বৃত্তবন্দী জীবন, লাগামহীন স্বপ্ন আর স্বপ্নের ইচ্ছেমৃত্যু

১)
ঘুমুচ্ছিলাম। এর মাঝে মা এসে ডাকতে শুরু করলো।
এই খোকা ওঠ না। আর কত ঘুমুবি?
উহু মা, এইতো মাত্রই শুলাম।
খোকা দেখ বাহিরে কি সুন্দর জোছনা। তোর বাবার থালাটার সমান একটা চাঁদ উঠেছে। তোর বাবা বারান্দায় মাদুর পেতেছে। সবাই মিলে জোছনা দেখবো। তোকে ডাকছে।
মা ঘুমুতে দাও না। তুমি আর বাবা মিলে দেখ না মা। তোমাদের মাঝে আমি কি করবো? তুমি এত সুন্দর করে লিপস্টিক আর টিপ দিয়ে সেজেছো বাবার জন্য।
ছিঃ পাজি ছেলে। কি যা তা বলিস। আমি তো পান খেয়েছি তাই ঠোঁট লাল হয়েছে।
মার সারাটা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। আমার হাসি পেয়ে গেল।
খোকা চল না। এই খোকা...
ছোট ছোট দুটো হাতের ধাক্কায় চোখ মেলে তাকালাম। রুনু ডাকছে।
এই দাদাভাই ওঠো না। ও দাদাভাই।
চোখের কোনে জল জমেছে। আবারও মাকে স্বপ্নে দেখছিলাম। কি অদ্ভূত ব্যাপার। মা বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদেরকে কখনও স্বপ্নে দেখিনি। রুনুর জন্মের পরই মা চলে গেল ঠিকই। কিন্তু সেটা যেন প্রতিনিয়ত আমার স্বপ্নে ফিরে আসার জন্যই। মাকে দাফন করে আসার পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতেই মা চলে এসেছিলো আমার স্বপ্নে। এসেই বললো, হি হি হি খোকা তুই তো আর ছোট্টটি নেই।
এখনও বাবাকে ধরে ঘুমোস? তোর না ছোট্ট একটা বোন হয়েছে? ওকে কে দেখবে?
মা চলে যাওয়ার পর বাবা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলেন? একা একা কথা বলতেন। কাছে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম, বাবা কার সাথে কথা বলছেন?
বাবা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলতেন। অপরাধীর সুরে বলতেন, খোকা তোর মার না খুব কষ্ট হয় রে একা একা থাকতে। সারাদিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। তুই তো জানিসই তোর মা কত্ত কথা বলে। চুপ করে থাকলে নাকি ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি যদি তোর মার কাছে চলে যাই তুই রুনুকে দেখে রাখতে পারবি না খোকা?
দীর্ঘশ্বাস চেপে বলতাম, পারবো বাবা।
এইটুকু শুনেই বাবার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠতো। এর কিছুদিন পর বাবাও চলে গেলেন খুব স্বাভাবিক ভাবেই। রাতে খেয়ে আমার সাথে প্রতিদিনের মত মায়ের একা থাকতে কষ্ট হয় এই গল্প বলে ঘুমিয়েছিলেন। পরদিন আর উঠলেন না। আমি হয়ে গেলাম দু’মাস বয়সী রুনুর সতেরো বছর বয়সী মা বাবা। সেই এত্তটুকুন রুনু এখন পাঁচ পেরিয়ে ছ’এ পা দিয়েছে।
ও দাদাভাই কি হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছ কেন?
পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে খেয়ালই করিনি। আর পাগলীটা আমার চোখে জল দেখে নিজেও কাঁদছে। উঠে বসলাম বিছানায়।
কাঁদছি না তো খুকি। চোখের ভেতরে একটা পোকা ঢুকে গিয়েছিলো। তুই কাঁদছিস কেন?
তোমার কান্না দেখে। দাদাভাই, তোমার চোখে কি প্রতিদিনই পোকা ঢুকে যায়?
কেনো রে খুকি?
তুমি যখনই ঘুমাও তখনই তোমার চোখ দিয়ে পানি পরে দাদাভাই। আমি তখন তোমার পাশে বসে তোমার চোখ মুছে দিই।
খুকি আয় কোলে এসে বস।
রুনু এক লাফে কোলে চলে এলো।
হ্যাঁ রে খুকি। একটা পাঁজি পোকা প্রতিদিন আমার চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে।
তুমি ওকে মারো না কেন তাহলে?
