গল্পঃ মনের আড়ালে

আজ আমার বিয়ে।চারপাশটা গমগম করছে।ছোটভাই বোনেরা তাদের সাজগোজে ব্যাস্ত ,বাবা অসুস্থ তাই চাচারাই সবদিকে সামলাচ্ছেন।মা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।সবাই খুব ব্যস্ত।একা আমারই কোন কাজ নেই।নিজের ঘরে একা বসে আছি।ঘরটির কোনায় কোনায় মিশে আছে আমাদের ভাইবোনদের নানান স্মৃতি।বিভিন্ন কারনে ভাই আর আমি ক্ষেপাতাম আমার ছোট বোনটিকে।আর ও তখন গাল ফুলিয়ে থাকত।আরো বেশি করে বলতাম "তোকে আমরা একটা কালো বয়স্ক মোটা বর দেখে বিয়ে দিয়ে দিব।" আমাদের কথা শুনে আমাদের বোনটা কৈ মাছের মত লাফাতো।আর আমরা অট্টহাসিতে চারপাশ জমিয়ে দিতাম।মা ও ঘর থেকে বলতো "হাসো আরো বেশি করে হাসো তোমরা।এই একটা কাজই তো খুব ভাল করে পারো তোমরা তিন ভাই বোনে।"

আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কাছের মানুষগুলো এত সহজে কিভাবে পর করে দেয়?
কিন্তু আমি কিছুতেই কাঁদবো না। কেউ যদি আমার চিন্তা না করে তাহলে আমি কেন আমার পরিবার আর সেই মানুষটার জন্য চিন্তা করে কষ্ট পাচ্ছি?
হ্যাঁ ,আমি আবীরের কথাও ভাববো না।এটাই হবে ওর আমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি।জানি তাতেও আবীর কষ্ট পাবে না। কারন আমরা নামে মাত্র গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ছিলাম।বাস্তবের সাথে নামের কোন মিলই ছিল না।

আমাদের কলেজের একটা অনুষ্ঠানে আমি গান. গেয়েছিলেম আর আবীর গিটার বাজিয়েছিল। অনুষ্ঠানের আগে গান প্র্যাকটিস করতে হতো প্রতিদিন।আর তখনই ওর সাথে আমার প্রথম দেখা।জানতে পারলাম ও আমার থেকে তিন বছরের সিনিয়র্।কয়েকদিনেই ওর সাথে আমার ভাল একটা সম্পর্ক হয়ে গেল।শুরু হলো ফোনে কথা বলা ,তারপর ওর অনুরোধে কলেজের যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে যাওয়া ,দু জন মিলে একসাথে ফুচকা খাওয়া ,বিভিন্ন মেলায় একসাথে ঘুরতে যাওয়া .. এবং অবশেষে আমি "ভালবাসি নিরা" কথাটা বলে ফেলা।

পরে জানাবো বলে ,আমিও কিছুদিন পর সম্মতি জানালাম। এভাবেই শুরু হলো আমাদের ভালোবাসার গল্প...

কিন্তু কয়েকদিন যেতেই ওর সাথে আমার একদম মিলতো না।নানা কারনে ঝগড়া করতাম আমরা।দোষ ওর থাকলেও কখনো আমায় সরি বলেনি।প্রয়োজনে চার পাঁচ দিন কথা না বলে থেকেছে।আমিই ফোন দিতাম সবসময়.. পরে রাগ ভাঙ্গতো ওনার্।

সারাদিন আমার সাথে ভাল করে কথা বলার সময় হতো না আবীরের্।তাই আশায় থাকতাম রাতে অনেকক্ষন কথা বলবো কিন্তু মাঝে মাঝে আবীর কথা বলার মাঝ খানেই চুপ হয়ে যেত।বুঝতে পারতাম ঘুমিয়ে পরেছে।খুব রাগ হতো।কিন্তু কিছুই করার থাকতো না।আমার জন্মদিনের দিন আশা করেছিলাম সর্বপ্রথম ও ই আমায় উইশ করবে।কিন্তু না ,আমার বোনটা করেছিল সাথে একটা উপহার নিয়ে।তখন বোনের উপর অনেক রাগ উঠেছিল কেন ও আমায় আবীরের আগে আমায় উইশ করবে..অথচ সে রাতে আবীর আমাকে ফোন অথবা মেসেজ কিছুই পাঠায়নি।পরের দিন জানায় "sorry! কাল রাতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই তোমায় উইশ করতে পারি নি।শুভ জন্মদিন নিরা"
আসলে তখন আর কিছুই বলার থাকে না।ওর জীবনে আমার জন্য কোন জায়গাই নেই।এ কথাটা আরো শিওর হলাম শেষ দেখা করার পর্।

