গল্পঃ সহযাত্রী

মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার চন্দ্র হাসে।
রাত সাড়ে তিন টার সময় তো আর কবিতার ছন্দ মেলাতে সূর্য উঠে বসে থাকবে না। তাই চাঁদ ই ভরসা। বেশ গোলগাল। মাঝে মাঝে কালো মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে।
সময়টা বর্ষাকাল, বর্ষাকালে এই দৃশ্য দুর্লভ নয়।
আকাশের রুপালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গরম এক কাপ চায়ে চুপুক, স্বপ্নকাতরতা জিনিসটা আমি ঠিক বুঝি না, তবু মনে হচ্ছে রাত সাড়ে তিন টায় বাসের এই যাত্রা বিরতির সময়টাতে আমি বোধহয় স্বপ্নকাতরই হয়ে গেছি কিছুটা। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চাঁদটার দিকে আর একবার তাকিয়ে চায়ের খালি কাপ টা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম দোকানদারের দিকে,

-আমি বোধহয় আপনার চায়ের বিলটা দিয়ে দিতে পারব। আপত্তি না থাকলে।

অকস্মাৎ এবং কিছুটা বোধহয় অযাচিত প্রস্তাব। যার কারনেই হয়তোবা কিছুটা চমকে যাওয়া। পরক্ষনেই কিছুটা লজ্জা এবং কিছুটা নিজের উপর রাগের কারনেই বোধহয় চুপ হয়ে যাওয়া। ঠিক চার সেকেন্ড পরে কথা বলতে পারল আমার সহযাত্রী।

-দেখুন আমার কাছে আসলেই পাঁচশ টাকার নোট ছাড়া আর খুচরা টাকা নেই। ভুলে গেছিলাম আমি। এখানে চা খাবার পর খেয়াল হল।
এটুকু বলেই আবারো বোধহয় নিজের বোকামির জন্যই নিজের উপর রেগে চুপ হয়ে যাওয়া।
-চা টা আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমি আর এক কাপ নিচ্ছি। আপনি?
-না, আপনি খান। আর বিলটা দেবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আমি আবার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চাঁদটাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পেলাম না। মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে।
মেয়েটা কেন জানি বাসে উঠে গেল না। আমার পাশে দাড়িয়ে রইল। ভদ্রতা করতে? কি জানি।
ভাগ্যিস মানুষ জেনেশুনে ভুল করে না। মেয়েটা যদি জানত সে জেনেশুনে এখানে দাড়িয়ে থেকে ভুল করছে তাহলেও কি দাড়িয়ে থাকতো? তাহলেও কি ভুল করত? সে যদি জানত আমার চা শেষ হবার আগেই বৃষ্টি শুরু হবে তাহলেও কি দাড়িয়ে থাকতো?
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘোষিত সময় অনুযায়ী আর দুই/তিন মিনিটের মধ্যেই আমাদের বাস আবার ছেড়ে যাবার কথা। চায়ের দামটা মিটিয়ে দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম।

-আসুন আমার সাথে, নয়তো বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন।

প্রাচীন যুগের সেই বিনিময় প্রথা আজও শেষ হয়নি তাহলে?
এক কাপ চা,ছয় টাকা। বিনিময়ে একই ছাতার নিচে হেঁটে যাওয়া কিছুটা পথ। বাসটা বেশ দূরে। পথটুকু খুব তাড়াতাড়ি ফুরাবে না। এই অবসরে এক পলক তাকালাম তার দিকে। এই মাত্র আকাশে চমকে ওঠা বিজলীটা যেন তার চোখে চিরন্তন হয়ে আছে। তবে নিষ্ঠুর নয়। কোমল।
বিজলির প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়েই বোধহয় আরও একটু কাছে সরে আসা। এক মুহূর্তেরও কম সময়ের জন্য হাতে হাত ছুয়ে যাওয়া। তাতেই তার চমকে ওঠা!

বাস চলতে শুরু করেছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে চাঁদটাও ছুটে চলেছে । চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার ছুটে চলেছে আমার ভাবনাও।
ওই একটুখানি ছোঁয়াতেই তার এমন চমকে ওঠা? এ কি শুধুই...?
কেনইবা এই ঘুমের মধ্যে নিজের অজান্তে আমার কাঁধে মাথা রাখা? নিজের অজান্তেই আমার উপর এমন নির্ভরতা? নিজের অজান্তেই নিজেকে সঁপে দেওয়া?
এটাই কি তবে...?
কি জানি।
জানি না আমি।
চিনি না তাকে, চেনা হয়ত হবেও না তাকে।
সহযাত্রী।
যার চোখ দেখলে তাকে চিনতে বড় সাধ হয়। যার চোখের চিরন্তন বিজলির উৎস যে মেঘ সেই মেঘ ছুতে ইচ্ছে করে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

by-পসর কুমার ভৌমিক
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url