প্রেম কিংবা প্রেমিকের গল্প


সদ্য প্রেমে পড়া ছেলেরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রাণী। এই কথার প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম আমার রুমমেট জুবায়েরকে দেখে। গল্পটা তবে শোনা যাক, বিচারের ভার আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম ।
জুবায়ের ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলো। বয়েজ স্কুল, বয়েজ কলেজ। কাজেই কলেজ জীবন তার কেটেছে কঠিন নারীহীন পরিবেশে। ফলে ইউনিভার্সিটিতে এসে যা হওয়ার তাই হলো। ধুপধাপ প্রেমে পড়া শুরু করলো। এক মেয়ের চোখ দেখে প্রেমে পড়ে তো, আরেক মেয়ের চুল। আমরা যত বিরক্ত হই, ও ততো মেয়েদের প্রেমে মাতাল হতে থাকে।

সিরিয়াস প্রেম শুরু করলো তিন মাস পর। আমাদেরই ব্যাচমেট বান্ধবীর সাথে। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম, যাক, বিপদ দূর হলো।
তখন কি আর জানতাম, যে বিপদের কেবল শুরু?

২.
বৃষ্টি হলেই আমাদের হলের হেডলসে মহাসমারোহে ফুটবল খেলা হয়। জুবায়ের নাদুদনুদুস টাইপের ছেলে, আমাদের গোলকিপার ।
হুট করে সহজ একটা বল ছেড়ে দিয়ে গোল খেয়ে নিলো।
কাব্য তেড়ে গেলো, এত সহজ বল ছাড়লি কেন??
জুবায়ের হাসিহাসি মুখে বললো, কী করবো বল, ফুটবলে হঠাৎ তোর ভাবীর চেহারাটা ভেসে উঠলো, লাথি মারি কীভাবে?

রাগে পাগল হয়ে গেলাম। সীমিত আকারে গণপিটুনিদিয়ে ঘাড় ধরে মাঠ থেকে বের করে দিলাম।

তাতে ওর কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং এই ঝরঝর মুখর বাদল দিনে.... গাইতে গাইতে বৃষ্টিতে নাচানাচি শুরু করলো।

৩.
রাতে কান্নাকাটির শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
দেখি জুবায়ের হাপুস নয়নে কান্না করছে।
হাতে কাশেম বিন আবু বকরের "পাহাড়ী ললনা" বই।
অথচ আগে ও বঙ্কিমচন্দ্র পড়তো, বিভূতিভূষণ পড়তো। আর এখন এই প্রেমের পাল্টাতে পড়ে এইসব লুতুপুতু ছাইপাঁশ পড়ছে??

প্রেম মানুষকে এতটাই নীচে নামিয়ে দেয়? ছিহ!!!!

৪.
জুবায়েরের এই বেহাল দশা দেখে প্রেম আর নারী এই দুই জিনিসের প্রতি আমার বিদ্বেষ চরমে উঠলো। ফেসবুকে প্রেমের বিরুদ্ধে কঠোর কঠোর পোস্ট লেখা শুরু করলাম, চিরকুমার সংঘে যোগ দিলাম। ভার্সিটির চিরকুমার সংঘে রকি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল করি।

এই দামী জীবন এবং সাহিত্য ঐ ছলনাময়ী ললনাদের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। ভ্যালেনটাইন্স ডে নিষিদ্ধ করার কথা বলি, প্রেম কীভাবে যুবসমাজকে ধ্বংস করছে, সেই ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনা সৃষ্টি শুরু করলাম। বছরান্তে বেশ কিছু জুনিয়র ভক্তও জুটলো। নিজেকে কেমন সক্রেটিস সক্রেটিস মনে হতে লাগলো।

এর মধ্যেই ইউনিভার্সিটিতে গ্রীষ্মের ছুটি হয়ে গেলো। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম।

৫.
মিলির সাথে আমার শেষ দেখা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে। আমি তখন নিউ ডিগ্রি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, ও রাজশাহী কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। একসময় আমরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতাম। বাসা বদলানোর পর ও ভর্তি হলো মেডিকেলে, আমি চলে গেলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আমাদের আর দেখা হয়নি।

