গল্পঃ কে ডাকে উড়িয়ে আঁচল... কে!

জেমস্ দা ষ্টেজে উঠেই তাঁর দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ''আমি এসে গেছি তোরা সব শান্ত হয়ে যা।'' আর্মি ষ্টেডিয়ামের মাথায় তখন লুটফাট হয়ে যাবার মত বিশাল এক চাঁদ। এতোক্ষন বসেই ছিলাম, এবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। গুরুর গীটারের ব্লুজে যখন মাতাল হয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই দেখলাম তাকে... সেই প্রথম দেখা! সে-ই আমার বুকের ভেতর ঢং ঢং করে প্রেমের ঘন্টা বাজার প্রথম সুখানুভূতি। ওদিকে গুরু তখন গাইছেন,
''চোখের দেখাই মনের দেখা হয়...
চোখের দেখাই যদি মনে রয়।
ভালোবেসে তোমরা তাকে কি বলবে?
কি বলবে?
ও বিজলী চলে যেও না!''

আমরা বন্ধুরা চেইন বানিয়ে কৌশলে ''ও'' যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে পৌছে গেলাম। বলে রাখা ভালো আমরা সব বন্ধুরাই গুরু জেমসের অন্ধ ভক্ত। জেমসদা একের পর এক গেয়ে যাচ্ছিলেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিলো আমাদের চিত্‍কার আর উম্মাদ নাচ। নাচের ফাঁকেই ওদের দুটি মেয়ে ও তিনটা ছেলে অর্থাত্‍ পাঁচ জনের দলটার সাথে সহজেই আমাদের সাত বন্ধুর দলটা ক্লোজ হয়ে গেলো আসলে এটাই ছিলো আমার টার্গেট! কি যে অদ্ভূত একটা ফিলিংস হচ্ছিলো বলে বোঝানো যাবে না।

জেমস্ দা যখন জগতের সব দরদ দিয়ে গাইছেন ''আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার!'' ঠিক তখনি বুক ভর্তি বাতাস নিয়ে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ''এক্সকিউজ মি, আপনার নামটা জানতে পারি?'' মুচকি হেসে সে উত্তর দিলো, ''সিলভিয়া।'' আমি যখন এক গাল হেসে নিজের বাপের দেওয়া নামটা অতি আগ্রহ নিয়ে বলতে যাবো ঠিক তখনি জেমসদা ''বেঁচে থাকলে দেখা হবে'' বলে নেমে গেলেন। অসংখ্য মানুষ যেন সমূদ্রের জলের মত মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো... অনেক খুঁজলাম তবু সিলভিয়ার দেখা আর পেলাম না। মাঝ রাতে বাসায় ফিরলাম ঠিকই তবু কি যেন ফেলে এসেছি আর্মি ষ্টেডিয়ামে। দু'দিন কেটে গেছে আমার অবচেতন মন কেবলই সিলভিয়াকে খোঁজে। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে আচমকা আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখের সামনে ছায়াছবির মত ভেসে ওঠে সিলভিয়ার চপল চাহনি। জীবন থেকে ২২টি বসন্ত কেটে যাবার পর এই প্রথম হ্যাঁ এই প্রথম কোন মানবীর জন্য এই উড়নচন্ডী মন আমার কেমন কেমন করে!

