গল্পঃ ভালবাসি-এটুকু শুধু বলার...

(৬)
সায়ন এক বড় ভাই কে অনেক বলে কয়ে চিলেকোঠার ঘর টা নিজের জন্য নিয়ে নিলো।সেদিন সারাদিন ছাদে বসে ছিলো । কিন্তু মেয়েটা একটাবারের জন্য ও ছাদে আসলোনা। সায়নের একটু রাগই হয়ে গেলো। সারাদিনে একটা মিনিটের জন্যেও কি ছাদে আসা যায়না??
পরের রাতে। হঠাৎ ই রাতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সায়নের নিজের ওপরেই রাগ হতে থাকলো। সকালে ক্লাস আছে। এখন না ঘুমালে ক্লাসে ঘুমায়ে যাওয়া লাগবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
নাহ!
আধা ঘণ্টা গড়াগড়ি করেও ঘুমের দেখা না পেয়ে সে উঠে পড়ল । ছাদ থেকে ঘুরে আসা যাক!
ছাদে এসে অভ্যাস বশত মেয়েটার ছাদের দিকে চোখ চলে গেল। চাদের আলোতে স্পষ্ট দেখা গেলো রেলিং ধরে কেও একজন দাড়িয়ে আছে। একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সায়ন চমকে উঠলো। ঐ মেয়েটা না তো?

কিন্তু এত রাতে ছাদে কি করছে মেয়েটা?
হয়তো তার মতই ঘুম আসছেনা তাই দাড়িয়ে আছে।
মেয়েটা একা একাই বিড়বিড় করছে। না না_ আপন মনে গান করছে। একটু নাচের মত ভঙ্গিও করলো । হ্যা _ মেয়েটা নাচছে ।দুলে দুলে কি সুন্দর করেই না নাচছে ।
সায়ন মুগ্ধ হয়ে গেলো ।একেবারেই মনে হচ্ছে চাঁদের আলোয় একটা পরী ঘুরে ঘুরে নাচছে ।
সায়ন নিজের ভাগ্যকে একবার সাবাশি দিয়ে দিলো। ভাগ্যিস সময় মতো ঘুম ভেঙ্গে ছিলো। না হলে এত সুন্দর দৃশ্য সে কোথায় দেখতে পেত??
মেয়েটা নাচতে নাচতে হঠাৎ থমকে দাড়ালো। তাকে দেখতে পেয়েছে নাকি?
সায়ন চট করে একদিকে সরে গেলো । চিলেকোঠার দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে আড়ালে থেকে দেখার চেষ্টা করলো । মেয়েটা এদিকেই তাকিয়ে আছে। উকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কেও তাকে দেখলো নাকি। অনেক্ষন দেখার চেষ্টা করেও কিছুই দেখতে পেলনা সে।তবুও নিশ্চিত হতে পারলোনা। তাড়াতাড়ি গেট দিয়ে চলে গেলো।
সায়ন হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে। ইশ অত কাছে না গেলেই হতো।
রুমে ফিরে আর ঘুম আসতে চাইলোনা। ঘুরেফিরে মেয়েটার কথা মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাহলে রাতেই ছাদে আসে!
প্রথমদিন ও তো তাকে এমনি সময়েই ছাদে দেখতে পাওয়া গেছিলো।
মেয়েটার সাথে এই পর্যন্ত তার ৩ বার দেখা হয়েছে। তিন বারই অসাধারন সময় ছিলো!
আচ্ছা এমন কেন হয়?
মেয়েটার সাথে দেখা হলেই কি সময় গুল অসাধারন হয়ে যায়? নাকি মেয়েটা ইচ্ছে করেই অসাধারন সময় গুলোতে দেখা দেয়... কোনটা??
মেয়েটার সাথে দেখা হলে অদ্ভুত এক অনুভুতি হয়। সে কি মেয়েটার প্রেমে পড়েছে?
হুম... প্রেমে তো পড়েছেই । গভীর প্রেমে পড়েছে ।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, Love at first sight… আর মেয়েটাকে দেখলে তার যা হয় তাকে বলে , Love at every sight..!
