গল্পঃ কমরেড ( প্রেমের গল্প )



বুঝলিরে মাফিয়া, শেষমেশ বোধ হয় আব্বার মতই দ্বিতীয় বিয়ে আছে আমার নসিবে।
কেবলই মাত্র মাগরিবের আযান হলো। হাজীরা সব নামাজের জন্য দলে দলে মসজিদের দিকে ছুটছে। এই ভর সন্ধ্যাবেলা জামান ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলুম। আমি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলুম,
--- এসব কি কও জামান ভাই? তোমার মাথা কি ঠিক আছে? নাকি আজ শখ্যতার বশে আফিমে নাক ডুবিয়ে উল্টাপাল্টা বকছো!!
জামান ভাই হাসলো। বলল,
--- তুই সবসময় আমার দিকে দোষারোপের আঙুল নিক্ষেপ করিস, কখনো ভুল করে হলেও আশালতার দোষটি দেখতে পাস নে।



আমি হতচকিত হয়ে বললুম,,
--- দ্যাখো ভাই, আমি তোমার এসব ছাইপাঁশ কথাবার্তা শুনতে চাইনে। আশালতা ভারি মিষ্টি মেয়ে, সংসারের প্রতি তার বেশ খেয়াল। এ মেয়ে নিশ্চয়ই তোমাকে বেশ ভালো রেখেছে। তবে কেবলই কেন এমন অলুক্ষণে কথা মুখে আনো? দিনভর পাপের কথা চিন্তা করে মস্তিষ্কতে চাপ প্রয়োগ করাটাও যে মস্তবড় পাপ, সেকথা বুঝি তোমার অবগত নয়?
সে যেন আমার কথা কানেই তুলল নে। বরঞ্চ নিজে এখন অনেক কথার শুনানি দেবার প্রস্তুতি নিতে ধপাস করে পাশের ফাঁকা বেতের চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসে নিম্নমুখী হলো। ভেবেছিলুম এখানেই সে ক্ষান্ত! আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলুম। সে চা বা কফি কিছু খাবে কিনা সেকথা জিজ্ঞাসা করতে না করতেই মাথা উঁচু করে আমার পানে তাকিয়ে বলল,,,
--- কি যেন বলেছিলি তুই? আশালতা আমায় ভালো রেখেছে। আচ্ছা! বলতে পারিস যে ঘরে ভালোবাসারই অভাব সে ঘরে ভালো থাকাটা আসে কেমন করে?
তার প্রথম কথার চেয়েও এই একটি কথা যেন আমার অন্তরে বেশি বিধলো। আমি ভ্রূ কুচকে তাকে উদ্দেশ্য করে বললুম,,
--- তোমার আসলে হয়েছেটা কি বলবে তো! এসব তুমি পাগলের মত কি বলো না বলো, শুনতে জঘন্য লাগে।
সে আবারও হাসলো। হাসতে হাসতেই বলল,,
--- তা জঘন্য লাগুক, কিন্তু সত্যকে তো অস্বীকার করা যায় না।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলুম। জামান ভাই আর আশালতার প্রায়ই ঝামেলা হয় জানি, সেজন্যে আমি আশার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে মাঝেমধ্যে তাকে বকিও। কিন্তু আজ জামান ভাই কোন সত্যের কথা বলছে? আসলেই কি অগোচরে এমন কিছু আছে যা আমার নিকট শুধুই রহস্যময় বৈকি আর কিছুইনা। সেসব বুঝতে হলে আমাকে জানতে হবে। আমি জানার আগ্রহ নিয়েই তাকে দ্বিতীয়বারের মত জিজ্ঞাসা করলুম,,
---- আসল কাহিনী কি! সেকথা কি আমাকে বলবে? নাকি সারাবেলা ভঙ্গিমা করেই কাটিয়ে দিবে।
সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে আরম্ভ করলো,,
আশালতার সাথে আমার বিয়েটা হয় অবুঝ বয়সে। এতটাই অবুঝ ছিলুম যে পেশাব চাপলে প্যান্ট খুলে তা ত্যাগ করতে হয় সে ব্যাপারটিও তখন আমার বোধে আসেনি। অথচ আব্বা-আম্মা নিতান্তই শখের বশে তাদের নিকটাত্মীয়ের এক মাত্র কণ্যার সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। যখনই একটু বুঝতে শিখলুম তখনই আব্বা আম্মা তাদের আদরের বউমাকে ঘরে তুললেন। সে যেন শুধুই বউমা নয়, পাঁচ ছেলের পরে আকাঙ্ক্ষিত এক কণ্যার আদরে তারা তাকে বড় করলেন। আমার চোক্ষের সামনেই দুই পাশে দুইবেনী ঝুলানো আশালতা কেমন করে যেন গায়ে গতরে বড় হয়ে উঠলো। ততদিনে আমাদের সংসার বাধার সময়টুকুনও ঘনিয়ে আসলো। তবে আমি তখনও পড়াশুনা শেষ করিনি বিধায় গুরুজনেরা আমার ঘাড়ের উপরে সংসার দায়িত্বের ভাড় চাপিয়ে দেননি। আশালতা হেথায় কণ্যার আদরে বড় হচ্ছে, নিয়ম করে রোজ সন্ধ্যেতে আম্মা তার কেশে নারকেল তেল ঘষে দেয় আর সে রাত্তিবেলা আম্মার পা টিপে শান্তি পায়। কখনও কখনও বাপের বাড়িতে দুদিনের অতিথি হয়ে গিয়ে সে নাকে কান্না শুরু করে --তার নাকি বাপের বাড়ি একটুও মনে ধরেনা, সেখানে তার সময় কাটেনা।
কখনও বা লাঠিয়াল কখনও বা ছিপ নৌকোর মাঝির খবরে তড়িঘড়ি করে আমাকেই তাকে আনতে যেতে হয়, নইলে আব্বার লাঠিপেটা যে তুলবে আমার পিঠের ছাল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিলো না। আচ্ছা বলতো মাফি, এই ছোট ছোট বিষয়গুলিতে যে শান্তি আমি অনুধাবন করেছি এর থেকে বেশি প্রাপ্তির কি দরকার আছে জীবনে?
