গল্পঃ শূণ্যতার মাঝে

-রিকশাওয়ালার মত সারাক্ষণ গান শোন কেন?
-হাহাহা রিকশাওয়ালারা বুঝি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে?
-তা হয়ত শোনে না তবে তুমি শুনলে ওরকমই লাগে
-তাই বুঝি?রিকশাওয়ালার বউটা হঠাত্‍ ক্ষেপেছে কেন?
-কিছুই বোঝ না তুমি,না?
-বুঝি না তো ।তোমার মত টিটার থাকতেও বুঝাতে পার না?
-চুপ কর ।বেহায়ার মত কথা বল না তো ।
-ওকে বাবা ওকে ।এবার বলবে তো নাকি?
-হেডফোনটা নামাও
-আর কিছু
-আমার হাতটা ধর আর আই লাভ ইউ বল

নিশুর কথা শুনে রিকশাওয়ালার মুচকি হাসি এবার অট্তহাসিতে পরিণত হল।
না না এই রিকশাওয়ালা কিন্তু আকাশ নয়,যিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন তিনি।
আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না।রিকশায় বসে এ কার্য সম্পাদন তার কাছে অসাধ্যই মনে হচ্ছিল।আকাশ নিশুর কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানালো ব্যতিক্রম কিছু আছে কিনা ভেবে দেখার জন্য।কিন্তু জেদী নিশু তার ইচ্ছা পূরণে আকাশের অনুরোধ শুনতে নারাজ।শুরু হয়ে গেল তাদের নিত্য পরিচিত খুনসুটি।হঠাত্‍ করে দ্রুত গতির রিকশাটা ব্রেক কষে শূন্যবেগ প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই হুড নামানো রিকশা থেকে নিশু পড়ে গেল।ভালবাসার রঙিন মুহূর্ত সহসায় বিবর্ণ হয়ে গেল।আকাশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিশুকে কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল।ডাক্তারের মুখে সামান্য ব্যাথা পেয়েছে মাত্র কথাটা শুনে আকাশের আটকে থাকা দম স্বস্তির নিঃশ্বাসে পরিণত হল।

দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেমের পরিণতি দিতে দুই পক্ষ ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করছে ।পাকা কথা প্রায় হয়েই গেছে শুধু অপেক্ষা সময়ের।নিশুর বড় ভাই দেশের বাহিরে থাকেন।একমাস পরেই তিনি চলে আসবেন তাই বিয়েটাও একমাস পরেই হবে।এরই মধ্যে দুই পক্ষের আত্মীয়তাও শুরু হয়ে গেছে।

নিশুর সেরে যাওয়া ব্যাথা ইদানিং নাড়া দিচ্ছে।কিছুদিনের মধ্যেই নিশু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।ডাক্তার বলেন কোন এক আঘাতে নিশুর মেরুদন্ডের হাড় বাঁকা হয়ে গেছে ।এখন সেটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কিছুটা অংশ ভেঙে গেছে।সেই অংশে জন্ম নিয়েছে ছোট্ত একটা টিউমার।এই অবস্থায় নিশুকে সুস্থ করার একটাই উপায় আর তা হয় অপারেশন।ডাক্তারের কথা এখানে শেষ হলেই পারত কিন্তু সেটা হয়নি।ডাক্তার আরো জানান মেরুদন্ডের অপারেশন করলে রোগী সারাজীবনের জন্য সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে নতুবা একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে।

অকস্মাত্‍ বীনা মেঘে বজ্রপাত।উপায় নেই,একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।ভেবে চিন্তে অপারেশন করার সিদ্ধান্তই নিতে হল।অপারেশন না করলেও উপায় নেই।যদি মরতেই হয় লড়াই করে মরাই ভাল।মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে আট লাখ টাকা যোগার করাও মুখের কথা নয়।সব সম্পদের বিনিময়ে বোনের জীবনদানও সম্ভব নয়।বাবা মা বিহীন চার ভাইয়ের সংসারের আদরের নিশু আজ তাদের কাছে বোঝা স্বরূপ।বোনের ভাগের সম্পদ বিক্রি করে আর চার ভাইয়ের চেষ্টায় টাকাটাও যোগার হয়ে যায়।এবার প্রতিক্ষিত সেই অপারেশন ।

অপারেশন হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নিশু হারিয়ে ফেলেছে তার মেরুদন্ডের জোর।নিশু দাঁড়াতে পারে ঠিকই তবে স্বাভাবিক মানুষের মত নয়।ক্রাচই তার একমাত্র অবলম্বন।
এরকম মেয়েকে কেউ ঘরের বউ করতে চায় না।করেই বা কি হবে? নূপুরের ধ্বনিতে বাড়ি মুখরিত করার ক্ষমতা তো নিশুর নেই।অফিসের তাড়ায় স্বামীর শার্ট টাই এগিয়ে দেবার ক্ষমতাও নেই।ভালবেসে নিজের পরিবারকে রান্না করে খাওয়ানো,গুটি গুটি পায়ে আধো আধো বুলিতে কারো মা ডাক শোনার ক্ষমতাও নেই।তাহলে কিসের আশায় তাকে কেউ ঘরের বউ করবে?শুধু ভালবাসা দিয়ে জীবন চলে না।এই বাস্তবতাটুকু বোঝার ক্ষমতা অন্তত নিশুর আছে।
আকাশ এসেছে নিশুকে দেখতে।একটা অসার দেহকাঠামো দেখতে।
-কেমন আছ নিশু?
-ভাল (ঠোট দুটি হালকা প্রসারিত করে)
আকাশের যেন আর কোন কথা অবশিষ্ট নেই।এটা তার অক্ষমতা নাকি নিরবতা সেটাও বোঝার উপায় নাই
-কিছু বলবে না
-হুম ভালবাসি তোমাকে

নিশু আবারো প্রসারিত ঠোটে সেই মুচকি হাসিটা প্রকাশ করল।নিশু বুঝতে পারছে আকাশের মনের অবস্থা।এতদিনের ভালবাসা মিথ্যা নয়।আজকের বাস্তবতাও তো মিথ্যা নয়।বর্তমানের বাস্তবতার কাছে অতীতের ভালবাসাকে হার মানতে হবে।নিশু আকাশের মুখ থেকে শুনতেও চায় না তাদের বিয়ে না হওয়ার কাহিনী।আকাশ এখনো নিশুকে বিয়ে করতে চায় ভালবাসার পরিণতি ঘটাতে।সে তো সম্ভব নয় তাই সে নিজেই আকাশকে না করে দেয়।সব ভালবাসার পরিণতি যে প্রাপ্তি নয় তার উদাহরণ নিশু নিজেই।

জীবন কখনো থেমে থাকে না।আকাশ নিশুরও নেই।আকাশ তিথিকে বিয়ে করেছে।নিশু টিউশনি করে ব্যস্ততাকে সাথী করে নিয়েছে।আকাশের সাথে যোগাযোগ রয়েই গেছে।তিথির সাথেও নিশুর ভাল আনডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে।জীবন চলছে তার গতিতে শুধু নিশুই রয়ে গেছে শূণ্যতার মাঝে ।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by Odhora Bristy

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url