যতবার তাকে দেখে ততবারই যেন নতুনভাবে প্রেমে পড়ে যায়...
কিন্তু মেয়েটার দিক থেকে ব্যাপার টা কি,সেটাও তো জানা দরকার। একহাতে যেমন তালি বাজেনা তেমনি এক দিকের ভালোবাসায় প্রেম ও হয়না!
কিন্তু তার ব্যাপারটাতো মেয়েটাকে জানাতে খুব ইচ্ছে করছে। হাত ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
“মায়াবতি তোমার মায়াতে আমি আটকে গেছি... ইচ্ছে করলেই আর সরে আসতে পারবোনা । এখন কি করা উচিৎ তুমিই বলে দাও...”
কিন্তু এইটুক বলার জন্যেও তো একটা কিছু দরকার। ফোন নাম্বার বা ফেসবুক আইডি । সেটুকুও পাই কোথায়?
করি তো কি করি???
কিছুদিনের মধ্যেই সুযোগ এসে গেলো। অনেক কষ্ট করে ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ঘুরে ঘুরে সে মেয়েটার ফোন নাম্বার জোগাড় করলো । এভাবে একটা মেয়ের নাম্বার যোগার করতে খুবই খারাপ লাগছিলো । নিজেকে একদম ছোটলোক লাগছিলো । কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে সব ছোটলোকি Granted… এই বলে সে নিজেকে সান্তনা দিলো।
কিন্তু কি লাভ হলো??
এত কষ্ট করে নাম্বার জোগাড় করার পরেও সে মেয়েটাকে কোনোদিন ফোন করতে পারেনি। এমনকি একটা এস এম এস ও দিতে পারেনি। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। তাই দিনের পর দিন নাম্বার টা বের করে চোখের সামনে হাস্যকর ভাবে ধরে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি!
সে রাতের ঘটনার পর থেকে প্রত্যেকটা রাতে সে ছাদেই বসে কাটায়। একটা মিনিটের জন্যেও কোথাও যায়না । যদি মেয়েটা আসে- আর সে দেখতে না পায়???
সারা রাত না ঘুমিয়ে এত অপেক্ষা করেও কোনও লাভ হয়না। মেয়েটা আর আসেইনা ছাদে। তবু সায়ন অপেক্ষা করে... প্রতিদিন...প্রতিরাত...
অপেক্ষার এই সময় গুলো কেমন ভাবে যেন ভেতরের ভালোবাসাটুকু অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক...
মেয়েটার জন্য এতটা ভালবাসা নিয়ে সে অপেক্ষা করে এটা কিনা মেয়েটা জানতেও পারেনা!
সায়ন ঠিক করে রেখেছে মেয়েটার সাথে যেদিন ৫ম বারের মত তার দেখা হবে সেদিন তাকে বলবেই ব্যাপারটা । বলবেই... যা হবার হউক !
এত special ব্যাপারের জন্য ৫ সংখ্যাটাই কেন বেছে নিল তা সায়ন মাঝে মাঝেই ভাবে... কিন্তু কেন যেন ৫ সংখ্যাটাকে ম্যাজিকাল মনে হয়।
হুমায়ুন আহমেদের কথা মনে হয়... “ প্রকৃতি সব প্রিয় মানুষকেই কমপক্ষে ৫ বার মুখোমুখি করিয়ে দেয়”
এইটাও দেখার ব্যাপার!
সে ও যদি মেয়েটার প্রিয় মানুষ দের মাঝে একজন হয় তবে অবশ্যই তার সাথে ৫ বার দেখা হবেই... হবেইই...
(৭)
রিদির মনটা খুব খুব খারাপ লাগছে। কত রাত ছাদে যাওয়া হয়না! জোছনা দেখা হয়না!
