গল্পঃ মনের বিপরীতে
সবুজ আমার প্রিয় রং। ব্যাপারটা কীভাবে জানি আয়াত জানতে পেরেছে। সম্ভবত এর পিছনে মা এর একটা হাত আছে। উনার ছেলে সবুজ রঙের সবকিছুই পছন্দ করে এটা হয়তো নতুন বউকে বলে দিয়ে থাকবেন। যখন তখন আমার সামনে সবুজ রঙের পরী হয়ে উড়াউড়ি করে মেয়েটা। কখনো জানতে চায় না নিজ থেকে সবুজে ওকে কেমন মানায় বা ওকে কেমন লাগছে। আমিও কিছু বলি না নিজ থেকে।
আমার কাজ উদাসীন হয়ে প্রকৃতি দেখা আর গল্প কবিতা লেখা। আমি সেসব করি। মানবীর মান অভিমান দেখার সময় কোথায়। খোলা মাঠ ঘাট নদী প্রান্তর দেখতে দেখতে আমার অনেক স্মৃতি মনে পরে যায়। যার বেশিরভাগই অনর্থক।
রোগে ভুগতে থাকা অবস্থার পর শরীরটা ভালো হয়ে উঠলে আগের চেয়েও বেশ তরতাজা একটা অনুভূতি হয়। শরীর সুস্থ থাকার একটা স্বাভাবিক আনন্দ আছে। সবকিছুই সুন্দর ভাবে অনুভব করা যায়। আর অসুখের মধ্যে আছে এক নির্মম নিঃসঙ্গতা। তা সে শরীরের অসুখই হোক আর মনের অসুখই হোক।
আয়াত এর সাথে যখন বিয়ে হয় তখন ও সদ্য শরীরের অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করা এক ছটফটে কিশোরীসুলভ যুবতী আর আমি বছরের পর বছর ধরে মনের রোগে রোগাক্রান্ত অকালে বুড়িয়ে যাওয়া যুবক।
আমাদের বাসর রাতটা হল অন্যরকম। আর সবারচেয়ে আলাদা। বাসররাতে আমার জ্বর উঠলো ১০৩ এ। স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেল আমার। কাতর শরীরে শুয়ে শুয়ে দেখলাম একটা মেয়ে সারা ঘরময় ছুটে ছুটে আমার সেবা করছে। কখনো বাসায় ফোন দিয়ে জেনে নিচ্ছে কি করবে কখনো মাথায় পানি ঢালছে কখনো বা ওষুধ খাওয়াচ্ছে। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হল তখন,যখন আমি জ্বরের ঘোরে পুরোপুরি বিস্মৃত অবস্থায় রুপা নামটা বারংবার উচ্চারণ করলাম। হ্যা,আমার অসুখ ছিল রুপা। জ্বর তো হয় শরীরে। সেটা আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু মনের অসুখ সারানি বেশ কঠিন। আমার এত কঠিন একটা মনের অসুখের সন্ধান পেয়ে বেচারির যে সুখ হয়নি তা নিতান্ত বোকার ও বুঝার কথা। অবশ্য ব্যাপারটা প্রকাশ পাওয়াতে আমার ভালোই লেগেছিল। গোপনীয়তার কিছু নেই। যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ পাবে ততই মঙ্গল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি একজোড়া উৎসুক চোখ গভীর আগ্রহে আমাকে দেখছে।
-জ্বর একদম বিচ্ছিরি। বিরক্তিকর। আমার একদম ভালোলাগে না। সারাদিন শুয়েবসে থাকা।
আমি হাসিমুখে বললাম মানুষের এরচেয়ে কত খারাপ অসুখ হয়। আর আমার তো সামান্যই।
-আপনি একটা গুড ফর নাথিং।
নীরব হাসিতে আয়াতের কথায় সাঁয় জানালাম ।
- কোথায় প্রেম করবো,গল্প করবো,ভালোবাসাবাসি হবে... আর উনি কিনা বিছানায় শুয়ে আছেন।
-তাহলে তো ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তোমার প্ল্যান টা আগে জানানো দরকার ছিল। তাহলে আমি জ্বরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে নিতাম।
- আপনি আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিলেন।
- আরও কিছু ছিল নাকি?