ইট-কাঠ-কংক্রিটের এই শহরে ঠিকানাবিহীন মানুষ খুঁজে বের করা আর অকূল সমূদ্রের মাঝ থেকে তীরের খোঁজে সাঁতরানোর মধ্যে খুব একটা প্রার্থক্য নেই। কিসের টানে যেন প্রায় প্রতিদিনই আর্মি ষ্টেডিয়ামের সামনে গিয়ে বসে থাকি, ভাবি যদি সিলভিয়া আসে। আমার বন্ধুরা হেসে বলে, ''কি পাগলামী শুরু করেছিস বলতো?'' কোন কোনদিন ঘন্টা হিসেবে রিকশা ভাড়া করে হাজারো অচিন মুখের ভীড়ে সিলভিয়াকে খুঁজে বেড়াই। মাঝে মাঝে মহাখালী ফ্লাই ওভার থেকে হাঁটতে হাঁটতে একদম কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত চলে যাই! আমার সংঙ্গে প্রায়ই বুলু মামা থাকেন। ও হ্যাঁ ভালো কথা বুলু মামাকে আমাদের মহল্লার সবাই পাগল বুলু বলে ডাকে। তবে আমার তা কোনদিনই মনে হয়নি বরং বাবরী চুলের বুলু মামার এই অদ্ভূত জীবন দর্শনটাকে আমার কাছে এই পঁচে যাওয়া নষ্ট সমাজের বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষগুলোর প্রতি গভীর ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের ভাষা বলেই মনে হয়। -''ভাইগনা কি এমন চিন্তা করো! সাধনায় মিলে দর্শন বুঝলা?'' পান চিবোতে চিবোতে বুলু মামা বলেন। -''মামা সিলভিয়ারে কই পাই!'' আমার গলায় রাজ্যের হতাশা। বুলু মামা হাহা করে হেসে উঠেন। পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ''পাইবা ভাইগনা পাইবা মাঝ রাতে ঈশ্বরকে কইয়া দিমু।'' কেমন যেন কান্না পায় আমার। চুপচাপ হাঁটতে থাকি আমরা।

ছয়মাস পরের কথা। বিজয় স্বরনীর বিশাল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে কাজ-টাজ নেই সুতরাং কই যাওয়া যায় ভাবছি- ঠিক এমন সময় আমার চোখের সামনে দিয়ে হলিক্রসের ড্রেস পড়ে, কাঁধে কলেজ ব্যাগ ফেলে হেলে-দুলে হেঁটে যাচ্ছে যে মেয়েটি তাকে দেখে আমার হৃদপিন্ডটা যেন আচমকা ইস্পাত হয়ে গেলো! মিনিট খানেক পর ট্রাফিকের হুইসেলের তীক্ষ্ন চিত্‍কারের আর্শিবাদে আমি যেন হুশ ফিরে পেলাম। কিছুটা শব্দ করেই বললাম, ''এই মেয়ে এই!'' ঘটনার আকস্মিকতায় সিলভিয়া কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বললো, ''আ আ আমাকে বলছেন?'' ''হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। আমি যদি ভূল না করি আপনার নাম সিলভিয়া। ঐ যে আর্মি ষ্টেডিয়ামের কনসার্টে পরিচয় হলো। মনে আছে?'' এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললাম আমি। ''ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। সেদিন কনসার্টের পর আপনাদের তো আর দেখলামই না। যা মজা করেছেন আপনারা হাহাহা। কেমন আছেন বলেন?'' কি সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা। ''আছি মন্দ-ভালো-সাদা-কালোয়।'' আমি ছোট্র করে উত্তর দিলাম। ''সরি আপনার নামটাই তো জানা হলো না!'' সিলভিয়ার লাজুক চোখে চোখ রেখে বললাম, ''আমার তো দুইটা নাম। একটা বাবা রেখেছেন অন্যটা আমি, কোনটা শুনতে চান।'' সিলভিয়া চোখ বড় বড় করে বাচ্চা মেয়েদের মত আশ্চর্য গলায় বললো, ''নিজেই নিজের নাম রেখেছেন? আপনারটাই বলুন ওটাই শুনি।'' আমি হেসে বললাম, ''বাবা নাম রেখেছিলেন সীমান্ত আহমেদ শান্ত। ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হয়নি! একটাই তো জীবন তাও যদি সীমাবদ্ধ গন্ডির ভেতর শান্ত-শীষ্ট হয়ে কাটাই তাহলে এর মত বেদনার আর কি আছে? তাই নিজেই নিজের নাম দিয়েছি সমূদ্র। আমার বিশালতায় আসলেই জীবনের অর্থ অন্যরকম হয়ে যাবে।'' আমার কথাগুলো শুনে সিলভিয়া অবাক হয়ে বললো, 'wow! what a nice philosophy! সেই শুরু সিলভিয়ার সাথে আমার পথচলা। সিলভিয়া তখন ইন্টার ফার্ষ্ট ইয়ার আর আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। সিলভিয়া ধানমন্ডিতে ওর মামার বাসায় থাকে আর ওর বাবা-মা দু'জনই দেশের বাইরে থাকেন। উনাদের প্রসঙ্গ আসলেই সিলভিয়া সেটা এড়িয়ে যায় তাই ওর বাবা-মার সম্পর্কে আমি থেকে যাই অন্ধকারে।