সে রাতে খুব সুন্দর জোছনা হয়েছিলো। এরকম জোছনা দেখলেই কেমন যেন হয় । মুখে আপনাতেই গান চলে আসে। সে রাতেও গান গাইতে গাইতে হঠাৎ ই নাচতে ইচ্ছে হয়েছিলো । এত রাতে তাকে দেখার কেও নেই ভেবেই নাচতে শুরু করে একটু পরেই কেন যেন মনে হলো কেও তাকে দেখছে। স্পষ্ট মনে হলো। হঠাৎ ই সামনে ছাদে একজন কে দেখা গেল এদিকেই তাকিয়ে আছে। শুধু এক ঝলক রিদি তাকে দেখতে পেয়েছিলো । তারপরেই মানুষটা যেন হাওয়াতে মিশে গেলো!
তারপর অনেক চেষ্টা করেও রিদি আর তাকে দেখতে পেলনা।
কেন যেন সে রাতে খুব ভয় লাগছিলো । তখনি সে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলো । তবু ভয় টা কেন যেন থেকেই গেছে। অনেকদিন হলো আর ছাদে যাওয়া হয়না।
বিকেল বেলা বসে এগুলো ভাবতে ভাবতেই মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। বাইরে হাটার জন্য বাড়ি থেকে বের হলো সে।
সায়ন বাইরে বের হচ্ছিলো । রাস্তাতে নেমেই মেয়েটাকে দেখা গেলো। সায়ন আর কোনদিক চিন্তা না করে মেয়েটার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু হাটতে থাকলো । মেয়েটা দানে গেলে সে ও ডানে যায় , বামে গেলে সে ও বামে...
এমন সময় মেয়েটা কোনো পূর্বাভাষ না দিয়ে হঠাৎ করেই পিছে ঘুরলো । কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে।
নাহ! মেয়েটার চোখে আর যাই হোক কাঠিন্যটা মানায়না একদমই । তবে সুন্দর মেয়ের সবই দেখতে ভাল লাগে। এই যে এখন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে এই ভঙ্গিটাও দেখতে ভাল লাগছে। সায়নের চিন্তা ভাবনায় বাধা পড়লো। মেয়েটা কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
ঃ আপনার কাহিনীটা কী?
সায়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো । নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ,
ঃ আমার তো অনেক কাহিনী আছে। কোনটা শুনতে চান ? আপাতত আমার প্রেম কাহিনী চলছে। ঐটা বলবো ?
মেয়েটা খুব রেগে গেছে। নিচের ঠোট কামড়ে ধরে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে। এই কাজটা করলে তাকে কত সুন্দর লাগে সে বোধহয় জানেনা।
ঃ আমি অনেক্ষন ধরে খেয়াল করছি আপনি আমাকে ফলো করছেন। এইটার পিছনে কাহিনী কি?
ঃ আমি!!! আপনাকে ফলো করছি!!!
সায়ন যেন আকাশ থেকে পড়লো !
“আমি আপনাকে ফলো করতে যাবো কোন দুঃখে ?? আমি তো দেখছি আপনিই তখন থেকে ইচ্ছা করে আমার সামনে সামনে হাঁটছেন । আমি যখনই ভাবছি ডানে যাব তখনই আপনি পট করে ডানে যাচ্ছেন , বামে যাব ভাবার সাথে সাথেই বামে টার্ন নিচ্ছেন !”
মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেছে। এভাবে কথা শুনবে এইটা সে আশা করেনি। এখন হয়তো ভাবছে, কেন অযথা গায়ে পড়ে উটকো একটা ছেলের সাথে কথা বলতে গেলাম...
মেয়েটার রাগ দেখতে সায়নের বেশ মজা লাগছে। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় সায়ন বললো,
ঃ এইসব কাজ বাদ দেন আপু। অযথা ছেলেদের ফলো করবেন না।
মেয়েটা ভয়ংকর রেগে গেছে। বারকয়েক কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারলোনা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ের মত চলে গেল!
আশ্চর্য তো!
এত অল্পেই কি ভিশন রাগ করতে পারে মেয়েটা !
সায়ন একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ।এতোটা রাগিয়ে দেওয়া ঠিক হলোনা। কিন্তু তার রাগি মুখটা একবার দেখতেও তো খুব ইচ্ছে করছিলো ।
আহারে! এই রাগি মুখটার দিকে তাকিয়েই তো একটা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় ...