- হ্যা ছিল তো। বাবাকে বলে রেখেছিলাম আপনাকে আমাদের বাড়ি পুরোটা ঘুড়িয়ে দেখাবো। জানেন তো, আমাদের বিশাল বড় বাড়ি। ইয়া বড় বাগান। সামনে মস্ত খেলার মাঠ।
আয়াতের বলার ধরনে আমার হাসি এসে যায়। ঠিক একটা বাচ্চা। কোন ভণিতা নেই যেন। তেইশ বছরের এক যুবতীর দেহে বার বছরের এক বাচ্চা মেয়ের ছটফটানি।
- বাড়িতে তে তোমার বেশ দাপট না?
- হুম। দাপট মানে সেরকম দাপট। বাড়ির সবাইকে আমার কথা শুনতে হয়।
ওর দুষ্টু দুষ্টু চোখ আর সেই চোখের এত ভাষা দেখলে কে বলবে এই মেয়ে দিনের পর দিন ভয়াবহ সব অসুখে ভুগেছে।
- আর একটা কথা। আপনাকে জানিয়ে দিই। আমাকে কিন্তু রাগানো একদম বারণ। ডাক্তার কড়াকড়ি নিষেধ করেছেন, হুম।
ওর সাথে সাথে আমিও কিশোর হয়ে যাই।
সাবস্ক্রাইব করুন:
ওমা, তাই নাকি? তা রাগলে কি করো?
-রাগলে পাগল হয়ে যাই। আমি না একবার পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, কাওকে চিনতে পারতাম না,সারাদিন রাগারাগি করতাম। কান্নকাটি করতাম আর জিনিসপত্র সব দেওয়ালে ছুড়ে ছুড়ে ভাঙতাম।
-আয়াত, তুমি কি সত্যি সত্যি পাগল হয়েছিলে না সবার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে?
আয়াত এবার চোখেমুখে সিরিয়াস ভঙ্গী করে বলল- না না সত্যি। আমাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার তখন খুব কষ্ট হতো মাথার মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণা। আমার সবকিছু মনে নেই। ডাক্তার কাকু আর চাকরবাকরদের মুখে শুনেছি আমি কি কি করতাম তখন। একবার কম্পিউটার ভেঙে ফেলেছিলাম।
-আচ্ছা আয়াত সত্যি করে বলতো তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্য কেন উঠেপড়ে লাগলে? আমি যদি রাজি না হতাম?
- রাজি হতেন না? কেন? আমি দেখতে খারাপ? আমি ভালো নই? আমাকে ভালো লাগে না?
চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার বুকের উপর ঝুঁকে পরে আয়াত।
-বলুন সত্যি করে।
খুব চিন্তিত তার মুখ।
আমি বিব্রত হয়ে যাই। সব কথা এই মেয়েকে কি করে বলি...
-তা ভালো লাগে নিশ্চয়ই। তুমি দেখতে অবশ্যই সুন্দর।
আয়াতের মুখটা আবার খুশীতে নেচে উঠে। তাহলে তো হয়েই গেলো। আপনি আমাকে রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক কথা বলবেন।
অনেক কষ্টে হাসি চেপে বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিতে নিতে বললাম – তোমার মা বলছিলেন, রেগে গেলে তুমি নাকি গালি দাও।
- হ্যা দেই তো। শুনবেন আপনি?
আয়াতের মুখ থেকে যেসব গালি বেরুলো সেগুলো কোনোমতেই গালির পর্যায়ে যায় না। সেগুলোর উচ্চারণ এতই নরম আর মিষ্টি যে পোষা বিড়াল এর আদুরে ডাক মনে হয় অনেকটা।
- আয়াত, তুমি কাওকে কখনও ভালোবেসেছো?
-হ্যা।বাবাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। মা কে আমার ভালোলাগে না।
-বাবা ছাড়া আর কাওকে? ধরো,কোন ছেলেকে? কোন ছেলের জন্য মন কেমন কেমন করে... সেরকম কিছু?
-উঁহু
-তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার কোন ছেলেকে ভালোবাসা অবশ্যই উচিত ছিল। সবাই বয়স হলে টুকটাক ভালোবাসে কাওকে না কাওকে।
-আপনি আমাকে ভালবাসবেন?
-না
- না? কেন?
