গল্পঃ নিয়তি

মিলা তার একমাত্র মেয়ের স্কুলে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে একটুকরো ছোট কাগজে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিটা আমি হাতে পেয়েছি ঠিক সন্ধ্যায়। সে চিঠিতে লিখেছে.....

"প্রিয় নাঈম, অনেকদিন ধরে তোমার কাছে একটি আবদারের প্রয়াসিনী আমি। একটি শুভ সময়ের অধীর অপেক্ষায় দিন গননা করছিলাম। কাল রবিবার আমি তোমাকে আমার মেয়ের স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখতে চাই। সেই না বলা আবদারটা সেখানেই তোমার কাছে তুলে ধরা হবে।
তুমি এসো কিন্তু! তুমি আসবে কিন্তু! তুমি অবশ্যই অবশ্যই আসবে।"




চিঠির লিখাটা বড্ড চেনা আমার। এত সুন্দর হাতের লিখায় মিলার চিঠি আরও অনেকবার পেয়েছি। এ লিখায় কোন ধোকা নেই, কোন ছলনাও নেই। সজিব আমাকে প্রায়শই বোকা বানালেও আজ এই চিঠিতে সে আমাকে বোকা বানাতে চেষ্টা করেনি, লিখাটা দেখেই আমি সেটা বুঝতে পারি। চিঠির বাহক সজিব। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন সে। মিলার মেয়ের সাথে তার ভাগ্নি পড়াশোনা করে। সেই সূত্রেই মিলার সাথে তার বন্ধুত্ব রয়েছে কিছুটা।

সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি বেশ ভালই ছিলাম। বিয়ে করেছি কেবল ষোল দিন হলো। আমার বউকে এখনো সবাই নতুন বউ বলেই ডাকছে। গতকালও আম্মা আমার ছোটবোন তিম্মিকে ডেকে বললো,

"তোর নতুন ভাবিকে বল তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সবার জন্যে যেন নাস্তা প্রস্তুত করে রাখে। আমি তোর ফুফুর বাসায় একটি জরুরি কাজে যাচ্ছি।"

নতুন বউ নিয়ে আমার এমন ভাবনার মাঝে হঠাৎ কেউ একজন চায়ের কাপে চামচের টুনটুন শব্দ করে পেছন থেকে এগিয়ে এলো। তাকিয়ে দেখি নয়ন্তী আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার হাতে চা তুলে দিতে দিতে বলল,

"আচ্ছা বলুন তো! আমাকে কোন শাড়িতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়? আপনি যেটা বলবেন আমি কাল সেটা পড়েই আমাদের বাড়ি যাবো।"

আমি নয়ন্তীর কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। এরপর চিঠিটা বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। নয়ন্তী বেশ কয়েকবার উঁকিঝুঁকি করতে করতে অবশেষে বলেই বসলো,

"আচ্ছা আপনি ওটা কিসের কাগজ পকেটে রেখেছেন??"

সাবস্ক্রাইব করুন:

"ও কিছুনা। কাকিমার দেয়া বাজারের তালিকা। কাকা বাড়িতে নেই তো! তাই আমাকেই করে দিতে হচ্ছে।"

"আচ্ছা কাগজটা আমাকে দিন! আমিও কিছু জিনিস আনাব সেগুলো নিচে লিখে দিচ্ছি।"

"তুমি বরং নতুন একটি কাগজে লিখে আমার টেবিলে রেখে দাও। আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।"

যদিও আমার কোন ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলনা তবুও মিথ্যা বলে মিলার চিঠিটা বাঁচিয়েছি নয়ন্তীর হাত থেকে। কিন্তু আমাকে কাল শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। নয়ন্তীকে গত বৃহস্পতিবার থেকে বিভিন্ন কাজের অজুহাত দেখিয়ে রবিবারে এনে ঠেকিয়েছিলাম। আপাতত কোন বুদ্ধিই আসছেনা রবিবার থেকে কিভাবে রেহাই নিয়ে মিলার সাথে দেখা করতে যাই।

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নয়ন্তীকে ব্যাগপত্র গুঁছিয়ে নিতে বললাম। আরও বললাম,

"আমি তোমাকে দিয়েই চলে আসবো। আমার এক যায়গায় জরুরি কাজে যেতে হবে। এরপর আমি আবারও ঠিক সন্ধ্যাবেলায় ফিরবো তোমাদের বাড়িতে।"

