গল্পঃ "কৃষ্ণকলি"

"দেখতে-শুনতে সব'ই তো ভালো,গায়ের রং ভীষণ কালো" কথাটুকু বলে'ই উঠে দাঁড়ালো মীরা'কে দেখতে আসা ছেলের মা।
পাত্রপক্ষের এমন ঠোঁটকাটা কথা শুনে থমকে যায় মীরার বাড়ীর সবাই। পাত্রপক্ষের প্রস্থান হতেই,মীরার মা বলে উঠলো-
'মরতে পারিস না বেটি??'

মীরা প্রায় দৌড়ে এসে নিজের রুমের খিল লাগিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশ চেপে কাঁদতে শুরু করলো। 'যতটুকু দুঃখ অসীম, ততটুকু বালিশ সংকুচিত সীমাহীন'। মীরা কাঁদছে।

'মীরা আজও আসলো না। কি হয়েছে মেয়েটার? দু'দিন হয়ে গেলো এই পথে আর আসছে না। না,আর ভাবতে পারছি না।'
পথিমধ্যে পিছন থেকে নীল ডাক দিলো 'এই শুভ্র দাঁড়া'।

নীল আর শুভ্র দু'জনেই ছোটবেলার বন্ধু। স্কুল-কলেজ একসাথেই পড়েছিলো গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ঢাকা চলে যায় শুভ্র। নীল গ্রামের ডিগ্রি কলেজেই অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের সুবাধে অনেকদিন পর নিজ গ্রামে আসা শুভ্রের।

শুভ্র পিছন তাকাতেই দেখলো নীল ডাকছে।

- কিরে কোথায় যাচ্ছিস? তোর মুখ এমন শুঁকনো লাগছে কেন?
-এমনি'রে। কেমন আছিস বল?
- কি হয়েছে সেটা বল আগে? তোর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
শুভ্র উত্তর না দিয়ে হাটাঁ শুরু করলো।

মীরা উঠুন ঝাড়ু দিচ্ছে । ঘামার্ত ছিপছিপে কালোরং এর চেহেরায় বড্ড মায়াবী লাগছে মীরা'কে। মীরাদের বাড়ীর পিছনের শিমুলগাছের আড়ালঁ থেকে অপলক দৃষ্টিতে শুভ্র তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। তেল চিটচিটে লম্বা কেশে দু'বেনী করা মীরার'কে ভালো লাগে শুভ্রের। শুভ্র নতুন করে আবার প্রেমে পড়ে। মীরা এসব কিছুই জানে না। শুভ্র বাড়ীর পথে রওনা হয়।

'বলি এমন কালো মেয়ে'কে কেও বিয়ে করবে না,বয়স তো আর কম হলো না। আজকাল রং ফর্শার কিছু ক্রিম বাজারে পাওয়া যায়, মুখে দিতে পারিস মীরা'।
ছোট চাচীর কথা শুনে মীরা উত্তর দিলো না। বসার রুম থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল।

ভীষণ সেকেলে মেয়ে মীরা। এখনও আধুনিকতা স্পর্শ করেনি। শান্ত প্রকৃতির গ্রামের চঞ্চল মেয়ে। দেখতে ভীষণ কালো হলেও গুনে স্বরসতী। ঢিলেঢালা জামা আর রঙিন ওড়না পরিহিত তেল চিটচিটে লম্বা কেশে কারও নজরে না পরলেও শুভ্রের নজর কাড়ে। সুদর্শন যুবক শুভ্র,মেধাবীও বটে।

পুকুর ঘাটের পথ ধরে মীরা আসছে। মীরা'কে দেখতে পেয়ে শুভ্রের চোখে-মুখে হাসির রেখা।

- 'এই মেয়ে দুইদিন কোথায় ছিলে? কত চিন্তে হয়েছে জানো'???
মীরা উত্তর করলো না।
- উত্তর দিচ্ছো না কেন শুনি??
- পথ ছাড়ুন। (মাথা নিচু করে)
- ছাড়ার জন্য তো পথ আটকায়নি।
- এমন করছেন কেন?? ( ভীত কন্ঠে)
- "আমি তোমাকে ভালোবাসি"।

কথাখানা শুনে মীরা'র বুক ধক করে উঠে।
কি বলছে মানুষ'টা?? কি শুনলাম?
নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না মীরা।

- কালো মেয়েদের জীবনে 'ভালোবাসা' বলতে কোনো শব্দ নেই।

- কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।
- আমার যেতে হবে পথ ছাড়ুন (অশ্রুসিক্ত কন্ঠে)
- উত্তর দিচ্ছো না কেন??
- বললাম তো, কালো মেয়েদের কপালে ভালোবাসা'টা শুধুই মরীচিকা ।

- বড্ড কথা শিখেছো আজকাল। আমার সাথে যাবে আমার কুঁড়েঘরে?

মীরার চোখ এতোক্ষনে জলে ছলছল।
-আমার এতো সৌভাগ্য নেই।

- "কলঙ্কনী রাঁধের চেয়ে আমার কৃষ্ণকলি ভালো"
কথাটা বলে শুভ্র মীরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। মীরা কিছু বলতে পারছে না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রের দিকে। অজানা ভবিষ্যতে পথ চলছে...

মীরা কাঁদছে। ভীষণ কাঁদছে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

-আরিশা তাসিন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url