গল্পঃ আনন্দ অশ্রু
তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে পিচগলা রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে চলার মাঝে কোন আনন্দ নেই । হয়তো আনন্দ আছে, কিন্তু আমি সেটা খুঁজে পাচ্ছি না । সবাই সব কিছুর মাঝে আনন্দ খুঁজে পায় না । যদি খুজেই পেত, তাহলে এই পৃথিবীতে দুঃখী মানুষ বলে কেউ থাকতো না । সবাই ভোগ করতো অনাবিল সুখ । সে যাই হোক......আমাকে এখন তপ্ত রোদ মাথায় নিয়েই পিচগলা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হচ্ছে । কারণ, আমার পায়ের একটি স্যান্ডেল কিছুক্ষণ আগেই আমাকে বহন করতে অপারগ হয়ে তার ফিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে । তাই, এখন তাকে হাতে নিয়েই আমার এগিয়ে চলা । বেকার মানুষ, চাকরি বাকরি নাই। একজোড়া স্যান্ডেল সেলাই করার টাকা যোগাতেও মাথার ঘাম পায়ে গিয়ে জমা হয়।
দুপুরের তপ্ত রোদে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মেজাজটা ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করেছে। ভুল হয়েছে, সকালবেলা ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কিছু টাকা নেয়া দরকার ছিল। তাহলে অন্তত স্যান্ডেলটা সেলাই করা যেতো।এখন পকেটে আছে মাত্র ১৫ টাকা। এদিকে খিদেও লেগেছে প্রচণ্ড। দেখা যাক,৫ টাকায় স্যান্ডেল সেলাই করে বাকি ১০ টাকায় হালকা কিছু খাওয়া যায় কিনা। এই চিন্তা করতে করতে আবার সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
মানুষজন কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমার দিকে তাকাচ্ছে । কারণ, স্যান্ডেল থাকতে তা হাতে নিয়ে খালি পায়ে তপ্ত রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোটা নিশ্চয় পাগলের কাজ । অনেকে আবার ব্যাপারটা কিছুটা হাস্যকর দৃষ্টিতে দেখছে ।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি, মোবাইলটাও রেখে এসেছি। ভালো হয়েছে, আজকে ফোন করে কারো আর পাওয়া লাগবে না আমাকে। মেজাজ খারাপ থাকার মুহূর্তগুলোতে কেউ ফোন দিলে বিরক্তিটা আরও জেঁকে বসে। বিরক্তি বাড়ানোর থেকে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখাটাই উত্তম।
অবশ্য আমি জানি, কিছুক্ষন পরেই একজন আমাকে একটা গরু খোঁজা দিবে। দিলে দিক, আমার কি? আমার তো কোনও দোষ নেই । আমি কি ইচ্ছা করে ঝগড়া করেছি নাকি ...... গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুলে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে , আজকে কত তারিখ ? তখন মেজাজটা কেমন লাগে ...... সেতু আপার এইরকম আজব ব্যাবহারে মাঝে মাঝে চরম বিরক্তি লাগে । সেই বিরক্তিকর অনুভূতির পরিসমাপ্তি ঘটে বিশাল রকমের ঝগড়ার মধ্য দিয়ে ।
আজকে সকালবেলা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার মাধ্যমে সেই ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছে । তারপর , সবসময়ের মতই ঝগড়ার রেশ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত হয়েছে আম্মার মাঝে । সেই প্রবাহের গতিবেগ মাঝে মাঝে দুপুরের আগেই থেমে যায় । কিন্তু , আজ দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরও প্রবাহের গতিবেগ আগের মতই বয়ে যাচ্ছিলো । শেষপর্যন্ত কোনও উপায় না পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভরদুপুরের ফাঁকা রাস্তায় ।
ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটতে ভালোই লাগছে । কিন্তু , পেটের ক্ষুধার আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সেই ভালো লাগা ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে ।
একটা মুচির দোকানে স্যান্ডেলটা সেলাই করে রাস্তার পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসতেই শুভ্রর সাথে দেখা । এলাকার ছোট ভাই । খুবই ভদ্র টাইপের একটা ছেলে ।
-ভাইয়া , কেমন আছেন ?
-এইতো ভালোই । তুমি কেমন আছো ? লেখাপড়ার কি অবস্থা ?
-আমিতো ভাইয়া গত বছর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি । এখন আপাতত একটা প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করেছি । পরবর্তীতে আরও ভালো কোন চাকরি পেলে এটা ছেড়ে দেবো ।
নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিলো । আমার থেকে কয়েক বছরের জুনিয়র একটা ছেলে চাকরি করছে , আর আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ২ বছর ধরে বেকার বসে আছি । একেই বলে ভাগ্য ।
-ভাইয়া , আমি আজকে যাই । আজ তো ৩১ তারিখ । মাসের শেষ দিন । তাই ,অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি । আরেকদিন আপনার সাথে কথা বলবো ।
-হ্যাঁ । অবশ্যই ।
আজ ৩১ তারিখ । কথাটা শোনার পর থেকে মাথাটা একটু ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে । তারিখটাকে কেন জানি অনেক বেশি পরিচিত বলে মনে হচ্ছে ।
পেটের ক্ষুধার কারণে ৩১ তারিখের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম । চা খেতে খেতে সেতু আপার কথা প্রবলভাবে মনে হচ্ছিলো । হয়ত আমাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে এখন মুখ ভোতা করে বসে আছে । ও ছোটবেলা থেকেই এইরকম । আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে আর অনেক বেশি শাসন করে । বেশি শাসন করার কারণেই ওর সাথে আমার ঝগড়াটাও বেশি হয় । আর মাঝে মাঝে ওর কিছু আজব ব্যাবহারের কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । যেমন , আজকের তারিখ জিজ্ঞেস করার ব্যাপারটা ।
সাবস্ক্রাইব করুন:
সেতু আপার সাথে সবসময়ই ঝগড়া করি । কিন্তু , তবুও আমাকে যদি আমার জীবনের সেরা বন্ধুর নাম বলতে বলা হয় , তাহলে আমি সেতু আপার নামটাই বলবো । মফঃস্বল শহরে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে , এখনও কেমন জানি ফুরফুরে লাগে । সেতু আপার সাথে সকালবেলা ফুল কুঁড়াতে যাওয়া , বৃষ্টির দিনে মাছ ধরতে যাওয়া ...... রঙিন সেই দিনগুলো আজ সাদাকালো হয়ে গেছে ।
একদিন মাছ ধরতে গিয়েই ভালোবাসার সংজ্ঞাটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম ।
মাছ ধরার সময় পা কেটে যাওয়ায় , সেতু আপা যখন নিজের অনেক প্রিয় সালোয়ার-কামিজের ওড়নাটা দুই ভাগে ছিরে আমার পায়ে বেঁধে দিয়ে বলেছিল , ‘ওড়না ছিরে গেলে ওড়না পাওয়া যাবে । কিন্তু , আমার ভাইয়ের পা ছিরে গেলে তো আর পাওয়া যাবে না’ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম ভালোবাসা কাকে বলে .........
