গল্পঃ চমকে দেয়া মেয়েটি

মোটা লেন্সের চশমার ওপারে বিড়ালের মতো ছোট্ট দুটি চোখ,বাশের কঞ্চির মতো আঙ্গুলগুলো আর নিষ্পাপ একটা মুখ দেখে যে কারোরই থমকে যাবার কথা। চোখ দিয়ে চোখ ধাধিয়ে দেয়া মেয়েদের সংখ্যাটা কমই একটু। তেমনই একটি মেয়ে সে।
প্রথম দেখাতেই এক ঝলক আলোর প্রতিফলন হয় আমার রোদে পুড়ে ছাই হওয়া মুখে। অগোছালো দাড়ি গোফের ফাক ফোকর দিয়েও ওর মায়াবী মুখের আলো এসে লাগছিলো খুব।এমন মেয়ের সাথে যে কারোর কথা বলতে ইচ্ছে করবে। হউক চেনা,হউক অচেনা। আমি হাত বাড়িয়ে ডাক দিতেই কপাল কুঁচকানো মেয়েটি তাকালো আমার দিকে।
বেশ ভদ্র ভাবেই বললো,"জ্বি বলুন"। গলায় কাপ ধরে আমার। ওখানে এক সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারছিলাম না আমি। হাটুর কাঁপে মনে হয় লুটেই পড়বো। মেয়েটি বুঝতে পেরেছিলো। সুন্দরী মেয়েদের সাথে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে।মেয়েটি গায়ে না লাগিয়ে হাটা শুরু করলো।

মুচকি হেসে,কপালের চুল সরিয়ে আমি হাটা শুরু করি। পরিধেয় ড্রেস বলে দিচ্ছিলো মেয়েটি কোন স্কুলের ছাত্রী। ওসবে আর মাথা না ঘামিয়ে আমি আমার কাজে চলে যাই।

রোদৌসীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এই মেয়েটাকে আগে কখনো দেখিনি আমি। কোত্থেকে, কিভাবে আমার সাথে পরিচয় সব কিছুই ঘোরের মধ্যে। মাঝে মাঝে আমাকে কুরিয়ার করে। বডি স্প্রে,টি শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি! কখনো ফোনে কথা হয়নি। চিঠি আদান প্রদান হতো। অথচ আজ পর্যন্ত আমরা কেউ কাউকে দেখিনি। প্রথম চিঠিটা দিয়ে শেষে লিখে দিয়েছিলো আমি যেন চিঠির উত্তর না দিই। কিন্তু এমন কিছু কথা বলেছিলো যেটার উত্তর দেয়া আবশ্যক মনে করেছিলাম। সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে বিষয় হলো প্রেরক কে,তার নাম কি,সে ছেলে নাকি মেয়ে আমার ঠিকানা পেলো কোথায়?আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চিঠির উত্তর দিই,সেই সাথে কিছু প্রশ্ন।

রোদৌসী কোন উত্তর দেয় নি। দেয় নি কোন পরিচয়। অপরিচিত পরিচিতা হতে নাকি তার ভাল্লাগে। শুধু এটুকু বলেছিলো তার নাম রোদৌসী এবং আমি তাকে চিনিনা।

কোন সম্পর্ক ছিলো না আমাদের মাঝে।না এটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক, না এটা তার চেয়ে কম বেশী কিছু!মাসে আট -দশটি চিঠি আদান প্রদান হতো। একদিন জিগেস করেছিলাম,"চিঠি পাঠানোর কারণ?" উত্তরে বলে,"আমার ডাক টিকিট জমাতে ভাল্লাগে। " পরের চিঠিতে আবার জিগেস করলাম,"ডাক টিকিট কিনেও তো রাখতে পারেন?" পরের চিঠির উত্তর,"খাম থেকে গাম খসিয়ে ডাক টিকিট জমিয়ে রাখতে অনেক মজা"

প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষা করছি। ভেবেছিলাম মেয়ের সামনে নিজেকে খারাপ ভাবে উপস্থাপন করবো না,কিন্তু কেউ কথার বরখেলাপ করলে সেটা আর আমার সহ্য হয়না। শরীরে প্রবাহমান সব রক্ত মাথা চাড়া দিলো। একটা গোল্ডলীফ না হলেই নয়!

