গল্পঃ রাশেদের ঈদ

- তোর বাপের জন্য একটা তবন আনিস তো বাপ ! একটাও ভালো তবন নাই! ঈদত এতি উতি যাইবে, কি পিন্দি যাইবে?

ফোনের অপর প্রান্ত হতে মায়ের আকুতি মাখা কন্ঠস্বর শুনতে পায় রাশেদ। ডানে বামে তাকায়। জিএম, সুপার ভাইজার ওকে ফোনে কথা বলতে দেখলেই মা বাপ তুলে গালি দিবে।

- ঠিক আছে মা। বেতন টা পাইলে বাড়ি যাইম। এখন রাখ, পরে কতা কইম।

- শোন, পারু তোক কি যেন কবার চায়! শুনতো?

- আচ্ছা দে...

ওপর প্রান্ত হতে খসখসে আওয়াজ আসে। রাশেদ বুঝতে পারে মোবাইল হাত বদল হয়েছে। ও কথা বলে,



- পারু?

- ভাইয়া।

- কি কবু?

- মোক কিন্তু এবার ঈদত থ্রি পিচ নিয়ে দিতে চাইছিস। দিবার নস?

- বেতন দিক। দিলে বাড়িত যায়া তোক নিয়া কুড়িগ্রাম যাইম। তুই তোর পছন্দ মতোন একটা থ্রি পিচ নেইস। দুদিন পর বেতন দিবে। আচ্ছা, মুই অপিসত, পরে কল দেইম এলা।

অপর প্রান্ত হতে ছোট বোন পারু কি বলে শোনা হয় না রাশেদের। সুপার ভাইজারকে দেখতে পায় হঠাৎ। সাথে সাথে মোবাইল পকেটে রাখে। তা না হলে গালি শুনতে হবে!

- রাশেদ?

- জি ছার ?

- দাড়িয়ে আছো কেন? একটু এদিক ওদিক হলেই ভাবতে শুরু করো এটা তোমাদের বাবার গার্মেন্টস! যাও স্যাম্পলের বস্তাটা চতুর্থ ফ্লোরে দিয়ে আসো।

রাশেদের ইচ্ছে হয় ছেয়াশি কেজি ওজােনের একটা ঘুষি দেয় নোংরা লোকটার মুখে। কিন্তু দেয় না। যতই হোক তারই অধিনে কাজ করে সে। কিছু বলে না সে, কুড়ি কেজি ওজনের বস্তাটা মাথায় তুলে নেয়। কাজ আর কাজ। এক মহুর্ত স্থির থাকতে দেয় না।

স্যাম্পলের বস্তা মাথায়, কঁপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। রোজায় শরীর ভীষন ক্লান্ত। তবু সুখের অনুভূতিটা ওকে ছুয়ে যায়। আর দুটো দিন। এর পর বাড়ি ফিরছে সে। বেতন, অভার টাইম,ঈদ বোনাম সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকা বেতন পাবে। এক হাজার গাড়ি ভাড়া। বাকী নয় হাজার হতে ছোট বোন পারুকে একটা থ্রি পিচ নিবে, বাবার জন্য লুঙ্গি, মায়ের জন্য শাড়ি। ওর নিজেরো ভালো প্যান্ট নেই। জুতো জোড়া ছিড়ে গেছে । বেতন পেলেই কিনবে । ভাবতেই সব ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। দ্রুত পদক্ষেপে স্যাম্পলের বস্তা মাথায় চতুর্থ ফ্লোরে ছোটে রাশেদ।

সাবস্ক্রাইব করুন:

- ছার, চার হাজার টাকা কেন? আমি বেতন তো দশ হাজার পাবো?

চার হাজার টাকা হাতে , চোখে বিষ্ময নিয়ে জানতে চাইলো রাশেদ। যে লোকটি বেতন দিচ্ছিলো চোখ বড় করে তাকালো ওর দিকে।

- তের দিনের বেতন। বাকী বেতন ঈদের পর।

- আজ তের তারিখ। গেল মাসের বেতন টা পাবো আমি। কিন্তু তের দিনের বেতন দিচ্ছেন? ঈদের বোনাস?

- সব ঈদের পর।

- আমাদের ঈদ করতে হবে না? ঈদের বোনাস ঈদের পরে নিয়ে কি করবো? পুরো বেতনই দেন।

- মালিককে বলো যাও। আমাকে বিরক্ত করো না। আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেয়া আছে, আমি সেভাবেই বেতন দিচ্ছি। তোমরা যাতে ঈদের পর আবার কাজে আসো সেজন্য এই ব্যবস্থা।

বিষন্নতা গ্রাস করে রাশেদ কে। চার হাজার টাকা? কি হবে এ দিয়ে? গতকাল বাস কাউন্টারে গিয়ে টিকেট পায় নি। টিকেট হয়তো পাওয়া যাবে, টিকেট মূল্য পনেরোশ টাকা! বাড়ি যাওযার ভাড়া পনেরোশ টাকা, বাকী থাকে দুই হাজার পাঁচশ। থাকা খাওয়ার ভাড়া? এখানেই তো দুই হাজার পাঁচশ টাকা! কান্না আসে ওর! চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা লবনাক্ত পানি গড়িয়ে পরে। কেউ দেখার আগে ও জলদি করে পানি মুছে হাত দিয়ে। গরিবের চোখের পানি অন্যদের কাছে উপভোগ্য বস্তু! কেউ কখনো এ কথা বলে নি হয় তো, কিন্তু রাশেদ জানে, তারা না বললেও এ চোখের পানি তাদের ভিতরে পৈচাশিক আনন্দ দেয়!