“আর একবার মায়াবতি... শুধু একবার দেখা হোক ...তোমাকে আমার সবটা ভালোবাসা দিয়ে দেব...”
নিজের মনেই কথা গুলো বলে ফেললো সায়ন।
(৮)
রাত ৩টা বেজে ২০ মিনিট । রিদি ছটফট করছে। আহারে কতরাত আকাশ দেখা হয়না! তারা গোনা হয়না!
সে এত সাহসি মেয়ে হয়ে কিনা অন্য একজনের জন্য ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিবে???
উহু! হতেই পারেনা। যার ইচ্ছে থাকুক বসে! আজ সে তারা দেখবেই দেখবে...
পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে ছাদে আসতেই মনটা ভরে গেলো !
বুক ভরে নিশ্বাস নিলো রিদি।
আহারে! কি সুন্দর! কি ভয়ংকর সুন্দর!!!
সায়ন অনেকক্ষণ থেকে পড়াতে মন বসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার মন টা ছাদের দিকে চলে যাচ্ছে । যদি মেয়েটা আজ ছাদে আসে??
মেয়েটার জন্য রোজ রোজ অপেক্ষা করতে করতে রাতে আর ঘুমই আসেনা তার। সময়টা কাজে লাগিয়ে তাই সে পড়াশোনা করে। একটু পর পর ছাদে যায় ।
আজ কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা আসবেই। মেয়েটা আকাশ দেখতে খুব ভালবাসে। আজ এত এত তারা ফুটেছে!
মেয়েটা না দেখে থাকতেই পারবেনা।
ছাদে আসতেই সায়ন খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠলো । সত্যি সত্যি ছাদে একজন হাটছে!
মোবাইলটা হাতে নিয়ে সায়ন খুব দ্রুত মেয়েটার নাম্বারে একটা ম্যাসেজ পাঠালো ।
মেসেজ টোন বাজতেই রিদি অবাক হয়ে গেলো ।
আজিব! এত রাতে কে মেসেজ দিবে তাকে?
ওপেন করতেই দেখা গেল একটা আননোন নাম্বার থেকে এসেছে। একটা গানের কিছু লাইন লেখা...
“ভালোবাসি ...
এটুকু শুধু বলার...
ভালোবাসি...
তুমি শুনে নাও না...
ভালোবাসি...
ফিরিয়ে দিওনা...
ভালবাসি... ”
গানটা রিদির খুব প্রিয়। তাই বলে এত রাতে কে এরকম মেসেজ পাঠাতে পারে তা সে ভেবে পেলোনা। নাম্বারটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে সে যখন ভাবছে যে এটা কে হতে পারে ঠিক তখনই নাম্বার টা থেকে আরেকটা মেসেজ আসলো ।
“মায়াবতি...
হাসলে তোমাকে যতটা সুন্দর লাগে রাগলে তার থেকেও
আরও অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগে। এই যে এখন অবাক
হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছো ,ভাবছো এই উটকো
ছেলেটা আবার কে??
ভুল করে মেসেজ দেয়নিতো??
এই ভঙ্গিটাও অসাধারন...
কিন্তু এটা কিন্তু কোন উটকো ছেলে দেয়নি। যে দিয়েছে, সে
গত ৬ মাস ধরে তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে । গত ২টা মাস
সে একটা মুহূর্তের জন্যেও রাতে ঘুমায়নি,তোমাকে এক নজর
দেখার জন্য...
তোমরা মেয়েরা নাকি ছেলেদের ভালোবাসা খুব সহজেই বুঝে
যাও?
তাহলে এই ছেলেটা যে তোমার জন্য এতোটা ভালবাসা নিয়ে
অপেক্ষা করে সেটা তুমি কোনোদিন কেন বোঝনা ??
আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষ কে
খুব স্পেশাল ভাবে আমার ভালোবাসার কথা জানাবো। কিন্তু
ভালোবাসা মানেই তো অনেক স্পেশাল,তা সে যেভাবেই
জানানো হোক... তাই না??
আমি জানি তুমি কি ভাবছো ... কিন্তু
উহু... আমার নাম্বার ভুল হয়নি। আমি তোমাকেই ভালোবাসি ...
