গল্পঃ যেখানেই হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা

সবকিছুতেই আজ কেমন যেন একটা মাদকতা ছড়ানো। যা দেখছে তাই ভালো লাগছে আবরারের। মাথার উপর দুপুরবেলার গনগনে সূর্যটাকেও ভীষণ ভালো লাগছে। সাত বছর পর বাংলাদেশে ফিরেছে আবরার। চাকচিক্য, জৌলুস আর নাগরিক সকল সুবিধাকে নিমিষেই বিদায় জানিয়ে আমেরিকা থেকে পরশু রাতে দেশে ফিরেছে, ফিরে এসেছে মায়ের কাছে। একটা বিষয় খুব মজা লাগে ভেবে, দেশে থাকতে ওর মধ্যে দেশপ্রেম জিনিশটা কখনোই এতোটা প্রবল ছিলোনা। এই সাত বছরে ক্রমেই দেশপ্রেমের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নাম শুনলেই বুকের ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করতো।

কার্ডিওলজিতে এমডি করার সময় এই অসাধারণ অনুভুতিই আবরারকে বহুদূর যেতে সাহায্য করেছে। চমৎকার রেজাল্ট আর পারফরমেন্সে সবারই খুব প্রিয় হয়ে
যায় সে আর বোনাস হিসেবেতো ওর চমৎকার একটি হাসি আছেই, যা মুহূর্তেই সবাইকে আপন করে নেয়। ধানমণ্ডি লেকের পাশে গাড়িটি ছেড়ে দিলো। কিছুদুর হেঁটেই সামনে একটি টং দোকান দেখতে পেল চায়ের। এগিয়ে গিয়ে এক কাপ চা অর্ডার দিলো। পাশের চেয়ারটায় বসা মাত্রই ঘটে গেল ঘটনাটি। বুকের ভেতর সাত বছর পর মোচড় দিয়ে উঠলো আবার সেই পুরনো ব্যথা। এগিয়ে আসছে সে। আবরার একবার ভাবলো দাম দিয়ে হেঁটে চলে যাই, কিন্তু ততক্ষনে বহু দেরি হয়ে গেছে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো নুহা।অবশেষে নিরবতা ভাঙল আবরারই।

‘কেমন আছো?’ বলে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। উত্তর না দিয়েই নুহা বলল, ‘ এসো আমার সাথে’। অবাক হোল না, আবরার জানতো কিছু মানুষ কখনোই পরিবর্তন হয়
না। কিন্তু কোন অধিকারে সে যাবে? কোন আহবানেই বা নুহা তাঁকে ডাকছে? রাইফেলস স্কয়ারের হেলভেসিয়াতে দুজন মুখোমুখি বসা, কতো কাছে আবার বহু
দূরে।‘কি করছ এখন? দেশে কবে ফিরলে?’ নুহার প্রশ্নে সম্বিত ফিরল।

- এইতো কিছুদিন হল আসলাম। আম্মার শরীরটা খারাপ। স্টেটসে এমডি করলাম। তোমার কি অবস্থা?’
- আমি আছি মোটামুটি। একটা মেডিক্যাল কলেজে লেকচারার।’
- ভালো তো। বাসার সবাই ভালো আছে?’
-

হুম বলেই চুপ হয়ে যায় নুহা। নিঃশব্দ ভর করে দুজনের উপরই। অনেকক্ষণ পর প্রশ্ন করলো নুহা, ‘তুমি আগের মতোই আছো। এতদিনেও নিজের ইগোটাকে ছাড়তে পারলে না। চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও? আমিতো তোমাকে সবচেয়ে ভালো করে চিনি। মনের ভেতর জমে থাকা প্রশ্নগুলো করতেও কি ইগোতে লাগছে, নাকি আমার সাথে বসে কথা বলতে?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিল একটা। স্মিত হেসে আবরার জবাব দেয়, ‘ তুমি আমাকে সবসময়ই জানতে, বুঝতে। এখন
তুমিই বল , কেন আজও আমরা টেবিলের দু’প্রান্তে? কেন আমার ঢাকা শহরে বের হলেই খুব কষ্ট লাগে? কেন আমি আর নীল রঙের কিছু ব্যবহার করি না? কেন আমি
সাতটি বছর নিজের কাছ থেকে, প্রিয়জনদের কাছ থেকে, সবকিছু থেকে দূরে ছিলাম, কেন আমি এখনও রাতে ঘুমাই না? বল, এখন জবাব দাও সবজান্তা নুহা’ ‘তুমি চলে যাওয়ার পর আমার আন্টির সাথে কথা হয়েছিলো। আমি সব শুনেছি। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। সরি বলার মতো মুখটাও আমার ছিল
না।