আয়াত একদম আমার উপর ঝুঁকে পরলো। খুবই ব্যগ্র আর উৎকণ্ঠিত তার চোখমুখ। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার শরীরের সমস্ত উত্তাপ এসে আমাকে ধাক্কা মারছে।
-একটু সরে বসো। অসুস্থ মানুষের এত কাছে থাকতে নেই।
-আমি সরবো না। আপনি আগে বলুন।
-কি বলবো?
-ভালোবাসবেন কিনা আমাকে।
-তুমি খুব ভালো আর বোকা একটা মেয়ে। এত সহজে এককথার মধ্যে যদি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো তাহলে আর কোন চিন্তাই ছিল না।
-অত কথা শুনতে চাই না। আপনি বলুন।
- মা আসবে এখন। একটু সরে বসো। খারাপ ভাববে এ অবস্থায় কেও দেখলে।
-আমার বয়ে যাবে তাতে। আপনি তাহলে আমাকে ভালোবাসবেন না?
-না
-আমি পাগল,আমি গালি দেই সেইজন্য?
-না কোনটাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারতাম,তুমি যেরকম ভালোবাসার কথা বলছো সেরকম না অন্যরকম ভালোবাসা। বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসা।
-বুঝতে পেরেছি আপনি আমাকে খারাপ ভাবেন।
আয়াতের মুখে বিষাদের একটা ছায়া পরলো। আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে খাট থেকে নামতে গেলো। মেঝেতে একটা পানি রাখার পাত্র ছিল। সেটা পায়ের কাছে লাগতেই সেটাকে লাথি দিয়ে আরও বহুদূর নিয়ে গেলো। সারা মেঝেতে পানি গড়িয়ে একাকার হল।
ঝুঁকে ওর একটা হাত ধরে বললাম, রাগ করো না। আমি মোটেই তোমাকে খারাপ ভাবি না। তুমি অনেক সুন্দর। খুবই সুন্দর। তোমাকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই। তোমার সাথে আমার আরও বছর সাতেক আগে দেখা হওয়া দরকার ছিল।
-থাক, আর বাজে কথা বলে আমাকে ভোলাতে হবে না। সাত বছর আগে আমি মনে হয় এসব বুঝতাম! ছিহ!
-না সত্যি, আমার বুকের ভেতরটা একদম খালি আর শুন্য। সব ভালোবাসা আমি আগেই একজনকে দিয়ে দিয়েছি। আর কাওকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই।
- কে সে? রুপা? আপনার আগে বিয়ে হয়েছিলো বুঝি?
-না বিয়ে হয়নি। হ্যা রুপা। সে হারিয়ে গেছে। অনেক ভালোবাসতাম।
-মরে গেছে?
-কি জানি। মরে গেলেও যেতে পারে। তবে হারিয়ে গেছে এটা সত্যি। আমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে। আমি আর তাকে খুঁজে পাই না।
আয়াত বাচ্চা মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বেশকিছুক্ষন ভাবলো আপনমনে। হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। তারপর বিছানা ছেড়ে মাটিতে নেমে আপন মনে কথা বলার সুরে বলতে লাগলো একজনকে ভালবাসলে বুঝি আর কাওকে ভালোবাসা যায় না? খুব যায়।
-না যায় না। একবারের বেশি ভালোবাসা হয় না।
-খুব যায়। একদম বাজেকথা বলবেন না আমার বান্ধবীই তো আগে একজনকে ভালোবাসতো এখন আরেকজনকে ভালোবাসে। কতলোক, একসাথে দুই তিন জনকে ভালোবাসছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
-আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। অনেকে হয়তো পারে। সবাইকে দিয়ে তো সবকিছু হয় না। আমি পারি না।
-সে আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়।
আমি হেসে দিলাম,আয়াত হাসলো না। সে ঘরের মধ্যে ছটফট করলো কিছুক্ষণ,এটা ওটা নাড়াচাড়া করলো তারপর বসে রইলো। মুখে চাপা রাগ আর দুঃখ যেন দারুন অস্বস্তির মধ্যে আছে।
-আয়াত তুমি না লক্ষ্মী মেয়ে,রাগ করতে হয় না। তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আসো দুজন গল্প করি।
এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। অনেকগুলো দিন। আয়াতের জন্য কষ্ট হয়। অদ্ভুত কষ্ট। মেয়েটা শুধু বাবাকে ভালোবেসেছে। স্বামীকে ভালোবাসতে চেয়েছে। স্বামীর ভালোবাসা পায়নি। আমি কি করবো আমি কাওকে ভালোবাসতে পারি না। আমি সেই একই গণ্ডিতে আবদ্ধ। নতুনত্ব আমার ভালো লাগে না। দুপুরের কাঠফাটা রোদ আর সন্ধ্যার উথালপাতাল জোসনা কোন কিছুই আমার ভালোলাগে না। রুপা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের মুখ আমার একটি বারও মনে আসে না। এটা আমার অসুখ। রুপা সিনড্রম। রুপা নামে কাওকে পেলে আমি দরকারের বেশি তাকিয়ে দেখি এই রুপাটা কেমন। আমার রুপার সাথে মিল কোথায় অমিল কোথায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। অন্যকোন মেয়ের কথা ভাবতে পারি না আমি। একা থাকলে এই অসুখে একদম কাবু হয়ে যাই।
জিপ গাড়িটা খানাখন্দে পরে হঠাৎই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। আয়াত একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে। হাওয়ায় ওর শাড়ির আঁচল উড়ছে। সাথে উড়ছে খোলা চুল। আয়াতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলাম।
-তোমার লাগছে না তো? গাড়িটা লাফাচ্ছে যে... আস্তে চালাবো?