ভয়ঙ্কর ভালোবাসি ... ”
মেসেজ টা পরে রিদি হতবাক হয়ে গেলো। ২ মাস রাতে ঘুমায়নি ... তাকে একবার দেখার জন্য !
মানে টা কি?? সে যে রাতে ছাদে আসে এটা সে জানে!! আর আশেপাশে থেকেই তাকে দেখে??
হুট করেই সে রাতের কথা মনে পড়ে গেলো! তার মানে সত্যিই সেরাতে কেও একজন তাকে লুকিয়ে দেখছিলো! কি ভয়ংকর !!
রিদি ব্যাস্ত হয়ে আশে পাশে দেখতে লাগলো । কিন্তু কাওকেই দেখা গেলনা।
রিদি আর এক মুহূর্তও দাড়ালোনা। চলে গেলো ।
সায়ন দেওয়ালের পাশে আড়ালে দাড়িয়ে আছে। মনে খুব শান্তি শান্তি লাগছে।কাওকে মনের কথা বলার পর যে এতোটা ভাল লাগে তা সায়নের জানা ছিলোনা ।

সাবস্ক্রাইব করুন:
(৯)
৩ মাস পর...
বিকাল ৪ টা বেজে ১৭ মিনিট। রিদি ফোনটা হাতে নিয়ে ছটফট করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১ টা মেসেজ আসবে...
সে রাতে আননোন নাম্বারটা থেকে মেসেজ আসার পরপরই সে নিচে নেমে এসেছিলো। আর ওভাবে ছাদে যাওয়া হয়না।
কিন্তু সেই থেকে প্রতিদিন বিকাল ৪ টা ১৯ মিনিটে নাম্বারটা থেকে একটা করে মেসেজ আসে। ৪ টা ১৯ মানে ৪ টা ১৯ ই... কখনই ৪ টা ১৮ বা ২০ না।
মেসেজ গুলো থাকে খুব অদ্ভুত। কখনই কোন প্রেমে গদগদ হওয়া রোমান্টিক মেসেজ না। তবুও মেসেজ গুলো পড়তে কি ভয়ংকর ভালো লাগে! একেকটা মেসেজ যে কতবার করে রিদি পড়েছে হিসাব নাই।
প্রতিদিন ৪ টা বাজার সাথে সাথেই বুকের ভিতর কেমন অদ্ভুত একটা অশান্তি হয়। বারবার মনে হয় যদি আজকে মেসেজ না আসে!!
আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক কাটায় কাটায় ওই সময়েই মেসেজ চলে আসে । একটা মিনিট ও লেট হয়না। তবু কি অধির ভাবে সে মেসেজ এর অপেক্ষা করে তা শুধু সে-ই জানে...
“মায়াবতি...
আমার জন্য ছাদে আসা বন্ধ করে দিয়েছো তাই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।
কি শাস্তি জানো ?
রোজ তোমার হয়ে তারা গুনছি । হিসাব করে রেখেছি। তবু বারবার ওলট পালট হয়ে যায় জানো? ”
“মায়াবতি...
জানো আজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। দেখেছি যে আমি তোমার কানে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছি। আজব স্বপ্ন না??
আচ্ছা তুমি কি কখনো কানে মেহেদি লাগিয়েছো?? ”
পাগল ছেলে একটা!
কানে কি কেও মেহেদি লাগায়? অর্থহীন মেসেজ... তবুও রিদির খুব খুব ভালো লাগলো । একটা মেহেদির টিউব কিনে নিজে নিজে কানে মেহেদি লাগানোর চেষ্টাও করে দেখলো।
বাবা মা খুব হাসাহাসি করলো । এটা দেখে রিদির খুব রাগ হয়ে গেলো। হাসাহাসি কেন করবে???
মায়াবতি...
কি অদ্ভুত সুন্দর নামে ছেলেটা তাকে ডাকে...
