অনুগল্প: স্নেহের ছায়া by জাহানারা রিমা
পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে রিশাদ পাশেই বসে আছে তার সহধর্মিণী মিথিলা।মেয়েটার মুখটা পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে আর দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে।
মিথিলাকে এভাবে দেখে রিশাদের বুকে মোচড় দিয়ে উঠে।ও বুঝতে পারছেনা মিথিলাকে কিভাবে স্বান্তনা দিবে,প্রতিটা মেয়েরই মা হওয়া নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে,যখন এ স্বপ্নটা তাদের চিরতরের জন্যে ভেঙ্গে যায়,তখন তাদের মনের উপর দিয়ে কি যায় সেটা শুধু তারাই জানে।
রিশাদের নিজেরও বাবা না হতে পারার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে মিথিলার জন্য।
রিপোর্ট এ এটা স্পষ্ট যে মিথিলার কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে ও কোন দিনও মা হতে পারবেনা।
এ কথাটা যতবারই মনে আসছে কষ্টে মিথিলার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।ও আর রিশাদ মিলে বাচ্চা নিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছিল আর আজ তা এক নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর থেকে মিথিলা একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেনি,শুধু নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে, ও জানে রিশাদ ওকে কখনো ছেড়ে দিবে না,কিন্তু সারাজীবন একটা কষ্ট ওকে কুড়ে কুড়ে খাবে যে ওর কারণেই রিশাদ বাবা হওয়ার সুখটা থেকে বঞ্চিত হলো।
হাসপাতাল থেকে ওরা যখন বাড়ি ফিরছিল তখন রাস্তার পাশে দেখতে পায় একটা দশ বছরের ছেলের কোলে একটি দেড় বছরের বাচ্চা,,,
ছেলেটি একজন পথচারীর সামনে হাত পেতে আছে আর বলছে,
আংকেল আমার বোনটা কাল থেকে কিছু খায়নি কয়টা টাকা দেন আমার বোনরে কিছু খাওয়ামো।
লোকটা টাকাতো দিলোই না উল্টো মেজাজ দেখিয়ে বলল,
যত্তসব আজাইরা জামেলা,তোর বোন না খাইয়া আছেতো আমি কি করব, সামনে থেকে সর,কাজের সময় এসব উটকো ঝামেলা কোত্থেকে যে এসে জোটে বলেই ছেলেটাকে সামনে থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে হনহন করে চলে গেলো।
মিথিলা আর রিশাদ ছেলেটার কাছে এগিয়ে যায়,
দুজনেরই খুব মায়া হচ্ছে বাচ্চা দুইটার জন্য।
মিথিলা- তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছো কেন? তোমার বাবা মা কোথায়?
ছেলেটা- আমরা এতিম মেডাম,আমার এই বোনটা ছাড়া আর কেউ নাই,কালকের থাইকা আমার বোনটা না খাইয়া রইছে আমারে দশটা টাকা দেন,বোনরে একটা পাউরুটি কিননা খাওয়ামো বলেই মিথিলার সামনে ছেলেটা হাত পেতে দেয়,,
ছেলেটার কথা শুনে কষ্টে মিথিলার চোখে পানি চলে আসে।
তখন রিশাদ ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলে তুমি খেয়েছো?
ছেলেটা- না।আমার খাওন লাগবোনা,আমার দুই তিনদিন না খাইয়া থাওনের অভ্যাস আছে,কিন্তু আমার বোনটা তো ছোট ও আজকেও যদি কিছু খাইতে না পায় তাইলে আমার বোনটা মইরা যাইবো,বলেই ছেলেটা হু হু করে কেঁদে দেয়।
রিশাদ ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে,
তুমি আমাদের সাথে চলো আমরা তোমাকে আর তোমার বোনকে খাওয়াবো।
মিথিলা- তোমার বোনটাকে একটু আমার কোলে দিবে?
ছেলেটা- আমগো গায়ে ময়লা জামা কাপড় ওরে কোলে নিলে আপনের গায়েও ময়লা লাইগা যাইবো।
মিথিলা- তোমাদের তো কাপড়ে নোংরা এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মনে হাজারও নোংরা যা ধোলেও পরিষ্কার হবেনা,তাইতো তোমাদের মতো নিষ্পাপ দুটি বাচ্চাকে দেখেও কারো মনে দয়া হলোনা।
ছেলেটাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মিথিলা মেয়েটাকে ওর কোলে নিয়ে নেয়।
কি মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটা,আল্লাহ যেন পৃথিবীর সব মায়া মেয়েটার মুখে ঢেলে দিয়েছে,অথচ ওরা কতোটা অসহায় এটুকু বাচ্চা ছেলেটাকে বোনের খাবার জোগাড় করতে ভিক্ষে করতে হচ্ছে।
রিশাদ ছেলেটার হাত ধরে পাশের একটা খাবার দোকানে নিয়ে যায়,মিথিলাও মেয়েটাকে কোলে করে ওদের পিছু পিছু যায়।
রিশাদ দোকানে ঢুকে নুডুলস আর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত অর্ডার করে।মিথিলা মেয়েটাকে নিজের হাতে নুডুলসটা খাইয়ে দেয়,আর ছেলেটাকে মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে নিতে বলে।
রিশাদ মিথিলার দিকে তাকিয়ে দেখে মিথিলা বাচ্চাটার সঙ্গে খুব খুশি,একটু আগের কষ্টটা হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে আছে।
হঠাৎ কিছু একটা চিন্তা করে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে,
তোমরা দুজন কি আমাদের সাথে যাবে?
ততক্ষণে ছেলেটার খাওয়াও হয়ে গেছে।
ছেলেটা রিশাদের কথা শুনে অবাক নয়নে রিশাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মিথিলাও অবাক হয়েছে সেই সাথে খুশিও।
ছেলেটা- সাহেব আমরা আপনাগো লগে যাইয়া কি করমু?
রিশাদ- কিছু করতে হবেনা,আজকে থেকে তোমরা দুজন আমাদের সাথে থাকবে আমাদের সন্তান হয়ে,আল্লাহর হয়তো এইটাই ইচ্ছা ছিল তাইতো আজকের দিনেই তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হলো।
সেদিন ছেলেটা খুশিতে কান্না করে দিয়েছিলো।
রিশাদ সেদিনই ওদের দুজনকে বাড়িতে নিয়ে যায়,পরেরদিনই উকিলের সাথে কথা বলে ওদের দুজনকে অফিসিয়ালি দত্তক নেয়।
সেদিনের পর থেকে রিশাদ আর মিথিলা কোন দিনও ওদের দু ভাইবোনের চোখে জল আসতে দেয়নি।
কেটে গেছে অনেক বছর সেই ছেলেটি আজ অনেক বড় ডাক্তার, আর তার সেই ছোট বোনটিও অনেক বড় হয়ে গেছে, পড়াশোনা শেষ করে এখন নিজের একটা এঞ্জিও চালায়, এই এঞ্জিওটা ছোট অসহায় এতিম বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে।
আজও মিথিলা আর রিশাদ ওদের মাথার উপর ছায়া হয়ে আছে,*স্নেহের ছায়া*।