আজকাল প্রায় প্রতিদিনই আমি হলিক্রস কলেজের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি। ক্লাস শেষ করে সিলভিয়া এসেই বোকাঝোকা শুরু করে। -''আমার ক্লাস সিডিউলটাতো তোমার কাছে আছে তাই না? তবুও কেন ঘন্টা দুয়েক আগেই এসে রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকো? নিজের ভালোটা বোঝো না কেন!'' সিলভিয়ার অভিমানী কথাগুলো শুনতে দারুন লাগে। তাই কথাগুলোর উত্তর না দিয়ে বোকার মত হাসি আমি, ''চলো রাস্তার পাশের সস্তা চায়ে স্বপ্ন ওড়াই।'' সিলভিয়া আলতো করে আমার হাত ধরে। আমরা হাঁটা ধরি চায়ের খোঁজে। মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিলভিয়া মিরপুরে চলে এসে আমায় ফোন দেয়, ''কই তুমি? আমি তোমার বাসার পাশে আসবা প্লিজ!'' কিসের আবার প্লিজ! যত কাজই থাক সিলভিয়ার ফোন পেলে আমি যে দৌড়টা দেই সেটা দেখলে সয়ং উসাইন বোল্টও নির্ঘাত আমাকে কড় জোরে বলতো ''ওস্তাদ সালাম!'' চোখের পলকেই যেন প্রায় দুটো বছর কেটে গেলো। তবু আজও আমি সিলভিয়াকে বলতে পারিনি ''ভালোবাসি... ভীষন... ভীষন... খুব বেশী।''

সিলভিয়ার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে সমাজের খেটে-খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি ওর ভালোবাসা কিংবা টান। কোন কোন মায়াবী সন্ধ্যায় শহরের নির্জন পথ ধরে সিলভিয়া যখন আমার হাত ধরে হাঁটে আর গুনগুনিয়ে গান গায়, জানি না কেন মাত্রাহীন সুখে আমার তখন স্রেফ মরে যেতে ইচ্ছে করে! তবে মাঝে মাঝেই কেন যেন সিলভিয়া বিষন্য হয়ে বসে থাকে। কি হয়েছে জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোন উত্তর পাই না। আমার তখন পাগল পাগল লাগে। সামনে সিলভিয়ার ইন্টার পরীক্ষা তাই রাত জেগে পড়ে। হঠাত্‍ হঠাত্‍ একটু রাত করে আমি ওর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই, এক পলক দেখেই বাতাসে চুমু খাই। জীবনটাকে তখন আর মন্দ লাগে না। এর মাঝে একদিন রাত এগারোটার দিকে সিলভিয়া ফোন করে বললো, ''মনটা খুব খারাপ কি করা যায় বলতো সমূদ্র?'' আমি বললাম, ''তোমার প্রিয় নায়ক টম ক্রুজকে নিয়ে আসি?'' সিলভিয়া হাসতে হাসতে বললো, "তোমার সবকিছুতেই খালি রসিকতা!'' আমি মাঝ রাতে আমার পোষা খোরগোশ এক বছর বয়সী টম ক্রুজকে নিয়ে সিলভিয়াদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সিলভিয়া বারান্দা থেকে টম ক্রুজ এবং আমাকে দেখেই আনন্দে চিত্‍কার করে উঠলো। দৌড়ে নিচে নেমে খোরগোশটা কোলে নিয়ে খুশিতে কেঁদেই ফেললো ও!