ও তো আমাকে কামড় দেয়না রে, সুড়সুড়ি দেয়। তাই চোখে পানি আসে।
রুনু দু’হাত মুঠো করে চোখে মুখে কপট রাগ এনে বললো, যেদিন কামড়ে দেবে সেদিন কিন্তু ওকে তুমি আর আমি মিলে মারবো।
ওর ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললাম। আচ্ছা বাবা মারবো। আগে বল, এত রাতে ঘুম ভেঙ্গেছে কিভাবে তোর? নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে?
না তো দাদাভাই, এমনিই ভেঙ্গেছে। দেখোনা কত্তবড় একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। চলোনা চাঁদ দেখি।
সত্যি বলছিস তো তোর ক্ষিদে পায়নি?
ক্ষিদে পেয়েছিলো। আমি পেট ভরে বিস্কুট খেয়েছি। সব বিস্কুটই খেয়ে ফেলেছি। তোমার জন্য একটাও রাখিনি।
অবাক হলাম। এইটুকুন বয়সে মার স্বভাব পেয়ে গেছে রুনুটা। ঘরে একটা বিস্কুটও নেই। অথচ কি অবলীলায় ক্ষিদে লুকিয়ে হাসছে ও। ঠিক যেমনটা মা করত। প্রায়দিনই খেতে বসে হাসতে হাসতে বলতো, আমি আগেই খেয়ে ফেলেছি। তোরা খেয়ে নে খোকা। জানিসই তো আমি একদম ক্ষিদে সহ্য করতে পারিনা। এক গ্লাস পানি খেয়েই মা হাসিহাসি মুখ করে রাত কাটিয়ে দিত।
ও দাদাভাই চলোনা চাঁদ দেখি।
হ্যাঁ খুকি চল।
রুনুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। বাবার সারাজীবনের কষ্টে গড়া ছোট্ট দুই রুমের টিনের বাড়িটাই একমাত্র সম্বল আমাদের। এটি না থাকলে রুনুকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাইও মিলতো না হয়ত। টিউশনি করে কি আর ঢাকা শহরে চার দেয়ালের ছাদ ভাড়া পাওয়া যায়?
দাদাভাই চাঁদ গোল হলো কেনো? তিনকোণা হলোনা কেনো?
তা তো জানি না রে খুকি।
তারাগুলো এত ছোট কেনো? ওরাও চাঁদের মত বড় হয়না কেনো দাদাভাই?
এটাও তো জানি না।
দাদাভাই তুমি এত্ত বোকা কেনো গো? কিচ্ছু জানো না।
হেসে ফেলি আমি। তুই বুঝি খুব চালাক?
হ্যাঁ তো। আমি অনেক চালাক।
খুকি ঘুমুবি না?
ঘুম আসে না দাদাভাই।
খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই না রে খুকি? মিথ্যে বললি কেন? ঘরে তো কিছুই নেই। কাল টিউশনির বেতন পাব। সবকিছু বাজার করে আনবো। কি কি খাবে আমার খুকিটা?
রুনু খুশিতে জাপটে ধরলো আমাকে।
সত্যি দাদাভাই?
হুম সত্যি।
আমি ডিম খাবো দাদাভাই। আমার আর ডাল, আলু ভর্তা খেতে ভাল লাগে না।
শুধু ডিম খাবি? আর কিচ্ছু না?
গোশতের অনেক দাম তাই না দাদাভাই?
না রে পাগলী। কাল আমরা গোশত আর পোলাও খাবো। সাথে ডিমও থাকবে।
সত্যি?
হ্যাঁ বাবা সত্যি।
ও দাদাভাই একটা গান শোনাও না।
আমি যে গান গাইতে পারি না রে খুকি।
তোমার মোবাইলে গান বাজেনা কেনো? বল্টুর দাদার মোবাইলে তো গান শোনা যায়।
আমার মোবাইলটার দাম কম খুকি। অনেক দামি না হলে মোবাইলে গান বাজে না।
দাদাভাই তুমি চাকরি পেলে একটা দামী মোবাইল কিনবে? আমি গান শুনবো।
ঠিক আছে কিনবো।
জানো দাদাভাই, নীলা দিদির মোবাইলে না গান শোনা যায়।
তাই নাকি?
ওমা তুমি জানই না? জান, নীলা দিদি বলেছে তোমাকে বিয়ে করে আমাদের সাথে থাকবে। ও নাকি তোমাকে অনেক ভালবাসে। ভালবাসা কি দাদাভাই?
এই যে আমি তোকে আদর করি। গল্প শোনাই। তোকে ছেড়ে কোথাও যাই না। এটাই ভালবাসা খুকি।
তুমিও নীলা দিদিকে ভালবাসো?