আগে হলে কেও এই নামে ডাকলে হয়তোবা খুব বিরক্ত লাগতো , রাগ হতো ।
এখন একদমই তা লাগেনা। বরং অদ্ভুত ভালো লাগে! মনে হয় নামটা তো শুধুই তার জন্য !
সে ও ছেলেটাকে একটা নামে ডাকে । টুনটুন বলে ডাকে । খুবই গোপনে। আর কেও জানেনা... নামটা বলে ডাকতে কেমন যেন লাগে। নিজে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় !
আচ্ছা এমনটা কেন হচ্ছে??
ছেলেটার জন্য এমন লাগছে কেন? প্রতিদিন অস্থির হয়ে তার মেসেজের অপেক্ষা করা, অদ্ভুত নামে তাকে সম্বোধন করতে ভালো লাগা, তার একটা মেসেজ হাজার বার পড়া , তার কথা ভাবতে ভাবতে রাত জাগা... এগুলো কি খুবই স্বাভাবিক ??
মনের কোন এক যায়গাতে ছেলেটার জন্য অনেকখানি ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে ।
ছেলেটাকে না দেখে,না শুনে, না চিনে , না জেনে... এই ভালোবাসা কে বাড়তে দেওয়া কি উচিৎ হচ্ছে??
কেন যেন উচিত অনুচিত নিয়ে ভাবতে আর ভালো লাগেনা। না চিনে না জেনেও জাকে এতোটা আপন মনে হয় তাকে চেনার পর আরো বেশি আপন লাগাটাই তো স্বাভাবিক !
ছেলেটার জন্য আজকাল অদ্ভুত সব অনুভুতি কাজ করে। ছেলেটা তার এই ব্যাপারগুলো জানেনা। তার এস এম এস এর জন্য অধির হয়ে অপেক্ষা করলেও রিদি কখনই তার মেসেজের উত্তর দেয়না। ছেলেটার ভালোবাসার একটা পরিক্ষা ও নেওয়া হয়। কিন্তু ছেলেটা তাকে সত্যিই ভালোবাসে । তাই তো এতদিনেও তার অনুভুতির কোনও পরিবর্তন হয়নি
যার সাথে কথা বলবো তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবো , ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কেন কথা বলতে হবে??
রিদির এইটা সব সময় মনে হয়। সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, যেদিন ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা হবে সেদিন ই তাকে বলে দেবে,
“আমি শুধু তোমার মায়াবতি হয়ে থাকতে চাই...আর কিচ্ছু চাইনা...কিচ্ছুনা...”
(১০)
অনেক্ষন ধরে সায়ন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহ! আজ ও মায়াবতি রিপ্লাই করলোনা!
খুব হতাশ লাগছে! কাল তাকে এই যায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে। হলে সিট পাওয়া গেছে। একসময় এই নিউজ টা শোনার জন্য সে কত অপেক্ষা করেছে। আর আজ যখন তা পাওয়া গেল তখন আর যেতে ইচ্ছে করছেনা। এই যায়গা ছেরে যাওয়া মানেই তো মায়াবতি কে একবার দেখার সুযোগ হারানো !
তা কি সে করতে পারবে??
কিন্তু কি লাভ? সে যেখানেই যাকনা কেন মায়াবতি তার মনের মাঝেই থাকবে সবসময়। কিন্তু মেয়েটার ক্ষেত্রে ব্যাপার আলাদা। সে হয়তো কখনই তাকে কাছের মানুষ ভাবেনা
মন টা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
এতদিন ধারনা ছিলো যে কোনজিনিস মন থেকে চাইলে তা অবশ্যই পাওয়া যায় ।
এখন এইসব কথা ভাওতাবাজি মনে হয় !
মায়াবতি তাকে এখন চেনেনা,দেখেনি তাই কি এমন অবহেলা করছে??
কিন্তু তাকে তো সে তার সবকথা ই জানায়,সব কিছুই বলে। একটা মানুষ কে চেনার জন্য আর কি দরকার??
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়ন গোছগাছ শুরু করলো । খুব বেশি জিনিস না। ১০ মিনিটেই হয়ে গেলো । গিটার হাতে সায়ন ছাদে চলে আসলো ।
মায়াবতি কে উদ্দেশ্য করে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি লাভ??
