ভাল মানুষের দল এবং প্রভাতফেরির ইতিকথা ( আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ গল্প )

১।
একুশে ফেব্রুয়ারি, ভোর ৬টা।
স্কুল বন্ধ যদিও, তবুও পুণ্য আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরেছে, তারপর ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পড়েছে। পাজ্ঞাবী পড়ছে বলেই কিনা জানি না, পুণ্যের আজকের দিনটা ঈদের দিন ঈদের দিন বলে মনে হচ্ছে। আজ সে বাবার সাথে প্রভাতফেরি তে যাবে.....
মাত্র ৪ বছর বয়স পুণ্যের। এই বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আজ স্কুল থেকে ছেলে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হবে প্রভাতফেরি তে। কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
স্কুল থেকে নিচের ক্লাসের ছেলে মেয়েদের প্রভাতফেরিতে নেয়া হবে না, ভীষণ ছোট কিনা!
তবে পুণ্যের এক কথা, সে যাবেই। বাবা অনেক বুঝিয়েছে। সে আরেকটু বড় হোক, বাবা তখন নিয়ে যাবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুণ্যের জেদের কাছে বাবা কে হার মানতে হল। এবারে তাই পুণ্যও প্রভাতফেরি যাচ্ছে বাবার সাথে! তাই শোনে সারা রাত ঘুম হয়নি পুণ্যের, সকালেও মা ডাকতেই এক লাফে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।
>বাবা, তোমার হয়েছে? আর কত?
পুণ্যের আর তর সইছে না যেন। কখন যাবে সে, কখন?
বাবা রুম থেকে তখনি একটা কাল পাজ্ঞাবী পড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর পুণ্যকে কোলে নিয়ে রওনা দিলেন, মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।
কিছু দূর যাওয়ার পর পুণ্যের মনে হল ফুল তো নেয়া হয়নি! এখন কি হবে?
কাঁদো কাঁদো গলায় বাবা কে বলল,
>বাবা! আমারা তো ফুল আনতেই ভুলে গেছি, এখন কি হবে? আমরা তো ফুল দিতে পারব না!
>যাওয়ার পথে সামনে যে দোকানটা পড়বে সেখান থেকে কিনে নিব সোনা।
পুণ্য বাবার কথা শুনে ভাবল, ঠিক ই তো! সামনের দোকান থেকে কিনে নিলেই তো হয়। ইশশ... আমি কত্ত বোকা!

সাবস্ক্রাইব করুন:

২।
পুণ্য বাবার সাথে ফুল কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। এখন তাদের হাতে বড় একটা গোলাপের তোড়া। পুণ্যের ওটা ধরে থাকতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। তাই দেখে বাবা ওটা নিজের হাতে রাখতে চেয়ে ছিলেন, কিন্তু না! পুণ্য ওটা নিজের হাতেই নিয়ে যাবে শহীদ মিনারে।

