গল্পঃ মায়াসক্ত

প্রায় তিন বছর পর তারাকান্দি যাচ্ছি।উদ্দেশ্য মাসুদার সাথে দেখা করব।মনটা তাই খুব খুশি।সেই তিন বছর আগে ওকে দেখেছিলাম,আর দেখা হয়নি।সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সবকিছু বদলে যায়।মেয়েটা কি আগের মতোই আছে নাকি অনেকখানি বদলে গেছে?
মাসুদার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ওর বিয়েতে।বিয়েটা ওর সম্মতিতেই হয়েছিল।বর উচ্চশিক্ষিত।ভদ্র চেহারার লোকটি সরকারি চাকুরিজীবি ছিলেন।মাসুদার বাবা মেয়ের জন্য একটা সরকারি চাকুরে বরই খুঁজছিলেন।লোকটা ভীষণ ভাগ্যবান।বেঁচে থেকেই নিজের মেজো মেয়েকে পছন্দমতো পাত্রের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন।পাগলের মতো কি সব ভাবছি!গাড়ি খুব দ্রুত চলছে তবু রাস্তা বেশি মনে হচ্ছে।আর কতদূর...

মাসুদার বাবা যমুনা সার কারখানার একজন কর্মকর্তা।পরিবার সহ তারাকান্দি কলোনীতে থাকেন।মাসুদা সন্তান সম্ভবা।আমি জানি ও এখন কলোনীতেই আছে।মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি তার বাবার বাড়িতে হয়।তাই আমিও কলোনীতেই যাচ্ছি।কারণ ওখানে গেলেই আমি মাসুদার দেখা পাবো।তিন বছর পর আবারও প্রাণভরে দেখব ওকে।ওর অজান্তেই জাগিয়ে তুলবো আমার সুপ্ত ভালবাসাকে।যে ভালবাসার কথা মাসুদা কোনদিন জানেনি-বোঝেনি এমনকি জানতেও চায়নি কখনো।

তারাকান্দির মাটিতে পা রাখার পর বুঝলাম অনেক পাল্টে গেছে আমার প্রিয় এলাকাটা।এ অঞ্চলের মাটির বুকে গজিয়ে উঠেছে অনেক বহুতল ভবন।সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সবই পাল্টায়।মাসুদাও তেমনিভাবে পাল্টে গিয়েছিল।আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও বিয়েতে রাজি হবে।থাক ওসব...

কলোনীর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না।কিছু কেনা দরকার।কারণ আজ ওর বাসায় আমি প্রথম যাচ্ছি তাও আবার একটা বিশেষ সময়ে।আচ্ছা মাসুদার ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে?ছেলে হলে আমি খুব খুশি হবো।একসময় ভাবতাম আমার মেয়ের প্রথম কান্না শুনবে মাসুদা।পরম যত্নে আমার মেয়েকে বুকে টেনে নেবে।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখব আমার জীবনের সবচেয়ে মায়াবী মূহুর্ত।কিন্তু তা হয়নি।মানুষের সকল আশা পূর্ণতার ছোঁয়া পায়না।

কলিংবেল টিপে দাঁড়িয়ে আছি।কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো ১৭-১৮ বছরের একটা মেয়ে।ও আমাকে না চিনলেও আমি ওকে ঠিকই চিনেছি।ঝর্ণা,মাসুদার ছোট বোন।আমার মাসুদার আলতাসুন্দরী।কথাটা মনে হয় ভুল বললাম!মাসুদা কি কখনো আমার ছিল?না,ছিলনা।
বাসার সামনে এতগুলো ব্যাগ হাতে অচেনা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা সম্ভবত অবাক হয়েছে।

:ঝর্ণা বলতো আমি কে?
-আপনি রিসাদ ভাইয়া,তাই না?আসুন ভিতরে আসুন...
আমাকে দেখে ও যতখানি বিস্মিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি বিস্মিত আমি ওর কথা শুনে।মেয়েটা আমাকে চিনলো কিভাবে?ও তো আজকের আগে আমাকে কখনো দেখেইনি।

এই প্রথম আমি ওদের ঘরের ভিতর পা রাখলাম।সবকিছু কেমন যেন নীরব নীরব!বাসার সবার সাথে পরিচিত হলাম।এর আগে মাসুদার বিয়েতে আমি এসেছিলাম,কিন্তু আমাকে কেউ চিনতো না তখন ও ছাড়া।মাসুদাকে দেখেই চলে গিয়েছিলাম সেদিন।আর আসা হয়নি।সত্যি কথা বলতে আমারই আসতে ইচ্ছে করেনি।ও অবশ্য কয়েকবার বলেছিল।কিন্তু আমি ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
খেয়াল করলাম সবাই যেন কি একটা লুকাচ্ছে আমার কাছে।কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।আমি মাসুদার কথা বলতেই ঝর্ণা আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা দোলনায় ঘুমাচ্ছে।অবিকল মাসুদার প্রতিচ্ছবি!ঝর্ণা বলল,আপুর মেয়ে।আমি ধৈর্য্য হারিয়ে বললাম,মাসুদা কোথায়?ও বলল,চলুন বাইরে যাই ভাইয়া।আমি উত্তর দেয়ার আগেই ঝর্ণা বাইরে চলে গেল।আমিও ওকে অনুসরণ করলাম।মনের মধ্যে একটা খটকা লাগলো।বাসার সবাই মাসুদার বিষয়ে এত নীরব কেন?

ঝর্ণা আমাকে বাড়ির পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে নিয়ে গিয়ে তর্জনী দ্বারা নতুন মাটির দিকে ইঙ্গিত করলো।হঠাত্‍ আমার শরীর অবশ হয়ে গেল।থপ করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম।নতুন মাটি কৃষ্ণচূড়ায় লাল হয়ে আছে।দু'হাতে মাটি তুলে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলাম।আশ্চর্য!মাটিতে ঠিক মাসুদার শরীরের ঘ্রাণ।কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না।ঝর্ণার হাতের স্পর্শে চেতনা ফিরল।ওর সাথে বাসায় গেলাম।শুনলাম মেয়েটাকে জন্ম দেয়ার সপ্তাহখানেক পরেই মাসুদা চলে গেছে ওপারে।আর শুনলাম,মাসুদার স্বামী নাকি এই মেয়েকে নিতে নারাজ।তার পরিবার নাকি ছেলে চেয়েছিল।হায়রে মানুষ..!

আমি মাসুদার মেয়েটিকে ওদের কাছে চাইলাম।ওরা খুব সহজেই রাজি হয়ে গেল।মাসুদার শেষ ইচ্ছাও নাকি এটাই ছিল।মেয়েটাকে বুকে নিয়ে ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম।
আমার মেয়েটা এখন কথা বলতে পারে,হাঁটতে পারে।বাবা বাবা বলে ডাকে।রাতে একসাথে খাবে বলে আমার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকে।কিছুদিন যাবত্‍ পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।দেখি কতদিন এভাবে থাকা যায়।মেয়েটার দিকে তাকালেই দুনিয়াদারী সব ভুলে যাই।শুধু মনে হয় "মায়া" আমার মেয়ে,আমার মাসুদার মেয়ে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- আসলাম মালিক
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url