ওর ন্যায্য বেতন, ওকে দিলে কি ক্ষতি হতো মালিকের? বরং এখন রাশেদের ঈদ আনন্দই নষ্ট করে দিয়েছে মালিকের হীন সিদ্ধান্তে। রাশেদের কানে বাজে ওর মাযের সেই আকুতিময় কন্ঠস্বর, "তোর বাপের জন্য একটা তবন আনিস তো বাপ ! একটাও ভালো তবন নাই! ঈদত এতি উতি যাইবে, কি পিন্দি যাইবে? "

বোনের কথা, "মোক কিন্তু এবার ঈদত থ্রি পিচ নিয়ে দিতে চাইছিস। দিবার নস?"

বেতনটা পেলে সে মায়ের আকুতি, বোনের আবদার পূরন করতে পারতো। ঈদ আনন্দের সাথে উৎযাপন করতে পারতো। কিন্তু তা আর হলো না! না বাড়ি যাবে না সে। গাড়ি ভাড়ার টাকাটাই বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। এতে বোনের থ্রি পিচ, আর বাপের লুঙ্গি কেনা হলে ক্ষতি কি? এটাই ওর আনন্দ। বাড়িতে ফোন দেয় ও।

- মা, বিকাশত পনেরো শ টাকা পাঠে দেইম, আব্বাক একটা তবন আর পারুক থ্রি পিচ নিয়ে দেইস। মুই ঈদের পর বাড়িত যাওয়ার সময় তোর জন্য শাড়ি নিয়ে যাইম।

- তুই আসপের নইস বাপ ?

- না মা। বেতন পাঙ নাই। ঈদের পর বেতন দিলে বাড়িত যাইম।

এর পর রাশেদের মা কিছু বলতে পারে না রাশেদ কে! কি বলবে? ছেলে বেতন পায় নি। গরিবের জন্য এর চেয়ে দুঃখের সংবাদ আর কি হতে পারে? ছেলে ঢাকায় ঈদ করবে, মায়ের মন সহ্য করে কি করে? ফোনের দু প্রান্তের দুজন মানুষ, মা ছেলে, দুজনেরই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে ।

রাশেদের পাঠানো টাকায় মেয়ের জন্য একটা থ্রি পিচ, রাশেদের মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে বাড়ি ফেরে রাশেদের বাবা। রাশেদের মা অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকান।

- শাড়ি আনছেন ক্যান? আপনার না তবন নাই?

- যা আচে তাতেই চলবে । শাড়ি দুইটা ছিড়ে তেনা হয়ে গেছে। গেল দুই বচর, একটাও শাড়ি কিনে দিবার পাঙ নাই।

ভিজে আসে রাশেদের মায়ের চোখ। গরিবের ঘরে টাকা না থাকুক ভালোবাসা ঠিকই থাকে। আর এই ভালোবাসার প্রকাশ ঘটলেই কেঁদে ফেলে মানুষ। কারন এ ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। নিখাদ ভালোবাসাই পারে প্রিয়জনকে সুন্দর মহুর্তে কাঁদাতে। যে কান্নায় থাকে না কোন কষ্টের ছাপ।

- হ্যালো মা। বাড়ি যাবার নাকছঙ। যে ছেলেটার সাথে থাকঙ, সে দুই হাজার টাকা হাওলাত দিছে ।

- গাড়িত চড়ছিস বাপ?

- হ মা। মুই এখন গাড়িত।

- আচ্ছা বাপ দেখি শুনি আসিস।

বেতন পায় নি, শুনতে পেয়ে ওর ম্যাচের রাহুল ছেলেটা ওকে দুই হাজার টাকা দিয়েছে। বলেছে, বাড়ি গিয়ে মা বাবার সাথে ঈদ করতে। টাকাটা বড় কিছু নয়। টাকাটা , মা বাবার সাথে ঈদ আনন্দ করার কাছে খুব তুচ্ছ একটা বস্তু। টাকাটা বেতন পেলে সে ফেরত দিতে পারবে কিন্তু মা বাবার সাথে পরের বছর ঈদ করার ভাগ্য নাও হতে পারে ।

আজ ঈদ। ইল উল ফিতরের ঈদ। এ ঈদে মিষ্টি মুখে দিয়ে তার পর ঈদগাহ মাঠে যেতে হয়। রাশেদের মা সেমাই রান্না করেছেন। রাশেদ, ওর বাবা, ওর বোন পারু মাদুর বিছিয়ে বসে সেমাই খাচ্ছে। রাশেদের মা চেযে দেখছেন স্বামী সন্তানের খাওয়া। চোখে তার খুশির ঝিলিক। পাশের বাড়িতে গান বাজছে। "রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ......."

সাবস্ক্রাইব করুন:

লেখা : নুর আলম সিদ্দিক
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url