গল্পঃ কষ্টসুখের ভালবাসা

বন্ধুরা মিলে ভার্সিটির মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । খুব মাথা ধরেছিল । একটা ছোট সেভেনাপ কিনে এইমাত্র শেষ করলাম । খালি বোতলটা এখনো হাতে । হঠাত্ একটা পিচ্চি টোকাই এসে বলল,
- ভাইজান বোতুলটা দেন ।
- ক্যানরে? কি করবি?
- কি করমু আর! বেচমু ।
- কালতো পহেলা বৈশাখ । কালকে স্পেশাল কিছু করবি ?
- হেইডা কি ভাইজান?
- আরে পহেলা বৈশাখ বুঝোস না? কালকে নববর্ষ । বাংলা বছরের প্রথম দিন । উত্সব বলা যায় । সবাই পান্তা ইলিশ খাবে, ঘুরাফিরা করবে, মেয়েরা বাঙালি সাজ দিবে । এইতো এটাই উত্সব।
- আমগো আর উত্সব! পান্তা তো প্রতিদিনই খাই । ইলিশ ক্যান, ছুডু মাছগুলাও তো আমগো কপালে জুটে না । আমগো কাছে সবদিনই এক । উত্সব বলে কিছু নাই ।
আমি পিচ্চি টোকাই টার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকি । আর ভাবতে থাকি উত্সব বলে ওদের হয়তো কিছু নেই ।
- ভাইজান বোতুলটা দিবেন ?
- নে ধর ।

দুপুরে ক্লাস শেষে বাসায় ফিরলাম । বাসায় ঢুকেই দেখলাম ভাবী আর তার ছেলের মাঝে ঝগড়া চলছে । আমি বললাম,
- কি হয়েছে ভাবী ?
- আর বলোনা তনয় । কাল পহেলা বৈশাখ । রবিন জেদ ধরেছে কাল ইলিশ পোলাও খাবে । ইলিশের যে দাম পড়সে, তাতে তোমার ভাইয়ার পক্ষে ইলিশ কিনা সম্ভব না ।
ভাইয়া ভাবীদের মধ্যবিত্ত সংসার। সংসারে আছে ভাইয়া ভাবী, রবিন, দুমাস বয়সী ভাতিজি আর আমি । এসএসসি পাশ করার পর ভাইয়া আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে চলে এসছেন । তারপর এখান থেকেই আমার কলেজ লাইফ শুরু। এখন ভার্সিটিতে । একটা টিউশনি করি । নিজের খরচ পুরাপুরি হয়তো এখনও চালাতে পারিনা । তবে কেটে যাচ্ছে আমার । খুব ভালই কাটছে ।

খেয়েদেয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম । এসময় অবন্তির কল আসলো । অবন্তি আমার গার্লফ্রেন্ড । ছয়মাস আগে সে আমার লাইফে প্রবেশ করেছিল । আধুনিক যুগের স্টাইলিশ মেয়ে । মোটেও আমার টাইপের নয় । এই সম্পর্কটা জোর করে । হয়তো মন থেকে নয় । আমি কোনদিনই প্রেম ভালবাসায় জড়াতে চাইনি । সম্পর্কটা হয়েছে সম্পূর্ণ ওর ইচ্ছাই ।
- হ্যালো অবন্তি বলো ।
- শোন তনয়, কাল আমার সাথে আমার বান্ধবীরা থাকবে । তোমাকে পান্তা ইলিশ খাওয়াতে হবে । পারবা না ?
- একদিনের জন্য পান্তা ইলিশের কি দরকার? বাসায় পিয়াজ মরিচ দিয়ে পান্তা খেলেই হয় ।
- চুপ । ফাজলামি করবা না । কাল নয়টার মাঝে আমার সাথে আগে ক্যাম্পাসে দেখা করবা । ওকে? আর তোমার ঐ ময়লা শার্ট পড়ে আসবা না । আজকেই নতুন একটা শার্ট কিনবা । মর্ডান যুগে বাস করছো তুমি । ব্যাকডেটেড হয়ে থাকলে চলবে?
- আচ্ছা দেখি । এখন রাখি ।

সাবস্ক্রাইব করুন:

রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে খাচ্ছি ।
- ভাইয়া আমার কিছু টাকা লাগবে কালকে ।
- কত?
- এইতো হাজার খানেক ।
কথাটা অনেক সংকোচ নিয়ে বলেছিলাম । ভাইয়া বললেন, আচ্ছা কালকে দিব ।

রাত বারটা । কারেন্ট নেই । রবিন চার্জার দিয়ে পড়ছে । গরমের কারণে আমি বারান্দায় গেলাম । আমার আর ভাইয়াদের রুম বারান্দার সাথে লাগোয়া । তাদের রুম থেকে কথপোকথন শুনতে পাচ্ছিলাম ।
- কাল তোমার ছেলে ইলিশ পোলাও খেতে চেয়েছে । অথচ তার শখটা পূরণ করতে পারছি না।
- কি করবো রবিনের মা বলো? ওদের পড়ালিখার পিছনে সব টাকা ঢেলে দিচ্ছি । মধ্যবিত্ত সংসারে মাসের মাঝখানে টানাপোড়েন লেগেই থাকে । মধ্যবিত্তের সব শখ পূরণ হয়না । একদিন ওরাও বাবা হবে । ওরাও সেদিন বুঝবে সংসারে কতটা সংগ্রাম করতে হয়।
- হুম । তনয়কে কাল হাজার টাকা দিতে পারবে?
- না । সাতশো দিতে পারব । তোমার কাছে কিছু হবে না? থাকলে পুরোটাই দিতে পারতাম ।
- হুম হবে ।
আমি সবই শুনলাম । সন্তানদের পিছনে বাবা মা কতটা সংগ্রাম করেন সেটা আজই বুঝলাম ।

