গল্পঃ অদ্বিতীয় ভালোবাসা

জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে কারো নিয়মে বাঁধা পরে না; প্রকৃতির লালিত স্বপ্নে বিভোর কোন জানা কিংবা অজানার মাঝে শুরু হয় সুখ আর দুঃখের পারস্পরিক ধারাপাত। অন্ধকারে কখনো নিজের ছায়া দেখা যায় না কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন আলোর মাঝে অনেক সময় নিজের ছায়াও খুঁজে পেতে কষ্ট হয়?
বাস্তব কিংবা কাল্পনিক যাই হোক আলোর মাঝে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে বাজি ধরতে হয় জীবন নামের এই বস্তুটাকে।
আজ হাসানের বিয়ে। হাসান মফস্বলে কাপড়ের ব্যবসা করে, সে তার মা-বাবার একমাত্র ছেলে হলেও ছোট বেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে চাচার কাছে বড় হয়েছে, কোন ভাই কিংবা বোন নাই, আছে চাচাতো দুই ভাই আর এক বোন, সবাই হাসানের খুব আপন।ঢিলে ঢালা জামা, সাইকেলের পিছনের সিটে খাতা,বই গুঁজে ক্রিং ক্রিং করে কলেজে যাওয়া কিংবা আসার সময় হতে এই হাসানের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল পার্শবর্তী গ্রামের স্কুল পড়ুয়া রিনা,

৮ বছরের ভালবাসায় আজ সেই রিনাকে জীবনসঙ্গিনী করতে যাচ্ছে হাসান।
বিয়ের কার্যাদি কিন্তু সম্পন্ন হবে রিনাদেরই বাড়িতে। বর আগমন, বিয়ের কার্যাদি সম্পন্ন, প্রীতিভোজ শেষ করে হাসান এবং তার পরিবার রিনাকে নিয়ে চলে এলেন তাদের নিলয়ে। সুখী-সুন্দর স্বামী সংসার নিয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছিল রিনার,একদিন একটা সুখবর দিলো রিনা হাসানকে যে সে বাবা হতে যাচ্ছে ।খুশিতে আত্মহারা হাসান।দশ মাস দশ দিন পর তাদের কোল আলো করে এলো আইমান। আইমান জন্মের আগেই নামটা ঠিক করে রেখেছিল হাসান। দেখতে দেখতে বড় হতে লাগল আইমান, ওর বয়স যখন তিন বছর, সবে মাত্র কথা বলতেছে, বাবা কিংবা মা মা করে ডাকে তখনই ঘটলো জীবনের সবচেয়ে অঘটন!!
জমি সংক্রান্ত ঘটনায় চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিরোধ সহ্য করতে না পেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে হাসানকে হাসপাতালে নেয়া হয় আর সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক হাসানকে মৃত ঘোষণা করেন, আইমান কিছুই বুঝতে পারছেনা যে তার বাড়িতে এতো মানুষ কেন? কেন সবাই শুধু তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে? কেন তার মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ছোট্ট সেই শিশুটি!! শুধুই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল, আর বিরক্ত হয়ে তার নানীর কোলে মাথা গুঁজে রেখেছিল। তার নানীও কাঁদে, সবাই কাঁদে, সবাইকে সে দেখতেছে কিন্তু শুধু একজনকে ছাড়া আর সেটা হলো তার বাবা। কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়ির সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি এলো, কয়েকজন লোক মিলে একটা স্ট্রেচার করে কাকে যেন নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো, আইমান বুঝতে পারে না কাকে নিয়ে এলো এই লোকগুলা?
সাদা কাপড় মুখ থেকে যখন সরানো হলো তখন দেখলো তার বাবার নিথর দেহ। সে ডাকে বাবা বাবা.... বাবা কিন্তু বাবা তো উঠে না। সে তার নানীকে বলে বাবাকে ডেকে দিতে কিন্তু তার বাবা যে আর তাকে কোলে নিয়ে আদর করবে না, তার জন্য শহর থেকে খাবার আনবে না সেটা তো তার নানী জানে কিন্তু উনি আইমানকে কিভাবে বলবে যে তার বাবা আর নেই এই দুনিয়াতে।
তার বাবাকে নতুন সাদা কাপড় পড়ানো হলো সাথে তার মা কেও লাল শাড়ীর বদলে পরিধান করতে হলো সাদা শাড়ী। তার নানী থাকে একটা পাঞ্জাবী পরাই দিলো যেটা তার বাবা তাকে কিনে দিয়েছিল গত ঈদে । সবাই তার বাবাকে কাঁদে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে সেটাও তার প্রশ্ন কিন্তু কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। বাবা চলেন গেলেন না ফেরার দেশে সেটা ভাল করে বুঝতে না পারলেও বাবার অনুপস্থিতি তাকে জানান দিচ্ছে তার বাবা নেই, না হলে যেখানে সে তার বাবার কোলে থাকার কথা সেখানে সে তার নানীর কোলে তারপর মামার কোলে কেন? বাবাকে শুয়াই দিলো মাটির সেই অন্ধকার ঘরে, তারপর মাটি দিয়ে এদিক ওদিক কি যেন সে খুঁজে বেড়ায়!!