তার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি কল্পনা নগরীতে ডুবে গেলুম। হুঁশ আসলো তার উচ্চস্বর শুনে,
--- মাফিয়া, আমার কথা কি আদৌ তোর শ্রবণশক্তিতে পৌঁছেছে?
আমি বললুম,,
--- আমি শুনতে পাচ্ছি তুমি বলো।
সে চুপ করে রইল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলুম,,
---- কি ব্যাপার! স্থির হয়ে রইলে যে?
সে চেয়ারে আরেকটু হেলান দিয়ে তন্দ্রাবেশে চোখ দুটি বন্ধ করলো। সাথে চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,,,
---- আমাকে কি তৃষ্ণার্তই বসিয়ে রাখবি? নাকি চা কফি কিছু দিবি।
আমি সামান্য লজ্জিত হলুম। সেই কখন তাকে চা, কফির অফার করেছি। গল্পের মাঝে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিলুম যে সেকথা আমার মস্কিষ্ক থেকে পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। আমি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললুম,,
---- দেখেছো তো! তোমার গল্পে এতটাই মাতোয়ারা হয়ে গেছি যে আমার কিছুতেই মাথায় ছিলো না তোমায় চা কফি দেয়ার কথা। তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।
সে পিছন থেকে ডাকলো,,,
--- মাফি,
আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলুম,,,,
----- হ্যা, আর কিছু লাগবে?
সে কোনো জবাব দিলো নে। ক্ষীণদৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,,,
---- শাড়িতে তোকে দারুণ লাগছে।
আমি মুচকি হেসে বললুম,,,
--- আমাকে তো সবসময়েই তোমার দারুন লাগে। যাক গে থ্যাংক ইউ।
.
আমি তার জন্য কড়া দুধে মালাই কফি বানালুম, সাথে একটা পিরিচে নিলুম কিছু কাজু। কফির সাথে কাজুবাদাম চিবুতে সে বরাবরই ভালোবাসে সেকথা আমার অজানা নয়। ক্যাম্পাসের দিনগুলিতে তাকে কত দেখেছি কফির সাথে কাজু চিবুতে। একদা তো আমি হেসেই মরে যাই, হাসতে হাসতে তার গাল টেনে বলেছিলুম,,,
--- জামান ভাই তুমি এগুলা কি ছাঁইপাশ খাওয়ার অভ্যাস গড়েছো? কফির ভিতরে কাজু বাটনা করে মিক্স করলে হয়ত আলাদা ফ্লেভার আসে কিন্তু এভাবে কেউ কফির সাথে আস্তো কাজু গলাধঃকরণ করে?
সে আমার কথা মনে নিলো না, বরঞ্চ সে আমাকে পাশে বসিয়ে বললো,,
--- সবকিছুই একবার না একবার ট্রাই করতে হয়। খেয়েই দেখ না, ভালো না লাগলে তখনই না হয় বলিস?
আমি তার কথা রাখতে সেদিন জোরপূর্বক সামান্য মুখে নিলেও, এখন তা আমার নিয়মিত অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার চোখের কোণে জল এসে গেলো, জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনগুলি যে আর কখনোই ফিরে আসবেনা সেকথা ভাবলে কারই না কান্না পায়!!!
.
শাড়ির আঁচল দিয়ে আমি চোখের জল মুছলুম,তার হাঁক শুনে দ্রুত কফি নিয়ে গেলুম। সে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,,,
---- এক কাপ কফি করতে এত সময় লাগে বুঝি? কিন্তু হ্যা, এত বছর পরও তোর হাতের কফির স্বাদ পাল্টায়নি। সবসময়েই একই রকম স্বাদ পাই তোর কফিতে। যেমনটা পেয়েছিলুম ক্যাম্পাসের দিনগুলিতে আমার নিজের হাতে ঘটা করে বানানো কফির মধ্যে।
আমি হেসে বললুম,
--- তোমার কাছ থেকেই তো শিখা।
সে হাসিরসাত্মকভাবে বলল,,,
---- তা কফি বানাতে বানাতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? নিশ্চয়ই দুয়েকবার পতিদেবতার নিকট হতে ঘুরে এসেছো?
আমি চুপ করে রইলুম, সাথে বিষয়টাও এড়িয়ে গেলুম।
সে দ্বিতীয়বার কাপে চুমুক দিয়ে বলল,,,
--- আচ্ছা মাফি, তুই তো নারীবাদী হয়ে অনেক বড়সড় কাজ করিস, বাল্যবিবাহ নিয়ে উচ্চস্বরে স্লোগান দিস। বলতে কি পারিস, একটা মেয়েকে যদি অপরিপক্ক বয়সে বিয়ে দিলে তা বাল্যবিবাহ হয় তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রে কেন এই অবিচার! কেন একই কারনে একটা ছেলেকে বিয়ের মঞ্চে বসালে সেটা বাল্যবিবাহ হবেনা?
আমি তার চোখ মুখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ দেখতে পেলুম। বললুম,,,
---- আমি বুঝতে পারছি কেন তুমি একথা বলছো। কিন্তু তোমার আর আশালতার বিয়েটা ছিলো বহুদিন আগের, তখনকার সময়ে এসব আইন পাশ ছিলো নে৷ সেসময়ে শুধু তুমি কেন মায়ের বুকের দুধ ছাড়েনি এমনও অহরহ বাচ্চাদের বিয়ের পিড়িতে বসানো হয়েছে। হচ্ছে হলোগা তাতে শুধুই বাচ্চাদের মা-বাবার শখ মিটেছে, বাচ্চারা তো বুঝবান না হওয়া পর্যন্ত সংসার জীবন কি তা বুঝেনি।
--- হ্যারে নীতিবাক্য শুনালি। আমি নিজেই এখন হারে হারে টের পাচ্ছি বাল্যবিবাহের সংসার জীবন আসলে ঠিক কেমন। -- উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলল।
তার কথা শুনে সহসা আমার ভিতরে আবারও জানার আগ্রহ জাগলো। আমি কোনো সংকোচ না করেই তাকে বললুম,,,
--- তা তুমি তো অর্ধেক বলে চুপ রইলে, বাকিটুকু কি বলবেনা? নইলে কি করে আমার বোধে আসবে আসলে আশালতা আর তোমার সংসারে ঠিক হয়েছেটা কি?
