসে বলল, ‘‘অ্যান্টির দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা।’’ মুগ্ধর কথায় হাতের মুঠি থেকে শাড়ির আঁচলের কোনাটা ছেড়ে দিল বর্ণ। নীতুকে বাসে তুলে দিয়ে মুগ্ধ বর্ণকে নিয়ে পার্কে গেলো। অফিস ছুটি নিয়েছে সে। বর্ণকে সাথে নিয়ে সারাদিন ঘুরবে বলে।

বিকেলে বাসায় ফিরতেই দুজনের চোখ কপালে উঠলো। দরজার সামনের সিঁড়িতে নীতু বসে আছে। ওদের দেখে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো ও। ধমকের সুরে বলল, ‘‘বাড়ি থেকে আপদ বিদেয় করে সারাদিন মজা করে বেরুলে তোমরা তাই না? ফোন কই তোমার? কতশতবার নাম্বার ডায়াল করেছি?’’
হতভম্ব মুগ্ধ পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো সেটা বন্ধ হয়ে আছে। কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘‘কিভাবে যেন বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পারি নি। তুমি ফিরে এলে যে? কিছু ফেলে গিয়েছো?’’
নীতু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘‘গাধা কোথাকার। আমি কি বলেছিলাম আমাকে টিকিট কেটে এনে দাও? কেনো আটকালে না আমাকে? একবার থেকে যেতে বললে কি আমি খেয়ে ফেলতাম তোমাদের?’’
বর্ণ ফোঁপাতে ফোঁপাতে নীতুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘মা আমাকে রেখে আর যাবে না তো?’’

নীতু ওকে আরও শক্ত করে ধরে বলল, ‘‘আমার বাবাটাকে রেখে আমি আর কখখনও কোথথাও যাবো না। অনেক হয়েছে, আর কাঁদবে না বাবা।’’
মুগ্ধ চোখের জ্বলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমাটা খুলে মুছতে শুরু করলো। নীতু বলল, ‘‘এই যে গাধামানব, খালি হাতে ভেজা চশমা মুছলে হবে? এদিকে আসো।’’ মুগ্ধ এগিয়ে যেতেই ওর হাত থেকে চশমা নিয়ে নীতু ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ‘‘আমার বাস ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অমন বাচ্চাদের মত ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলে কেনো? ছেলের কান্না দেখে? নাকি এই মাথামোটা হিটলারের জন্য? বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে এই দৃশ্য দেখে কি কোন মেয়ের চলে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে?’’
‘‘তাহলে চলে যাচ্ছিলে কেনো?’’
‘‘তুমি যেতে দিলে কেনো?’’
বর্ণ এক হাতে মাকে ধরে অন্য হাতে চশমা খুলে নীতুকে বলল, ‘‘মা আমারটাও মুছে দাও।’’
ওর কথা শুনে মুগ্ধ আর নীতু হেসে ফেললো।

by- Habiba Bristy

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url