বাবার শহরে বদলী হয়ে আসার কারণে আমাদেরকেও ছেড়ে আসতে হয়েছিলো ছোটবেলার প্রিয় সেই মফঃস্বল শহরটাকে । ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক জীবনকে সঙ্গী করে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো । কলেজ লাইফ শেষ করে ভার্সিটির গণ্ডিতে পা রাখলাম । আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি , তখন সেতু আপার বিয়ে হয়ে যায় । সেতু আপার চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না । বাসায় থাকলেই ওর শূন্যতাটা অনুভব করতাম । কিন্তু , কি আর করা ...... বাস্তবতাটাকে তো মেনে নিতেই হবে ।
এরই মাঝে আমার জীবনে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা । সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমার স্বপ্ন বোনার সাথী হিসেবে আবির্ভাব হয় অর্থী নামের একটি মেয়ের । কীভাবে যে ওকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম তা নিজেই জানিনা ।
কিন্তু , হঠাৎ করেই ওলটপালট করে দেয়া একটা ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যেতে থাকে সবকিছু । এক্সিডেন্টে বাবার প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া , যৌতুকের সব টাকা দিতে না পারায় সেতু আপার সংসারের অশান্তি , অর্থীর বিয়ে হয়ে যাওয়া ...... কেমন জানি ঘোরের মধ্য দিয়ে ঘটতে থাকে ঘটনাগুলো আর মিলিয়ে যেতে থাকে আমার সব স্বপ্ন ।
অর্থীর কথা এখনও মাঝে মাঝেই মনে হয় । আসলে , আমার সাথে ওর সুন্দর জীবনটা না জড়িয়ে হয়ত ভালোই করেছি । তা না হলে ওকেও আমার সাথে দুঃখের ঘানি টানতে হত ।
সেতু আপার ডিভোর্স হয়ে গেছে প্রায় এক বছর হতে চললো । ও এখন আমাদের সাথেই থাকে ।
অর্থীর স্মৃতি , সেতু আপার দুঃখে ভরা মুখ , আম্মার চোখের জল , প্যারালাইসিস বাবার চিকিৎসা আর আমার বেকার জীবনের কথা মনে হলে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না । ইচ্ছে হয় পাখির মত ডানা মেলে দূর অজানায় হারিয়ে যেতে ......
-ভাইজান , আপনার চা তো ঠাণ্ডা হইয়া গেছে । আরেক কাপ বানাইয়া দেই ?
চায়ের দোকানের পিচ্চি ছেলেটার কথায় চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম ।
আরেক কাপ চা খেতে হলে আরও ৬ টাকা দরকার । কিন্তু , জুতা সেলাই করার পর পকেটে আছে ১০ টাকা । যার মধ্য থেকে ৬ টাকা দিয়ে দিতে হবে আগের এক কাপ চায়ের জন্য । তাই , আরও এক কাপ চা খাওয়া মোটেই সম্ভব নয় ।
-না থাক । আরেক কাপ চায়ের দরকার নেই ।
ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে দ্রুত চুমুক দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায় ।
বিভিন্ন রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরির পর , যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ছায়া নামতে শুরু করেছে তখন বাসার দিকে পা বাড়ালাম ।
‘বাসায় গিয়ে এখন যতটা সম্ভব নীরব থাকতে হবে । তারপর অবস্থা অনুকূলে আসলে আম্মা আর আপার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে । না হলে আবার ঝগড়া লেগে যেতে পারে’ । কথাগুলো মনে মনে চিন্তা করতে করতে বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম ।
মেইন গেইটটা খুলে ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকলাম । কাউকেই দেখতে পেলাম না । কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে । সন্ধ্যা হতে চলেছে , তবুও একটা রুমেও লাইট জ্বালানো দেখতে পেলাম না । এইরকম থমথমে পরিস্থিতির কারণটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে যেই লাইটটা জ্বালাতে যাবো , তখনই কয়েকটা মোমবাতি জ্বলে উঠলো । মোমবাতির আলোয় আম্মা আর আপাকে স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম । আর , সোফায় বসে বাবা তার অবশ শরীরটাকে দুলুনি দিয়ে হাসতে চেষ্টা করছে , সেটাও বোঝা যাচ্ছিলো । মোমবাতিগুলোর মাঝে যে একটা ছোট কেক আছে , সেটা এতক্ষণে লক্ষ করলাম ।
সেতু আপা একটা মোমবাতি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো ।
-সকালবেলা থেকে তো ঘুম ভাঙানো নিয়ে খুব ঝগড়া করলি । এখন কি বুঝতে পেরেছিস , কেন তোকে ঘুম থেকে ডেকে আজকের তারিখটা জিজ্ঞেস করেছিলাম । গাধা , আজ তোর জন্মদিন । সেই কখন থেকে তোর জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক নিয়ে বসে আছি । আয় , এখন রাগ কমিয়ে কেক কাট ।
যেই মানুষগুলোর সাথে আমি সবসময়ই ঝগড়া করি , যেই মানুষগুলোকে ছেড়ে আমি দূর অজানায় হারিয়ে যেতে চাই ...... সেই মানুষগুলোই আমাকে এতো ভালোবাসে । চোখের জল আর বাঁধা মানলো না । গড়িয়ে পড়তে থাকলো গাল বেঁয়ে । কিন্তু , এই জল দুঃখের জল নয় ...... আনন্দের জল , ভালোবাসার জল .........