সে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বাদাম চিবুতে চিবুতে বলল,,
তারপর দিনকাল ভালোই কাটছিলো। শহরের ভার্সিটি থেকে মাস্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করলুম। আমি চাইলেই বড় কোনো চাকুরি নিয়ে শহুরে বাবুদের সাথে অনায়াসে মিশে যেতে পারতুম। কিন্তু আমি তা করিনি, আমার যে বাড়ির প্রতি অদ্ভুত টান। ভেবেছিলুম গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতা করবো। সাথে সাথে নিয়ম করে রোজ বউটারও খোঁজ খবর নেয়া হবে। পড়াশুনার জন্যে এখানে ওখানে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তো কখনও বউটার সাথে বসে চারটিখানে গল্পও জুড়া হলো না। ভাবলুম পড়াশুনা শেষ, আর কোথাও দৌঁড়াবো না। বউটার কাছাকাছি থেকে মনের যত খায়েশ আছে সব মিটাবো। কিন্তু আমার আর সে সৌভাগ্যে হলো কই? আমি সেই অভাগা যে কিনা নিজের বউকে ভালোবাসতে গিয়ে জানতে পারলুম আমার বউ আমায় ভালোবাসেনা, সে ভালোবাসে আমারই মামাতো ভাইকে। যে কিনা আমার থেকে বয়সে দু'দফা ছোট। বীজ বপন করার পর পরিচর্যায় তা একসময় গাছে পরিণত হয়। তারপর পুষ্ট হয়ে কলি ফোঁটে, সেই কলি পরিস্ফুটিত হয়ে পাঁপড়ি -পরাগ ছড়িয়ে সামনে থাকা জীবকে বিমোহিত করে। তার মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলে তাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার আকাঙ্ক্ষা। আর তখনই কিন্তু ঐ জীব দ্বারা ফুলটি গাছ থেকে বিচ্যুত হয়। আশালতার হয়েছে তেমন দশা। আমার বাড়ির ছায়াতলে মানুষ হয়ে সে তার প্রস্ফুটিত পাঁপড়ি - পরাগ মেলে ধরেছে। আর আমার মামাতো ভাই সেই সুগন্ধে বিমুগ্ধ হয়ে তাকে একান্ত নিজের করে পেতে চাইছে। তাতে অবশ্য আশালতারই সায় আছে, যতই হোক সে নিজেও যে তাকে ভালোবাসে।
একথা শোনার পর আমার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো৷ আমি অবাক হয়ে জামান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলুম।
.
আশালতাকে আমি হাতে গোনা কয়েকবার স্বচোক্ষে দর্শন করেছিলুম। উত্তরবঙ্গে মামা বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় মাঝে মধ্যেই জামান ভাইয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতুম। আমি আশালতাকে নিবিড় পর্যবেক্ষন করে দেখেছি সে বেশ গোছানো এবং পরিপাটি মেয়ে। সংসারের প্রতিও বেশ যত্নশীল। সেই মেয়ে এমন অযাচিত কর্মকান্ড ঘটাবে আমি তা বিশ্বাস করতে পারছিনে৷ তবে জামান ভাইও যে মিথ্যে কথা বলার মত মানুষ নন। আমি তাকে সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে চিনি। যদিও সে আমার সিনিয়র আর আমি জুনিয়র। কিন্তু আমাদের মেলামেশা দেখলে কেউ কখনও সে ব্যাপারটি আন্দাজ করতে পারেনি৷ মূলত এমন এক অবাঞ্চিত কারনেই আশালতাও আমাকে সইতে পারছিলো নে । কিন্তু সে যেমনটা ভাবছে ব্যাপারটা তেমনও নয়। জামান আমার প্রেমিকপুরুষ নয়, আবার সো কলড ভাইও নয়। সে শুধুই আমার বন্ধু। যেই সম্পর্কতে কখনও পরিণয়ের ভয় থাকেনা। যে সম্পর্ক বজায় রেখে একসাথে পাশাপাশি পথ চললে নিজেকে কখনও বিপরীত অর্থাৎ আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মনে হয়না। যার সাথে গল্প করতে হাজারো নিশুতি রাত পাড় করা যায় অথচ তাকে একটিবারের জন্যও স্পর্শ করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়না। মোদ্দাকথা জামান আর আমার সম্পর্ক আত্মিক, কাম বাসনার নয়। কিন্তু একথা কোনোদিনই একজন বলিষ্ঠ পুরুষের স্ত্রী সহজভাবে নিবেনা, আমার প্রতি আশার উগ্রভাব প্রকাশ হলে তবেই আমি জামানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। আর সেই আশালতা কিনা আজকাল তার প্রণয় দেবতাকে কাছে না টেনে ভীন পুরুষকে কাছে টেনে পাপে আড়ষ্ট হচ্ছে!!
.
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমি এক প্রকার ধ্যানে চলে গেলুম। চেতনায় আসলুম তার কথা শুনে। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,,,
--- কি ভাবছিস, আশালতার কথা?
আমি কিঞ্চিৎ অস্বস্তিবোধ করে বললুম,,,
--- হ্যা, আশালতার মত একটা পরিপাটি মেয়ে এটা কি করে করতে পারে সেটাই ভাবছি।
সে হাসলো। বলল,,,
---- এখানে আমি পুরোপুরি আশালতার দোষ দিতে পারছিনে৷ দোষ আমাদের সমাজের, আমাদের পরিবারের। তখনকার সমাজ কি করে মেনে নিলো দুটো অবুঝ ছেলে-মেয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক৷ আর আমাদের পরিবারের কথা কি বলবো। তারা তো বিয়ে দিয়ে নিজেদের শখ মিটিয়েছেন, ছেলে-মেয়ের বৈবাহিক সম্পর্কে যে কলোহ সেদিকে দৃষ্টিগোচর করার মত বিন্দুমাত্র সময় তাদের কখনোই ছিলো নে। হ্যা মানছি আশালতা যা করছে সেটা ভুল। কিন্তু ভুলে পথে যেতে পরিবার, সমাজই তাকে সহায়তা করেছে। আমার সাথে যখন তার বিয়ে হয় তখন সে পুরোপুরি অবুঝ। কিছু ধরা বাধা নিয়মের মধ্যে সে বড় হয়েছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার হৃদয়ে যখন প্রেমের ফুল ফুটলো তখন সে আর নিজেকে নিয়মগুলোর মধ্যে ধরে রাখতে পারেনি। তাই আমি তাকে কোনো দোষ দিচ্ছিনে। যা দোষ পুরোটাই বয়সের আর বাকিটা আমার ললাটের।
কথাগুলো বলে সে চোখ বুঝতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে বিন্দু জল ঝড়লো। আমি আরেকটা চেয়ার নিয়ে তার কাছাকাছি বসে জলটুকু মুছিয়ে দিলুম। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলুম মানুষটা আসলেই বড় অদ্ভুত। যতই কঠিন মুহূ্র্ত আসুক না কেন সে ঠিক সহজেই মানিয়ে নেয়।
.
