গল্পঃ সম্পর্ক

- বউমা তুমি বসে আছো কেন?? আক্কেল নেই নাকি তোমার?? নীলি চলে আসবে, এখনো রান্না শেষ হয় নি। আসো তাড়াতাড়ি।
- জ্বী, মা আসতেছি।
- আসো তাড়াতাড়ি। জামাই আসবে, আর তুমি বেআক্কেলের মতো বসে আছো।

বলেই সাহানা বেগম হাটা দিলেন নিজের রুমে। ঈদের দিন মেয়ে আসবে, মেয়ে জামাই আসবে কত কাজ ঘরে। ঘরের বউ রুমে বসে আছে কাজ না করে এটা কি কারোর সহ্য হয়। এমনেই বউমা মনের মতো হয় নি বলে প্রচুর মন খুঁতখুঁত করে তার, কোথায় দেখে শুনে ছেলের বিয়ে দিবেন তা না,, কোথা থেকে ছেলে এমন মেয়ে পছন্দ করেছে। এই আজকালকার জেনারেশন এই এক ঝামেলা। বাবা-মার কোনো পছন্দ অপছন্দের দাম নেই।

সাহানা বেগম চলে যাওয়ার পর পরই রুমি ছুট লাগালো রান্না ঘরে, রান্না করতে হবে যে ১০ টা বেজে গেছে। ছেলেরা নামাজ পড়ে এসে গেছে, তাদের খাবার ও দিতে হবে। রুমির এই নিয়ে তৃতীয় ঈদ শ্বশুরবাড়িতে। এই তিনটে ঈদে বাবার বাসায় যাওয়া তার হয় নি। ঘরের বউ ঈদের সময় বাপের বাড়ি যায় তবে কি করে চলবে! আর রুমি বাবার বাসাও অন্য শহর। আকাশ স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে তার বাবা-মার সাথে ঈদ করবে। একদিকে সে তো ভুল নয়। কারণ, ঈদের সময় বাড়ির ছেলে বউ এর সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে শ্বশুরবাড়ি যাবে লোকে কি বলবে!

দুপুরের দিকে নীলির ফোন আসলে জানা যায় নীলিরা আসতে পারবে না। হুট করে কিছু মেহমান এসে পড়ায় তারা ম্যানেজ করতে পারে নি। সাহানা বেগম ভেবেছিলেন এবার ঈদ ছেলে-বউমা, মেয়ে-জামাই নিয়ে করবেন। হলো কোথায়। আসতে তো পারলো না নীলি। রুমি দুপুরের খাবার টেবিলেই খেয়াল করলো,সাহানা বেগম কেমন যেন মনমরা হয়ে আছেন। সমস্যাটা রুমির বুঝতে বাকি রইলো না। উনিও তো মা, রুমির মার মতো উনারও ইচ্ছে হয় মেয়েকে সাথে নিয়ে ঈদ করবেন। কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় ঠিক তেমন থাকে না যেমনটা আমরা চাই।

সাবস্ক্রাইব করুন:

- মা,আসবো?
- হুম আসো,কিছু বলবে?
- মা আপনার নীলির মন খারাপ তাই না?
- ভেবেছিলাম, এবার একসাথে ঈদ করবো বুঝলে। আর কই হলো!
- মা মন খারাপ করবেন না, এখন তো শুধু ও এই বাড়ির মেয়ে নয়, ওর ও কিছু দায়িত্ব আছে।
- সবই ঠিক কিন্তু ওর তো আর আসা হলো না।
- ও তো এখানেই থাকে মা, দেখবেন কাল ঠিক ওরা আসবে। আপনার মন খারাপ থাকলে আপনার ছেলের ও তো খারাপ লাগবে।