আমি বড় মেয়ে তার উপর বাবা অসুস্থ..বাসা থেকে প্রচন্ড চাপ বিয়ের জন্য। কিন্তু আবীরকে সেদিন বিয়ের কথা বলাতে ও আমায় বলে "আরে বোকা এত টেনশন কর কেন তুমি? কিছু হবে না বাদ দাও এইসব কথা ,সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।"

সেদিন থেকেই বুঝতে পারলাম আমার জন্য ওর কোন চিন্তাই নেই।কিন্তু ও আমার অনেক কেয়ার নিত।তাই মাঝে মাঝে একটা দোটানায় পরে যেতাম আমি।

শেষ দেখা হয় আজ থেকে দুমাস আগে এর পর আবীরের সাথে আমার কোন কথাও হয় নি দেখাও হয় নি।

জানিনা আমার বিয়ের খবর টা ও জানে কিনা,অনেক বার ফোন দিয়েছিলাম ওকে কিন্তু মোবাইল সুইচ অফ ছিল ওর্।

খুব কষ্ট হচ্ছে।যাকে জীবন সাথী করার স্বপ্ন দেখতাম বারেবার্।আজ সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার দিন।কষ্ট হোক তবুও পরিবারের জন্য যে এইটুকু না করলেই নয় ....
-এই আপু নিচে চল বরযাত্রী এসে পরেছেতো
-হুম
-কাঁদছিস কেন তুই?দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে
-হুম
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল
-হ্যালো নিরা! এত আলো কেন তোমাদের বাসার সামনে?
-এত দিন কোথায় ছিলে তুমি?তুমি কি জানো আজ আমার বিয়ে
-তুমি রাজি?
-আমি কি করবো?তুমি তো আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা ই করনি।তাছাড়া বাবা যে অসুস্থ
-আচ্ছা বাবা আর কাঁদতে হবে না।তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়ে আস।বাকীটা আমি ম্যানেজ করছি।
-সেটা আর সম্ভব নয় আবীর ..ভালোই যেহেতু বাসতে তাহলে এত অবহেলা করেছ কেন আমায়?
-আচ্ছা সব বাদ।একবার জানালার পাশে আস প্লিজ শেষ দেখাটা দেখতে দাও একবার
-আবীর!!!!!!!!!!
-প্লিজ নিরা একবার
-আবীর তুমি এই পোশাকে কেন?
-হাহাহা
-তুমি হাসছো কেন?কি হয়েছে আগে বল তো
-কি আর বলবো তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আস তোমার জন্য যে সবাই অপেক্ষা করে আছে। তুমি আমায় যতটা খারাপ ভাবো আমি কিন্তু ততটা খারাপ নই।ভালবাসি এই কথাটা দিনে ১০০বার বললেই কি ভালবাসা হয়ে যায়?কথা না বললে কি ভালবাসা কমে যায়? তুমি কি ভাব আমি তোমায় ভালবাসি না?আমি প্রকাশ করতে পারি না আমার ভালবাসা তাই বলে কি তুমি আমায় অবিশ্বাস্ করবে? তোমায় আমি বলতাম না ,কোন চিন্তা কর না।
-তুমি এত বড় কথাটা আমার কাছ থেকে লুকিয়েছ কেন?

-আমার ইচ্ছাছিল তাই।তাছাড়া তুমি এখন যে সুখটা পেয়েছে বললে কি আর সেই সুখটা পেতে?
-এত দিন যোগাযোগ রাখনি কেন?
-তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ,তোমার সাথে যোগাযোগ রাখি নি কিন্তু তোমার পরিবারের সাথে রেখেছি।এখন কি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনেই কথা বলবো ,না ভিতরে আসবো মহারানী?
-oww sorry তাড়াতাড়ি আস ফোন রাখছি

-এই শোন কান্না করতে করতেতো চোখ ফুলিয়ে ফেলেছ একটু ফ্রেশ হয়ে নিচে আস নয়তো আমাদের বিয়ের ছবি তো সুন্দর আসবে না।
-শয়তান ..তোমায় আজ বুঝাবো
-হুম জেলখানায় যেহেতু বন্দী হচ্ছি শাস্তি তো পেতেই হবে।

-উল্টো পাল্টা কথা বলো নাতো।তাড়াতাড়িয়ে তোমার জায়গায় গিয়ে বস।তাছাড়া বর কে রাস্তায় দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখলে সবাই খারাপ ভাববে।
-আমি আমার হবু বৌয়ের সাথে কথা বলছি কার কি?
-এত দিন এত কষ্ট দিয়েছ কেন আমায়?ভালবাসাটা একটু প্রকাশ করলেই পারতে।কেন রেখে দিয়েছিলে সব ভালবাসা তোমার মনের আড়ালে?
-এই বোকা আমি আছি তো।আর কেঁদো না।আজ যে আমাদের বিয়ে ....

সাবস্ক্রাইব করুন:

by - মেঘলা আকাশ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url