মনে পড়ে গেলো ভার্সিটি লাইফের কথা,
ব্যারিস্টার লতিফ মুন্সীর ছেলে ইশরাক আমার ক্লাসমেট। তার বাবা দেশের নাম করা একজন গুণী ব্যক্তি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু বাবার গুণকে নিজের অপশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা কতটুকু যৌক্তিক তা আমি জানিনে। ভার্সিটির অধিকাংশ মেয়েরাই খ্যাতি আর যশের জন্যে ইশরাকের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়তো, অথচ সে কিনা তাদের রেখে শেষে আমাকে প্রেম নিবেদন করলো। আমি সাদামাটা মানুষ, ভার্সিটিতে যাই ক্লাস করি, আর অর্ধবেলাতে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরি। এসব প্রেম ভালোবাসা আমার চরিত্রে যায় নে। তাছাড়া ইশরাকের স্বভাব চরিত্র আমার কোনো কালেই মনে ধরেনি, যে মানুষ অপকর্ম করে বাপের নাম বেচে বুক উচিয়ে চলে দেহে প্রাণ থাকতে অন্তত আমি মাফি তাকে মহব্বত করতে পারিনে। স্বভাবত এসব কারনেই জামানের সাথে আমার উঠা বসা ইশরাক পছন্দ করতো নে। একদিন তো সে ভার্সিটির মাঠে সকলের সামনে আমাকে অপমান করেই বলল জামানের সাথে নাকি আমি হষ্টি নষ্টি করে বেড়াই। অথচ নোট আদান প্রদান আর মাঝে মাঝে একসাথে বসে দুয়েক কাপ কফি খাওয়া ছাড়া জামান ভাইয়ের সাথে আমার কোনো আলাদা সম্পর্কই ছিলো নে। আমার অপমানে জামান সেদিন চুপ থাকেনি, সে প্রতিবাদ করলো। যার ফলস্বরূপ জামানের হলো মূর্ছা যাওয়ার মত অবস্থা৷ ইশরাক ধূর্ত এবং চতুর প্রকৃতির ছেলে মানুষ। সাথে বাপের ক্ষমতার সংমিশ্রণ তাকে গড়ে তুলেছিলো অমানুষ। সেদিন চেলাকাঠের বারিতে জামানের মাথা রক্তাক্তও করলো সে আর তার দলবল, অথচ তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে আমাদের নালিশও কোনো কাজে আসেনি। ঠিক সে পার পেয়ে গেলো, আর নিরঅপরাধ জামান পুরো একটা মাস ধরে গড়াগড়ি খেলো হাসপাতালের বেডে। এ ঘটনায় আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। যাই হোক না কেন আমার জন্যেই তো আজ তার এমন দশা হলো। জামান আমার হাতটি ধরে বলেছিলো,,
--- তুই নিজেকে দোষারোপ কেন করিস? ইশরাকের কথাবার্তা শুধু তোর না আমারও মানে আঘাত হেনেছে। তবে ইশরাকের সাথে আমার সেদিন ওভাবে চেঁচানো উচিত হয়নি। তাকে গোপনে ডেকে বিষয়টা শলাপরামর্শ করে নিলে হয়তো এমন দ্বন্দ হতো নে।
রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। যেই অমানুষটার জন্যে আজ সে বিছানায় পড়ে আছে তার দোষ ঢেকে সব দায়ভার নিজের উপর বর্তায়ে আসলে সে কি প্রমাণ করতে চায় আমি বুঝিনে। রাগের চোটে আমি তার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললুম,,,

সাবস্ক্রাইব করুন:

--- এতো ভালো মানুষ হয়ো না গো, বেশি দিলদরিয়া হলে একদিন দেখবে সমস্ত অভিশাপ তোমার উপরে এসেই লাগবে।
সে মুচকি হেসে বলল,,,
--- জীবনটা আর কতটুকু অভিশপ্ত হবে বল, হোক না হয় একটু অভিশপ্ত তবুও না দ্বন্দ আসুক এ ছোট জীবনের অংশ হয়ে। আজ দুনিয়ায় আছি, সময় ঘনিয়ে আসলে একদিন ঠিক চলে যাবো দুনিয়া ছেড়ে। তার মধ্যে শুধু শুধুু দ্বন্দকে ডেকে এনে লাভ আছে বল?
.
