গল্পঃ প্রবাসী ভালোবাসা

প্যারিসের কোন এক আর্ট গ্যালারিতে লেনার সাথে পরিচয়। আমি তখন প্যারিসেই ফটোগ্রাফির উপর একটা কোর্স করতেছি। নিরামিষ জীবন, কত আর সুন্দরী ললনা দেখা যায় ! টাইম পাস করতে সন্ধ্যার পর বের হতাম আর্ট গ্যালারী ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে বোর হলে যেতাম নাইটক্লাব এ। তখন লুভর এর পাশের আর্ট গ্যালারীতে এক ইতালীয় চিত্রশিল্পীর প্রদর্শনী চলতেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে গেলাম দেখতে। চিত্রকর্ম দেখে যারপরনাই হতাশ,ফিরতে যাবো এমন সময় পিছন থেকে ডাক “হ্যালো মিস্টার, ইউ ফরগেট সামথিং”
প্রথমেই যা অনুভব করলাম তা হল অনেক দিন পর অনেক সুন্দর ইংরেজি শুনলাম এবং কণ্ঠটি খুবই সুমিষ্ট ।
সেই পরিচয়। কথা হল, বন্ধুত্ব হল, জানাশোনা হল। কথায় কথায় জানলাম তার নাম লেনা। বাবা মা কার এক্সিডেন্ট এ মারা গেছেন প্রায় দশ বছর। ভাইবোন নেই। আপন বলতেও তেমন কেও নেই,এক দূরসম্পর্কের চাচার বাসায় থাকে। দয়ামায়া আবেগ জিনিষ গুলো আমার মধ্যে সীমিত পরিমাণ। তারপরও খুবই খারাপ লাগলো ওর কথা শুনে। আমার নিজের পরিচয় দিলাম।পরে ওর সাথে দেখা করার জন্য প্লেস, টাইম ঠিক করে বিদায় নিলাম।

লেনাকে প্রথম দেখার পর থেকেই ওর প্রেমে পরে গেলাম। কিভাবে কি হল আমার বোধগম্য না। লেনার ব্লন্ড হেয়ার এর প্রেমে পরলাম , নাকি অদ্ভুত সুন্দর নীল নয়নের প্রেমে পরলাম, নাকি সুন্দর মার্জিত ইংরেজির প্রেমে পরলাম কিছুই বুঝলাম না। আরও দেখা করতে চাই, আরও বেশী এই মেয়েকে জানতে চাই এইধরনের তাগিদ পেলাম মন থেকে। প্রকৃতির নিয়মেই আবার দেখা হল লেনার সাথে, দেখা হতেই থাকলো। পরের সাক্ষাতেই খুব ভালোমতো প্রশ্ন করে জেনে নিলাম সে সিঙ্গেল না এঙ্গেজড। গ্রিন সিগন্যাল পেলাম, উত্তর আমার অনুকূলে। আমার নিজের তেমন কিছু বলার নেই, আমি মুগ্ধ স্রোতা । ওর ভালো লাগা মন্দ লাগা, পছন্দ অপছন্দ মেমোরিতে ইন্সটল করতে থাকলাম।

লেনা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বাচ্চাদের একটা কিন্ডারগার্টেন এ পড়াত তখন। মোটামুটি ফ্রিই বলা চলে। ওর ক্লাসের পর দুজন বের হতাম। কোনদিন অপেরা, কোনদিন ক্যাফে,কোনদিন আর্ট গ্যালারি ... উড়ে চললো সময়।

লেনার কিছু স্বভাবগত বৈশিষ্টের কথা বলা দরকার। অসম্ভব ফান লাভিং একটা মেয়ে,নিজে প্রচুর মজা করে অন্যকে ও অনেক মজা দেয়। ভীষণ রকম চঞ্চল,বাচাল। কিন্তু সাধারন মেয়ের মতো ও না। মাসের অর্ধেক সময় তাকে বিছানায় পরে থাকতে হয়। সাইনোসাইটিস আর মাইগ্রেন এর সমস্যায় প্রচুর ভুগতে হতো বেচারিকে।একটা ব্যাপারে আমি বেশ অবাক হতাম, এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড না থাকার তো কোন কারন নাই!! পরে বুঝতে পারলাম অনেক ছেলেই ওর জন্য পাগল কিন্তু আসলে ও একটু আলাদা। ছেলেদের সাথে প্রচুর মিশবে, হাসবে ,হাসাবে কিন্তু রিলেশন ওকে দিয়ে হবে না। ও আসলে রিলেশন করা টাইপ মেয়ে না।

সাবস্ক্রাইব করুন:

