গল্পঃ পরিচয়

 আমাদের সপ্তম বিবাহবার্ষিকীতে সবথেকে বড় সারপ্রাইজ পেয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটার রক্তাক্ত লাশ।

সেদিন বিকেলটা ছিলো আমার জীবনের সবথেকে অভিশপ্ত দিন। একদল লোক সেদিন কোনো অনুমতির প্রয়োজনবোধ না করেই বাসার গেট অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে। আমার শাশুড়ি মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তে জরাজীর্ণ শরীরে পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে পাশের বাসার পাগল ছেলেটা শানু।

শানুকে কাঁদতে দেখে মা প্রশ্ন করে, কেন ও এভাবে কাঁদছে আর এতো মানুষই বা বাসার ভেতরে কেন? শানু 'হুসাম' ভা..ই.য়া বলে মাটিতে নিঃশব্দে বসে পড়ে।

অগণিত মানুষের ভীর ঠেলে কিছু মানুষ ধরাধরি করে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ আমাদের মুখোমুখি এনে রাখে। আমি লাশের হাতটার দিকে তাকাতেই আমার ভেতরটা মোচড়ে ওঠে। কালো ঘড়ি পড়া হাতটাতো আমার স্বামী হুসামের। কাল রাতেই ও'কে এই ঘড়িটা গিফট দিয়েছিলাম। আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

মা ভয়ার্ত চোখে হুসামের মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরাতেই একটা দমফাটা চিৎকারে মাটিতে পড়ে যায়। সাদা পাঞ্জাবিটা কেমন রক্তে লাল টকটকে হয়ে আছে। আমার হুসামের মুখটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। মুখের এপাশ ওপাশ থেকে রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে হুসামের পুরো শরীর।

আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। ভেতরে থাকা সমস্ত চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার আর্তনাদে সেদিন ঘুমিয়ে থাকা আমার ছয় বছরের ছেলেটাও দৌঁড়ে এসেছিলো। আমার ছেলে হুসামকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বার বার বলছিলো,

বাবাই ও বাবাই ওঠো না তুমি, কি হয়েছে তোমার? ও বাবাই এত্ত রক্ত কেন তোমার মুখে? ও বাবাই, আমার সোনা বাবাই আর রাগ করবো না ওঠো না তুমি।


আমি আর এই দৃশ্য সহ্য করতে পারিনি। কখন জ্ঞান হারিয়েছিলাম জানা নেই আমার। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে আধমরা হয়ে শুয়ে আছি। মা'কে দেখার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। মা ও শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা সেদিন হারিয়েছিলো।


আমার শ্বশুর আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে ছিলেন। বাসায় প্রবেশ করতেই বাবা বুকের ব্যথায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন। মা পাগলের মতো বার বার ছুটে যেতে চাইছিলো হুসামের কাছে। কিন্তু প্রতিবেশীরা সকলে সেদিন নির্দয়ের মতো অাটকে রেখেছিলো আমাদের পুরো পরিবারটাকে।


শেষবারের মতো যখন আমার হুসামের মুখটা দেখানো হলো, আকাশ বাতাস আমার আর মায়ের চিৎকারে কেঁদে উঠেছিলো। আমার ছেলেটা অবুঝের মতো ডুকরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলো, 'বাবাই তুমি যেওনা, যেওনা আমাদের ছেড়ে। আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না বাবাই'।


মা আমার ছেলেকে বুকের মধ্যে নিয়ে 'হুসাম, হুসাম আমার বাবা' বলে চিৎকার করে কাঁদছিলো। আমি তখন পাগলপ্রায়। শেষবারের মতো হুসামের মুখটা দেখতে যে আমার কত ব্যথা, যন্ত্রণা ভেতরটায় হয়েছিলো। আল্লাহ যার কেড়ে নেয় সেই বোঝে এর কষ্ট।


শানুর মুখে শুনেছিলাম দাফনের প্রথম মাটি টা নাকি আমার ছেলেই দেয়। তারপর বাবা দেন। কত অভাগা আমার ছেলে আর শ্বশুর। একজন এতটুকু বয়সেই বাবা কে হারালো, আরেকজন এই বৃদ্ধ বয়সে এসে সন্তানের লাশ কাধে নিলো।


একটা বছরের মতো কারো সাথে ঠিক করে কথা বলিনি আমি। হাসিনি কখনো মন খুলে। ছেলেটা রোজ রাতে বায়না ধরতো, আমার বাবাই কে এনে দাও,আমার বাবাই কে এনে দাও। আমি পারিনি শুধু চোখের জল মুছে ওকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছি প্রতিরাত।


বছর যেতেই আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বললো আবার বিয়ে করতে। আর নিজের বাবা মায়ের কথা নাই বা বললাম। পারা প্রতিবেশীরা ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে দেখলেই বলতো, 'নতুন করে জীবনটা সাজাতে, পরিচয়হীন জীবন কাটানো যায় না কখনো'।

