গল্পঃ আজ পরীর জন্মদিন

শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো তুলোর মত ভেসে বেড়ায়।দেখতে ভালো লাগে।তবে গরমটা বেশ পড়েছে আজ।অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা বিরক্ত নয় অর্ণব।আজ ছাতা নিয়েই বের হয়েছে সে।যদিও আশেপাশের লোকগুলো বেশ অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।তবু সবসময় মানুষ কি মনে করল সেটা ভাবলে চলেনা।কোন বিশেষ দিনে সাধারনত কাজগুলো ঠিকভাবে করা যায়না।কোন না কোন একটা ঝামেলা হয়েই যায়।সে হিসেবে আজকের দিনটি খুব ভালোই যাচ্ছে ওর।সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়নি,গোসলের সময় পানি পাওয়া গেলো।শহরের মেসবাড়িগুলোতে কখনই প্রয়োজনের সময় পানি পাওয়া যায়না।বাড়িওয়ালাদের আচরণ দেখলে মনে হয় পানি না তাদের কাছে কিডনি চাওয়া হচ্ছে।শাহেদকেও বাসায় পাওয়া গেলো সময়মত।ওর কাছ থেকে টাকাগুলো ধার না পেলে বেশ বিপদেই পড়তে হত অর্ণবকে।পুরো দিনের প্ল্যানটাকেই নতুন করে সাজাতে হত।টাকা হাতে এসে পড়ায় সে চিন্তা নেই আপাতত।সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার আজ রিক্সা ভাড়া নিয়েও কোন ঝামেলা হচ্ছেনা।যা ভাড়া দিচ্ছে তাই নিচ্ছে,ছেঁড়া ফাটা নোট নিয়েও অহেতুক ঝগড়া বাধাচ্ছেনা।সবই কি শুভ দিনটার কারসাজি নাকি কে জানে!অর্ণবের বেশ খুশি লাগছে এখন।একটু আগে সেলুন থেকে শেভ করে নিল।শেষ কবে শেভ করেছিল মনে নেই ওর।স্বভাবতই চেহারা থেকে এক হলদে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।সে দ্যুতিতে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট।

পকেট থেকে ছোট একটা কাগজ বের করে দেখে নিল অর্ণব।আজ কি কি করতে হবে তা লিখে এনেছে।অনেক সময় ছোট ছোট কাজের ভিড়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ কাজের কথা মনে থাকেনা।অর্ণব মোটেই এতটা গোছানো না।তবে কিছু সময়ে মানুষ নিজের মধ্যে থাকেনা।মনের অজান্তেই অনেকটা বদলে যায়।অনেকটা দায়িত্ববোধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।এই পরিবর্তনগুলো সুন্দর,শুভ্র।আর আজকের মত দিনে এইটুকু আয়োজনতো আশা করাই যায়।
আজ যে পরীর জন্মদিন!!