সেই মিলিকে এতদিন পর সোনাদিঘীর মোড়ে বইয়ের দোকানে দেখে চমকে উঠি। রূপবতী মেয়ে দেখলে না চমকালেও চলে, তবে অতি রূপবতী দেখলে চমকাতে হয়। এটাই নিয়ম।

এতদিন পর আমাদের কথা আর ফুরোয় না। আমরা দুজনই বই পড়ি। সাহিত্য নিয়ে ভাবি। মিলি খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় ছোট থেকেই।

মিলি আমার কবিতার কথা শুনতে চায়।
আমি ওর গানের খবর জানতে চাই।
যাওয়ার সময় আমার ফোনে ওর নম্বর সেভ করে দেয়, রহস্যময় হাসি হেসে বলে, পাবলিক প্লেসে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায়,বলো কবি? রাতে ফোন দিও, সীমিত পরিসরে গান শুনিয়ে দেবনি!

মিলি খিলখিল করে হাসে।
ও হাসিতে আমি ঝর্ণার কুলকুল শব্দ শুনি।

ও হাসিকেই সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন জলতরঙ্গের হাসি।
ঐ জলতরঙ্গের হাসিতে আমার চিরকুমারত্বের বাঁধ ভেঙে যায়। সাঁতার জানি না, যা হওয়ার তাই হলো।
নারীবিদ্বেষী এই আমি ধড়মড় করে মিলির প্রেমে পড়ে গেলাম।

হায় চিরকুমার সংঘ, হায়রে প্রেম, হায়রে নারী, হায় বাবা সক্রেটিস!! আমি সক্রেটিস ছুড়ে ফেলে নজরুলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করি, কবি নই,দার্শনিকও নই আমি এখন শুধুই প্রেমিক!!মুগ্ধ প্রেমিক!!

৬.
আমরা পদ্মার ধার ঘুরি, মুক্তমঞ্চে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি, টি বাঁধের পেয়ারা মাখানো খাওয়ার সময় মিলি চোখমুখ কুঁচকে ফেলে, আমি মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।

রাবি ক্যাম্পাস চষে বেড়াই, শেষে মিলি আমাকে স্টেশনে ছলছল চোখে বিদায় দেয়।
আমরা পরবর্তী ছুটির ক্যালেন্ডার খুঁজি।আচ্ছা, পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন?

৭.
হলে পৌছালাম দুপুর দুইটার দিকে।
বিকেলে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।
হেডলসে নেমে পড়লাম ফুটবল নিয়ে । জুবায়ের দল থেকে বহিষ্কার হয়েছে। কাজেই গোলকিপারের দায়িত্বে আছি আমি।

খায়রুল শট নিলো।
বল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ দেখি ও বলে মিলির মুখ। ও বলে আমি কী করে পা ঠেকাই? ছেড়ে দিলাম, গোল হয়ে গেলো।

কাব্য তেড়ে মারতে আসলো।
আমাকে সীমিত আকারের গণপিটুনি দিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিলো সবাই!!

আশ্চর্য!! আমার একটুও খারাপ লাগলো না। বরং গুণগুন গাইতে শুরু করলাম:

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল...
করেছো দান..........।

৮.
গভীর রাতে হাতে প্রিয় লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দফতর বইটা নিয়ে বসে আছি।
অথচ একটুও পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।
জগৎ সংসার তুচ্ছ মনে হচ্ছে ।

আমি জুবায়েরের টেবিল থেকে কাশেম বিন আবুবকরের বই নিয়ে পড়তে শুরু করি!! আহারে!! কী সুন্দর লেখা!! লাইলি-মজনুর প্রেম।পড়তে পড়তে আমি ডুকরে কেঁদে উঠি।

পাশের বেড থেকে কাব্য গালি দিয়ে উঠে।

টেবিলের উপর ফেলে রাখা বঙ্কিমচন্দ্র আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থাকে আর বলে,

"পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো!!"

সাবস্ক্রাইব করুন:

সাদিকুর রহমান খান
৩০/০৫/২০২০
রাজশাহী ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url