সাবস্ক্রাইব করুন:
By- Nafi Sykes Sami
দুপুরের তপ্ত রোদে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মেজাজটা ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করেছে। ভুল হয়েছে, সকালবেলা ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কিছু টাকা নেয়া দরকার ছিল। তাহলে অন্তত স্যান্ডেলটা সেলাই করা যেতো।এখন পকেটে আছে মাত্র ১৫ টাকা। এদিকে খিদেও লেগেছে প্রচণ্ড। দেখা যাক,৫ টাকায় স্যান্ডেল সেলাই করে বাকি ১০ টাকায় হালকা কিছু খাওয়া যায় কিনা। এই চিন্তা করতে করতে আবার সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
মানুষজন কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমার দিকে তাকাচ্ছে । কারণ, স্যান্ডেল থাকতে তা হাতে নিয়ে খালি পায়ে তপ্ত রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোটা নিশ্চয় পাগলের কাজ । অনেকে আবার ব্যাপারটা কিছুটা হাস্যকর দৃষ্টিতে দেখছে ।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি, মোবাইলটাও রেখে এসেছি। ভালো হয়েছে, আজকে ফোন করে কারো আর পাওয়া লাগবে না আমাকে। মেজাজ খারাপ থাকার মুহূর্তগুলোতে কেউ ফোন দিলে বিরক্তিটা আরও জেঁকে বসে। বিরক্তি বাড়ানোর থেকে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখাটাই উত্তম।
অবশ্য আমি জানি, কিছুক্ষন পরেই একজন আমাকে একটা গরু খোঁজা দিবে। দিলে দিক, আমার কি? আমার তো কোনও দোষ নেই । আমি কি ইচ্ছা করে ঝগড়া করেছি নাকি ...... গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুলে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে , আজকে কত তারিখ ? তখন মেজাজটা কেমন লাগে ...... সেতু আপার এইরকম আজব ব্যাবহারে মাঝে মাঝে চরম বিরক্তি লাগে । সেই বিরক্তিকর অনুভূতির পরিসমাপ্তি ঘটে বিশাল রকমের ঝগড়ার মধ্য দিয়ে ।
আজকে সকালবেলা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার মাধ্যমে সেই ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছে । তারপর , সবসময়ের মতই ঝগড়ার রেশ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত হয়েছে আম্মার মাঝে । সেই প্রবাহের গতিবেগ মাঝে মাঝে দুপুরের আগেই থেমে যায় । কিন্তু , আজ দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরও প্রবাহের গতিবেগ আগের মতই বয়ে যাচ্ছিলো । শেষপর্যন্ত কোনও উপায় না পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভরদুপুরের ফাঁকা রাস্তায় ।
ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটতে ভালোই লাগছে । কিন্তু , পেটের ক্ষুধার আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সেই ভালো লাগা ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে ।
একটা মুচির দোকানে স্যান্ডেলটা সেলাই করে রাস্তার পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসতেই শুভ্রর সাথে দেখা । এলাকার ছোট ভাই । খুবই ভদ্র টাইপের একটা ছেলে ।
-ভাইয়া , কেমন আছেন ?
-এইতো ভালোই । তুমি কেমন আছো ? লেখাপড়ার কি অবস্থা ?