অথচ তারা কেউ এটা বুঝতেই চাইতো না যে আমার ভেতরের ক্ষত'টা এখনো শুকোয়নি। তাদের মতো করে তো আমি জীবনটাকে নিয়ে আর ভাবতে পারিনা।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? শ্বশুর-শাশুড়ি আমার ভালো হবে দেখেই নতুন করে পাত্র দেখতে শুরু করলো। এই প্রথম কাউকে দেখেছি কোনো মেয়ের বিয়ে তার বাবা মা তুল্য শ্বশুর-শাশুড়ি ঠিক করেন। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমি তাদের সাথেই আমার ছেলেটা কে নিয়ে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তাদের কান্নাজড়িত কথাগুলো আমায় বার বার কষ্ট দিতো।


এভাবেই আরো একটা বছর কেটে যায়। একদিন রাতে হুট করেই মা আমার রুমে আসে৷ আমি তখন আমার ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম। কেন যেন তখন মা'র চোখগুলো বেশ ফোলা প্রকৃতির লাগছিলো। আমি প্রশ্ন করার আগেই মা আমার হাতদুটো ধরে বলে উঠলো,

-মা'রে আমরা তোর খারাপ চাই না। তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যা। দেখবি খুব সুখী হবী জীবনে। আমাদের বুড়ো বুড়ির দোয়া আছেতো তোর সাথে। এমনভাবে জীবন চলে না যে মা৷


জানি না আমার অবুঝ ছেলেটা কি বুঝলো। লেখা রেখে বলে উঠলো,

-ও দাদুন, তোমরা আমার বাবাই'কে এনে দেবে তাইনা?


মা আর কিছু বলতে পারেনি মুখে আঁচলটা গুজে দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আমি পাথর হয়ে বসে আছি ছেলের পড়ার টেবিলটার সামনের চেয়ারে। হুসামের কথা মনে হতেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু চক্ষুদ্বয় ভেদ করতেও বেশি সময় নিলো না।


হুসাম সেদিন আমায় চমকে দিতেই বাইক নিয়ে বেড়িয়েছিলো কেনাকাটা করতে। সবথেকে বড় চমকটা যে এভাবে দেবে ভাবতেও পারিনি কোনোদিন।

আমার ছেলেটা চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, আমার বাবাই আসবে আম্মু, তুমি আর কেঁদো না।


আমার মা প্রায়ই কল করে বলতো,

-এভাবে তোকে আর আমরা দেখতে পারছি নারে মা। কতটুকু আর বয়স হয়েছে তোর? কেন এমন অবাস্তব জেদগুলো করিস? জীবনটা এভাবে কাটানো যায় না। বেঁচে থাকতে হলে একটা পরিচয়ের দরকার হয়। তুই কার পরিচয়ে বেঁচে থাকবি বল? ছেলেটার কথা চিন্তা করে অন্তত নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখ। আমরা তোর খারাপ চাই নারে মা।


আর কিছু বলতে পারতো না মা। ওপাশ থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ ভেসে আসতো আমার কানে। আর আমার বাবা প্রতি শুক্রবারে একবার করে দেখে যেতো আমায়। কিন্তু আমিই না করে দেই। কিই বা করতাম আর? এমন অবস্থায় মেয়েকে দেখে বাবা মায়ের যে কতটা কষ্ট হয় তা কি বলার মতো। 

হুসাম মারা যাওয়ার কয়েকমাস পরই আমার বাবা মা আমায় একেবারে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি যাইনি। কারণ আমার শ্বশুর-শাশুড়ির একটাই ছেলে ছিলো হুসাম। আমি আর আমার ছেলে ছাড়া যে এই পৃথিবীতে বৃদ্ধ মানুষদুটোর আর কেউ নেই। কি করে পারি স্বার্থপরের মতো অসহায় মানুষ দুজন কে ফেলে যেতে? বিবেক বার বার বাধা দিয়েছিলো আমায়।


কোনো কিছু না ভেবেই একদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে আমার শাশুড়ি মা'কে বলে দেই বিয়েতে আর অমত নেই আমার। কেন বলেছিলাম আজও জানি না। তবে সমাজের মানুগুলোর কানাঘুঁষা আমায় বার বার জানান দিতো একটা সঠিক পরিচয় চাই তোর।


বিয়েতে আমার আর অমত নেই শুনে শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা মায়ের অানন্দের শেষ নেই। সবাই খুশি হয়ে পাত্র দেখতে শুরু করে। কিন্তু একটা ছেলেসহ এমন মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চায়? তবুও পাঁচ সাতটার মতো সম্মন্ধ আসে। কিন্তু যখন আমার ছেলেটার কথা শোনে তখনিই তারা অমত করে দেয়। আমি এটা ভেবে খুশি যারা বিয়ের আগেই আমার অবুঝ শিশুটাকে টানা হেছড়া করে তারা যে বিয়ের পর কি করতে পারে তা অজানা নয়। তাই তাদের অমত কে আমি আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহন করি।


কিন্তু এভাবে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। বার বার আমার ছেলেটার কথা বলে আঘাত করাকে যেন কোনোমতেই সহ্য হচ্ছিলো না। অথচ আমার শাশুড়ি মা বরাবরের মতোই খুব শান্তভাবে আমায় বোঝাতেন 'আল্লাহ তায়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন'।


.