এসব কথা ভেবে ভেবে আমি পুরোপুরিভাবে অতীতে হারিয়ে যাচ্ছিলুম। হঠাৎই কলিংবেল বাজলো,
আমি তৎক্ষনাৎ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলুম সীমান্ত এসছে, হাতে সদাইয়ের ব্যাগ। সীমান্ত আমাদের ভাড়াটিয়ার ছেলে। আমি একা মানুষ, বাজার সদায় যখন যা লাগে সীমান্তকে বলি সে কষ্ট করে হলেও তা জোগাড় করে দেয়। যার দরুন আমাকে মানতে হয়েছে তার নিকট হতে প্রাপ্ত শর্ত। কখনও যদি সে পরীক্ষায় কম মার্কস পায় তবে যেন আমি তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে চেলাকাঠের পিটুনির হাত থেকে রক্ষে করি। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বর্তমানে পরিবারগুলোর হয়েছে এই এক বেহাল অবস্থা৷ অমুকের মেয়ে ম্যাথে স্টার পেলো তুমি কেন পেলে না, এই কেন এবং না এর রোগে তাদেরকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে। তাদের সর্বনিম্ন বিবেবকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে অহমিকার গড়িমসিতে। তাদের বোধে একটুকু কুলোচ্ছে নে, বাচ্চাদেরকে বেধম পিটুনি দিলেই তো ম্যাথে স্টার উড়ে উড়ে আসবেনা, তাদরকে বুঝিয়ে এবং ভালোবাসা দিয়ে পড়াশোনার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী করে তুলতে হবে। তবেই তো তারা সবকিছুতে সাইন করবে। সীমান্তর বাবা-মাকে কয়েকদিন বসে থেকে বুঝিয়েছি, ছেলেটাকে এভাবে না মারতে। যদি পিতা-মাতা দুজনই তার বিরুদ্ধে যায় তাহলে ছেলেটা যাবে কোনদিকে? একজনকে না একজনকে তো ছেলেটার ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। না হয় তারা সময় ভাগ করে হুঁশিয়ার থাকুক তবুও ছেলেটাকে এভাবে না মারুক। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি। লাস্ট যেইবার ছেলেটাকে মারলো আমি ডিরেক্ট গিয়ে থ্রেড দিয়ে আসলুম,,,
---- ফের যদি ছেলেকে মারো, তবে অন্য বাসা খুঁজে নিতে পারো। আমার বাসায় কোনো জালিমদের আশ্রয় দেবো নে।
সীমান্তের বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা চলছে। এই মুহূ্তে তার পক্ষে নতুন বাসায় উঠা সম্ভব না। আর এই শহরের এত কমে আমার বাসার মত খারাপ সয় ভালো বাসা তারা পাবেনা সেকথা আমার অজানা নয়।
.
আমি সীমান্তর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললুম,,,
---- যা যা আনতে বলেছিলুম সব ঠিকমক এনেছিস তো?
সীমান্ত ভেঙচি কেঁটে বলল,,,
---- খুলে দেখলেই পারেন।
আমি ব্যাগটা খুলে দেখলুম গোটা চারেক ইলিশ, আর একটা আস্তো মেটে আলু, সাথে সোয়াখানেক সরিষাও আছে। সীমান্ত ঘরের ভিতরে ঢুকলো নে তবে উঁকি দিয়ে দেখলো আমার ঘরে কোন অতিথির আগমন ঘটেছে। ও দরজা টেনে যেতেই আমি পিছু ডেকে বললুম,,
---- সীমান্ত শোনো ভাই,
----- কিছু বলবে দিদি?
আমি বললুম,,
---- হ্যা শোনো রাতে অংক বই নিয়ে চলে এসো, ঐ যে দাদাকে দেখতে পাচ্ছো সে অংক খুব ভালো করায়।
সীমান্ত মাথা নেড়ে চলে গেলো। আমি সদাইয়ের ব্যাগ নিয়ে ভিতরের দিকে যেতেই জামান আমাকে ডাকলো। আমি ব্যাগটা রেখে তার কাছে গেলে সে বলল,,,
----- কে ছিলো? তোর বাপের বাড়ির লোক তো কেউ দেশে নেই। তবে নিশ্চয়ই তোর অপরদিকের বাড়ির লোক?
আমি ভ্রু কুচকে বললুম,,
--- তুমি সবসময়েই কেন আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে পড়ে থাকো বলোতো? তোমার দৃষ্টিতে কি নারী মানেই বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি! তাছাড়া তাদের কি নিজস্ব কোনো জীবন থাকতে পারেনা?
সে কিছুটা থমকে বলল,,,
---- স্বামী-সংসার, শ্বশুরবাড়ির কথা বললেই তবে কেন তা এড়িয়ে চলিস? সত্যিই কি বিয়ে-শাদী করিসনি?
--- না করিনি, এক জীবনে বিয়ে, সংসারই সব না। আমি যথেষ্ট শিক্ষিতা এবং স্বাধীন মেয়েমানুষ। সমাজের বুকে আমি মাথা উঁচু করে একাই চলতে পারি, তাতে অন্তত কারো উপরে আমাকে ডিপেন্ডেট হতে হয়নে। এবং আমি আমার এমন স্বাধীন জীবন নিয়েই খুশি।
সে হেসে জবাব দিলো,,
---- ধুরো বোকা, এটা প্রকৃতির নীতি। এই এক জীবনেই বিয়ে, সংসার এসবের দরকার আছে। নইলে সুখ পাবি কি করে? চিরটাকাল যে একাকীত্বে ভুগবি।
আমি না চাইতেও ফস করে মুখের উপর বলে ফেললুম,,,
--- তা তুমি তো বিয়ে করেছো, তুমি কেন অসুখী? সেই তো ঘরে আজ বউ, সুন্দর গোছানো একটা সংসার থেকেও তুমি একাকীত্বে ভূগছো।
কথাটা বলে আমি নিজেই অবাক বনে গেলুম। কথার জবাবে কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই জামানকে কষ্ট দিয়ে ফেললুম। সে আশ্চর্য হয়ে চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ আমি দিশেহারা হয়ে তার হাত চেপে ধরে বললুম,,,
---- প্লিজ! আমি কথায় কথায় বলে ফেলেছি, যেরকম ভাবছো সেরকম মনে করে কিছু বলিনি।
সে তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। এবং তখনও তার হাতটা তুমুল বেগে কাঁপছিলো। সে চলে যাচ্ছে, আমি পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে রইলুম। তাকে আঁটকাতে তার সামনে দাঁড়ানোর মত মুখটি যে আমার নেই। শুধু ভারী কন্ঠে একবার বলেছিলুম,,,
---- অনেক স্বাদ করে তোমার জন্যে ইলিশ আনিয়েছি, প্লিজ! না খেয়ে যেয়ো নে।
কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। অভিমানী হয়ে হনহন করে চলে গেলো৷ আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ছায়াটাও বিলীন হয়েছে।
.
আমার মনের মধ্যে উশখুশ হচ্ছে, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিনে। মানুষটা এমনিতেই একরাশ দুঃখ নিয়ে সামান্য সুখ খুঁজতে এসছিলো আমার কাছে, আর আমি কিনা তাকে উল্টো আরো বেশি দুঃখ দিলুম।
.