পুড়তে পুড়তে সিগারেট প্রায় ফিল্টারের কাছাকাছি। চিকন কন্ঠে কেউ সিগারেটের দোকানে জিগেস করছে,"কোন সিগারেটে ক্ষতি কম? আমাকে একটা দেন"। তাকিয়ে দেখি জিন্স,টি শার্ট আর বড় সানগ্লাস চোখে দিয়ে সিগারেট চাচ্ছিলো একটা মেয়ে। মেজাজ খারাপের শেষ পর্যায় আমার। মেয়েরা কেন সিগারেট খাবে? যার সাথে যা যায়! মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়েই ঘাড় ফিরিয়ে নিই। রাস্তার ফুটপাতে বসে যাই আমি।

সন্দেহ হচ্ছিলো রোদৌসীর ব্যাপারে। আদৌ কোন মেয়ে? সে আসলে কে? গত ছয় মাস এত চিঠি আদান প্রদান! আচ্ছা,আমার কোন বন্ধু ফাজলামী করছিলো না তো? পরে এই চিন্তা মুক্ত হলাম,আমার বন্ধুরা এত ভালো না মাসে মাসে আমাকে উপহার দিবে।

সিগারেট খাওয়া মেয়েটি কাশ দিচ্ছিলো। ট্যারা চোখে একবার তাকালাম। মেয়েটিও আমার দিকে চেয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নিই আমি।
চিঠি পাঠানো মেয়েটির জন্য আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহই জানে। অপেক্ষা করতাম ও না। শুধু কৌতুহল। কে এই মেয়ে! কেনইবা নিজ থেকে আমার এত খবর নেয়। আমাকে চিনেও। আমার ঘরের পাতিলের খবরটাও তার জানা ছিলো।

অবশেষে কেউ আমাকে ডাকলো। মেয়েলি কন্ঠ। আমার নাম ধরে ডেকে নিশ্চিত হলো,আমিই চিঠিগুলোর প্রাপক।মেয়েটির দিকে তাকাইনি আমি। যাদের উপর রাগ হয়,আমি তাদের দিকে তাকাই না। "আমাকে চিনতে পেরেছেন তো?" মেয়েটির এই প্রশ্নে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে যাই আমি।এই মেয়েটাকেই তো দেখেছিলাম। বিড়াল চোখী সেই মেয়েটা! চোখ ধাধিয়ে দেয়া মেয়েটি!!

সাবস্ক্রাইব করুন:

-আ আ আ আপনি রোদৌসী?
মেয়েটি চুপ থাকে। নিচের দিকে চেয়ে থাকে।
-কি হলো?
-না,মানে...
-কিসের মানে?
-মানে আমি রোদৌসী না
-আপনি কে?
-আমি যুথিকা।
-রোদৌসী কে?
-একটি মেয়ে
-আমার সাথে কার সাথে চিঠি দেয়া নেয়া হতো?
-রোদৌসীর সাথে
-সে আসেনি কেন?
-রোদৌসী বেচে নেই আর।
-মানে?

কথাগুলো শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। রোদৌসী মেয়েটি কোন এক অজানা কারণে আমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু সেটা কখনো বলেনি।কারণ সে জানতো,সে কখনো আমার হতে পারবে না। আকাশের ওপারের তারা হয়ে যাবে সে। এই প্রথম কোন মেয়ের জন্য আমি কেদে দিই। চোখের পানি টুপ করে পড়লো আমার। যুথিকা এসব বলার পর চলে যায়। আজ আমার সাথে রোদৌসীর দেখা হবার কথা ছিলো। কিন্তু হলোনা।

গভীর রাত।ছাদে শুয়ে আছি একা একা। কিছু একটার খুব অভাব অনুভব করছি আমি। যে মেয়েটির সাথে আমার চিঠি আদান প্রদান হতো তাকে খুব মনে পড়ছে আমার। আশ্চর্যের বিষয়,আমাদের ফোনে কথা হতোনা। ফোনে কথা হলেও তো বুঝাতাম যে প্রতিদিন ফোনে কথা হয় অথচ আজ সে হারিয়ে গেছে, মনে মনে ভাবতাম আর কাদতাম। কিন্তু এই সামাণ্য চিঠির প্রেরকের জন্য আমার হাহাকার করছে কেন?