আমি তোমার নাম্বারটি জোগাড় করতে অনেক চেষ্টা করেছি, পরে একদিন ইকবাল আমাকে তোমার নাম্বারটা দেয়। তুমি কি খেয়াল করেছ, দু’তিন দিন পরপরই রাতে
তোমার কাছে একটি ফোন আসতো?’ ‘তোমার নিঃশ্বাসও আমি চিনতে পারি নুহা। চিনতে পেরেও কিছু বলিনি। কারন প্রচণ্ড কষ্টে আমার কথা বলতে সমস্যা হয় খুব। কেন আমাকে ফোন করতে? সবকিছু ধ্বংস করার পরও কি জানতে চাইতে আর?’ ‘কিছুনা। তুমি বুঝবে না। ফিরে যাচ্ছ কবে?’ ‘ফিরছিনা আর। এখানেই থাকবো ভাবছি। ওসব কথা বাদ দাও, তোমার বাচ্চাদের কথা বল। নিশ্চয়ই তোমার মতো সুন্দর হয়েছে?’

‘আমি আম্মুর সাথে একাই থাকি। আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মু খুব একে হয়ে গেছেন।আর ভাইয়াও আর দেশে ফেরেন নি।আচ্ছা তুমি জিজ্ঞেস করলে না কেন
আব্বুর কথা? ‘আমি সবই জানি তোমার সম্পর্কে। চাইনা কিছু জানতে ,তবু কিভাবে যেন জেনে
যাই।ভেবেছিলাম ফোন দিবো একটা, কিন্তু কোন শব্দ খুঁজে পাইনি।’

- ‘তুমি? এখনও কি...?’
- ‘হুম, একাই আছি। যা জানো কেন জিজ্ঞেস করো? খুব ভালো লাগে অনুভূতি নিয়ে খেলে করতে? আর কতো?
- নুহা, আমার এখন যেতে হবে, আম্মাকে নিয়ে বের হবো।’
- ‘বাসায় এসো, আমার বাসা এখানেই...জদিও জানি তুমি বাসায় আসবে না।’
- ‘দেখি সময় পাই যদি চেষ্টা করবো। ভালো থেকো।’
- ‘আর একটু কি বসা যায়? আর কিছু বল। আমাকে গালিগালাজই না হয় করো কিছুক্ষন। তবুও একটু থাকো।’
- ‘নুহা, খুব পছন্দের আয়নাও যখন ভেঙে যায় তখন সেটাতেও ফাটলের দাগ থেকে যায়। প্রতিবার চেহারা দেখার সময়ই সে দাগ চোখে পরে, না চাইলেও পরে। আসি,
ভালো থেকো।’

চলে যায় আবরার আর রেখে যায় পুরনো সেই সুর। গরম কফি ঠাণ্ডা হয়ে যায়, নুহা তবুও বসে থাকে। সাত বছর আগের মতো হঠাৎ যদি ফিরে আসে আবার। চারপাশে ভিড়ের মাঝে , গানের কোলাহলে নুহার আজ খুব একলা লাগছে, খুব। আবরারের ভেতরে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার পুরো ব্যথাই বুকের মাঝে অনুভব করে আপনমনেই ফোনটি হাতে তুলে নেয় সে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- রাশেদ আবদুল্লাহ অনু

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url