পথে অনেক অনেক অনেক মানুষ। সবার হাতেই ফুল। নিশ্চয় শহীদ মিনার যাচ্ছে। হঠাত্‍ পুণ্যের চোখ পড়ল লোক গুলোর পায়ের দিকে।
চাচ্চু গুলো তো পায়ে জুতোই পড়েনি! এত্ত বড় মানুষ তাও ওরা খালি পায়ে হাঁটছে কেন!
>বাবা দেখ, ঐ যে চাচ্চু গুলো যাচ্ছে, ওরা খালি পায়ে হাঁটছে ।
>হু... সবাই ই তো খালি পায়ে যাচ্ছে।
>বাবা তুমি তাদের বকে দাও, ওরা খালি পায়ে হাঁটবে কেন!
>কিভাবে বকি বল, আজকে তো আমিও খালি পায়ে হাঁটছি সোনা।
পুণ্য অবাক চোখে তাকায় বাবার দিকে, তারপর বাবার পায়ে। আসলেই তো! আজ বাবা পায়ে জুতো পরেনি!
এবার ভীষণ অভিমান হয় তার, ঠোঁট উল্টে যায় অভিমানে।
>বড়রা খালি পায়ে রাস্তায় হাটলে দোষ নেই আর আমি উঠোনে খেলতে গেলেই যত দোষ তাই না?
বাবা হেসে বলেন,
>কি করব সোনা বাবাই, আজেকের দিনে যে এভাবে হাঁটা নিয়ম।
>কেন!
পুণ্যের চোখে মুখে বিস্ময়।
>তাহলে একটা গল্প শোনাই তোমাকে। এটা কিন্তু সত্যিকারের গল্প। কি বাবাই, শুনবে তো?
পুণ্য জোরে মাথা দোলায়। বাবা তাঁর গল্প শুরু করেন,
>অনেক দিন আগে, আমাদের দেশে ২ দল মানুষ বাস করত। একদল ছিল ভাল মানুষ, যারা ছিল সহজ সরল মনের। খেটে খেয়ে হেসে খেলে দিন পার করত তারা। আরেক দল ছিল ভীষণ খারাপ। তারা শুধু ভাবত কিভাবে ভাল মানুষ গুলোকে কষ্ট দেয়া যায়, তাদর লুট করে নিজেদের কাজে লাগানো যায়। একদিন ঐ খারাপ লোক গুলো ঠিক করল তারা ভাল মানুষ গুলোকে আর কথাই বলতে দিবে না। আর কথা বলতে না পারলে ভাল মানুষ গুলো কিছুই করতে পারবে না। খারাপ মানুষ গুলোও তখন তাদের ইচ্ছে মত ভাল মানুষ গুলোকে লুট করতে পারবে, অত্যাচার করতে পারবে, কষ্ট দিতে পারবে। কিন্তু ভাল মানুষ তাদের সাথে হওয়া এই অন্যায় মেনে নিল না। তারা ঠিক করল প্রতিবাদ করবে, কঠিন প্রতিবাদ!
খারাপ মানুষ গুলো তখন তাদের ভয় দেখাল। তবে ভাল মানুষ গুলো সহজ সরল হলে কি হবে, তারা ছিল ভীষণ সাহসী। তারা সবাই এক হয়ে প্রতিবাদ করল। আর খারাপ মানুষ গুলো তখন ভয় পেয়ে ভাল মানুষের ভীড়ে গুলি করল। অনেক ভাল মানুষ মারা গেল।
পুণ্যের চোখে তখন জল চিক চিক করছে। সে বাবার পাজ্ঞাবীর কলারটা তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করল,
>তারপর কি হলো বাবা? ভাল মানুষ গুলো কি হেরে গেল?
বাবা পুণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন
>না সোনা, ভাল মানুষ গুলো হারেনি। তারা জিতেছিল। খারাপ মানুষ গুলোই হেরে গিয়েছিল, ভাল মানুষ গুলোর মনের জোরের কাছে।
পুণ্যের চোখ থেকে এবার সত্যি জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু ঠোঁটের এক কোণে তৃপ্তির হাসি। সে খুশিতে বাবা কে জড়িয়ে ধরল। আবার কি যেন ভেবে বলল,
>কিন্তু বাবা, এটার সাথে খালি পায়ে হাঁটার কি সম্পর্ক?
>আমরা যেখানে ফুল দিতে যাই মানে শহীদ মিনারে, সেখানে ভাল মানুষ গুলো মারা গিয়েছিল। তাঁদের রক্তে ভিজে গিয়েছিল সেখানকার রাস্তা। তাই তাঁদের সম্মান জানাতে, তাঁদের পবিত্র রক্তকে সম্মান জানাতে আমরা আজকের দিনে সেখানে খালি পায়ে হেঁটে যাই। বুঝলে বাবাই সোনা?
বলেই বাবা পুণ্যের গাল টেনে আদর করে দিলেন।

৩।
বাবার কাছে গল্পটা শুনে পুণ্য ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল । আসলে সে ভাবছিল, সেও তো ফুল দিতে যাচ্ছে ঐ ভাল মানুষ গুলোকে। তাহলে, সে কেন বাবার কোলে চড়ে যাবে? তারও তো হেঁটে শহীদ মিনারে যাওয়া উচিত।
বাবা!
বল সোনা,
আমাকে নিচে নামিয়ে দাও।
কেন বাবাই?
আমিও হেঁটে ফুল দিতে যাব।
ওখানে তো অনেক ভীড় তোমার কষ্ট হবে।
সবাই পারলে আমিও পারব।
বাবা অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকান। পুণ্যের চোখে তখন কিসের যেন জ্যোতি!
বাবা তাকে নামিয়ে দিল কোল থেকে। পুণ্য বাবার কোল থেকে নেমে এক হাতে ফুলের তোড়া ধরল অন্য হাতে শক্ত করে বাবার হাত।
তারপর???
তারপর ধীরে ধীরে হাজার হাজার জনতার ভিড়ে মিশে গেল দুজন......
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিশেষ গল্প-- "

সাবস্ক্রাইব করুন:

By- ফারিয়া জহরি 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url