আমি ভালো থাকতে পারিনা। ছয় মাস যাবত সেসব কথা হয়েছিলো সেসব মনে পড়ছিলো। মেয়েটির উপর কেমন যেন ভরসা পেতে শুরু করেছিলাম। অথচ আজ....

খুব অভিমান করে তার কাছে চিঠি লিখে। আমার মন খারাপের দিন গুলোর কথা তাকে বলি।অদেখা সেই মানুষটাকে, অপরিচিত সেই পরিচিতাটাকে ভালো বেসে ফেলেছি সেটা তাকে বলেই দিই। শেষে লিখেও দিই,"জানি,এ চিঠি পৌছুবে না তোমার কাছে,তবুও তুমি জেনে রেখো,সন্ধ্যাতারা হয়ে থেকো,ভোরের আকাশের সুখতারাটা আমার জন্যে দেখে রেখো"।
অনেক দিন পরে আমার বাসার দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। আমি খুলিনা। কেমন যেন হয়ে গেছি। কখনো কাউকে ভালোবাসিনি,তাও মনে হচ্ছে একজনকে খুব ভালোবাসি!

দরজা খুলতেই কঠিন সুর,"দাড়ি রাখো ভালো কথা,গোফ কাটোনা কেন?সিগারেট খাও ভালো কথা,নিজের টাকায় খেও,অন্য মেয়েদের দিকে তাকাও ভালো কথা,বিয়ে করার পর তাকিও,কাউকে ভালোবাসো ভালো কথা,তাকে জানিয়ে ভালোবেসো"

আমি চোখ কপালে তুলে বলি,"যুথিকা আপনি?"উত্তরে বলে,"আমি যুথিকা না,আমি রোদৌসী। " আমি ভুরু কুচকে বলি,"তাহলে সেদিন..."

আমাকে এলোমেলো করে দেয়া মেয়েটা বলে,"শোনেন,আমি আপনাকে দেখেছিলাম আমার আপুর সাথে,আমার আপু নাকি আপনার খুব ভাল বান্ধবী। এরপর আপনাকে জ্বালাতে ইচ্ছে হলো,ছেলেদের জ্বালাতে খুব মজা,জানেন? কিন্তু জ্বালাতে গিয়ে নিজেই জ্বলে গেছি। এরপর চিন্তা করলাম আমি কি ভুল আগুনে জ্বলছি নাকি? পরীক্ষা করা দরকার। তারপরই এত নাটক। জানেন,ওই সিগারেট খাওয়া মেয়েটিও আমি। আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন আমি জানি। আমিও আপনাকে ভালোবাসি,এটাও আপনি জানেন। এখন আপনি সিগারেট খেলে আমিও খাবো। বাকিটা আপনার বুঝ। আপনি অন্য মেয়ের দিকে তাকালে আমিও অন্য ছেলের দিকে তাকাবো,বাকিটা আপনার বুঝ.. "
আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখ টলমল করে জিগেস করলাম,"ভুল আগুনে পা দিয়েছো?" ও বলে,"নাহ,তাহলে পানি নিয়ে আসতাম,নিয়ে এসেছি আংটি,নিন পরিয়ে দিন,আপাতত আংটির টাকাটা ধার দিলাম,চাকরী করে শোধ করে দিবেন কিন্তু! "

আমি হাতের তালু বিছিয়ে দিই। রোদৌসীর হাত আমার হাতে। চঞ্চলা মেয়েটি হটাৎ করে কাঁপতে শুরু করলো,আমার ছোয়ায়....

সাবস্ক্রাইব করুন:

By- Alaxender Abir
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url