-না একটুও না। আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।
চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে আয়াতের। আমার দিকে সড়ে বসে একটু। ওর গা থেকে দামী পারফিউমের গন্ধ ভেসে এসে বাতাস টা মোহনীয় করে তুলেছে। আয়াতকে রুপা ভেবে বারবার ভুল করে ফেলি। বড্ড ভুলো মন আমার।
বেঁচে থাকতে হলে কিছু মিথ্যে কথা বলা জরুরী হয়ে যায়। জরুরী একটা মিথ্যে বলে ফেলেছি আয়াতকে- ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
রুপাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি। শেষ নিঃশ্বাস অবধি বাসবো মনে হয়। কিন্তু ভালোবাসার আকর্ষণটা একটু অন্যরকম। চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই,পাওয়ার লোভ নেই। জীবনের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। সে নিয়মে বাধা পরতে হবেই। আজ নতুবা কাল। সে নতুন নিয়মের বেড়াজালে কত শত পুরনো নিয়ম নতুন মাত্রা পায়। কে জানে নতুন নিয়মের মধ্যে হয়তো একদিন সত্যি সত্যি আয়াতকে ভালোবাসতে শুরু করবো। ইউ নেভার নো হোয়াট ইয ওয়েটিং নেক্সট ...
সাবস্ক্রাইব করুন:
By- Fairuz Ahmed
আমার কাজ উদাসীন হয়ে প্রকৃতি দেখা আর গল্প কবিতা লেখা। আমি সেসব করি। মানবীর মান অভিমান দেখার সময় কোথায়। খোলা মাঠ ঘাট নদী প্রান্তর দেখতে দেখতে আমার অনেক স্মৃতি মনে পরে যায়। যার বেশিরভাগই অনর্থক।
রোগে ভুগতে থাকা অবস্থার পর শরীরটা ভালো হয়ে উঠলে আগের চেয়েও বেশ তরতাজা একটা অনুভূতি হয়। শরীর সুস্থ থাকার একটা স্বাভাবিক আনন্দ আছে। সবকিছুই সুন্দর ভাবে অনুভব করা যায়। আর অসুখের মধ্যে আছে এক নির্মম নিঃসঙ্গতা। তা সে শরীরের অসুখই হোক আর মনের অসুখই হোক।
আয়াত এর সাথে যখন বিয়ে হয় তখন ও সদ্য শরীরের অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করা এক ছটফটে কিশোরীসুলভ যুবতী আর আমি বছরের পর বছর ধরে মনের রোগে রোগাক্রান্ত অকালে বুড়িয়ে যাওয়া যুবক।
আমাদের বাসর রাতটা হল অন্যরকম। আর সবারচেয়ে আলাদা। বাসররাতে আমার জ্বর উঠলো ১০৩ এ। স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেল আমার। কাতর শরীরে শুয়ে শুয়ে দেখলাম একটা মেয়ে সারা ঘরময় ছুটে ছুটে আমার সেবা করছে। কখনো বাসায় ফোন দিয়ে জেনে নিচ্ছে কি করবে কখনো মাথায় পানি ঢালছে কখনো বা ওষুধ খাওয়াচ্ছে। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হল তখন,যখন আমি জ্বরের ঘোরে পুরোপুরি বিস্মৃত অবস্থায় রুপা নামটা বারংবার উচ্চারণ করলাম। হ্যা,আমার অসুখ ছিল রুপা। জ্বর তো হয় শরীরে। সেটা আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু মনের অসুখ সারানি বেশ কঠিন। আমার এত কঠিন একটা মনের অসুখের সন্ধান পেয়ে বেচারির যে সুখ হয়নি তা নিতান্ত বোকার ও বুঝার কথা। অবশ্য ব্যাপারটা প্রকাশ পাওয়াতে আমার ভালোই লেগেছিল। গোপনীয়তার কিছু নেই। যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ পাবে ততই মঙ্গল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি একজোড়া উৎসুক চোখ গভীর আগ্রহে আমাকে দেখছে।