আমাদের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হল। তবে তা বন্ধুত্তের মাঝেই সীমাবদ্ধ। ওর কোনকিছুই আমার অজানা নয়, আমার কোনকিছুই ওর অজানা নয়।একদিন আকারে ইঙ্গিতে বললাম ওর মতো মেয়ে পেলে বিয়ে করবো। ও বেশ হাসলো এই কথা শুনে।ওর বিয়ে নিয়ে কি চিন্তা ভাবনা জিজ্ঞেস করলাম।ফ্যামিলি যার সাথে বিয়ে দেয় তাকেই বিয়ে করবে বলে জানালো। আমি তো অবাক, প্যারিসেও এই ধরনের মন মানসিকতার মেয়ে আছে!
আমার কোর্স তখন অর্ধ সমাপ্ত। ঠিক করলাম প্রপোজ করে ফেলবো,যা থাকে কপালে।এক সন্ধায় প্রপোজ করেও ফেললাম, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব “will u marry me?”. আমার ধারনা ছিল ও হয়তো সময় চাইবে চিন্তা ভাবনা করার জন্য।কিন্তু ও সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলল, আমরা দুইটা আলাদা সংস্কৃতির মানুষ, ভাষা আলাদা, ধর্মও আলাদা।আমাকে জীবনসঙ্গী করা ওর পক্ষে সম্ভবপর না। কষ্ট পেলাম অনেক, ওকে বুঝতেও দিলাম না। লেনা বলল আমরা খুবই ভাল বন্ধু, তাই সে থাকতে চায়। আমরা এই ঘটনা ভুলে যাবো, কেউই মনে রাখবো না। ও ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারলাম না। ওর সঙ্গ আমার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ালো। প্রপোজ করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাকে আর বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না।প্যারিস আমার জন্য নরক হয়ে দাঁড়ালো। পালিয়ে বাঁচতে চাইলাম।বিদায় নেওয়ার আগে ওর সাথে শেষ দেখা করলাম।অজুহাত একটা দিতে হয়, বেশ ভালই অজুহাত দিলাম-দেশে আমার মা অসুস্থ,আমাকে দেখতে চায়।দুইজনেই বুঝতে পারলাম এরচে ভালো জোকস কেও কোনদিন বলিওনি শুনিওনি। ও বলল তোমার কোর্সের কি হবে? আমি বললাম ওটা আমি দেশেই কমপ্লিট করে নিব।আমি যে চিরতরে বিদায় নিতে যাচ্ছি তা বেশ ভালই বুঝিয়ে দিলাম। ওর চোখে কষ্টের ছায়া দেখলাম। কষ্টের আড়ালে আমার জন্য ভালবাসাও দেখলাম। ওর মনে হয় অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু কিছুই বললো না বা বলতে পারলো না।বন্ধুত্তের দাবিতে শেষ অনুরোধ হিসেবে থেকে যেতে বলল। আমার এয়ার টিকেট কনফার্ম, খামাখা ইমোশনের ফালতু মায়ায় জড়ালাম না। লেনার সব কন্টাক্ট নিয়ে আমার গুলো দিয়ে বন্ধুত্তের কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিদায় নিলাম।

দেশে ফিরে কোনরকম কন্টাক্ট রাখবো না সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু বেশিদিন খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারলাম না, ভালো তো বাসি। মেইল চেক করতে গিয়ে লেনার অজস্র মেইল এর সন্ধান পেলাম। রিপ্লাই দিবো না দিবো না ভেবেও দুই চারটার দিয়ে দিলাম। সব মেইলেই আমার কুশলাদি, আমার পরিবারের খোঁজ জানতে চেয়েছে, আমাকে অনেক মিস করে তাও বলেছে। দুই একটা মেইল পেলাম যাতে লিখেছে সে আমাকে ডিসারভ করে না, আমি তারচেয়েও অনেক ভাল মেয়ে পাবো লাইফ পার্টনার হিসেবে। হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারলাম না।রিপ্লাই দিলাম- তোমাকে পাবো না জেনেই ভালবেসেছি, ডিসারভ এর প্রশ্ন অমূলক।বাঙ্গালি তরুণরা আর কিছু পারুক না পারুক তারা হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে জানে, পাবার আশা না করেই।

সময়ের সাথে সাথে মানুষ সব ভুলে যায়। আমিও ভুলে গেলাম,মাঝে মাঝে যে মনে পড়তো না, তা না। সহ্য করে নিলাম সবই। কোনধরনের কন্টাক্ট রাখলাম না প্রায় ৫ মাস। হটাত ফ্রান্সে থাকা আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেলাম লেনা হাসপাতালে অ্যাডমিট,ব্রেইন কান্সার।আমার সাথে কথা বলতে চায়।

আবার দৌড়ালাম পারিস, ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানলাম লেনা আর বেশীদিন নেই। ডাক্তার আমাকে মেডিক্যাল রিপোর্ট গুলা দেখালো, প্রথম থেকেই উনি চিকিৎসা করতেছেন বললেন, এখন লাস্ট ষ্টেজ। আর বড়োজোর এক সপ্তাহ।

লেনার সাথে দেখা হল। আগের চঞ্চলতা বিলুপ্ত।আমাকে দেখেই কেঁদে ফেলল।আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মত ফোঁপাতে শুরু করল। কান্না কিছুটা কমে এলে বলল সেও আমাকে ভালবাসে। আমাকে তার সাথে জড়াতে চায় নি। তাই প্রকাশ করেনি কিছু। দুনিয়া অন্ধকার দেখলাম,কিছু বলার মত শক্তি খুঁজে পেলাম না।বুকের মধ্যে সিডর বইতে লাগলো। ওর কান্নায় আমার কান্নায় সব দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে গেলো।

নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল, ওর সবচেয়ে দরকারের সময় আমি ওকে ত্যাগ করেছি।নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করলাম, সবকিছু জানতে পারলে হয়তো এমন হতো না।

পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত।আমার প্যারিস যাওয়ার দশ দিনের মাথায় আমাকে ছেড়ে লেনা পরপারে পাড়ি জমালো। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করতে পারলাম না। লেনার পরিবারের সাথে দেখা করলাম,আমার জন্য রাখা অনেক গুলা গিফট আর ওর ডায়েরি নিলাম। এক বুক না পাওয়ার হতাশা আর যন্ত্রণা নিয়ে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করলাম।

সাবস্ক্রাইব করুন:

By- Fairuz Ahmed
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url