কিন্তু কিছুই হলনা। হঠাৎ নানু বাড়ি থেকে আমার নানুর অবস্থা যায়যায় বলে একটি সংবাদ এলো। আমি ছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কেউ নেই, যে আম্মাকে নিয়ে নানু বাড়ি যাবে। সবকিছু ফেলে আম্মাকে নিয়ে রওনা হলাম নানু বাড়ির পথে। সাথে নয়ন্তীকেও নিলাম। আমরা মাঝপথে যেতেই আমার খালাতো ভাই শায়ান ফোনে জানালো নানু আর বেঁচে নেই। আমি আম্মাকে খবরটা তাৎক্ষণিক না দিয়ে নানু বাড়ি গেলাম। সারাদিন ওখানেই কেটে গেলো। একটি রবিবারকে আর রক্ষা করা গেলোনা মিলাকে দেয়ার জন্য।

এভাবেই দিন যায় রাত্রি আসে। মিলার আর চিঠি আসেনা। মিলার মেয়ের স্কুলের সামনে গিয়ে প্রায়শই দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু কে মিলা কে মিলার মেয়ে কাউকেই চিনতে পারিনা।

গত ছ'বছর আগে মিলার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা ফেরার বিকেলের ট্রেইন মহুয়ায়। আমার হাতে মিলা একটুকরো কাগজে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিল সেদিন বিদায়ের বিকেলে।

"যত দূরে যাও, লুকাও যত অচেনা জনতার ভিড়ে।
মনে রেখো আমিও রয়েছি কাছেই যেন -
রয়েছি প্রহরী হয়ে তোমারই অগোচরে।
এভাবেই কাছে রবো আজীবন - গল্পরা দল বেঁধে হয়ে যাক অগণন।
আফসোস রবেনা তবুও কভু, জনতার ভিড় ভেঙে আর যদি নাহি আসো ফিরে।"

মিলার কবিতার এই টুকরোটা গত ছ'বছর ধরেই আমার ডায়েরীর মলাটে আগলে রেখেছিলাম।
আজ মিলার স্মৃতি গুলো মনে করতেই পুরনো ডায়েরীটা খুলে বসেছিলাম বিকেলের বারান্দায়। বারান্দায় বিকেলের রোদ নেমে আসে। দেশে ফেরার পর থেকে সেই রোদটুকোর ভীষণ যত্ন নিচ্ছি। একটি চিংড়ী মাছের এ্যাকুরিয়াম কিনেছি। বিকেলের রোদে এ্যাকুরিয়ামটা রেখে দিলে চিংড়ি মাছটা সেই স্মিত রোদে খেলা করে। তখন পানিতে একটি হলদে আভা পরে। দেখলে মনে হয় আমি একটি ভবের রাজা, সেই রাজ্যে রোদ ছড়িয়ে সুখ ফেরি করছি। ডায়েরীটা বন্ধ করে হঠাৎ করেই এমন ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।

পেছন থেকে দিদি এসে পাশে বসতে বসতে বলল,

"কিরে এভাবে কি ভাবছিস! নানুর একটি স্মৃতির কথা বল। মনটা বড়ই খারাপ লাগছে নানুর জন্য।"

উত্তরে দিদিকে বললাম,

"দিদি আমার মনে আছে নানুর উপর একদিন ছেলেবেলায় ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। তখন না বুঝে নানুকে অনেক বকা দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখ! নানু কি অদ্ভুতুড়ে মানুষ ছিলেন! যাওয়ার সময় আমাকেও তিম্মির সাথে তখন একশত টাকা দিয়ে যান। সেসময় আমার কাছে এক টাকার মূল্য প্রায় লাখ টাকার সমান ছিল। আর নানুর পাওয়া সেই একশোটাকায় আমি সম্ভবত একশোটারও বেশি স্বপ্ন কিনেছিলাম। আজ আমাদের মাঝে নানু আর নেই। মনে হচ্ছে গেল ক'দিন আগেই নানুর সাথে আমার এসব ঘটেছে।"

ভাইবোন মিলে গল্প করেই সেদিনের বিকেল ফুরিয়ে এলো। সন্ধ্যার আজান হলে মসজিদে চলে গেলাম। ঠিক সেদিনের সন্ধ্যায় সজিবের কাছে মিলা একটি উপহার বক্স পাঠিয়েছে।
মসজিদের পাশে একটি বেঞ্চিতে বসে সজিবকে নিয়ে বক্সটা খুলে দেখলাম।

বক্সে ছিলো সুতোয় গাঁথা একটি বকুলের মালা। একটি চিরকুট। প্রথম আলো পত্রিকার একটি সংবাদের টুকরো কাগজ।