-আমিতো ভাইয়া গত বছর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি । এখন আপাতত একটা প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করেছি । পরবর্তীতে আরও ভালো কোন চাকরি পেলে এটা ছেড়ে দেবো ।
নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিলো । আমার থেকে কয়েক বছরের জুনিয়র একটা ছেলে চাকরি করছে , আর আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ২ বছর ধরে বেকার বসে আছি । একেই বলে ভাগ্য ।
-ভাইয়া , আমি আজকে যাই । আজ তো ৩১ তারিখ । মাসের শেষ দিন । তাই ,অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি । আরেকদিন আপনার সাথে কথা বলবো ।
-হ্যাঁ । অবশ্যই ।
আজ ৩১ তারিখ । কথাটা শোনার পর থেকে মাথাটা একটু ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে । তারিখটাকে কেন জানি অনেক বেশি পরিচিত বলে মনে হচ্ছে ।
পেটের ক্ষুধার কারণে ৩১ তারিখের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম । চা খেতে খেতে সেতু আপার কথা প্রবলভাবে মনে হচ্ছিলো । হয়ত আমাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে এখন মুখ ভোতা করে বসে আছে । ও ছোটবেলা থেকেই এইরকম । আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে আর অনেক বেশি শাসন করে । বেশি শাসন করার কারণেই ওর সাথে আমার ঝগড়াটাও বেশি হয় । আর মাঝে মাঝে ওর কিছু আজব ব্যাবহারের কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । যেমন , আজকের তারিখ জিজ্ঞেস করার ব্যাপারটা ।
সাবস্ক্রাইব করুন:
সেতু আপার সাথে সবসময়ই ঝগড়া করি । কিন্তু , তবুও আমাকে যদি আমার জীবনের সেরা বন্ধুর নাম বলতে বলা হয় , তাহলে আমি সেতু আপার নামটাই বলবো । মফঃস্বল শহরে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে , এখনও কেমন জানি ফুরফুরে লাগে । সেতু আপার সাথে সকালবেলা ফুল কুঁড়াতে যাওয়া , বৃষ্টির দিনে মাছ ধরতে যাওয়া ...... রঙিন সেই দিনগুলো আজ সাদাকালো হয়ে গেছে ।
একদিন মাছ ধরতে গিয়েই ভালোবাসার সংজ্ঞাটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম ।
মাছ ধরার সময় পা কেটে যাওয়ায় , সেতু আপা যখন নিজের অনেক প্রিয় সালোয়ার-কামিজের ওড়নাটা দুই ভাগে ছিরে আমার পায়ে বেঁধে দিয়ে বলেছিল , ‘ওড়না ছিরে গেলে ওড়না পাওয়া যাবে । কিন্তু , আমার ভাইয়ের পা ছিরে গেলে তো আর পাওয়া যাবে না’ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম ভালোবাসা কাকে বলে .........
বাবার শহরে বদলী হয়ে আসার কারণে আমাদেরকেও ছেড়ে আসতে হয়েছিলো ছোটবেলার প্রিয় সেই মফঃস্বল শহরটাকে । ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক জীবনকে সঙ্গী করে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো । কলেজ লাইফ শেষ করে ভার্সিটির গণ্ডিতে পা রাখলাম । আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি , তখন সেতু আপার বিয়ে হয়ে যায় । সেতু আপার চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না । বাসায় থাকলেই ওর শূন্যতাটা অনুভব করতাম । কিন্তু , কি আর করা ...... বাস্তবতাটাকে তো মেনে নিতেই হবে ।
এরই মাঝে আমার জীবনে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা । সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমার স্বপ্ন বোনার সাথী হিসেবে আবির্ভাব হয় অর্থী নামের একটি মেয়ের । কীভাবে যে ওকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম তা নিজেই জানিনা ।
কিন্তু , হঠাৎ করেই ওলটপালট করে দেয়া একটা ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যেতে থাকে সবকিছু । এক্সিডেন্টে বাবার প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া , যৌতুকের সব টাকা দিতে না পারায় সেতু আপার সংসারের অশান্তি , অর্থীর বিয়ে হয়ে যাওয়া ...... কেমন জানি ঘোরের মধ্য দিয়ে ঘটতে থাকে ঘটনাগুলো আর মিলিয়ে যেতে থাকে আমার সব স্বপ্ন ।
অর্থীর কথা এখনও মাঝে মাঝেই মনে হয় । আসলে , আমার সাথে ওর সুন্দর জীবনটা না জড়িয়ে হয়ত ভালোই করেছি । তা না হলে ওকেও আমার সাথে দুঃখের ঘানি টানতে হত ।
সেতু আপার ডিভোর্স হয়ে গেছে প্রায় এক বছর হতে চললো । ও এখন আমাদের সাথেই থাকে ।
অর্থীর স্মৃতি , সেতু আপার দুঃখে ভরা মুখ , আম্মার চোখের জল , প্যারালাইসিস বাবার চিকিৎসা আর আমার বেকার জীবনের কথা মনে হলে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না । ইচ্ছে হয় পাখির মত ডানা মেলে দূর অজানায় হারিয়ে যেতে ......