সারারাতে আমার ঘুম হলোনে। ঢাকা থেকে জামানের বাড়ি পৌঁছানো মধ্যকার সময়ের ব্যবধান পুরো একদিন। এই একটাদিন আমি অনেক কষ্টে কাটিয়েছি। না হচ্ছে খাওয়া দাওয়া না হচ্ছে ঘুম। আমার মাথাতে শুধু একটাই টেনশন যে করেই হোক জামানের নিকট আমাকে ক্ষমা প্রার্থী হতেই হবে। একদিন পর আমি আন্দাজ করলুম এখন নিশ্চয়ই সে বাড়িতে পৌঁছেছে। আমি টেলিফোন করলুম। কিন্তু রিসিভ করলো আশা। আমি তাকে জামানের কথা জিজ্ঞাসা করতে না করতে সে ওপাশ থেকে চোটপাট শুরু করলো। আমাকে সে নানাবিধ গালাগালি দিয়ে বলল,,
---- কেন ফোন দিয়েছো, তার কাছে তোমার কি চাই? সে শহরে থাকতেই তো তার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছো। নষ্ট মেয়ে ছেলে, এক নারী হয়ে আরেক নারী পতিদেবতার দিকে নজর দিতে তোর শরম করলো না?
আমি আশার কথাতে বেশ অবাক হলুম। সে কি ভেবে যে আমাকে এসব বলছে আমি বুঝতে পারছিনে। কিন্তু তার এ অবাঞ্ছিত কথাবার্তাও আমার সহ্য হচ্ছিলো নে। তাই রাগের মাথায় বলে ফেললুম,,,
---- তা, তুমি কতটা ভদ্র মেয়েছেলে গো, যে কিনা নিজের পতিদেবতাকে রেখে তারই অগোচরে ভীন পুরুষকে সোহাগ বিলাও। শোনো মেয়ে তোমার থেকে আমি হাজার গুনে সৎ চরিত্রের মানুষ। জামান শুধুই আমার বন্ধু, তুমি বিষয়টা যেভাবে নোংরামির সাথে তুলনা করছো আমি তাকে কোনোদিন সেই দৃষ্টিতে দেখিনি। তার মানে এমনও না যে তাকে আমি ভালোবাসিনে। তাকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসি। কারন পৃথিবীতে সব ভালোবাসা প্রেমী, বাগদত্তার ক্ষেত্রেই হয় না কিছু ভালোবাসা বন্ধুর জন্যও হয়। যেই ভালোবাসায় কখনও মধ্যবর্তী নিষিদ্ধ আকর্ষণ থাকেনা। বিষয়টা কি বুঝতে পেরেছো? তবে তোমার মত পর চোখা মেয়ে মানুষরা এসব বুঝতে নাও পারো। আর হ্যা তোমার পতিদেবতাকে দয়া করে বলে দিও আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
জামানের মামাতো ভাইয়ের সাথে আশালতার অবৈধ সম্পর্কের কথা তাকে মুখের উপর বলে খানিকবাদে নিজেই নিজের দাঁতে জ্বিভ কেটেছি। এটা কি করলাম আমি? এক ভুলের ক্ষমা চাইতে গিয়ে আরেকটা ভুল করে ফেললাম না! এজন্যই বোধ হয় বলে মেয়ে মানুষের পেটে কথা সয় না। জামান আমাকে বলেছিলো আশার সম্পর্কের ব্যাপার যে জামান জানে সেটা আশার অবগত নয়। এদিকে কিনা আমার জন্য আশা জেনে গেলো যে শুধু জামান না ব্যাপারটা আমার কান পর্যন্ত চলে এসছে। না জানি এটা নিয়ে এখন সেখানে কি তুমুল কান্ড বাধে!
.
আজ জামান যে অবস্থায় আছে একটাসময় ঠিক তেমন অবস্থাই হয়েছিলো জামানের বাবার। কিন্তু ঘটনা একটু ব্যতিক্রম। মা-বাবার আল্হাদীপনার কারনে জামানের বাবাকেও ছোটবেলাতে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো তার ফুফাতো বোনের সাথে। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে ছোটবেলার ঐ বিয়ের প্রতি তার ঘেন্না ধরে যায়। ফলে সংসারের প্রতি নেমে আসে অনীহা। যার দরুন তার নিকট হতে তার সেই ছোটবেলার বউ হয় তালাকপ্রাপ্ত আর জামানের মাকে ভালোবেসে বিয়ে করে তিনি নতুনভাবে সংসার জীবন গড়েন। ছোটবেলা থেকে এই গল্প শুনতে শুনতে জামানের ভিতরে বিরক্তির উদ্রেক ঘটে। তার বাবার সাথে যে ভুলটা হয়েছিলো জেনে শুনে তার বাবা কি করে সেই একই ভুল তার সাথে করলো সেটাই সে বুঝতে পারছিলোনে। তবে সে ভেবেই নিয়েছিলো দ্বিতীয়বার তার বাবা যে ভুলটা করেছিলো সে নিজে সেটা করবেনা। বাবার গল্প শুনে দিনে দিনে সে নিজের চরিত্রে পরিবর্তন এনেছে। তার বাবা ছোটবেলার বিবাহিত বউকে ছেড়ে দিলেও সে চেয়েছিলো আশাকে নিয়েই সারাজীবন ঘর বাঁধতে৷ কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এখানে কিনা জামানের বাবার চরিত্রের প্রতিবিম্ব হিসেবে আশার চরিত্রের দেখা মিললো। জামান কখনোই চায়নি তার চরিত্রে তার বাবার মতন দ্বিতীয় বিয়ের ছাপ লাগুক। কিন্তু আশার সুখের কথা ভেবে আর সংসারী হতে হলে যে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হবে এই দুঃখেই সে মরিয়া হয়ে আছে।
.