না রে খুকি? আমাদের ভালবাসতে নেই। তোর নীলাদির সাথে একটা রাজপুত্রের বিয়ে হবে।
বাহ রে তুমি বুঝি রাজপুত্র নও?
হা হা... আমি কি করে রাজপুত্র হবো? আমার কি বড় রাজপ্রাসাদ, গাড়ি ঘোড়া এসব আছে?
রুনু গাল ফুলিয়ে বললো, না নেই। দাদাভাই, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমিও তোকে অনেক ভালবাসি খুকি। এবার ঘুমিয়ে পর। কাল সকাল সকাল বেরুতে হবে আমাকে।
আচ্ছা দাদাভাই।
রুনু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে কোলে নিয়ে বসেই রইলাম বারান্দায়। উঠতে ইচ্ছে করছে না। নীলার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মেয়েটা গত দু’বছর ধরে আঠার মত লেগে আছে আমার পেছনে। দুদিন পরপরই বাসায় এসে রুনুর সাথে সারাদিন থাকে। রান্না করে। বেশ বুঝি আমাদের প্রতি ওর টানটা। মুখে কখনও বলা না হলেও মনে মনে হাজারবার বলেছি, নীলা ভীষণ ভালবাসি তোমাকে। ভার্সিটির সেই প্রথম দিনটা থেকেই।
কতবার ঘুম ভেঙ্গে ঠিক করেছি আজ নিজের মনটাকে এক জোড়া ঠোঁট উপহার দিই। কিন্তু দিন শেষে ঠিকই নিজ হাতে সেই ঠোঁটে স্কচ টেপ লাগাতে হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত নামক গণ্ডীর ভেতরের মানুষদের বুঝি আজীবন এই করতে হয়।
দূরে কোথাও থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। কোন বাসায় বাজছে হয়তো। রুনুটা জেগে থাকলে খুশি হতো খুব। আমি কান পেতে রইলাম।
চুপি চুপি রাত যায় যে চলে
কি জানি কি যায় সে বলে
আজ বুঝি আর ঘুম আসবে না।।
তারাদের সাথে তারা গুনি
শূন্যের বুকে স্বপ্ন বুনি
ওগো চাঁদ ছেড়ে যেও না।।
রাতের আড়ালে চোখ ভিজে গেলে
জানবে না কেউ লজ্জা পেলে,
মন মরে ভালবাসা মরে না
গতকাল পিছু ডাকা ছাড়ে না...
রুনু হঠাৎ ঘুমের ঘোরে বলে উঠলো, ও দাদাভাই পাঁজি পোকাটা আবারও তোমার চোখে সুড়সুড়ি দিচ্ছে তাই না? দেখো না তোমার চোখ থেকে পানি পড়ে আমার গাল ভিজে যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

২)
সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। দুটো টিউশনির একটার আজ মাস ফুরোবে। টাকাটা খুব দরকার। ঘরে একটা চাল নেই। রুনুকে দোকান থেকে পাউরুটি আর কলা এনে খাইয়ে দিয়ে এসেছি। দুপুর নাগাদ বাজার নিয়ে ফিরে আসতে হবে। আজ অবশ্যি একটা চাকরীর ইন্টারভিউ আছে। চাকরীটা পেয়ে গেলেই রুনুটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। বেরুনোর আগে শার্ট আর প্যান্টটা ভাজ করে যেই না বালিশের নিচে রেখেছি কুঁচকানো ভাব কমাতে, ওমনি পাগলীটা এক লাফে বালিশের উপর উঠে বসলো। জিজ্ঞেস করতেই বলে, আমি বসে থাকলে তাড়াতাড়ি তোমার শার্ট সোজা হয়ে যাবে দাদাভাই। আমি যখন স্কুলে যাবো তখন তুমি আমার জামা বালিশের নিচে রেখে বসে থেকো।
এই একটামাত্র ভাল শার্ট আমার। আজ ইন্টারভিউ আছে বলে পড়লাম। প্রথম যেবার ইন্টারভিউ দিতে যাবো সেবার শফিক সকালে উঠে বাসায় হাজির। অবাক হয়ে বললাম, কিরে কি হয়েছে? এত সকালে তুই? চাচার শরীর ভাল তো?
হ্যাঁ, আব্বা ভাল আছে। তুই কখন বেরুবি?
এইতো ঘণ্টাখানিকের ভেতরই। তোর কাজ আছে ওদিকটায়?