পরীর সাথে পরিচয়ের পর আজই প্রথম ওর জন্মদিন।তাই এই দিনটার মাঝে রংধনুর প্রত্যেকটা রঙের ছোঁয়া দিতে চায় অর্ণব।পরীর আসার জন্যই এখন অপেক্ষা করছে সে।একধরনের টেনশন কাজ করছে।প্রথম যেদিন দুজন দেখা করে সেদিনও এমন হয়েছিল।পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল অর্ণব।পায়চারী করতে করতে পরীকে এগিয়ে আসতে দেখে।ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলোর আভা পড়ছে ওর উপর।অর্ণব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নীলের উপর লালের কাজ করা একটা জামা পড়েছে পরী।নীল রঙটা এমনিতেই সুন্দর।পরীর স্নিগ্ধতা সে সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব করুন:
.
মুগ্ধতাটুকু কেটে উঠে পরীর কথা শুনে
-সরি।খুব বেশি দেরী করেছি?
-না।একদমই না।
-পাখির খাঁচা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
-খাঁচা না।পাখিও আছে।মুনিয়া পাখি।কিছুক্ষন আগের কথা।কাঁটাবনের এদিক দিয়ে আসছিলাম।হঠাৎ মনে হল তোমার জন্য পাখি কিনে নিয়ে যাই।তাই কিনলাম।
-তো?এখন এটা নিয়ে ঘুরে বেড়াব?
-না।এটা আশেপাশের একটা দোকানে রেখে যাই কি বল?পরে নিয়ে নিব।
অর্ণবের এসব পাগলামি সম্পর্কে মোটামুটি অবগত পরী।মাঝে মধ্যেই রাত বিরাতে বাসার সামনে হাজির হওয়া,উদ্ভট সব উপহার আনা।পাখিটার কথা ভিন্ন।দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।অবশ্য পরী এতে খুশি যে হয়না তা না।মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলেও মনের মধ্যে ঠিকই বলে উঠে 'পাগল ছেলে একটা'।সে কথাটা কেউ শুনেনা।শুধু অর্ণব শুনতে পায়।ঠিক শুনতে পায়।
আজ আমরা সারারাত হাঁটব একসাথে।আমি হিমু হব আর তুমি হবে রুপা।দেখো কি সুন্দর জোছনা উঠেছে।কথাগুলো বলতে বলতে পরীর দিকে একটা বেলি ফুলের মালা এগিয়ে দেয় অর্ণব।পরী এবার অবাক হয়।বেশ ভালো লাগছে ওর।রাস্তাটা ফাঁকা।নীরব নিভৃত নিশিতে বেলি ফুলের সুবাসটা নেশা ধরানোর মত লাগছে।পরীকে এখন ইন্দ্রাণীর মত দেখাচ্ছে।অর্ণবের খুব ইচ্ছে করছে পরীকে সুন্দর কিছু বলতে।কিন্তু মেয়েটা সামনে থাকলে কখনই সেটা সম্ভব হয়না।সব কেমন জানি হয়ে যায়।তবু কথাগুলো যে আজ জানাতেই হবে।যেভাবেই হোক।একটা চিঠি লিখে এনেছে ওর জন্য।'তুমি চিঠিটা পড়।আমি একটু আসছি।'বলেই চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দেয় পরীর।তৃতীয়বারের মত অবাক হয় পরী।


"আজকের দিনটা আমার জন্য কতটা আনন্দের আমি বুঝাতে পারবনা।আজ থেকে তেইশ বছর আগে এ দিনটায় তোমার আগমনে হেসে উঠেছিল তোমার পুরো পরিবার।এতোগুলো মানুষকে খুশি করার পর তুমি আমার জীবনটা রাঙাতেও এতটুকু কার্পণ্য করনি।বরং যতটুকু আমি তোমায় দিয়েছি তা কত শত গুণ করে তুমি আমাকে ফেরত দিয়েছ তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না।মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো?এই যে চাঁদ,তারা,আকাশ সবই সুন্দর শুধু তোমার জন্য।তোমার ভাবনায় বিভোর থাকার আগে আমি মোটেই এসব সুন্দরের খোঁজ পাইনি।


পরী আমি তোমাকে কোনদিন সুখ কিনে দিতে পারবনা হয়ত।মাসে চল্লিশ হাজার টাকায় কখনো সুখ কেনা যায়না।তবে সুখের সন্ধানে সর্বদা তোমার সাথী হব।কথা দিচ্ছি।কথা রাখার সুযোগটা দিবেনা আমায়?আমি জানি আমি তোমায় অনেক জ্বালাব।মধ্যরাতে ঘুম ভাঙিয়ে জোছনা ভেজা রাস্তায় হাঁটব।ঝুমবৃষ্টির রাতগুলোতে বৃষ্টিতে ভিজবো।আমার প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ধাত আমি জানি।তবুও ভিজবো।ঠাণ্ডা আর জ্বরের সময় আমার জন্য একটু আদা চা করে দিতে তোমার খুব কষ্ট হবে?তোমার জন্য গল্প লিখব,কবিতা লিখব।সেগুলো পড়ে যখন তোমার চোখ ছলছল করবে তখন আমার জন্য দু চার চরণ গান গাইতে খুব কি অসুবিধা হবে তোমার?পরী তোমার সুখের কারণ না হতে পারি দুঃখের সাথী কি হতে দিবে আমায়?


