গল্পঃ অভিনয়ের খেলা

রাত তিনটা চল্লিশে যদি কোন অবিবাহিত যুবকের ঘরে কোন যুবতীকে পাওয়া যায়, ব্যাপারটা খুব ভাল কিছু হয় না। মান-ইজ্জতের হালুয়া হয়ে যায়। যুবকটা আমি হলে তো ব্যাপারটা আরও বিচ্ছিরি, আমার জন্য। অথচ আমি চিন্তিত না। যদিও যুবকটা আমিই। তবুও আমি খুব একটা চিন্তিত বা বিচলিত না। যে মেয়েটা পাশে বসে আছে তার বাস্তবমূল্য নিয়ে আমি সন্দিহান। আমার খুব জোর সন্দেহ মেয়েটা কল্পনা।


-কি করিস তুই?

-কিছু না। এমনি বসে।



-কীবোর্ডে খটখটাচ্ছিস যে?

-অনর্থক গল্প লেখার চেষ্টায়!

-ভালোবাসার গল্প?

-ঐটাইপের গল্প এখন আর আসে না।

-আসে না কেন?

-আসে না। কারন আসে না।

-আমার জন্য না তো?

মেয়েটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। তা করুনা হতে পারে। উপহাসও হতে পারে। দুঃখবোধ মিশে থাকাও বিচিত্র না। সেই 'কিছু একটা'র টানে ওর দিকে ফিরলাম। ঠিক সে সময় বুক থেকে বেরিয়ে আসল শামুকের খোলে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। আমরা দুজন সেই দীর্ঘশ্বাসে চড়ে ফিরি ফেলে আসা অতীতে।

ক্লাস শেষ। রিক্সায় চড়লে পুরো আকাশটাকে মাথার ওপর পাওয়া যায়। তাই রিক্সা আমার এত পছন্দের। শেষ বিকেলের ঠান্ডা বাতাস আমাদের ছুঁয়ে পেছনে থেকে যায়। ভালই শীত পড়ছে। সময়ের আগে শীত পড়াটা এখনকার একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। পৌষ মাস আসতে এখনও ঢের দেরি আছে। অথচ এখনই কি শীত। আর আমি বোকার মত চে গুয়েভারার মাথাওয়ালা একটা টিশার্ট পরেই ভার্সিটি চলে এসেছি। মনে মনে নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে।
-নে জড়ায়া নে।

নীলা ওর বিশাল চাদরটার একদিক বাড়িয়ে দিল।
-লাগবে না। শীত করতেছে না।
বোকামীটা স্বীকার করব নাকি?

-হয়েছে আর ঢং দেখাইস না। নে তো।

ভাতের উপর রাগ করে লাভ নাই। তাই চাদরের একদিক গায়ে জড়ালাম। আর নীলা বকবক করে যেতে লাগল। আমি ভাল শ্রোতা। খুব ভাল শ্রোতা।আর অভ্যাসও হয়ে গিয়েছিল। রিক্সাওয়ালা প্যাডেলে পা চালাচ্ছিল দ্রুত। হয়ত আজ আর 'খ্যাপ' মারবে না। আমরাই লাস্ট পেসেঞ্জার। ঘরে ফেরার তাড়া আছে হয়ত বেচারার। হয়ত নতুন বিয়ে করেছে। ঘরে নতুন বউ।
-আহা। ব্যাটা আস্তে চালাস না। তোর বউ কি ভাইগা যাইতেসে?

মনে মনে রিক্সাওয়ালাকে ধমক দিলাম। ধমকে কাজ হয়েছে বলে মনে হল না।
রিক্সা দ্রুতলয়ে চলছিল। নীলা বকবক করছিল। আর আমি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, কত ছোট এই জীবন। তারচেয়ে কত ছোট এই রিক্সা, ভ্রমন। দেখতে দেখতেই চৌরাস্তা চলে আসবে, বা এই রিক্সা চৌরাস্তায় পৌঁছে যাবে। রিক্সাটা যদি অনন্তকাল ধরে এমনি চলতে থাকত। আমরা একটা চাদর জড়িয়ে বসে থাকতাম। নিজেকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম চাদর না আনার জন্য। সাথে চে গুয়েভারাকেও। আজকাল মশা এত বাড়া বেড়েছে। 'শালার মশা'। আস্তে করে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

মেয়েটা পাশ থেকে উঠে গেল। বিছানায় গিয়ে বসল। ওর চোখে বিষন্নতার হালকা নীল রং।

সাবস্ক্রাইব করুন:

-তুই আমাকে ভালবাসতি, কাব্য?

-বুঝতি না?

-এখনও বাসিস?

-কি মনে হয়?

-বলিসনি কেন আমাকে?