আজ পহেলা বৈশাখ । সকালে খেয়েদেয়ে বের হলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্য । যাওয়ার আগে ভাবী আমাকে একহাজার টাকা দিলেন । ভার্সিটিতে ঢুকে ক্যাম্পাসে অবন্তিকে দেখতে পেলাম ।
দেখেতো আমি পুরাই টাশকিত! স্টাইলিশ মেয়ে পড়েছে শাড়ি? যেই মেয়ে স্টাইলিশ ড্রেসাপ করত, সেই মেয়েকে শাড়িতে মানায়? হুম মানায় । খুব ভাল মানিয়েছে অবন্তিকে । কিন্তু শাড়ি পড়া এই মেয়েটিকে আবার শাড়িতে কবে দেখব কে জানে?
- কি ব্যাপার তুমি আবার এই ময়লা শার্ট পড়ে এসেছ?
- ময়লা বলছ কেন? পুরাতন আরকি!
- এভাবে তুমি আমার বান্ধবীদের সামনে যাবা?
- আমার মত আমি চলব । তোমার এত প্রবলেম কি?
- সমাজের একটা স্ট্যাটাস আছে না? চোখে সানগ্লাস নাই, বাইক নাই, স্যান্ডেলটাও মান্ধাত্বা আমলের ! তোমার মত ব্যাকডেটেড ছেলের সাথে প্রেম করাটাই ভুল হয়েছে ।

অনেক ঝগড়াঝাটি হল । অতঃপর ব্রেকাপ । ভালোই হল । টাকাটা বাঁচল । এই টাকা দিয়ে ভাতিজার জন্য ইলিশ কিনে দিব । কিন্তু আজকের দিনে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া । আমি গেলাম ছাত্রের বাসায় । ছাত্র আবার বিশাল বড়লোকের ছেলে । মাত্র সেভেনে পড়ে ।
- আন্টি আমার কিছু টাকা আরজেন্ট দরকার ছিল । এই মাসের টাকাটা এডভান্স দেয়া যাবে?
- তুমি একটু বসো । আমি নিয়ে আসছি ।
এসময় রুম থেকে বেরিয়ে আসলো আমার ছাত্র পিন্টু । পিন্টুকে দেখে আরেক দফা টাশকি খেলাম! চোখে সানগ্লাস, গলায় চেন, হাতকাটা গেন্জি, থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ! বাপরে! মাত্র সেভেনে পড়ে । এখনই এই অবস্থা। বুঝলাম । এটাতো মডার্ন যুগ । মডার্ন যুগে এগুলাই ফ্যাশন!
- হাই ভাইয়া কেমন আছেন?
- এইতো ভাল । কোথাও যাচ্ছ নাকি ?
- হ্যা । আমার বন্ধু পার্টি দিয়েছে । ওখানেই যাচ্ছি ।
- আচ্ছা যাও ।
আমিও আন্টির কাছে টাকাটা নিয়ে বের হলাম ।

ইলিশ মাছ নিয়ে রিকশা করে বাসায় ফিরছি । রাস্তায় শুনতে পাচ্ছি এসো হে বৈশাখ গান । ভালই লাগছে । আবার আবার কিছু কিছু দোকানে শুনতে পেলাম তুমহি হো, বেবি ডল সহ হরেক রকমের হিন্দি গান ! এটাতো মডার্ন যুগ । সো ব্যাপার না ।
ইলিশ নিয়ে ঘরে ঢুকে ভাবীর হাতে মাছ ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
- ভাবী ভাল করে রান্না করো । আমি রবিনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি । (স্কুলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ছিল)
- আরে আরে টাকা পেলে কোথায়?
- উফফ ভাবী, পরে বলব। তুমি রান্না শুরু করো ।

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছি । একসাথে সবাই মিলেমিশে খাওয়ার মজাটাই আলাদা । রবিন বলল,
- আম্মু খাইয়ে দাও ।
- কাটা বেছে দিচ্ছি । তুই নিজে খা ।
- উফফ আম্মু খাইয়ে দাও । অনেকদিন তোমার হাতে খাই না।
- আচ্ছা বাবা দিচ্ছি ।
আমি তাদের খাওয়াদাওয়া দেখছি। ভাবী পরম মমতায় তার সন্তানকে খাইয়ে দিচ্ছেন, আর ভাতিজা আমার খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে ।এসব কষ্টসুখের আনন্দগুলো মধ্যবিত্ত পরিবারেই দেখা যায়, বড়লোকের বিলাসিতার মাঝে নয়।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- Rj Kuber Majhi

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url