সিলভিয়ার পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার আগের রাতে আমি ঘুমাইনা কারন ঘুমালে যে সকালে উঠতে পারবো না! বেচারী আবদার ধরেছে হলে ঢোকার আগে আমাকে দেখে ঢুকবে! পাগলী মেয়ে একটা! পরীক্ষা শেষে সিলভিয়া প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে হল থেকে বের হয়। মুখটা কেমন শুকনো দেখায়। বড় মায়া লাগে আমার। পরীক্ষা শেষ হবার পরের দিন থেকে রেজাল্ট বের হবার দিন পর্যন্ত আমরা দুজনেই রোদে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় কালো হয়ে গেলাম। বলতে গেলে প্রতিদিনই ঢাকা শহরের পিচঢালা রাজপথে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতাম, মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে মুখোমুখী চেয়ে থাকতাম অপলক! আমার মত অতি নিন্মমানের অপদার্থ ছাত্রের সাথে ঘুরে ঘুরেও সিলভিয়া গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে গেলো। খুশিতে আমি একগাদা কবিতা লিখে ফেললাম তবুও ওর যেন কোন ফিলিংস্ নেই। মেধামী মেয়েরা হয়তো এমনি হয়। সময়গুলো এভাবেই কাটছিলো মহাসুখে তবু আজও আমি সিলভিয়াকে আমার ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি তবে মনে মনে ভাবি হয়তো আমার চোখের ভাষায় সিলভিয়া বুঝতে পারে আমি যেমন ওর চোখ দেখে বুঝতে পারি ও আমায় ভালোবাসে!

কে জানে আমি হয়তো তখন ভাবতাম ভালোবাসা প্রকাশ করার মত বিষয় নয় তাই আমার মধ্যে কোন দ্বিধাদন্ধ কাজ করে না। ভাবি সিলভিয়া তো কাছেই আছে। কিন্তু হঠাত্‍ দুদিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও সিলভিয়ার সাথে আমার কোন যোগাযোগ হচ্ছিলো না। পরের দিন খুব ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেংঙ্গে গেলো। দরজা খুলেই দেখি আমাদের মহল্লার টং দোকানি ছেলেটা একটা খাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ''দাদা গতকাল দুপরের দিকে এক আপা আমারে ১০০টাকা বকশিশ দিয়া কইছে যেন আইজ ভোরেই আপনেরে চিঠিটা দেই।'' বুঝলাম সিলভিয়ার চিঠি। আমি রুমে চলে এসে খামটা খুলি...

প্রিয় সমূদ্র,
তুমি যখন চিঠিটা পাবে আমি তখন বাংলাদেশ থেকে যোজন যোজন দূরের দেশ কানাডায়। এখানে আমার মা থাকেন। তোমার সাথে আবার যেদিন বিজয় স্বরনীর রাস্তায় আমার দেখা হলো সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম অদৃশ্য কোন কিছু আমায় টানছে লোকে যাকে ভালোবেসে ভালোবাসা বলে। তোমার সাথে অসাধারন সব মূহুর্ত কাটিয়েছি। দিনে দিনে তোমার প্রতি আমার মায়া বেড়েছে... ভয়াবহ মায়া অথচ আমি চেয়েছিলাম কিছুতেই তোমায় ভালোবাসবো না কিন্তু উড়নচন্ডী আর পাগলাটে তোমাকে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেই জানি না। তোমাকে কখনো আমার বাবা-মা সম্পর্কে বলিনি, এড়িয়ে গেছি। আমার বাবা-মা দশ বছর প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। তারপর আমার জন্মের পাঁচ বছর পরই দুজনই আলাদা হয়ে গেলেন আর আমি এতিমের মত খালা এবং মামার কাছে বড় হয়েছি। আমার বাবা-মা দুজনই আবার বিয়ে করেছেন। বাবা আমেরিকা এবং মা কানাডাতে থাকেন। বাবা কখনো আমার খবর নেননি অথচ কত রাত বাবা নামের মানুষটার জন্য যে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি! আচ্ছা সমূদ্র, দশ বছরের ভালোবাসা কতটা মিথ্যে কিংবা সস্তা হলে সাত বছর একসাথে থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া যায়?? ভালোবাসাকে সেই থেকে আমার ভয়... ভীষন ভয় পাই আমি ভালোবাসাকে। আমি বহু বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিয়ে করবো না কিন্তু তোমার সাথে মিশে সম্পূর্ন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। মাস খানেক আগে খবর ফেলাম আমার মার দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙ্গে গেছে প্রায় পাঁচ বছর আগে অথচ মা আমাদের কাউকেই বলেনি। আমার মাও দূর্ভাগা মহিলা, সে কেবলই হারায়। এরপর হঠাত্‍ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি ... একটা খুন করবো! স্রেফ একটা খুন! খুন করে অগ্নীকন্যা হবো। শুনেছি অগ্নীকন্যারা নাকি কখনো কষ্ট পায় না। তাই আমি খুন করেছি সমূদ্র... খুন করে কানাডায় চলে এসেছি। তোমার প্রতি জন্মানো তীব্র ভালোবাসাটাকে গলা টিপে খুন করেছি আমি। আমার ভয় হতো যদি তুমি আমার বাবার মত একদিন চলে যাও!! এর চেয়ে তুমি আমার মনের ঘরে এভাবেই আজীবন থাকো তাই ঢের ভালো। আচ্ছা সমূদ্র, তুমি কি আমায় ভালবাসতে নাকি আমি তোমার চোখে ভূল দেখতাম? নিজের প্রতি যত্ন নিও