আবার দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। পাথরের নীচে চাপা থাকা শ্যাওলামাখা স্যাতস্যাতে দীর্ঘশ্বাস।
আমি জানি কেন বলিনি। নিজের ভীরুতাকে পায়ে পিষে, আদিবার সামনে বারবার রিহার্সেল শেষে নীলাকে বলতে গিয়েছিলাম। বলতে গিয়েছিলাম ভালবাসি। উন্মাদপ্রায় অবস্থা ছিল, "হয় বলব না হয় মরব"
বলতে পারিনি। মরেছিলাম। কেউ জানলও না আমি মারা গেছি। আমার জানাজা হল না। আমাকে পোড়নো হল না। একফোঁটা চোখের জলও কারও চিবুক বেয়ে গড়ালো না। শুধু আমি জেনেছিলাম, মারা গেছি।

সেদিন হাতে সময় নিয়েই ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। ওকে কোথাও দেখলাম না। তপ্ত চোখজোড়া নীলাকে খুঁজছিল। হঠাৎ চোখ খুঁজে পেল মুখটাকে, ভার্সিটি এর কোনে। রাকিন আর নীলা বসে আছে। নীলার হাত ধরে আছে নায়ক রাকিন। যে নাটকে এতক্ষন আমি নায়ক ছিলাম সেই নাটকের দর্শকরা চমকে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে, আমি নায়ক না, আমি ভিলেন। আসলে ভিলেনও না। আমি কিছুই না। আই এম নোবডি। ফিরে এসেছিলাম এতদিনের অভিনয়ের পারিশ্রমিক, চোখঝাপসা করা লবনাক্ততা আর ফুসফুস ভর্তি কষ্ট নিয়ে।

এবারের দীর্ঘশ্বাসটা আদতেই বেশ দীর্ঘ হয়। নীলা পেছনে বসে থাকে চুপচাপ। পেছনে বসা বলে ওর মুখ দেখতে পাই না।
এখনও তোকে দেখি। ভার্সিটিতে গিয়ে তোকে দেখি না আসলে, তোকে দেখার জন্যই ভার্সিটি যাই। এমন ভাব করি যেন কিছুই হয় নি। সব ঠিকঠাক চলছে। তুই হয়ত বুঝিস কিছু। হয়ত না। নতুন নায়ক নিয়ে তোর সুখ দেখে আমি পুড়ি। হিংসার আগুনে, অভিমানের আগুনে, অসহায়ত্বের আগুনে। জানি আমি স্বার্থপর, সবসময় নিজের দিকটাই দেখি আমি। কারন আমি কাব্য। আমি মহাত্না গান্ধী বা গৌতম বুদ্ধ নই। তোকে এড়িয়ে চলি। নিদেনপক্ষে তোর কাছ ঘেঁষি না। ভুলেও তোর চোখের দিকে তাকাই না। মাঝে মাঝে তোর সামনে পড়ে যাই।
-কিরে ইদানীং এত পার্ট নিতেসিস ক্যান?

সত্যি করে বলছি আমি পার্ট নেই না। আমার কষ্টগুলো তোর কাছ থেকে লুকানোর জন্যই এই পালিয়ে বেড়ানো। আমি শুধু দূর থেকে তোকে একটু দেখি। একদিনে থিতিয়ে ওঠা কষ্টের আগুনটাতে ফুঁ দেই। কষ্ট তার ফেনিয়ে ওঠা শিখা নিয়ে আমাকে গিলে খায়। তোকে হারিয়ে এখন এই কষ্টটাই সম্বল। অন্তত এই কষ্টটা হারাতে চাই না।

নেটে অনলাইন থাকি। তোকে দেখি। আমি নক করি না। তুইও না। অপেক্ষা করি শুধু। হয়ত তোর নকের অপেক্ষায়। হয়ত তুই রাকিনের সাথে চ্যাটে ব্যস্ত। হয়ত আমাকে দেখিস ই নি। হয়ত বা দেখিস। কখনও সখনও নক করিস। হাই, হ্যালো হয়। তারপর আবার নীরবতা। আমি আবার এক টেবিল চামচ কষ্ট গিলে ফেলি।

সাবস্ক্রাইব করুন:

পেছনে ফিরি। নীলা নেই। এই মেয়েটা হঠাৎ আসে, হঠাৎ যায়। আবার পুরোনো কুয়ায় জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। নিজের সাথে অভিনয়ের খেলা করি। নিজেকে বোঝাই, নীলাকে ভোলা কোন ব্যাপারই না। আর আমি কি বেহায়া নাকি? তবুও মাঝে মাঝে খুব আলতো ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কানে যেন দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা না পৌছায়। অন্তত কানটা জানুক আমি ভাল আছি।
ইদানীং রাত জাগাটা বেশি হচ্ছে। এত রাত জেগে থাকা ভাল কিছু না। এটাকে কনট্রোল করতে হবে। নীলার ব্যাপারটাও কন্ট্রোল করতে হবে। এমন না ওকে ছাড়া থাকা যাবে না, ওকে না দেখলে মন অশান্ত হয়ে থাকবে। ওর চেয়ে অনেক সুন্দর মেয়ে আমার সাথেই পড়ে তিন, চারজন। আমিও দেখি আরিশার সাথে চান্স নিতে পারি কি না। অথবা রওশনের সাথে।
নীলার গলা শুনতে খুব ইচ্ছা করছে। মোবাইলটা হাতে নিলাম।
-দুঃখিত। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি......

নীলা তো কখনও ফোন অফ রাখে না। ওর কি শরীর খারাপ? ওর কি অসুখ? ওর কি মন খারাপ? ও কি কাঁদছে এলোচুলে?
নাহ। কালকে খোঁজ নিতে হবে, আড়াল থেকে, আড়াল রেখে।

লেখাঃ Megher Kabbo
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url