-ভাইজান , আপনার চা তো ঠাণ্ডা হইয়া গেছে । আরেক কাপ বানাইয়া দেই ?
চায়ের দোকানের পিচ্চি ছেলেটার কথায় চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম ।
আরেক কাপ চা খেতে হলে আরও ৬ টাকা দরকার । কিন্তু , জুতা সেলাই করার পর পকেটে আছে ১০ টাকা । যার মধ্য থেকে ৬ টাকা দিয়ে দিতে হবে আগের এক কাপ চায়ের জন্য । তাই , আরও এক কাপ চা খাওয়া মোটেই সম্ভব নয় ।
-না থাক । আরেক কাপ চায়ের দরকার নেই ।
ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে দ্রুত চুমুক দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায় ।
বিভিন্ন রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরির পর , যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ছায়া নামতে শুরু করেছে তখন বাসার দিকে পা বাড়ালাম ।
‘বাসায় গিয়ে এখন যতটা সম্ভব নীরব থাকতে হবে । তারপর অবস্থা অনুকূলে আসলে আম্মা আর আপার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে । না হলে আবার ঝগড়া লেগে যেতে পারে’ । কথাগুলো মনে মনে চিন্তা করতে করতে বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম ।
মেইন গেইটটা খুলে ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকলাম । কাউকেই দেখতে পেলাম না । কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে । সন্ধ্যা হতে চলেছে , তবুও একটা রুমেও লাইট জ্বালানো দেখতে পেলাম না । এইরকম থমথমে পরিস্থিতির কারণটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে যেই লাইটটা জ্বালাতে যাবো , তখনই কয়েকটা মোমবাতি জ্বলে উঠলো । মোমবাতির আলোয় আম্মা আর আপাকে স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম । আর , সোফায় বসে বাবা তার অবশ শরীরটাকে দুলুনি দিয়ে হাসতে চেষ্টা করছে , সেটাও বোঝা যাচ্ছিলো । মোমবাতিগুলোর মাঝে যে একটা ছোট কেক আছে , সেটা এতক্ষণে লক্ষ করলাম ।
সেতু আপা একটা মোমবাতি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো ।
-সকালবেলা থেকে তো ঘুম ভাঙানো নিয়ে খুব ঝগড়া করলি । এখন কি বুঝতে পেরেছিস , কেন তোকে ঘুম থেকে ডেকে আজকের তারিখটা জিজ্ঞেস করেছিলাম । গাধা , আজ তোর জন্মদিন । সেই কখন থেকে তোর জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক নিয়ে বসে আছি । আয় , এখন রাগ কমিয়ে কেক কাট ।
যেই মানুষগুলোর সাথে আমি সবসময়ই ঝগড়া করি , যেই মানুষগুলোকে ছেড়ে আমি দূর অজানায় হারিয়ে যেতে চাই ...... সেই মানুষগুলোই আমাকে এতো ভালোবাসে । চোখের জল আর বাঁধা মানলো না । গড়িয়ে পড়তে থাকলো গাল বেঁয়ে । কিন্তু , এই জল দুঃখের জল নয় ...... আনন্দের জল , ভালোবাসার জল .........
সাবস্ক্রাইব করুন:
By- Nafi Sykes Sami