শফিক কাচুমাচু মুখে বলল, দোস্ত তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। কিন্তু দিতে লজ্জা করছে ভীষণ। অনেক সস্তা তো তাই।
কি এনেছিস?
হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল ও আমার হাতে। খুলে দেখি একটা শার্ট। বললাম, তুই শার্ট এনেছিস কেন? টাকা কোথায় পেলি?
টিউশনির বেতন পেয়েছি কাল। তুই আজ প্রথমবার ইন্টারভিউ দিতে যাবি। একটা ভাল শার্ট না পড়ে গেলে কি হয়?
ওই মুহূর্তে কিছু বলতে পারি নি ওকে। শুধু জড়িয়ে ধরেছিলাম শক্ত করে। জীবনে প্রথমবার খুব অহংকারবোধ হয়েছিলো ওর মত একজন বন্ধু পেয়েছি বলে। যে ছেলে নিজেই একটা শার্ট টানা এক সপ্তাহ পড়ে সে এত কষ্টের টাকা দিয়ে আমার জন্য শার্ট এনেছিলো। সেবার চাকরিটা যখন হল না, আমার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিলো পাগলটা।
টুনুদের বাসায় পৌঁছুতেই দেখি দরজায় তালা ঝুলছে। খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। আজ টিউশনির টাকাটা না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে। গনি মিয়াঁর দোকানে বাকি বেড়ে যাওয়ায় গনি মিয়াঁ বাকিতে খরচ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। টুনুর মার নাম্বারে ফোন করলাম।
হ্যালো হাসান
স্লামালিকুম খালা। আমিতো টুনুকে পড়াতে এসেছি।
হাসান তুমি দু’দিন পর এসো। আমরা একটু গ্রামের বাড়িতে এসেছি। টুনুর খালার শরীরটা ভাল নেই তো।
জি আচ্ছা খালা।
ঘড়িতে দেখি ন’টা বাজে। ইন্টারভিউ এগারোটায়। ভেবেছিলাম টাকাটা নিয়ে বাসে করে চলে যাবো। এখন সে চিন্তা বাদ দিলাম। পকেটে মাত্র বিশ টাকা আছে। বাসে উঠলে তেরো টাকা চলে যাবে।
ইন্টারভিউ বোর্ডে পৌছুলাম সাড়ে এগারোটায়। আমার ডাক তখনও আসেনি। আশেপাশের মানুষগুলো বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর কারন আমার ভেজা শার্ট। নাহ, বৃষ্টিতে ভেজা নয়। তীব্র রোদে মেঘ ছাড়াই আমার শরীরে ঘামের বৃষ্টি নেমেছে। এখানে অপেক্ষমান ক’জনের পাশে নিতান্তই বেমানান আমি।
বারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। আমার ডাক এলো। ঢুকেই দেখি তিনজন ভদ্রলোক হাসিহাসি মুখে চেয়ে আছেন। তবে আমাকে দেখেই ওনাদের হাসিকে মিইয়ে দিলো বিরক্তি। সালাম দিলাম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসুন।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
আপনার অ্যাপ্লাইড পোস্ট ও এই রিলেটেড অন্যান্য পোস্টের ক্ষেত্রে ক’বছরের অভিজ্ঞতা আছে?
স্যার আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।
মিঃ হাসান, অভিজ্ঞতা ছাড়া আজকাল রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলের মালিকও কর্মচারী রাখেন না।
স্যার, আপনারা ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট চেয়েছেন। আবার এখন বছরভিত্তিক অভিজ্ঞতা চাইছেন। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগে আপনারা আমাদেরকে সুযোগ দেন না অভিজ্ঞতা জমানোর। আর কমপ্লিট করার পরেও একই কথা বলছেন। তাহলে অভিজ্ঞতাটা আমরা পাবো কোথা হতে? আপনারা সুযোগ না দিলে আমাদের মতো গ্র্যাজুয়েটরা আজীবন অভিজ্ঞতাহীনই রয়ে যাবে স্যার।
স্যরি মিঃ হাসান। আমাদের কিছু এক্সপেরিয়েন্সড লোক দরকার। এবং এ পর্যন্ত আমরা অনেককেই পেয়েছি।

খারাপ লাগছে না একটুও। জানতাম এমনটাই হবে। ডজন খানেক চাকরির ভাইভা দিয়ে ছ’মাসের অভিজ্ঞতা হয়েছে ইতোমধ্যেই। ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। ভুলেই গিয়েছিলাম এখন পর্যন্ত এক গ্লাস পানিও পেটে পড়েনি। টুনুকে যেদিন পড়াতে যাই সেদিন কিছু খাই না ইচ্ছে করেই। খালা কিছু না কিছু নাস্তা খেতে দেনই। খাওয়ার চিন্তা আপাতত মাথা থেকে বাদ দিলাম। যে করেই হোক কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে। রুনুটা না খেয়ে বসে আছে। শফিকের বাসার দিকে রওনা দিলাম। ঘন্টাখানেকের ভেতর পৌঁছে যাবো। ওর কাছে কিছু টাকা ধার নিয়ে জলদি বাজার করে বাসায় ফিরতে হবে।
শফিক বাসায় নেই। চাচার অসুখ বেড়েছে। ওকে ফোন করারও উপায় নেই। টিউশনির টাকায় কেনা ওর শখের মোবাইলটা গেলোবার চাচার অসুখ বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো শফিক কে। চাচী রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে। এসেই জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, কেমন আছো বাবা?