-সিলভিয়া।

এরপর এই জীবন আর আগের মত থাকেনি। সিলভিয়ার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো আমায় ঘুমতো দেয়না। কোন কোন দিন রাত একটু বাড়লেই আকাশটা কাঁদতে শুরু করে। আকাশের হাহাকার বারান্দার চেয়ারে বসে থাকা এই আমাকে একদম এলোমেলো করে দেয়... আমি তখন রাস্তায় নেমে আসি। লাইটপোষ্টের নিয়ন আলোয় বৃষ্টির জলগুলোকে বড় অদ্ভুত লাগে। একা একাই ভিজতে ভিজতে হাঁটি। ঘুমন্ত শহরে এক কাপ চায়ের অভাব খুব বেশী অমানবিক মনে হয়! মাঝে মাঝে বুলু মামা বাসার সামনে এসে ভাইগনা বলে ডাক দেন। আমিও বাসা থেকে বের হয়ে আসি। বুলু মামা অবিরাম কথা বলে যান সবই উচ্চশ্রেনীর কথাবার্তা। শেষ রাতে আবার ফিরে আসি কংক্রিটের বদ্ধ খাঁচাটায়। ফ্লোরে পড়ে থাকা আধ খাওয়া সিগারেট আর পিঁপড়ে ধরা কফির মগ যেন এই জীবনটারই প্রতিচ্ছবি! ম্যাক্সিম গোর্কী, রুদ্র, সমরেশ, কাম্যু আর হেমিংওয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অগোছানো বিছানাটায়... আহা কি অনাদরে- বড্ড হাসি পায় দেখে! আমি হেসে উঠি প্রান খুলে। হাসির শব্দে চার দেয়াল কেঁপে ওঠে। আমার শরীরটাও কাঁপে। বড় অস্থির লাগে আমার... আলো-আঁধারীর মাঝে সিলভিয়ার নীল শাড়ীর আঁচল আমায় যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়... হ্যালুসিনেশন... হ্যালুসিনেশন... হঠাৎ-ই বুকের ভেতরটা ভীষন জ্বালা করে আমার, দুমড়ে-মুচড়ে যায়... কোথায় যেন সব কিছু ভেঙ্গে ছুড়ে পড়ে! আমি তখন রাত্রির গুহায় মুখ ঢেকে চুপটি করে বসে থাকি সূর্য ওঠার অপেক্ষায়... বড় বেশি ক্লান্তিকর আর বেদনাময় সে-ই অপেক্ষা!!

by- আরাফাত হিমু
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url