বাড়িতে এলো মামার কোলে করে, দেখে তার মা কাঁদছে সবাই তার মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে!! একে একে কেটে গেলো তার বাবার মৃত্যুর কয়েকমাস,
একদিন আইমানের নানী আইমান আর তার মা'কে নিয়ে গেলো তাদের বাড়িতে। আইমান আস্তে আস্তে ৫ বছর পূর্ণ হলো, থাকে নানার বাড়িতেই ।
একদিন সে দেখলো তার দাদা বাড়ির অনেক মেহমান তার নানার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে হাতে অনেক গুলা মিষ্টি আরো অনেক কিছু। এমনকি ওখানে তার বাবার চাচার ছোট ছেলেও ছিল। যাই হোক আইমানকে সবাই আদরও করল, এগুলো দেখে সে তার নানীকে বলল নানী এতো মেহমান কেন আসল? নানী বলল তোরে আর তো মা'কে দেখতে আসছে। কিছুক্ষণ পর দেখল তার মা একটা লাল টুকটুকে শাড়ী পরে মেহমানদের নাস্তা দিচ্ছে,
ছোট্ট পাঁচ বছরের আইমান কি এতো কিছু বুঝে আর যে তার মা আবার নতুন সংসারে পদার্পণ করতে যাচ্ছে!! মা এবং তার সেই চাচাকে দেখতে পেল পাশাপাশি বসা আর ছিল অন্যান্য আত্মীয়রা কিন্তু বিমর্ষ ছেলে তার মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। ডাকও দিয়েছিল মা বলে কিন্তু তার মা শুনতে পান নি, পরে অবশ্য হাতের ঈশারায় ছেলেকে ডাকলেও যেতে মন চায় নি পাশে বসা ওই চাচাকে দেখে কিংবা কোন অস্পষ্ট মুহুর্তের সাক্ষী বলে, দরজা ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন তার মা তাকে কোলে করে আনতে গেল না সেটা নিয়েও ক্ষোভ ছিল তার। যাই হোক নির্মম বেদনা তখনই মনে আঘাত করেছিল যখন তার মা তার সেই দাদা বাড়ির লোকদের সাথে চলে যাচ্ছিল তাকে না জানিয়ে কারণ তার নানী তাকে দেখা করতে দেয় নি সে কাঁদবে বলে। সে জানালা দিয়ে দেখে তার মা চলে যাচ্ছে তাকে না নিয়ে তবুও সে কিছু করতে পারে না শুধু কান্না ছাড়া কারণ তার নানী তাকে ঘরে আটকে রেখেছিল। পরে সে জানতে পারে তার মায়ের আবার বিয়ে হয়েছে সেই চাচা টার সাথে। রাগে, ক্ষোভে তখন তার বাবার কথা মনে করে করে কাঁদে আর বলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন বাবা, আমাকেও নিয়ে নাও তোমার কাছে..... পরে আবার তার মা তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও পারেনি তার সৎ বাবার জন্য কারণ আইমান ছিল হাসানের ছেলে। এরই মধ্যে আইমানের নানীও মারা যায় আর নানা তো মারা গেছে আইমানের জন্মের আগে। বাবা চলে গেছে অনেক আগে আর মা তো থেকেও নেই, নানীও নাই, তাই সেই কষ্টে একদিন আইমান কাউকে না জানিয়ে নানার বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যায় শহরে। আশ্রয় মিলল এক নিঃসন্তান দম্পতি মারুফ-শাহানার সংসারে!! মাস যায়, যায় বছর.....স্কুল, কলেজ শেষ করে সেই আইমান ভর্তি হয় শহরের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

ডাক্তারী টাও পাশ করল, বিসিএসও সম্পন্ন হলো। তাহলে এবার মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে যোগদান কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু না সে তার বাবা হাসানের নামে একটা ক্লিনিক স্থাপন করবে তার বাবা এবং তারই জন্মস্থানে।
