অনুগল্পঃ স্বপ্ন
"বাবা মেঘ, শোন, আজকে গ্রামে ১৮ শতাংশ জমি দান করে এলাম। "
"কেন আব্বু?"
"আরে, হাসপাতাল হবে রে হাসপাতাল। আর আজ থেকে ১৫ বছর পর তুই ওখানে বসে বসে রোগী দেখবি।"
"আমি!"
"আরে হ্যাঁ রে হ্যাঁ, তুই। তোর জন্যই তো এসব করছি রে বাবা। তুই বড় একটা ডাক্তার হবি,আমার বুক দশ হাত উঁচুতে থাকবে। "
"কিন্তু আব্বু, আমার তো ডাক্তার হবার ইচ্ছা নেই। আমি তো লেখক হতে চাই। "
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন মেঘের বাবা। হঠাৎ হাসিখুশি চেহারাটা বদলে যেতে থাকলো। রেগে লাল হয়ে যেতে থাকলো। চিৎকার করে উঠলেন,
"মেঘের মা, এই মেঘের মা। তোমার ছেলেকে কিছু বুঝাও। এহ,লেখক হবে সে,লেখক। লেখক যে হবি, সারাজীবন কি খাবি,কয়টাকা পাবি হ্যাঁ? এতো কষ্ট করে বুকের ঘাম বের।করে টাকা কামাচ্ছি, সাইন্সে পড়াচ্ছি, যখন যেটা লাগছে একবার বলার সাথে সাথে নিয়ে আসছি, আর সে কিনা বাপের মুখে চুনকালি মেখে হবে লেখক। " এই বলে দরাম করে দরজা আটকে ঘরে ঢুকে বসে রইলেন আসাদ সাহেব।
সারারাত বারান্দায় বসে রইলো মেঘ। সতেরো বছরের একটা ছেলের জন্য পরিস্থিতিটা খুব অনুকূল নয়। এই বয়সটা একটু দোটানার বয়স।এই বয়সের ছেলেগুলোর সুখ বাবা-মার কাছে থাকে না। এই বয়সের ছেলেগুলো বাবাদের থেকে একটু বেশিই জানে, কিন্তু অভিজ্ঞতা নামক জিনিসটা তাদের জ্ঞানকে ঢেকে রাখে। তারা চায় সবাই তাদের কথাটার একটু গুরুত্ব দিক, কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে তার কথার দামটা হয় সবচেয়ে কম। জেনারেশন গ্যাপ নামক জিনিসটা এই বয়সে সবচেয়ে প্রখর হয়ে উঠে। এ বয়সটা দ্বিধার বয়স,বাবামার সন্তানের স্বপ্ন বুঝতে পারার দ্বিধা।
দুই মাস ধরে ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করছে মেঘ। ভালোই সাড়া পাচ্ছে। মনের ভিতর গোপনে গোপনে একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছে তার, লেখক হবার ইচ্ছা। স্বপ্ন দেখছে নিজের একটা সত্ত্বা গড়ে তোলার। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে তার মনের উপর একটা পাথর বসে গেছে, 'বাবার ইচ্ছা' নামক পাথর।কেন জানি মনের ওই গোপন ইচ্ছাটার উপর একটু একটু ধূলো জমছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক আইডিটা ডিএক্টিভেট করলো সে।সামনে ইন্টার প্রথম বছর শুরু হবে।পড়তে হবে তাকে, জান পানি করে পড়তে হবে,বাবার একটা সম্মান আছে না।
কিভাবে কিভাবে জানি কয়েক বছরের মধ্যে মেঘের একটা বই বের হয়ে গেলো।হয়ত, ভাগ্য কিছুটা প্রসন্ন ছিলো তার প্রতি। তখন মেঘ একটা প্রাইভেট মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।সে বইটা নিয়ে দৌড়ে তার বাবার কাছে এলো। প্রথম কপিটি সে তার বাবার হাতে দিতে চায়।
"আব্বু, দেখো আমার একটা বই বেরিয়েছে।"
আসাদ সাহেব মেঘের দিকে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন, কিন্তু এরপর যা করলেন তার জন্য মেঘ একেবারে প্রস্তুত ছিলো না।
টান দিয়ে মেঘের বইটা ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেললেন তিনি।
"এতোকষ্ট করে ডাক্তারি পড়াচ্ছি কি বই বের করার জন্য?"
সেদিনও কিছু বললো না মেঘ। সেদিনও সারারাত বসে থাকলো বারান্দায়,তার সবচেয়ে প্রিয় চেয়ারটিতে। বুকটা তার ব্যাথা করছিলো,কান্নাগুলো বাষ্প হয়ে গেলে বুঝি এরকম ব্যাথা হয়। সারারাত ঘুমহীন কাটিয়ে শেষরাতে ছোট একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিলো খাতা থেকে। তাতে লিখলো,
"জীবনটা বড্ড মিথ্যাবাদী,সত্য বলতেই শিখলো না। ইশ...স্বপ্নগুলো যদি হাত দিয়ে ধরা যেতো।"
এটুকু লিখেই কাগজটা বারান্দার কার্নিশে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।
সে এখন ঘুমের ওষুধ খুঁজছে,অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ। শান্তির একটা ঘুম তার খুব দরকার।যে ঘুমে স্বপ্ন আসবে না, বাবা আসবে না, কেউ আসবে না। চমক হাসানের একটা কথা তার খুব মনে পড়ছে,
"বাবারা সবসময়ই আমাদের জন্য সেরাটা চায়। কিন্তু সেরাটা কোনটা এটা তারা জানে না।"
সাবস্ক্রাইব করুন:
by Ejajul Efat
"কেন আব্বু?"