আশার সাথেই ছিলো জামান সম্পর্কিত আমার শেষ কথা। সেদিন রাতে সীমান্ত বই খাতাসহ বড্ড আশা নিয়ে এসে ঘুরে গিয়েছিলো বাসা থেকে। কিন্তু আমার মন এতটাই বিষণ্ন ছিলো যে আমি একটাবারের মতও ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ফিরে তাকাইনি। শুধু চাপাস্বরে বললুম,,,
---- আপাতত দরজাটা লাগিয়ে চলে যাও, আমার শরীর ঠিক হলে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে অংক করিয়ে দিয়ে আসবো।
আমি সীমান্তর দিকে ফিরে তাকাইনি সত্য কিন্তু বুঝতে পেরেছিলুম তার ভারাক্রান্ত মনের আক্ষেপ। সে আসলে চেয়েছিলো অংকের পাশাপাশি জামানের কাছ থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর গল্প শুনতে। মা-বাবা কখনও তাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যায় না কিনা। সবসময় বন্ধুদের কাছে গল্প শুনে শুনে বড্ড আফসোস হয় তার। সেও যদি কখনো কোনো নতুন সিনেমার গল্প সবার আগে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারতো তবে কতই না ভালো হত। আমি সীমান্তর মা-বাবাকে এত করে বলেছি সারাদিন বাচ্চাদের পড়াশুনার ভিতরে রাখলে তাদের মধ্যে একঘেয়েমি ভাব চলে আসে। মাঝে মধ্যে তাদের একটু বিনোদনেরও দরকার আছে। কখনো তো ছেলেটাকে নিয়ে একটু সিনেমা টিনেমাও দেখে আসতে পারো? প্রতিত্তরে সীমান্তর মা বলল,,,
---- তুমি ভাই তোমার মনমর্জিমত কথা বলতেছো। আমি থাকি সারাটাদিন রান্না ঘরে কুটনো কাটতে ব্যস্ত, আর অন্যদিকে তার বাবা ব্যবসার চাপে ঠিকমত খাওয়া দাওয়ারও সময় পায় নে। তবে বলোতো কার এত অযথা সময় হবে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর?
আমি আর তাদের সাথে কথা বাড়ালুম নে। মনে মনে ভেবে রাখলুম সময় সুযোগ হলে একদিন আমি নিজেই না হয় ছেলেটাকে বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবোক্ষন।
.
তারপর পরবর্তী তিনমাসের মধ্যে জামানের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। কয়েকদিন মন খারাপ করে দিন কাটালেও সময়ের সাথে সাথে আমি আমার ব্যস্ত জীবন নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছি। এর মধ্যে হঠাৎই একদিন তার আগমন ঘটলো আমার বাড়িতে। গোধুলি লগ্নে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় হালকা সাউন্ডে রেডিওতে গান শুনছিলুম। সে দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে আসার অনুমতি চাইলে আমি পিছু ফিরে এতদিন পর স্বশরীরে তাকে আমার দরজায় দাঁড়ানো দেখে অবাক হলুম নাকি খুশিতে আত্মহারা হলুম বুঝতে পারছিলুম নে। আমি কিছুক্ষনযাবত তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম,,,
--- হঠাৎ তুমি?
সে ভঙ্গিমার স্বরে উত্তর দিলো,,
--- কেন তোর বাড়িতে আসতে আমার না আছে নাকি?
আমি লজ্জা পেলুম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,,,
--- আরে কি বলো না বলো,, ভিতরে এসো, বসো এখানে৷ আর হ্যা ভুল আমার হতেই পারে তাই বলে গতবারের মত না খেয়ে যেন চলে যেওনে।
সে হাসলো। তার মৃদু হাসিই প্রমাণ করলো সে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তারপর একসাথে বসে আড্ডা দিতে দিতে চিরায়িত সেই কফির সাথে কাজু চিবুতে চিবুতে তার জন্যে সর্ষে দিয়ে ইলিশ আর মেটে আলু রান্না করার সময় হয়ে গেলো।
.
আমি সব মশলা দিয়ে হাতমাখা করে চুলোতে রান্না বসাচ্ছিলুম। এমন সময় সেও রান্নাঘরে আসলো খুন্তি নাড়তে। সে তরকারি নাড়ছে আর আমি তাকে আড়চোখে দেখে ভাবছি,,
-- এই মানুষটা রসিকও আছে বটে।
রান্নার এক পর্যায়ে একটা ছোট বাটিতে আমি তাকে সামান্য তরকারি তুলে দিয়ে বললুম,,
--- দেখোতো নুন ঝাল সব ঠিক আছে কিনা।
সে বাটিটা আমার হাত থেকে নিয়ে পাশে সরিয়ে বলল,,
---- সে না হয় দেখব ক্ষন। আগে তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললুম,,
--- কি?
সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,
--- উইল ইউ ম্যারেই মি মাফিয়া?

সাবস্ক্রাইব করুন:

আমি যেন তব্দা খেলুম। এক জীবনে আমি তার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। কিন্তু তাকে নিয়ে আমি কখনো এরকম ভাবিনি। আর আমি যতদূর জানতুম সেও আমাকে নিয়ে এমন কিছু ভাবেনা। তবে আজ হঠাৎ কি করে তার এই পরিবর্তন? আমি সত্যিই আমাদের সম্পর্কের এরকম কোনো পরিণতি চাইনে কিন্তু তবুও কেন যেন থতমত খেয়ে বলে ফেললুম,,,
---- কিন্তু আশালতা?
জামান আমার হাতটি ধরে আমাকে রান্নাঘর থেকে সোজা বারান্দায় নিয়ে গেলো। যেখানে বসে আমাদের নিয়মিত গল্পের আসর। সে নিজে একটা চেয়ার পেতে বসলো আর আমাকেও একটা চেয়ারে বসে বলতে আরম্ভ করলো,,
---- শোন মাফিয়া, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো সংসার বাধা যায় নে। ঐদিন তোর ফোনের পর আশা আর আমার বেশ ঝামেলা হয়। যার দরুন বাড়ির লোকেরাও আশা আর আমার মামাতো ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। আমি তাকে ধরে রাখার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখিনি, কিন্তু সে কিছুতেই আমার সাথে সংসার করবেনে। এ পরিস্থিতে আমি কি করতে পারতুম বল? তাই কিছুদিন পরই আইন মেনে তার সাথে লিখিতভাবে আমার ডিভোর্স হয়ে যায়। সে তার শান্তির প্রয়াসে নতুন করে সংসার গড়ে আমার মামাতো ভাইয়ের সাথে। আর আমি গত দু'মাস ধরে নিজেকে অনেক বুঝিয়ে মনটাকে ঠিক করেছি। চিরটাকাল তো এভাবে একা থাকা যায় নে। কিন্তু সারাজীবন একসাথে কাটানোর মত এতটা বিশ্বাসযোগ্য মানুষই বা আমি কই পাবো? যে মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে আদর যত্ন করে বড় করলুম সে-ই তো আমার বিশ্বাসের মান রাখলো নে। আমি কেমন জানি দোটানায় পড়ে দোদুল্যমান হয়ে গিয়েছিলুম। কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারছিলুম নে। এরপরেই আমার তোর কথা মনে হলো। তোর সাথে আমার যে বন্ডিং আমার মনে হলো তোর সাথেই আমি আমার বাকি জীবনটা অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবো।
জামানের এসব কথা আমি আর নিতে পারছিলুম নে। আমার দুচোখ জুড়ে কান্না চলে আসলো। আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বললুম,,,
---- চুপ করো তুমি। আমি তো তোমাকে নিয়ে এরকম কখনো ভাবিনি। আমি তো এটা চাইনে। আমি শুধু জানি তুমি আমার কমরেড।
জামান আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,,
--- কমরেড! কমরেড মানে কি?
আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললুম,,,
--- আমি জানিনে, তবে কোনো একসময় প্রবোধকুমার সান্ন্যালের একটা বইয়ে পড়েছিলুম, "ভাই, বন্ধু, ভগ্নিপতি, স্বামী আর প্রণয়দেবতা এই সবকিছুর সংমিশ্রণে একটা মধুর ক্যামিকাল শব্দ কমরেড"। যেই সম্পর্কতে কখনও বিপরীতধর্মী আকর্ষণ থাকেনা। যেই সম্পর্কে তুমি পুরুষ নাকি নারী তা আমি জানবো না, শুধু জানবো আমি আমার কমরেডকে কাছে টেনেছি।
সে আমার কথা শুনে খিলখিল করে হাসলো। আমি কেঁদেমেদে একাকার হয়ে বললুম,,,
--- তুমি হেসোনে তো। আমার বেজায় কষ্ট হচ্ছে। যা ভাবনাতে এনেছো সব বাদ দাও। এখন তুমি ও স্বাধীন মানুষ আর আমি স্বাধীন মানুষ, সংসারের কোনো পিছুটান নেই আমাদের। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে এরচে চলো দুই কমরেড মিলে ঘুরে বেড়াই না হয় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।
সে আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,,
--- উহুম, তুমি শিক্ষিতা মেয়ে মানুষ। কালে কালে যে পৃথিবীতে হাজারও নিয়মের পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হয়েছে সেকথা তোমার অজানা নয়। মানব জীবন বড়ই বিচিত্র! এমন অনেক ব্যাপরই আছে যা আমরা মেনে নিতে পারিনা কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে তা আমাদের গ্রহণ করতে হয়। এতদিন ধরে পৃথিবীতে কমরেডের যেই সংজ্ঞা বিরাজমান ছিলো আমরা দুজন না হয় আমাদের প্রণয় ঘটিয়ে তা পুরোপুরি পাল্টে দিলুম। তাতে মনে হয়না পৃথিবীজুড়ে এত এত নিয়মের খুব বেশি ক্ষতি হবে। এতদিন কমরেড মানে ছিলো প্রণয় ব্যতীত এবং যৌন আকর্ষণ বহির্ভূত বিপরীতের সাথে আমৃত্যু সম্পর্কের বন্ধন, আজ থেকে না হয় কমরেডের সংজ্ঞায় প্রণয় শব্দটা যোগ হবে। আমরা না হয় কমরেড হয়ে শুধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নয় বরঞ্চ কাস্মীর থেকে কন্যাকুমারী কিংবা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ঘুরে বেড়াবো, তবে কমরেড শব্দটার সাথে প্রত্যেকটা স্থানে ছড়িয়ে রবে আমাদের প্রণয় স্মৃতি।।
আমি তার কথা শুনে আপ্লুত হয়ে আরো জোরে কান্না শুরু করলুম। সে আমাকে বুকে টেনে নিলো। এমন সময় সীমান্ত দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে এসে বলল,,,
---- দিদি, মা-বাবা আজ আমাকে কথা দিয়েছে, সামনের সানডেতে তারা আমাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলুম,,,
--- হঠাৎ তাদের এই আমুল পরিবর্তন?
সীমান্ত হেসে বলল,,,
--- আমি ম্যাথে স্টার পেয়েছি।
আমি জামানের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললুম।বললুম,,,
--- সেদিন তোমার অভিমান করে চলে যাওয়ার ফল এটা। তোমার মনে আঘাত করে আমি শান্তি পাচ্ছিলুম নে। তাই অশান্তি দূর করতে গত তিনটা মাস ধরেই আমি ছেলেটাকে অংক করেয়েছি। ভেবেছিলুম তোমার সাথে হয়ত আমার আর সাক্ষাত হবেনে, ক্ষমা চাওয়া তো দূর কি বাত। তবুও যদি তোমার দেয়া সাজেশন অনুযায়ী অংক করিয়ে ছেলেটাকে স্টার পাইয়ে দিতে পারি কিছুটা হলেও শান্তি পাবো।
----- আমার দেয়া সাজেশন মানে?
আমি হেসে বললুম,,,
--- ক্যাম্পাসের দিনগুলিতে টিউশনির জন্যে তুমি আমায় যেভাবে অংক করিয়েছো, সেকথা বুঝি ভুলে গিয়েছো?
--- কি বলিস না বলিস, আজও তুই থিওরিগুলি মনে রেখেছিস?
আমি তার বুকে আবারও লুটিয়ে বললুম,,
--- আমি আমার কমরেডের দেয়া উপহার কি করে ভুলে যাই বলোতো?
সে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় আমি এই প্রথমবারের মত সিক্ত হলুম। বুঝলুম, এটাকেই বুঝি প্রণয়ের অনুভূতি বলে!! তারপর আমি কান পেতে শুনলুম, সে বিড়বিড় করে বলছে,,
" প্রকৃতি তাহলে অবশেষে আমাকে নারাজ করেনি, আমার যেটা প্রাপ্য দেরিতে হলেও আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে"।

লিখা-- Modhu Chondrima (পপি)
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url