-জ্বর একদম বিচ্ছিরি। বিরক্তিকর। আমার একদম ভালোলাগে না। সারাদিন শুয়েবসে থাকা।
আমি হাসিমুখে বললাম মানুষের এরচেয়ে কত খারাপ অসুখ হয়। আর আমার তো সামান্যই।
-আপনি একটা গুড ফর নাথিং।
নীরব হাসিতে আয়াতের কথায় সাঁয় জানালাম ।
- কোথায় প্রেম করবো,গল্প করবো,ভালোবাসাবাসি হবে... আর উনি কিনা বিছানায় শুয়ে আছেন।
-তাহলে তো ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তোমার প্ল্যান টা আগে জানানো দরকার ছিল। তাহলে আমি জ্বরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে নিতাম।
- আপনি আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিলেন।
- আরও কিছু ছিল নাকি?
- হ্যা ছিল তো। বাবাকে বলে রেখেছিলাম আপনাকে আমাদের বাড়ি পুরোটা ঘুড়িয়ে দেখাবো। জানেন তো, আমাদের বিশাল বড় বাড়ি। ইয়া বড় বাগান। সামনে মস্ত খেলার মাঠ।
আয়াতের বলার ধরনে আমার হাসি এসে যায়। ঠিক একটা বাচ্চা। কোন ভণিতা নেই যেন। তেইশ বছরের এক যুবতীর দেহে বার বছরের এক বাচ্চা মেয়ের ছটফটানি।
- বাড়িতে তে তোমার বেশ দাপট না?
- হুম। দাপট মানে সেরকম দাপট। বাড়ির সবাইকে আমার কথা শুনতে হয়।
ওর দুষ্টু দুষ্টু চোখ আর সেই চোখের এত ভাষা দেখলে কে বলবে এই মেয়ে দিনের পর দিন ভয়াবহ সব অসুখে ভুগেছে।
- আর একটা কথা। আপনাকে জানিয়ে দিই। আমাকে কিন্তু রাগানো একদম বারণ। ডাক্তার কড়াকড়ি নিষেধ করেছেন, হুম।
ওর সাথে সাথে আমিও কিশোর হয়ে যাই।
সাবস্ক্রাইব করুন:
ওমা, তাই নাকি? তা রাগলে কি করো?
-রাগলে পাগল হয়ে যাই। আমি না একবার পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, কাওকে চিনতে পারতাম না,সারাদিন রাগারাগি করতাম। কান্নকাটি করতাম আর জিনিসপত্র সব দেওয়ালে ছুড়ে ছুড়ে ভাঙতাম।
-আয়াত, তুমি কি সত্যি সত্যি পাগল হয়েছিলে না সবার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে?
আয়াত এবার চোখেমুখে সিরিয়াস ভঙ্গী করে বলল- না না সত্যি। আমাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার তখন খুব কষ্ট হতো মাথার মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণা। আমার সবকিছু মনে নেই। ডাক্তার কাকু আর চাকরবাকরদের মুখে শুনেছি আমি কি কি করতাম তখন। একবার কম্পিউটার ভেঙে ফেলেছিলাম।
-আচ্ছা আয়াত সত্যি করে বলতো তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্য কেন উঠেপড়ে লাগলে? আমি যদি রাজি না হতাম?
- রাজি হতেন না? কেন? আমি দেখতে খারাপ? আমি ভালো নই? আমাকে ভালো লাগে না?
চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার বুকের উপর ঝুঁকে পরে আয়াত।
-বলুন সত্যি করে।
খুব চিন্তিত তার মুখ।
আমি বিব্রত হয়ে যাই। সব কথা এই মেয়েকে কি করে বলি...
-তা ভালো লাগে নিশ্চয়ই। তুমি দেখতে অবশ্যই সুন্দর।
আয়াতের মুখটা আবার খুশীতে নেচে উঠে। তাহলে তো হয়েই গেলো। আপনি আমাকে রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক কথা বলবেন।
অনেক কষ্টে হাসি চেপে বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিতে নিতে বললাম – তোমার মা বলছিলেন, রেগে গেলে তুমি নাকি গালি দাও।
- হ্যা দেই তো। শুনবেন আপনি?
আয়াতের মুখ থেকে যেসব গালি বেরুলো সেগুলো কোনোমতেই গালির পর্যায়ে যায় না। সেগুলোর উচ্চারণ এতই নরম আর মিষ্টি যে পোষা বিড়াল এর আদুরে ডাক মনে হয় অনেকটা।
- আয়াত, তুমি কাওকে কখনও ভালোবেসেছো?
-হ্যা।বাবাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। মা কে আমার ভালোলাগে না।
-বাবা ছাড়া আর কাওকে? ধরো,কোন ছেলেকে? কোন ছেলের জন্য মন কেমন কেমন করে... সেরকম কিছু?
-উঁহু
-তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার কোন ছেলেকে ভালোবাসা অবশ্যই উচিত ছিল। সবাই বয়স হলে টুকটাক ভালোবাসে কাওকে না কাওকে।
-আপনি আমাকে ভালবাসবেন?
-না
- না? কেন?
আয়াত একদম আমার উপর ঝুঁকে পরলো। খুবই ব্যগ্র আর উৎকণ্ঠিত তার চোখমুখ। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার শরীরের সমস্ত উত্তাপ এসে আমাকে ধাক্কা মারছে।
-একটু সরে বসো। অসুস্থ মানুষের এত কাছে থাকতে নেই।
-আমি সরবো না। আপনি আগে বলুন।
-কি বলবো?
-ভালোবাসবেন কিনা আমাকে।
-তুমি খুব ভালো আর বোকা একটা মেয়ে। এত সহজে এককথার মধ্যে যদি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো তাহলে আর কোন চিন্তাই ছিল না।
-অত কথা শুনতে চাই না। আপনি বলুন।
- মা আসবে এখন। একটু সরে বসো। খারাপ ভাববে এ অবস্থায় কেও দেখলে।
-আমার বয়ে যাবে তাতে। আপনি তাহলে আমাকে ভালোবাসবেন না?
-না
-আমি পাগল,আমি গালি দেই সেইজন্য?
-না কোনটাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারতাম,তুমি যেরকম ভালোবাসার কথা বলছো সেরকম না অন্যরকম ভালোবাসা। বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসা।
-বুঝতে পেরেছি আপনি আমাকে খারাপ ভাবেন।
আয়াতের মুখে বিষাদের একটা ছায়া পরলো। আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে খাট থেকে নামতে গেলো। মেঝেতে একটা পানি রাখার পাত্র ছিল। সেটা পায়ের কাছে লাগতেই সেটাকে লাথি দিয়ে আরও বহুদূর নিয়ে গেলো। সারা মেঝেতে পানি গড়িয়ে একাকার হল।
ঝুঁকে ওর একটা হাত ধরে বললাম, রাগ করো না। আমি মোটেই তোমাকে খারাপ ভাবি না। তুমি অনেক সুন্দর। খুবই সুন্দর। তোমাকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই। তোমার সাথে আমার আরও বছর সাতেক আগে দেখা হওয়া দরকার ছিল।
-থাক, আর বাজে কথা বলে আমাকে ভোলাতে হবে না। সাত বছর আগে আমি মনে হয় এসব বুঝতাম! ছিহ!
-না সত্যি, আমার বুকের ভেতরটা একদম খালি আর শুন্য। সব ভালোবাসা আমি আগেই একজনকে দিয়ে দিয়েছি। আর কাওকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই।
- কে সে? রুপা? আপনার আগে বিয়ে হয়েছিলো বুঝি?
-না বিয়ে হয়নি। হ্যা রুপা। সে হারিয়ে গেছে। অনেক ভালোবাসতাম।
-মরে গেছে?