আমি তোমার জীবনে থাকি আর না থাকি এই শুভ দিনে একটাই শুভকামনা সুখী হও অনেক।আর আমিই জানি তুমি তা হবে,খুব সুখী হবে।"
এই অল্প কয়েকটা কথা পড়ে চোখের জল আটকাতে পারছেনা পরী।গালের মাঝে বসে থাকা শিশির ফোঁটাগুলোর উপর চাঁদের আলো খেলা করছে।এমন সময় অনেকগুলো ছোট বাচ্চা মোমবাতি আর বেলুন হাতে হ্যাপি বার্থডে বলে উঠল।তাদের মাঝখানে একরাশ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব।পরী এগিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।অর্ণবের হাত ধরে আজ বলবে কখনো ছেড়ে যেওনা আমায়।বলতেই হবে...

আকাশটা বেশ পরিষ্কার।তারাগুলোকে ইচ্ছে করলেই গুনতে পারা যাবে মনে হচ্ছে।জোছনার আলো নদীর জলে খেলা করছে।শীতল একটা বাতাস বইছে এ দিকটায়।বেশ ফুরফুরে মেজাজে হাঁটছে অর্ণব।অবশ্য খুশি লাগাটাই স্বাভাবিক।
আজ যে পরীর জন্মদিন।


ইচ্ছে করলেও পরীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর উপায় নেই।আজ ভালোবাসা থাকলেও অধিকার নেই।অধিকার ছাড়া ভালোবাসা মূল্যহীন,নিতান্ত তুচ্ছ।দুবছর আগে পরী অন্যের ঘরে চলে গেছে।ফেলে আশা সেই জন্মদিনের কথা মনে পড়তেই কেমন একটা হাহাকার জেগে উঠে বুকের মাঝে।মনের অজান্তেই পুরনো কবিতাটা ফিশ ফিশ করে বলে উঠে অর্ণব...
এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,
তুমি সুখী হবে,
ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, দেখে নিও, খুব
সুখী হবে।
-------------------------------------------------------------
বারটা থেকে সবার এত ব্যস্ততা,এত আয়োজন!রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে পরী।বারান্দায় লতানো পাতায় ঘেরা গ্রিলটার পাশে এসে দাঁড়াল সে।তিন তলার উপর দখিন দিকের এ জায়গাটা ভীষণ প্রিয় ওর।এ দিকটায় আর কোন বাড়ি নেই।বেশ বড় একটা রাস্তা চলে গেছে সামনে দিয়ে।যতদূর তাকানো যায় গাছ গাছালি,পাখিদের উড়াউড়ি।চুল এলোমেলো করা বাতাস,ঝুম বৃষ্টি কিংবা জোছনাস্নান সবই উপভোগ করা যায় এখান থেকে।মন খারাপের রাতগুলো এখানেই বসে কাটায় পরী।তারা দেখে,জোছনা দেখে,গুনগুন করে গান গায়।ফুরফুরে বাতাসটাও মনের কালো মেঘগুলোকে সরিয়ে দিতে অলসতা দেখায় না পরীর সাথে।তবে সবার এত আয়জনের পরও আজ কেন জানি একটা শূন্যতা লাগছে মনের মধ্যে।মুনিয়া পাখিটার খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠে পরী।অনুভূতিগুলো কখনো শেষ হয়না।অনুভূতির মৃত্যু নেই।তারা ঘুমিয়ে থাকে নীরবে।একটু নাড়া খেলেই জেগে উঠে।মনের মধ্যে কাটাকুটি খেলে।অস্পষ্ট শব্দ হয়ে কানে বাজতে থাকে।তুমি সুখী হবে,খুব সুখী হবে।


(অনুপ্রেরণা,অনুসরণ এসবের জায়গাটা সবারই থাকে কম বেশি।কলম ধরার সাহস আর ইচ্ছেটা যার জন্য করেছিলাম সে মানুষটার জন্মদিন ইদানিংকালের মধ্যে।উৎসর্গ করার মত লিখা লিখার যোগ্য এখনো হয়ে উঠিনি তবু গল্পটা তার জন্যই থাকলো।)

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- Rubaiyat Tonmoy
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url