মিলা চিরকুটে লিখেছে,

"প্রিয় নাঈম....
আসলে আমার কোনদিনও বিয়ে হয়নি। বাচ্চাটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আমার বাচ্চার রহস্যটা পত্রিকার কাগজটুকো পড়ে নিলেই জেনে যাবে। আমার পূর্বের স্বামী মন্দ ছিল বলে যে চরিত্র তোমার কাছে সাজিয়ে ছিলাম! সেই চরিত্র না সাজালে আমার সমাজ আমার কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটাকে জারজ ট্যাগ দিয়ে প্রতিনিয়ত আঘাত দিতো। তার বেঁচে থাকার ভুবনটা সুশোভিত করতেই নিজের জীবনকে কাগজের ফুলে রূপান্তরিত করেছিলাম। যেই ফুলের কোন গন্ধ নেই, কোন মূল্য নেই, কোন সুভাসও নেই।
প্রমাণ দেখো! এমন গ্লানির জীবন তুমিও মেনে নিতে পারলেনা।

আচ্ছা আমার কথা থাকুক। সেদিন মেয়ের স্কুলের সবার অনুরোধ ছিল মেয়ের বাবাকে নিয়ে যেতাম। আমি বলেছিলাম মেয়ের বাবা বিদেশে থাকে। দেশে ফিরেছো, এই আশায় তাদের আশা দিয়েছিলাম তুমি আসবে। আমার মেয়ে তোমাকে বাবা বলে ডাকবে।
কি যে অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার মেয়েটা বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথেছিল তোমায় পরাবে বলে! আমি আর লিখতে পারছিনা। চোখের জলের কাছে আমার অনুভূতি পরাজিত হয়ে গেছে। আজও যে মালাটা দিয়েছি! এটা আমার মেয়ের হাতেই গাঁথা। আমাকে পরাবে বলে গেঁথেছিল।

তোমার প্রিয় একটি গান খুব মনে পরছে গত ক'দিন যাবত। তোমার মনে আছে কিনা জানিনা।
পড়ে দেখো সবটুকোই লিখে দিলাম। সম্ভবত কবে কোথায় আমাকে শুনিয়েছিলে তোমার মনে পরে যাবে,,,

সাবস্ক্রাইব করুন:

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই,
কেন মনে রাখো তা’রে।
ভুলে যাও মোরে, ভুলে যাও একেবারে।

আমি গান গাহি আপনার দুঃখে,
তুমি কেন আসি’ দাঁড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর নিশীথ –অন্ধকারে।

দয়া কর, মোরে দয়া কর,
আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা,
শত কাঁদিলেও ফিরিবেনা প্রিয়, শুভ লগনের বেলা।

আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি!
তবু চোখে কেন সজল মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোনোদিন এসে’ দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে??

কি মনে পরলো! যদি মনে পরে থাকে তবে গানটা শুনিও। আমার মেয়ের আজ থেকে আর বাবাও নেই মা ও নেই। আমি কাগজের ফুল আজ নিজেকে নিজেই ধ্বংস করে দিলাম। তোমার বিয়ের দিন একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেটাও পড়ে নিও। চিঠির দ্বিতীয় পাতার তৃতীর পৃষ্ঠায় লিখা আছে। ভালো থেকো।"

মিলার চিঠিটা পড়ে চোখ দু'টো ঝাপ্সা হয়ে এলো। সজিবকে তাৎক্ষণিক মিলার বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে মিলা সুইসাইড করেছে কিনা খবর নিতে পাঠালাম। সজিব রাত দশটায় ফোন করে বলল,

"মিলাকে পোস্টমর্টেম করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাল সকালে বিনা জানাযায় মিলার শেষ বিদায় দেয়া হবে বহ্মপুত্র নদের দ্বারের একটি ঝুপড়ি গভীর কবরে।"

খবরটা শুনে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। নতুন বউয়ের সামনে অজানা রহস্য নিয়ে কান্নাকাটিও করা যায়না। তবুও লুকিয়ে লুকিয়ে বেশকিছুক্ষণ কেঁদেছিলাম।

আজ মিলার নবম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। এদিকে কিছুদিন আগে নয়ন্তীর সাথে সাথে আমার বিয়ের নবম বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠান করেছিলাম। আমি আজও বাবা হতে পারিনি। নয়ন্তী সেদিন ঘুমের ঘোরে আমার বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপানো কান্নায় আমাকে বলল,

"নাঈম! আমাকে একটা মেয়ে বাচ্চা কিনে এনে দিবা? আমি তার নাম রাখবো 'নিয়তি'।"

লিখা - Md Marufur Rahman
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url