রুমির কথা সাহানা বেগমের মনে ধরলো, ঠিক ই তো আজ রুমিও তার বাবার বাড়ি যেতে পারে নি। তারও ইচ্ছে হয় তার মা-বাবার সাথে ঈদ করতে। সাহানা বেগম নিজের মেয়েকে না দেখতে পেরে যতোটা কষ্ট পাচ্ছেন, অপরপক্ষে রুমির বাবা মাও তাদের মেয়ে না দেখতে পেরে কষ্ট পাচ্ছেন। মেয়েদের জন্য এই ব্যাপারটা খুব কমন। এটা অনেকটা একই কয়েনের দুই পিঠের মতো, বাপের বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি কোনোটাকে তারা বাদ দিতে পারবে না। যতোটা দায়িত্ব তাদের নিজের মা-বাবার প্রতি আছে ঠিক ততোটাই তার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের প্রতি আছে। সাহানা বেগম এবং রুমি দুজনেই দুজনের দিক থেকে একই সাথে সঠিক আবার ভুল। আজকের ঘটনাটা তাদের ভুল চিন্তাটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। একদিকে যেমন রুমির তার শ্বশুরবাড়ির প্রতি দায়িত্ব গুলোকে যেমন মনে করিয়ে দিলো, অপরদিকে সাহানা বেগমের কাছেও মনে হলো তিনি যেমন তার মেয়েকে কাছে পেতে চান ঠিক তেমন ভাবেই অন্য একজন মাও তার মেয়েকে কাছে পেতে চান। তাদের সম্পর্কের মাঝে দূরত্বটার মাঝে যেন ধীরে ধীরে সেতু তৈরি হতে লাগলো।

রুমে যেয়েই রুমি খেয়াল করলো, আকাশ কারোর সাথে ল্যাপটপে কথা বলছে। রুমিকে আসতে দেখেই ও বলতে লাগলো,
- এসেছো, মা লাইনে আছেন। তুমি একবারো ফোন দেও নি দেখে আমি ভাবলাম আমিই ফোন দেই। আসো।

ওই মূহুর্তে রুমির সারাদিনের ক্লান্তি, খারাপ লাগা গুলো যেন নিমিষেই হারিয়ে গেলো। অনেকক্ষন মার সাথে কথা বললো৷ আজ সারাদিন কিভাবে কাটালো সব মাকে বলতে লাগলো। কাছে না থাকলেও দূর থেকে আপনজনকে দেখার মাঝেও শান্তি আছে।

পরদিন দুপুরে নীলি এবং তার স্বামী ঘুরতে এলো। মেয়ে-জামাইকে সাথে পেয়ে সত্যি যেন মন ভরে সাহানা বেগমের। সন্তান এমনই হয়, তারা কাছে থাকলে মনের তৃপ্তি অন্য রকম থাকে। ঈদ যেন আজ মনে হচ্ছে, আপন মানুষগুলো সব কাছে থাকাই তো আনন্দ,সেটা যেকোনো দিনই হতে পারে। সাহানা বেগমের মনে হলো, রুমির মা-বাবাও হয়তো রুমিকে দেখলে এতোটাই খুশি হবে, রুমিও তাদের একমাত্র মেয়ে।

পরদিন সকালে টিকিট কেটে আনায় খুবই অবাক হলো রুমি, কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তখন সাহানা বেগম এসে বললেন,
- তোমরা আজ রওনা দিয়ে দাও, দুই দিন মার কাছে থেকে আসো। আমার যতোটুকু অধিকার তোমার উপর আছে, উনাদেরও আকাশের উপর আছে। যাও, ঘুরে আসো উনারাও খুশি হবেন।

নিজের শ্বাশুড়ির মুখে কথাটা শুনে রুমি যেন নিজেকে সামলাতে পারলো না। সাহানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। না জানি কতোই না ভুল বুঝেছিলো। সম্পর্ক গুলো এমনি, নিজেদের চেষ্টা না থাকলে সেগুলো গড়া সম্ভব নয়। মানুষ আপাতপক্ষে শুধু নিজের কথা গুলোই ভাবে, নিজের দিকে সে যেমন ঠিক অপরপক্ষের মানুষটি যে ভুল তা কিন্তু নয়। বোঝাপড়া থাকলে সবই সম্ভব। বাসে বসে রুমির মনে হচ্ছিলো, আজ যেন নতুন সম্পর্কের আবির্ভাব হলো। এ যেন নতুন সূচনা।

সাবস্ক্রাইব করুন:
by Musfikun Nesa Tanjin
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url