-কি জানি। মরে গেলেও যেতে পারে। তবে হারিয়ে গেছে এটা সত্যি। আমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে। আমি আর তাকে খুঁজে পাই না।
আয়াত বাচ্চা মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বেশকিছুক্ষন ভাবলো আপনমনে। হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। তারপর বিছানা ছেড়ে মাটিতে নেমে আপন মনে কথা বলার সুরে বলতে লাগলো একজনকে ভালবাসলে বুঝি আর কাওকে ভালোবাসা যায় না? খুব যায়।
-না যায় না। একবারের বেশি ভালোবাসা হয় না।
-খুব যায়। একদম বাজেকথা বলবেন না আমার বান্ধবীই তো আগে একজনকে ভালোবাসতো এখন আরেকজনকে ভালোবাসে। কতলোক, একসাথে দুই তিন জনকে ভালোবাসছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
-আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। অনেকে হয়তো পারে। সবাইকে দিয়ে তো সবকিছু হয় না। আমি পারি না।
-সে আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়।
আমি হেসে দিলাম,আয়াত হাসলো না। সে ঘরের মধ্যে ছটফট করলো কিছুক্ষণ,এটা ওটা নাড়াচাড়া করলো তারপর বসে রইলো। মুখে চাপা রাগ আর দুঃখ যেন দারুন অস্বস্তির মধ্যে আছে।
-আয়াত তুমি না লক্ষ্মী মেয়ে,রাগ করতে হয় না। তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আসো দুজন গল্প করি।
এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। অনেকগুলো দিন। আয়াতের জন্য কষ্ট হয়। অদ্ভুত কষ্ট। মেয়েটা শুধু বাবাকে ভালোবেসেছে। স্বামীকে ভালোবাসতে চেয়েছে। স্বামীর ভালোবাসা পায়নি। আমি কি করবো আমি কাওকে ভালোবাসতে পারি না। আমি সেই একই গণ্ডিতে আবদ্ধ। নতুনত্ব আমার ভালো লাগে না। দুপুরের কাঠফাটা রোদ আর সন্ধ্যার উথালপাতাল জোসনা কোন কিছুই আমার ভালোলাগে না। রুপা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের মুখ আমার একটি বারও মনে আসে না। এটা আমার অসুখ। রুপা সিনড্রম। রুপা নামে কাওকে পেলে আমি দরকারের বেশি তাকিয়ে দেখি এই রুপাটা কেমন। আমার রুপার সাথে মিল কোথায় অমিল কোথায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। অন্যকোন মেয়ের কথা ভাবতে পারি না আমি। একা থাকলে এই অসুখে একদম কাবু হয়ে যাই।
জিপ গাড়িটা খানাখন্দে পরে হঠাৎই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। আয়াত একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে। হাওয়ায় ওর শাড়ির আঁচল উড়ছে। সাথে উড়ছে খোলা চুল। আয়াতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলাম।
-তোমার লাগছে না তো? গাড়িটা লাফাচ্ছে যে... আস্তে চালাবো?
-না একটুও না। আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।
চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে আয়াতের। আমার দিকে সড়ে বসে একটু। ওর গা থেকে দামী পারফিউমের গন্ধ ভেসে এসে বাতাস টা মোহনীয় করে তুলেছে। আয়াতকে রুপা ভেবে বারবার ভুল করে ফেলি। বড্ড ভুলো মন আমার।
বেঁচে থাকতে হলে কিছু মিথ্যে কথা বলা জরুরী হয়ে যায়। জরুরী একটা মিথ্যে বলে ফেলেছি আয়াতকে- ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
রুপাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি। শেষ নিঃশ্বাস অবধি বাসবো মনে হয়। কিন্তু ভালোবাসার আকর্ষণটা একটু অন্যরকম। চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই,পাওয়ার লোভ নেই। জীবনের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। সে নিয়মে বাধা পরতে হবেই। আজ নতুবা কাল। সে নতুন নিয়মের বেড়াজালে কত শত পুরনো নিয়ম নতুন মাত্রা পায়। কে জানে নতুন নিয়মের মধ্যে হয়তো একদিন সত্যি সত্যি আয়াতকে ভালোবাসতে শুরু করবো। ইউ নেভার নো হোয়াট ইয ওয়েটিং নেক্সট ...
সাবস্ক্রাইব করুন: