গল্পঃ জীবনের সংগ্রামের গল্প ( পরিবারের কষ্ট থেকে সফলতার গল্প )

 সেদিন যখন বাবা মারা গেলো, আমি তখন কলেজে পড়ছি আলিশা স্কুলে। বাবার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমার আম্মু কাঁদছিল,সেই কান্না একেবারেই আলাদা সেই কান্না দশ বছর প্রেম করা প্রেমিকার না, সেই কান্না বাইশ বছর সংসার করা স্ত্রীর ও না। সেই কান্না ছিল দুইটা বাচ্চার মায়ের কান্না। অদ্ভুত ভাবে আম্মুর আর্তনাদে একটাই শব্দ জমেছিল আমার বাচ্চাগুলা আর বাবা ডাকতে পারবে না তাদের বাবা বলার মত কেউ থাকলো না।

বাবা মারা যাওয়ার দিন পাঁচেক বাদে ভাবনার লিস্টে আসলো ঢাকা শহরে টিকে থাকা বিশ বছর আগে কিছু না ভেবেই দুটো মানুষ দুজনকে ভালবাসার দায়ে নিজের সব আপন পরিসর ছেড়ে দুইজন দুইজন কে আপন করে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিল।এই বিশ বছরে আমি এই ঢাকাকেই চিনেছি,আমার ভ্যাকেশনে ঘুরতে যাওয়া যেমন ঢাকাতে বাড়ি ফিরে আসাও ঢাকাতে।আমার আত্নীয়স্বজন বলতে কেউ নেই।ঢাকার নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে ভালবাসাও দেখেছি।আমার বাবার লাশের সামনে এই বিশবছরের পরিচিত হওয়া মানুষগুলোই কাঁদছিল।আর এখন এই চিন্তা ভাবনার পাশে এরাই দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো আমরা আছি তো চিন্তা কিসের!

আম্মুর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে সারাদিন চিন্তা করছে ছেলে মেয়ে নিয়ে এই শহরের বুকে টিকে থাকবে কী করে!কিছু মানুষ এসে বলতে লাগলো আলিশার বিয়ে দিয়ে দাও বোঝা কমবে।আম্মু নরম গলায় বললো ও আমার সন্তান বোঝা না,ওর বাবার শখ ছিল তার মেয়ে চাকরী করবে আমি সেই শখ পূরণ করতে না পারলে কেমন অর্ধাঙ্গিনী হলাম। 

একমাস হয়ে গেলো।আম্মু বেশ কয়েকবার গ্রামে ফোন করার চেষ্টা করেছে সবসময় ই করে কেউ ধরে না সেদিন ও ধরলো না।বাইশ বছরে আম্মুকে অত টা ভয় পেতে কখনো দেখিনি। কেউ দরজার কড়া নাড়লেও আম্মু আমাকে আলিশাকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে, দরজা খুলতে চায় না।


আমাদের বিশাল চাররুমের ফ্লাটটা থেকে একরুমের একটা ছোট বাসাতে শিফট হতে হলো বেশ কিছু ফার্নিচার বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া গেছে সেদিন দেখলাম সানসেটের ওপর থেকে বিশাল এক ফাইল নামিয়ে কী সব কাগজপত্র ঘাটছে আম্মু। সামনে গিয়ে দেখলাম আম্মুর সার্টিফিকেট, শিক্ষক নিবন্ধন এর কিছু কাগজপত্র,জন্মসনদ এই সব।জীবন বদলাতে লাগলো প্রতিদিন সকাল হলে আম্মু বেড়িয়ে পরতো চাকরি খুজতে রাতে এসে আমার বই গুলো ঘাটাঘাটি করতো আরো অনেক বই ঘাটাঘাটি করতো।যেই আলিশা পানিটুকু ঢেলে খেতে পারতো না সে আম্মু না থাকলে আমাকে আম্মুর মত করে খাবার বেড়ে খাওয়াতো।আম্মুর বলার আগে নিজের সব পড়া শেষ করে ফেলতো আম্মুকে ছাড়া যার এক দন্ড চলতো না সে নিজের সারাদিন চালিয়ে নিতো মানসিক ভাবে বেশ পক্ক হয়ে উঠেছিল মেয়েটা।


আম্মু একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরী পেলো সেবার। ঢাকা শহরে ওই অতটুকু দিয়ে চলা টা প্রচুর কষ্টের তিনবেলা ভাত ডাল খেয়ে পাড় করে দিতাম।বাবা একটা ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলো আমি বিকাল থেকে বেড়িয়ে পরতাম ছবি তুলতে,বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে “আপু একটা ছবি তুলে দিবো,খুব সুন্দর লাগছে” “ভাইয়া আপুর সাথে একটা ছবি তুলেন ভালো লাগবে দুইজনকে” এসব বলে ৫০/৬০ কোনোবার ১০০ টাকা অব্ধি রোজগার হয়ে যেত।আম্মু বিকাল থেকে বাসায় ব্যাচ পড়ানো শুরু করলো।শুক্রবার নিজের ডিগ্রি গুলো ঝালাই করতে যেত।সেই সময়টা তিনজন একসাথে আমরা পড়াশোনা করতাম,আম্মু প্রতিদিন স্কুলে,ব্যাচে কী পড়াবে সেগুলো পড়ে ফেলতো।আর শুক্রবার নিজের পড়াতো আছে।আশেপাশের বাসার মানুষগুলো নিজের বাসার তরকারি থেকে আমাদের জন্য কিছু না কিছু দিয়ে যেত মাঝেসাঝেই ওইদিয়েই চলতে লাগলো।আম্মু মাধ্যমিক পড়ানোর একটা চাকরী করতে শুরু করলো ,বাবা মারা যাওয়ার সময় এই মানুষটাই বলেছিল আমি তো কিছু করতেও পারবো না যার মাধ্যমে ঢাকায় টিকে থাকা যায় সেই মানুষটাই কীভাবে যেন সব করে ফেলছে বাবার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে হাত দেয়ার ও প্রয়োজন পরছে না মা এভাবেই চালিয়ে নিচ্ছে সবটা।আমি আলিশা ততদিনে রান্না শিখে গেছি মায়ের সকালে রান্না করার প্রেশার নিতে হচ্ছে না ,দুইজন নিজের সময় মত হাতে হাতে সব করে ফেলছি।মা টুকটাক টেইলারিং করতে শুরু করলো।মানুষটার ঘুম খুব প্রিয় ছিল ইদানিং ঘুমায় না চোখের নিচে কালী পরে গেছে। ঘরে আলো জ্বললে আমাদের ঘুম হবে না এজন্য রান্নাঘরে গরমের মাঝে রাতে মেশিন চালায়।আশেপাশের পরিচিতি বেশি হউয়ায় অনেকেই আসে সেই সুবাদে আরো বেশ কিছু বাড়তি টাকা আসে।


আম্মুর চোখের নিচে কালীর দাগ পরেছে চোখ বেশি খানিকটা ভেতরে ঢুকে পরেছে।ছেলে হয়ে কিছুই পারছিলাম না করতে,আম্মুর আসতে আসতে পাঁচটা বেজে যায়।আমি আম্মুকে বললাম চারটার যদি একটা ব্যাচ করা যায় আমি পড়াতে পারি।আম্মু রাজি হয় না আমার পড়াশোনার কথা ভেবে তারপর রাজি হয়ে যায় সায়েন্সের একটা ব্যাচ আসে।এত সমস্যার মাঝেও আম্মু আমার প্রথম ইনকামের টাকা খরচ করে না।


কিন্তু এত কষ্ট করেও ঈদ আসতো না আমাদের জীবনে,প্রতিদিন একই ভাবে চলতো যেই দিনটা খালি যেত ওইদিন আমরা তিনজন ই পড়াশোনা করতাম।আম্মু নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে জমে থাকা মেশিনের কাজ গুলো করে ফেলতো।মাধ্যমিকে আম্মুর বেতন বাড়ছিল আর আমাদের ও খরচ।আলিশার এসএসসি আমার এইচএসসি এই হই হট্টগোল আমাদের সয়ে গেছে ততদিনে।দুইজনের একটাই উদ্দেশ্য বৃত্তি এই একমাত্র উপায়ে খরচ টা কিছুটা সবুর করবে।আমার একটা লম্বা খরচ যাবে অ্যাডমিশনে।এইচএসসি ব্যাচ পড়ে কাটিয়েছি।আম্মুর ইচ্ছা বৃত্তি পেলে বাসায় টিচার রেখে পড়াবে ওই কয়টা মাস ই তো তারপর আলিশার খরচ।আমার ব্যাচটাও অফ করে দিলো আম্মু,যাতে পড়াশোনা করতে সমস্যা না হয়।সকাল থেকে আলিশা আমি এমন ভাবে পড়তাম যেন বিকেলেই পরীক্ষা যতই সয়ে যাক তবু সকালের সময়টা হাতছাড়া করার মত না।


ভোরবেলা তিনজন নামায পড়ে দোয়া করতাম,নামায শেষ তিনজনের চোখ লাল হয়ে থাকতো তিনজন ই সিজদায় বসে কান্না করতাম,প্রথম প্রথম আম্মু বাবা কষ্ট করে সংসার করলেও সুখ এসেছিল বেশ।ছমাসে একবার বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মাসে এক থেকে দুবার শপিং প্রতি ঈদে যমুনা বসুন্ধরা চরিয়ে বেড়ানো,এমন ভাবে চলতে থাকা জীবনে এত বড়রকমের পতন আসবে ভেবেছিলাম কী!

গততিনবছর ঈদের জামা কী আমরা জানি না,শুক্রবারের খোজ ও থাকে না,ছমাস বছর গড়িয়ে যায় আমাদের প্লেটের খাবার বদলায় না।


আন্টিরা এসে বলে আলিশার বাবা কী কিছুই জমায় নি!তোমরা যেভাবে থেকেছো ঢাকায় যেভাবে দান করেছো মনে তো হয় ভাই কিছুটাকা হলেও রেখেছে।

আম্মু বলে,খরচ করতো অনেক তবে হ্যাঁ একেবারে কিছু জমায়নি তা না,তবে কী বলুন তো আমার বেশ ভয় হয় যদি কোনো বিপদ আপদ আসে, বড় কোনো আসুখ হয় তিনজনের মাঝে কারো,তাহলে কিন্তু ওই একটাই ভরসা।বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ির কেউ জানতেও চায় না আমাদের কথা মরে পরে থাকলেও দেখবে না তাই কষ্ট হলেও ধরছি না ওসব,থাকুক একটা ভরসা।ঐটা আছে বলেই যা জমাচ্ছি তা শেষ করার শক্তিটুকু পাচ্ছি।


আম্মুর কথা শুনলে আমি আলিশা বেশ শক্তি পায় মনে হয় সব ই করা সম্ভব সংসার করা মানুষটা যদি কর্ম করে টিকে থাকতে পারে সব ই সম্ভব। ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি দিলো আলিশা, এসএসসি শেষে কম্পিউটার কোর্স একটা দুইটা ভাষা আয়ত্তে আনতে শুরু করলো এত কষ্টের মাঝেও ওর যেই খরচটা হচ্ছিলো সেই খরচ ওর কিছু বাড়তি দক্ষতা বাড়ানোর দায়ে লেগে গেলো।


একটাই আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম তিনজন,আমার পাবলিক।একটা কোথাও হয়ে গেলে আমার খরচ থাকবে না বরং পাবলিকে পড়লে কিছু বাড়তি ইনকাম হবে টিউশন করিয়ে,আলিশাকে মা ছেলে মিলে চালিয়ে নিতে পারবো। বাবা কচুর পাতায় আগলে রাখতো আলিশাকে,আলিমা ছাড়া কোনো কথা ছিল না বাবার।

আলিশার আবদার বাবার প্রায়োরিটি লিস্টে ওপরে থাকতো। সেই মেয়েটা মুখ ফুটে আবদার করা ভুলে গেছে,তার আগে এটা সেটা কত কী লাগতো! এখন প্রশ্ন করলে বলে আমার আর কী লাগবে!অল্পতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে যাওয়া বাচ্চা আলিশা ইদানীং সকাল বেলা উঠে বাবার জন্য দোয়া পাঠায়,তারপর মা কে সাহায্য করে,কম্পিউটার ক্লাসে যায়,ভাষা আয়ত্ত করতে যায় এসে কয়েকটা বাচ্চা পড়ায় খাবার বেড়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়। মা কে ইদানীং টেইলারিং এ বেশ সাহায্য করে সে,রাত পর্যন্ত চলতে থাকে,রাতে কয়েক লোকমা আম্মুর হাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। আমি আর আম্মু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। খুব ক্লান্ত লাগে ওকে দেখতে,কত ছোট বয়স থেকে ও দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে।প্রয়োজন গুলো কে কমিয়ে এনেছে।আমার এখন ও মনে পরে বাবা প্রতি সপ্তাহে ওর জন্য সুইস থেকে বার্গার নিয়ে আসতো।  কোনো সপ্তাহে ভুলে গেলে সে কী কান্না মেয়ের,অভিমানে বাবার সাথে দুদন্ড কথা বলতো না।সেই মেয়ে আজ কতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো ডাল ভাত খেয়ে দিব্যি হাসছে।


এপ্রিলে এইচএসসি হলো,অ্যাডমিশন এর জন্য বাসায় টিচার রাখলো বাড়িওয়ালা সেই মাসে ভাড়াও বাড়িয়েছে টানাপোড়েন চলছে ভালো,মা সকাল থেকে উঠে দুদন্ড জিরোচ্ছে না। একবার ভেবে নিলাম ডি ইউনিট এর প্রিপারেশন নিবো নিজেই পড়ে ফেলবো বাড়তি খরচ লাগবেনা,তখন আবার মনে হলো অ্যাডভান্সের টাকাটা তো নষ্ট যাবে।হার মানা হার কে আবার জিতিয়ে নিলাম,সারাটা দিন বায়োলজি কেমিস্ট্রির লাইনগুলোর সাথে বোঝাপড়া চলতে লাগলো। আলিশা আমি দুইজন একসাথে জিকে পড়তাম ও আগে থেকেই পড়তো যার জন্য ও কিছুটা বেশি পারতো এর জন্য তার ভাবের মাত্রাও বেশ।আমি আলিশা যখন জিকে পড়ি মা তখন রান্না ঘরে রান্না করতে করতে বলে আমাকে প্রশ্ন কর,আমরা মা কে প্রশ্ন করি।জিকে নিয়ে গবেষনাও চলে টুকটাক।অ্যাডমিশন সময় টা ছুটে চলছিলো। রেজাল্ট বের হলো।আলিশা বৃত্তি পেলো আমি পেলাম না। বৃত্তির টাকা এখন বিলাসিতার না বরং অনেক টা হিসাবের। ঢাকায় ভালো কলেজ বলতেই প্রাইভেট কলেজ সেখানে হাজার খানেক টাকা খরচ হবে,রেজাল্ট ভালোর জন্য প্রথমে খরচ না হলেও পরে হবে।আলিশা সরকারি কলেজে পড়তে চায়লো। কিন্তু আমি একদম ই রাজি না।ওর কথা ভাইয়া তুই অ্যাডমিশন প্রিপারেশন নিচ্ছিস ক্লাস শুরু হলে আমি স্টুডেন্ট পড়াতেও পারবো না কম্পিউটার কোর্স শেষ হলেও ভাষা আয়ত্তের ক্লাস বাকি বাড়তি ইনকাম নাই কিন্তু খরচ তো আছে।আমি বললাম আমার তো পাবলিকে হবে তখন আর কষ্ট থাকবে না তুই ভর্তি হয়ে যা,বেশ ঘন্টাখানেক বোঝানোর পর সে রাজি হলো।আমি বাসা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছি একটা কলোনিতে,কত বড় একটা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি এখন আমার কোনো পাবলিকে না হলে কী হবে!জেদ টা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিনরাত সমান তালে পরিশ্রম করতে লাগলাম। মেডিকেলের এক্স্যাম পড়লো প্রথমেই। দুইদিন পর রেজাল্ট, মাথায় তখন ঘুড়ছে আরেক চিন্তা। যদি হয় তাও তো বেশ খরচ স্কেলেটন কিনতেই তো খরচ পরে যাবে তারপর আবার বইগুলা।আল্লাহ ঠিক বুঝেছিল আমার চিন্তার গভীরতা,মেডিকেলে আমি চান্স পেলাম না।জেনেশুনেও কেমন নিরাশ লাগছিল মনে হচ্ছিলো এত পরিশ্রম করলাম তাও এই রেজাল্ট!


মানুষ জেনেশুনেও কষ্ট পেতে ভালোবাসে।ভার্সিটির পরীক্ষা গুলো শুরু হলো এখানে বেশ কিছু বাড়তি খরচ আছে যাতায়াত থেকে শুরু করে থাকা খাওয়া অব্ধি।সেই কয়মাস বেশ ভালো কষ্ট যাচ্ছিলো,কিন্তু গেলেই বা কী..!প্লাস পেয়েও ঢাবি রাবি জাবি চবির একটাতেও একটা সিট আমি পেলাম না।জবিতে কোনো মতে একটা সিট যাও পেলাম তা অন্য ডিপার্টমেন্টের।তখন মাথায় ঢুকছিলো না,নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো।তখন মনে হচ্ছিলো সায়েন্স ছেড়ে দিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্ট যেতে হবে এত পড়াশোনার ফল এটা কী করে হতে পারে!বিজ্ঞান প্রযুক্তি গুলো দিতে শুরু করলাম নভেম্বর পর্যন্ত বেশ লম্বা সময় পাওয়া যাবে এই ভেবে।ওদিকে আলিশার কলেজ এদিকে আমার যাতায়াত, ফর্মের খরচ।মা একা একজন বেশ হিমসিম খাচ্ছে,এমন দিন আসলো বাজার নেই,বাজার করার টাকাও নেই।


মা, বাবার জমানো টাকা থেকে খরচ করবে ভাবলো,আমার কেমন নিরুপায় লাগছিল কিচ্ছু করতে পারছিলাম না।পরীক্ষা দেয়া বন্ধ করে দিলাম।ইন্টারের একটা ব্যাচ শুরু করলাম,আর সাথে চালাতে লাগলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি।খেয়াল করছিলাম নিজে পড়ার থেকে ওদের পড়াতে গিয়ে আমার পড়াটা বেশি ভালো হচ্ছে।ব্যাচ বাড়িয়ে দিলাম।আর সাথে নিজের পড়া চলছে।ওদের সাথে বই শেষ করছিলাম আবার রিভাইস ও দিচ্ছিলাম।


ডিসেম্বরে কৃষির এক্স্যাম তাহাজ্জুদ পড়ে প্রতি রাতে দোয়া করতাম একটা সিট এর জন্য।পরীক্ষা দিলাম আর কিছুই নাই সামনে, শেষ সব।যদি হলো তো ভালো নাহলে সেকেন্ড টাইমের প্রিপারেশন নিতেও পারবো না আর প্রাইভেট তো দূরে থাক।ন্যাশনালে ভর্তি হয়ে যেতে হবে,এগুলা নিয়ে সারাদিন চিন্তা চলতো আর সকাল থেকে রাত অব্ধি স্টুডেন্ট এর আনাগোনা।আলিশার সব গুলা প্রাইভেট এর খরচ চালাতেই আমার অর্ধেক বেলা কেটে যেত। বাকি অর্ধেক বেলার ফি আলিশার কলেজের খরচ।আমার অ্যাডমিশন এর জন্য যা জমিয়ে রেখেছিল তার থেকে কয়েকগুন খরচ হয়ে গেছে,মা এর টেইলারিং দিয়ে আমাদের নিত্যদিন চলছে।মাস শেষ হলে আম্মুর স্কুলের স্যালারি টা আসলে হয়তো খানিকটা নড়েচড়ে বসা যাবে,তাতেও আরো ১৫-১৬ দিন।


রেজাল্ট আসলো,আমার কৃষি তে হয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে গেলাম,জীবন একটু ঘুরে তাকালো।প্রাণ হাতে পেলাম যেন। টিউশন খুজতে যাওয়া এই আমার কাছে অকপটে টিউশন আসতে লাগলো,চেনা জানা কত মানুষের ছেলেমেয়ে বেরোচ্ছে এখন। ব্যাচ পড়ালাম বাকি আরো কিছু দিন। ক্লাস শুরু হলো শুরু হলো জীবনের নতুন মোড়।টিউশনি ধরলাম যা সারাদিনে ইনকাম করতাম তা একটা দুইটা টিউশনিতে চলে আসছিলো।ক্যামেরা টা নিয়ে তখন ও ছবি তুলতে বেড়িয়ে পরছি সেখান থেকে কিছু আসছে।উদ্ভাস এ পড়াচ্ছি।আমার খরচ সমেত আলিশা কে চালিয়ে নিচ্ছি।আম্মুকেও পড়াচ্ছি।আম্মুর কলেজে একটা চাকরি হয়ে গেলে অনেক টা সামলে যেত। কয়েকটা ব্যাচ আর কলেজ,টেইলারিং এর প্রেশার টা নেয়া লাগতো না।সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে জামাকাপড়ের ছোট ছোট ফোড় বসাতে বসাতে আমার আম্মুর চোখের পাওয়ার বেড়ে গেছে।এইসময়টা আমাদের কাছে অনেক ভালো সময় মনে হতো,মনে হতো এইতো বেশ ভালোই আছি ভালোই যাচ্ছে আমাদের।আগের থেকে নিশ্চিন্তে আছি জীবন এভাবে চললে মন্দ নয়।


আম্মু টেইলারিং ছেড়ে দিলো কলেজের আবেদন করবে তার প্রিপারেশন নিতে শুরু করলো।আমি আলিশা নেট ঘেটে কত কী বের করছি মা গোগ্রাসে গিলে ফেলছে।ওই সময় আমি আলিশা গার্ডিয়ান,আম্মু শিক্ষার্থী। পড়া আর ব্যাচ পড়ানো ছাড়া আম্মুর কোনো কাজ নেই। আম্মু বেশ ভালো বাচ্চার মত সবটা পড়ে ফেলতো,আমি আলিশা সন্ধ্যা করে পড়া ধরতাম।কলেজের চাকরিটা আম্মুর হয়ে গেলো।এদিকে ছবি তুলতে তুলতে আমিও বেশ কিছু ভালো অফার পেতে শুরু করলাম। কষ্টের সময়ের তুলনায় জীবন বদলানোর সময়টুকু বেশ কম।


এখন খরচ বাদে কিছু জমানোর জন্য থেকে যাচ্ছিলো। বাবা থাকতে পুরো বেতনের অংকটাই লেগে যেত,নিত্যদিনের কতশত প্রয়োজন। এখন বুঝি প্রয়োজনটা হচ্ছে নিজেদের আয়ত্তের,চাইলেই প্রয়োজন কে নিজের সুবিধামত বাড়িয়ে কমিয়ে নেয়া যায়।


সময় যেতে যেতে দুইটা টিউশনি চারটা হয়ে গেলো,ফটোশ্যুটের দাম বাড়লো। প্রফেশনাল হতে শুরু করলাম আরো,কিছু বড় ইভেন্ট এর ইনভাইটেশন আসতে লাগলো।আম্মুর ব্যাচ কমিয়ে দিতে বললাম কলেজ শেষে একব্যাচ পড়িয়ে মা ইদানীং হেলান দিয়ে বসে থাকে আলিশান ভাবে।দেখলে শান্তি লাগে,মনে হয় এতদিনে আম্মু একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে।আলিশা মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলো,একটা ব্যাচ পড়ায় আর কম্পিউটার শেখায়। ওর বাড়তি ভাষায় দক্ষতা থাকায় বেশ কিছু জায়গায় ইদানিং ভলেন্টিয়ার হিসেবে যাতায়াত হয়েছে।আলিশার খরচ আলিশায় চালাতে শিখে নিয়েছে।

ছোট বাসাটা ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। দুইমাস হলো চাকরি করছি,আর সাথে ফটোশুট করে যাচ্ছি।আম্মু কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে কাজ করতে করতে এমন হয়েছে এখন কিছু না করলে নাকি তার ভালো লাগে না বাসায় কিছু বাচ্চাদের পড়ায়।এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় যা হয়েছে খারাপ কই!বাবা থাকলে হয়তো নিজেদের পায়ের নিচের মাটিটা বাবা ধরে থাকতো আজ নিজেরা ধরে আছি।এখন চাকরী চলে গেলে ফ্ল্যাট না থাকলে আবার কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে ততটুকু শিখে গেছি।বাবা তো সবসময় ছোট খাটো বিষয় গুলো শিখিয়ে দিতো চলে যেয়ে জীবন চালানোটা শিখিয়ে দিলো।


কলমেঃ জারিন তাসনীম রুকু

Next Post Previous Post
2 Comments
  • Arman Hossain
    Arman Hossain October 20, 2020 at 1:47 PM

    Nice Story

    • Shaharear
      Shaharear December 17, 2020 at 6:29 PM

      Thanks a lot

Add Comment
comment url