জী চাচী ভালো আছি। শফিক কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে চাচী?
না বাবা। তোমার চাচার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে দু’দিন হলো। হাতে টাকা নেই। ছেলেটা গতকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘুরে বেরুচ্ছে টাকার খোঁজে।
কথা বলতে বলতেই চাচীর গলা ভারী হয়ে এলো। চাচী আমি এখন উঠবো। রুনুকে বাসায় একলা রেখে এসেছি।
বেড়িয়ে এলাম। চাচীকে সান্ত্বনা দেয়ার শক্তি কিংবা সামর্থ্য কোনটাই নেই এই মুহূর্তে। শেষ আশা নিয়ে রাশেদের মেসে গেলাম।
রাশেদ নেই। গ্রামের বাড়ি গিয়েছে নাকি বেশ কিছুদিন হল।
দ্রুত হাঁটছি। যদিও হাঁটার শক্তি নেই। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। পাঁচটা বেজে গেছে। আকাশ কালো হয়ে আসছে। রাস্তায় আমার বয়সী দু’জন ঠেলাগাড়ি ভর্তি বস্তা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষরা না পারি বৃত্তের বাইরে বেড়িয়ে এসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মতো রাস্তায় নামতে, না পারি উপরের আকাশটা ছুঁতে।
ভাইজান দুইটা টাকা দেন না। আমার বইনটা কাইল থিকা কিছু খায় নাই।
নয় দশ বছরের একটা ছেলে দু’তিন বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে কোলে করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওদেরকে দেখে মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে এলো। শুধু রুনুর মুখের দাদাভাই দাদাভাই ডাক শুনতে পাচ্ছি যেনো।
পকেট হাতড়িয়ে ২০ টাকার নোটটা দিয়ে দিলাম। আমার খুকিটা কি করছে জানি না। সন্ধ্যে হয়ে এলো। ক্ষিধে পেটে ঘুমুতেও পারে না।
পকেটে মোবাইলটা বেজেই চলেছে। নীলা ফোন করেছে।
হাসান তুমি কোথায়?
কেনো?
এখখুনি বাসায় এসো। রুনুর ভীষণ জ্বর। ও খুব কাঁদছে।
আসছি বলে ফোন কেটে দিলাম।
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। পা দুটোতে কোথা থেকে যেনো রাজ্যের শক্তি ভর করেছে। মাথায় শুধু রুনুর কথাগুলো ঘুরছে।
গোশতের অনেক দাম তাই না দাদাভাই?
ও দাদাভাই আমি ডিম খাব। আমার আর ডাল ভর্তা খেতে ভাল লাগে না।

↔ তবুও, নিম্ন মধ্যবিত্ত নামক বৃত্তের ভেতর আটকে থাকা মানুষগুলোর স্বপ্নগুলো কখনই বৃত্তবন্দী হয়ে থাকে না। যদিও কখনও কখনও স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়, সেই সাথে স্বপ্ন বোনার কারিগরও। কখনও বা স্বপ্নগুলো আয়নার ভেতরের নিজের প্রতিচ্ছবিটার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে যাকে দেখাতো যায় কিন্তু শত চেষ্টায়ও ছুঁয়ে দেখা যায় না। সপ্নগুলোকে নিজ হাতে গলা টিপে মারতে হয় কখনও বা। তবুও নিষ্ঠুর প্রকৃতি নিত্য নতুন স্বপ্ন দেখায়। দিন শেষে এইসব মানুষের পাশে আর কেউ না থাকলেও স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকা নিজের ক্লান্ত ছায়াটা ঠিকই রয়ে যায়।

সাবস্ক্রাইব করুন:
 By- Habiba Bristy
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url