যার জন্য গান সেই ই হয়তো শুনবেনা।
১ টা মেসেজ দিয়ে
ডাকলে কি আসবে?? দেখাই যাক ! দ্রুত মেসেজ টাইপ করলো সায়ন
“ একটাবার ছাদে আসবে? প্লিজ প্লিজ...”
৫ মিনিট গেলো -১০ মিনিট গেল... নাহ কোন রেস্পন্স নাই। ধ্যাত! মনটাই খারাপ হয়ে গেলো । না আসুক।।গান গাইতে দোষ কি??
সায়ন গিটার হাতে গান শুরু করলো ...
“তোমার চির চেনা পথের ওই সীমা ছাড়িয়ে
এই প্রেম বুকে ধরে আমি হয়তো যাব হারিয়ে
চোখের গভিরে তবু মিছে ইচ্ছে জড়িয়ে
একবার শুধু একটিবার হাত টা দাও বাড়িয়ে ...
ডাকবেনা তুমি আমায় জানি কোনোদিন...
তবু প্রার্থনা তোমার জন্য ... হবেনা মলিন
হবেনা মলিন...
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়...
বুঝিনি কভু সেই মায়া তো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মনিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে... ভালবাসবো তোমায়...
ভালবাসবো তোমায় ...
ভালবাসবো তোমায়... ”
চোখ কখন যে বন্ধ হয়ে গেছে সায়ন খেয়াল করেনি। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো ।মায়াবতি দাড়িয়ে আছে... শাড়ি পড়ে সুন্দর করে সেজে এসেছে। খুব সুন্দর লাগছে তাকে... চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা !
সামান্য একটা শাড়ি মেয়েদের রুপ এতোটা বাড়িয়ে দিতে পারে জানা ছিলোনা!
রিদি তন্ময় হয়ে গান শুনছিলো । আহারে! কি সুন্দর করেই না গাইছে!
এতোটা আবেগ শুধুই তার জন্য??
বিশ্বাস হতে চাইনা...
আজ হঠাৎ করেই সে নিয়ম ভঙ্গ করে ১ টার জায়গাতে ২ টা মেসেজ দিয়েছে ।তখনি ছুটে ছাদে আসতে ইচ্ছে করছিলো ।
কিন্তু আজ প্রথম বারের মত ভালোবাসার মানুষ টাকে দেখবে... তাই একটু সময় নিয়ে শাড়ি পরে এসেছে সে
অনেকখানি দেরি হয়ে গেছিলো ।ভয় হচ্ছিলো যদি ছেলেটা চলে যায়?
এসে দেখে ছেলেটা যায়নি । গান করছে...খুব সুন্দর ভাবে
কি আশ্চর্য !
এই সেই ছেলে??
এই ছেলেটাই তো সেদিন রাস্তাতে ঝগড়া করেছিলো ।
এই ছেলেটাকেই তো সেদিন অসাধারন ভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছিলো।।
এই ছেলেটাই কি তার টুনটুন ??
মা- কে ভরকে দেওয়ার জন্য সেবার এর সাথেই তো প্রেম করতে ইচ্ছে হয়েছিলো ।আল্লাহ সেদিন তার কথা এইভাবে শুনে ফেলেছে??
আজ সত্যি সত্যি সে এই ছেলেটাকেই ভালোবেসে ফেলেছে!
কি আশ্চর্য!
কি অদ্ভুত!
রিদি শব্দ করে হেসে ফেললো ।প্রথম যেদিন টুনটুন কে দেখেছিলো সেদিন তার চোখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে হয়েছিল! কখনই ভাবেনি এই মুখটার দিকেই সে সারাজীবন মুগ্ধ হয়ে তাকাতে চাইবে!
ছেলেটার গান শেষ হয়েছে । চোখ খুলে সে হতবাক হয়ে গেছিলো । এখন মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে আছে।
রিদি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। তারপর ছোট্ট একটা এস এম এস লিখলো ...
“ভালোবাসি ... এটুকু শুধু বলার ”

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- ZAFRIN AKTER TITHI
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url