জমি কেনা হলো আর সেই জমি বিক্রি করলো তারই গুণধর চাচা, যেই চাচা তার মা কে বিয়ে করেছিল। ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ শুরু, নিজ দায়িত্বে সবকিছু তদারকি করছে আইমান। তাকে কেউ না চিনলেও সে কিন্তু ঠিকই চিনে সবাইকে তাই ক্লিনিক নির্মাণ শুরুর আগে গিয়েছিল বাবার কবর জিয়ারত করতে কারণ নানার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার
আর কখনো তার গ্রামে যাওয়া হয় নি, এমনকি তার গর্ভধারিণী মা'কে ও
কখনো দেখতে যায় নি। যাই হোক অল্প কয়েকদিনে ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ শেষ হলো, ক্লিনিকের নাম দেয়া হলো "হাসান মেমোরিয়াল
ক্লিনিক", আর উদ্ভোধন করলেন তারই দত্তক মাতা পিতা শাহানা এবং মারুফ সাহেব। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই ক্লিনিকের প্রথম যে রোগী ভর্তি হয়েছিল সেটা ছিল তারই গর্ভধারিণী মা রিনা। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিল তার মা। যে ক্লিনিক সে দিয়েছিল তার বাবার নামে সেই ক্লিনিকের প্রথম রোগী তার মা'কে সুচিকিৎসা করতে কোন কমতি করেন নি আইমান। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠে তারই মা রিনা কিন্তু মায়ের মন বড়ই
বিচিত্র, সেই ছোট্ট আইমানকে সবারই না চেনার কথা কিন্তু তার মা ঠিকই
চিনে ফেলেছিল ছেলের ডান হাতে কব্জির উপর একটা জন্মদাগ
দেখে। কিন্তু মায়ের উপর প্রচন্ড রাগ থাকাতে আইমান সহজে মেনে নিতে চায় না তাই সে নিজেকে অস্বীকার করে যে সে আইমান না কিন্তু তার
মা বুঝতে নারাজ তাই ছেলেকে আবার নিজের করে ফিরে পেতে বলতে লাগলেন তার সাথে ঘটে যাওয়া সব পুরানো কাহিনীঃ
সৎ বাবার সংসার ছেড়ে বাপের বাড়িতে উঠেছিল এক কন্যা নিয়ে। কেন তার মা নতুন সংসার ছেড়েছিল? আইমানের বাবা মারা যাওয়ার বছর খানেক পর আইমানের মা হাসানের যে ভাইকে বিয়ে করেছিল সেই লোকটা ছিল একটা খারাপ প্রকৃতির মানুষ, রাত করে বাড়ি ফেরা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, আরো নানা অপকর্মের সাক্ষী ছিল এই লোকটা; রিনা অনেক চেষ্টা করেও তাকে ফেরাতে পারে নি মরিচাধরা জীবন থেকে আলোর সান্নিধ্যে। কিছু বললেও রিনার উপর চলত শারীরিক নির্যাতন!! এরই মধ্যে এক কন্যা সন্তানের মা হোন রিনা, আর এদিকে দিনকে দিন চলতে থাকে রিনার উপর অত্যাচার কিন্তু সব মুখ বুঝে সয়ে যান রিনা। অবশেষে শত কষ্ঠ বুকে চেপে ধরে শ্বশুর বাড়ির সবকিছু ত্যাগ করে ২ বছরের মেয়ে আদিবা'কে কোলে নিয়ে চলে যান ভাইয়ের কাছে বাপের বাড়িতে। মায়ের বিলাপ ধ্বনি ছিল এই রকম- কোন জায়গা বাকি রাখি নি, এমন কোন জায়গা ছিল না যে তোকে খুঁজি নি... কোথায় ছিলিরে এতোদিন বাপ আমার?? মায়ের আকুল বিলাপে নিজেকে আ সামলে রাখতে পারলেন না আইমান!! মায়ের চরণ যুগলে ক্ষমা চেয়ে, কাঁদতে লাগলেন মা'কে জড়িয়ে। পরিচয় করিয়ে দিলেন তার দত্তক মা-বাবা দুজনকে। সুস্থ হয়ে উঠা মা আর তার সেই ছোট বোনকে নিয়ে গেলেন শহরে যেখানে সে ছোটকাল হতে বড় হয়েছিল সেই মারুফ সাহেব এবং শাহানা বেগমের বাসভবনে। জীবনের পরবর্তী সময় দুই মা রিনা এবং শাহানা বেগম আর বাবা মারুফ সাহেব এবং ছোট বোন আদিবা'কে নিয়ে কাটাতে লাগল বাকিটা জীবন আর তার পাশাপাশি নিজেকে নিয়োজিত
রাখলেন বাবার নামে গড়া সেই ক্লিনিকে মানব সেবার ব্রতয়। অদ্বিতীয় ভালোবাসা তো এমনি হয়।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- অসমাপ্ত গল্প
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url