"আরে, হাসপাতাল হবে রে হাসপাতাল। আর আজ থেকে ১৫ বছর পর তুই ওখানে বসে বসে রোগী দেখবি।"
"আমি!"
"আরে হ্যাঁ রে হ্যাঁ, তুই। তোর জন্যই তো এসব করছি রে বাবা। তুই বড় একটা ডাক্তার হবি,আমার বুক দশ হাত উঁচুতে থাকবে। "
"কিন্তু আব্বু, আমার তো ডাক্তার হবার ইচ্ছা নেই। আমি তো লেখক হতে চাই। "
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন মেঘের বাবা। হঠাৎ হাসিখুশি চেহারাটা বদলে যেতে থাকলো। রেগে লাল হয়ে যেতে থাকলো। চিৎকার করে উঠলেন,
"মেঘের মা, এই মেঘের মা। তোমার ছেলেকে কিছু বুঝাও। এহ,লেখক হবে সে,লেখক। লেখক যে হবি, সারাজীবন কি খাবি,কয়টাকা পাবি হ্যাঁ? এতো কষ্ট করে বুকের ঘাম বের।করে টাকা কামাচ্ছি, সাইন্সে পড়াচ্ছি, যখন যেটা লাগছে একবার বলার সাথে সাথে নিয়ে আসছি, আর সে কিনা বাপের মুখে চুনকালি মেখে হবে লেখক। " এই বলে দরাম করে দরজা আটকে ঘরে ঢুকে বসে রইলেন আসাদ সাহেব।
সারারাত বারান্দায় বসে রইলো মেঘ। সতেরো বছরের একটা ছেলের জন্য পরিস্থিতিটা খুব অনুকূল নয়। এই বয়সটা একটু দোটানার বয়স।এই বয়সের ছেলেগুলোর সুখ বাবা-মার কাছে থাকে না। এই বয়সের ছেলেগুলো বাবাদের থেকে একটু বেশিই জানে, কিন্তু অভিজ্ঞতা নামক জিনিসটা তাদের জ্ঞানকে ঢেকে রাখে। তারা চায় সবাই তাদের কথাটার একটু গুরুত্ব দিক, কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে তার কথার দামটা হয় সবচেয়ে কম। জেনারেশন গ্যাপ নামক জিনিসটা এই বয়সে সবচেয়ে প্রখর হয়ে উঠে। এ বয়সটা দ্বিধার বয়স,বাবামার সন্তানের স্বপ্ন বুঝতে পারার দ্বিধা।
দুই মাস ধরে ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করছে মেঘ। ভালোই সাড়া পাচ্ছে। মনের ভিতর গোপনে গোপনে একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছে তার, লেখক হবার ইচ্ছা। স্বপ্ন দেখছে নিজের একটা সত্ত্বা গড়ে তোলার। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে তার মনের উপর একটা পাথর বসে গেছে, 'বাবার ইচ্ছা' নামক পাথর।কেন জানি মনের ওই গোপন ইচ্ছাটার উপর একটু একটু ধূলো জমছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক আইডিটা ডিএক্টিভেট করলো সে।সামনে ইন্টার প্রথম বছর শুরু হবে।পড়তে হবে তাকে, জান পানি করে পড়তে হবে,বাবার একটা সম্মান আছে না।
কিভাবে কিভাবে জানি কয়েক বছরের মধ্যে মেঘের একটা বই বের হয়ে গেলো।হয়ত, ভাগ্য কিছুটা প্রসন্ন ছিলো তার প্রতি। তখন মেঘ একটা প্রাইভেট মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।সে বইটা নিয়ে দৌড়ে তার বাবার কাছে এলো। প্রথম কপিটি সে তার বাবার হাতে দিতে চায়।
"আব্বু, দেখো আমার একটা বই বেরিয়েছে।"
আসাদ সাহেব মেঘের দিকে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন, কিন্তু এরপর যা করলেন তার জন্য মেঘ একেবারে প্রস্তুত ছিলো না।
টান দিয়ে মেঘের বইটা ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেললেন তিনি।
"এতোকষ্ট করে ডাক্তারি পড়াচ্ছি কি বই বের করার জন্য?"
সেদিনও কিছু বললো না মেঘ। সেদিনও সারারাত বসে থাকলো বারান্দায়,তার সবচেয়ে প্রিয় চেয়ারটিতে। বুকটা তার ব্যাথা করছিলো,কান্নাগুলো বাষ্প হয়ে গেলে বুঝি এরকম ব্যাথা হয়। সারারাত ঘুমহীন কাটিয়ে শেষরাতে ছোট একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিলো খাতা থেকে। তাতে লিখলো,
"জীবনটা বড্ড মিথ্যাবাদী,সত্য বলতেই শিখলো না। ইশ...স্বপ্নগুলো যদি হাত দিয়ে ধরা যেতো।"
এটুকু লিখেই কাগজটা বারান্দার কার্নিশে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।
সে এখন ঘুমের ওষুধ খুঁজছে,অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ। শান্তির একটা ঘুম তার খুব দরকার।যে ঘুমে স্বপ্ন আসবে না, বাবা আসবে না, কেউ আসবে না। চমক হাসানের একটা কথা তার খুব মনে পড়ছে,
"বাবারা সবসময়ই আমাদের জন্য সেরাটা চায়। কিন্তু সেরাটা কোনটা এটা তারা জানে না।"
সাবস্ক্রাইব করুন: