আমাদের সময়ের ঈদ

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন শবেবরাতের সময় থেকে ঈদের জন্য অপেক্ষা করা শুরু হতো।শবেবরাতের পরে থেকে ঢিলেঢালা ভাবে স্কুল হতো। তখন আমরা অপেক্ষা করতাম কবে স্কুল বন্ধ দেওয়া হবে তার জন্য। রোজা শুরু হওয়ার আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে যেতো বিশাল ছুটি একদম ঈদের পরে স্কুল খুলবে।



আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তিন টা রোজা অবশ্যই করতাম প্রথম রোজা শবেকদরের রোজা আর শেষ রোজা। রোজা রাখা ছিলো দারুণ টেনশনের বিষয় এক ফোটা থুতুও গিলে ফেলা যাবে না। যে-দিন আমরা ছোটরা রোজা রাখবো সেদিন একটা দুইটা ইফতারের আইটেম বেশি বানানো হতো বা দোকান থেকে কিনে আনা হতো। আর আমরা যে রোজা রেখেছি তার প্রমান ছিলো সারাদিন থুতু ফেলে গলা শুকিয়ে কাঠ করে ফেলা। আর আব্বা- আম্মা সেদিন কিছু বলতো না কোন কাজের কথা বা পড়ার কথা।আব্বা আমার শুকনো মুখ দেখে আস্তে করে কাছে ডেকে নিয়ে বলতো শোন মা ছোটদের রোজায় দুপুর বেলা মাটির কলসির মুখের ঢাকনা সরিয়ে কলসির ভেতরে রোজা টা রেখে দিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে দিবে তার পর খেয়ে ফেলবে খাওয়া শেষ হলে আবার কলসি থেকে ঢাকনা সরিয়ে তোমার রোজা তুমি নিয়ে নিবে।আমি তখন বলতাম আব্বা আপনি কি ছোট বেলায় এভাবে রোজা রাখতেন। আব্বা হাসতো আর বলতো সব বাচ্চা' রাই ছোট বেলা এভাবে রোজা রাখে। যেদিন বেশি ক্ষুধা লাগত সেদিন এভাবে রোজা রাখতাম।

রোজার দিনে প্রতিদিন লেইস ফিতা লেইস বলে কি সুন্দর করে লেইস ফিতা ওয়ালারা ডাকতো। আমরা দৌড়ে আম্মা কে বলতাম আম্মা লেইস ফিতা কিনবো। ওদের কাছ থেকে শুরু হতে প্রথম ঈদের কেনাকাটা যার মধ্যে থাকতো সাদা গোলাপি মুক্তার মালা আসলে মুক্তার মতো আকার আর চকচকে পুতির মালা। আমি সব সময় হালকা গোলাপি বড় মুক্তার মালা কিনতাম। ঐ মালার ওপর থেকে কিছুদিন পরে হাতদিয়ে খুটে আবরন তোলে ফেলতাম বা উঠে যেতো। আমার এখনো ইচ্ছে হয় ঠিক তেমন একটা মালা কেনার।আর সার্টিনের ফিতা কিনতাম, ক্লিপ কিনতাম। চুড়ি কিনতাম সব সময় যে জামার সাথে মিলিয়ে কিনতাম তা না। গোলাপি রং-এর সব কিছু কিনতে ভালো লাগতো।
আমরা ঈদের আগে আলতা কিনতাম পায়ে আলতা দিতে খুবই ভালো লাগতো আমাদের বড় বোনেরা আমাদের পায়ে আলতা দিয়ে দিতো। আমরা বাটা মেহেদী হাতে লাগাতাম মেহেদী বেশির ভাগ সময় পাড়ার কোন বাসা থেকে আনা হতো সেই মেহেদীতে নানির পান খাওয়ার খয়ের দিয়ে বাটা হতো যেন রং ঘাড় হয়। তার পরে হাতের নখে মেহেদী দিতাম আর হাতের তালুতে গোল করে বা পাঁচ পাতার ফুল বানিয়ে দিতো বড় আপা আর মেহেদী দেওয়া হতো কাঠি দিয়ে।
আমি ছিলাম আমাদের বাসার সব চাইতে জেদি বাচ্চা। সব সময় ঈদের নতুন সাবানটা আমার আগে কেউ খুলতে পারবে না আমি প্রথমে নতুন সাবান দিয়ে গোসল করবো।কত এমন হয়েছে আব্বা নামাজে যাওয়ার জন্য সবার আগে গোসল করেছে কিন্তু নতুন সাবান খুলে নাই কারণ আমি প্রথমে নতুন সাবানের মোড়ক উন্মোচন করবো।
সাবস্ক্রাইব করুন:

আমরা মেহেদী দিতাম উনত্রিশ রোজার দিন কারণ যদি উনত্রিশ রোজা হয় তাহলে চাঁদ কে মেহেদী দেখতে হবে। আমরা মেহেদী তুলে হাতে সরিষার তেল দিতাম তা হলে মেহেদী টা চকচক করতো।
আমাদের ছোট বেলায় সবার ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিলো না তার পরেও আমরা কিন্তু ঠান্ডা সরবত খেতাম।রোজার দিনের বিকেল বেলায় সব সময় আমি আব্বা'র সাথে যেতাম বরফ কিনতে তখনও ইফতার বাজার বসতো আর তার পাশেই বরফের বিশাল বিশাল চাই নিয়ে বসতো বরফওলা বরফের ওপরে তুষ দেওয়া থাকতো আমরা টিনের টিফিন বক্স নিয়ে যেতাম বরফ আনার জন্য। আম্মা বাসায় ছোলা, পিঁয়াজু, শরবত বানাতো ফল কাটতো আর আমাদের বাসায় বেগুনি, আলুর চপ এগুলো কিনে আনা হতো দোকান থেকে। আর যেদিন ইফতার বিলানো হতো সেদিন কত কিছু যে কিনে আনা হতো সেদিন আমরা খুবই আনন্দিত থাকতাম এত ভালো লাগতো ট্রেতে ইফতার সাজাতে আর দৌড়ে দৌড়ে আশেপাশের বাসায় ইফতার দিয়ে আসতাম।
রোজা শুরু হওয়ার পর থেকেই টেনশনে থাকতাম আমাদের ঈদের শপিং কবে করবে তা নিয়ে। আমাদের কে বেশির ভাগ সময় আম্মা সিট কাপড় কিনে সুন্দর করে জামা বানিয়ে দিতো। আমাদের আম্মা নতুন ডিজাইন ভালো না পারলে পাড়ার কোন ইয়াং আপা বেশি ভালো ডিজাইন পাড়লে তার কাছ থেকে ডিজাইন তুলে আনতো। আমরা কখনো ঈদের আগে কাউকে ঈদের জামা দেখতে দিতাম না। আমরা সব সময় লাল জামা নিলে বলতাম এবার ঈদে হলুদ জামা নিয়েছি এরকম আমরা সবাই করতাম।আম্মা এত কাজের মধ্যে যখন দেরি হতো জামা বানাতে তখন রাগ করে বলতাম আম্মা তুমি কি আমার জামা ঈদের পরের দিন বানিয়ে শেষ করবে!! আম্মা হাসতো আর বলতো দেখো জামার কুচি দেওয়া শেষ হলেই জামার শুধু বোতাম লাগাবো। আম্মা জামা বানানোর মধ্যেই একবার দু'বার একটু পরিয়ে দেখতো মাপ ঠিক আছে কিনা, সেই সময় আমি দৌড়ে আয়নার কাছে চলে যেতাম কি যে ভালো লাগতো।
জামা বানানো শেষ হলে শুধু দিন গুনতাম আর মাত্র পাঁচ দিন পরে ঈদ। যেদিন চাঁদ উঠতো সেদিন আমরা সবাই সনধ্যার সময় চাঁদ দেখার জন্য বাহিরে থাকতাম সবাই গল্প করতাম। তার পরে আম্মা অনেক রাতেই কিছু সেমাই রান্না করতো আমরা বাটিতে নিয়ে খেতাম।
আমাদের সময়ে আমরা শুধু রোজার ঈদে জামা কিনতাম আর সবাই একটাই জামা নিতাম ঈদে।সে-ই জামা পড়তাম ঈদের দিন সকালে গোসল করে। আমরা আব্বা'র সাথে ঈদের জামাতে যেতাম আর একটু দূরে দাড়িয়ে ঈদের জামাত দেখতাম। সবাই যখন সিজদা দিতো একসাথে সারি সারি সাদা সাদা পাঞ্জাবি পড়া আমার খুবই ভালো লাগতো ঈদের জামাত দেখতে। নামাজ শেষে আমরা আব্বা'র সাথে একধরনের মোটা কাগজের পুতুল কিনতাম যে গুলো থাকতো কাঠির সাথে আটকানো হাত পা নাড়ানো যেতো। আর বেলুন বাঁশ বাঁশি কিনে পেঁ পুঁ করতে করতে বাসায় আসতাম। তার পর শুরু হতো পাড়ার সকল বাসায় দল বেধে বেড়াতে যাওয়া আর সবাই কে সালাম করা। আব্বা - আম্মা সালামী দিতো। কখনো কখনো কোন কোন বাসা থেকে বড় কেউ সালামি দিতো তখন অনেক খুশি লাগতো। আমরা সালামির টাকা দিয়ে ঈদের দিন আইসক্রিম কিনে খেতাম। তার পর রাতে বেলা বিটিভে আনন্দ মেলা দেখা দিয়ে শেষ হতো ঈদের দিন। যদিও আমরা ছোট বেলায় বলতাম রোজার ঈদ থাকে সাত দিন আর কোরবানির ঈদ তিনদিন।

লেখা: সুরাইয়া শারমিন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url