এক ঘন্টার মতো আমি আর আমার ছেলে রুমে বসে আছি। অতীতগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে এত সময় হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমার ছেলেটা ততক্ষণে হোম-ওয়ার্কগুলো শেষ করছিলো। আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বললো,

-আম্মু তুমি আবার কাঁদছো? দেখো আমার বাবাই এসেই তোমায় বকা দেবে। আমি বাবাইকে বলে দেবো তুমি রোজ রোজ কান্না করেছো।


আজকেও কেউ একজন দেখতে আসবে আমায়। সকালে মা জানায় আজ যে দেখতে আসবে সে নাকি বাবার স্কুলের ছাত্র ছিলো একটা সময়।

কিছু সময় যেতেই মা রুমে এসে জানালো পাত্র এসেছে। আমি বরাবরের ন্যায় আজ আর একা গেলাম না। আজ আমার ছেলেটাকেও সাথে নিয়ে তাদের সামনে গেলাম। মা মানা করেছিলো বার বার কিন্তু শুনিনি। 

পাত্রের সামনে আমি সালাম দিয়ে শেষ না করতেই আমার ছেলেও সালাম দিলো। অপরপাশ থেকে সালামের উত্তর এলো। বাবা আমাকে আর ছেলেকে একসাথে দেখে কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলো। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। হঠাৎ করেই ছেলেটা আমার পাশ থেকে অপরিচিত লোকটার পাশে গিয়ে বসলো।


এই প্রথম এমন বাক্যে কারো গলার স্বর ভেসে আসলো আমার কানে,

-আমাকে কি আপনার পচ্ছন্দ হয়েছে?


কি বলতে হবে আমি জানি না। মাথাটা একটু উঁচু করে দেখলাম আমার উত্তরের আগেই আমার ছেলে লোকটার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ওর করুণ দৃষ্টি দেখে আর কোনো কথা বলতে পারিনি। বাবা আমাদের রেখে কি মনে করে যেন ভেতরের রুমে চলে গেলেন। উনি আবারও বললেন,

-আপনার ছেলেকে আমার খুব পচ্ছন্দ হয়েছে। স্যার আমাকে সবকিছু বলেছেন। কিন্তু আপনি হয়তো আমার কথা জানেন না। আমি এতিম, খুব ছোটোবেলায় আমার বাবা মা মারা যায়। তখন থেকেই দূর সম্পর্কের চাচার কাছে বড় হয়েছি। স্যারের স্কুলটাতেই বছর পাঁচেক হলো শিক্ষকতা করছি। আশা করি আমাদের পাঁচজন সদস্যের পরিবারটা খুব ভালোভাবেই চলে যাবে।


আমি অবাকের শেষ চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে লাজ লজ্জা ভুলে প্রশ্ন করলাম,

--পাঁচজন সদস্য বলতে ঠিক বুঝলাম না।


ভদ্রলোক মুচকি হাসি মুখে এনে উত্তর দিলো,

-স্যার, ম্যাডাম, আমি, আমাদের ছেলে আর আপনি।


আমি কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মুহুর্তেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো আমার। বাবা মা পাশের রুমেই ছিলেন হয়তো। ওনার কথাটা শোনামাত্রই বাবা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন এই রুমে। ভারি গলায় বলে উঠলেন,

-বাবা, তুমি আমার বুকের উপর থেকে কত বড় বোঝাটা যে আজ নামালে...কথাটুকু শেষ করতে পারলেন না আর। তৎক্ষনাৎ ওনাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। মা মিষ্টির বাটিটা হাতে নিয়ে চোখ মুছে সবাইকে দিতে লাগলেন।


অপরিচিত মানুষটা আমার ছেলেটার মাথায় অনবরত হাত বুলাচ্ছেন। আমি ঝাপসা চোখেই দরজার আড়াল থেকে দেখলাম কত মায়া তার চোখে ভাসছে। হয়তো তিনি এতিম বলেই আজ আমার এতিম ছেলেটার কষ্টটা অনুভব করতে পারলেন। এতো মানুষের ভীড় থেকে তিনিই এলেন আমাদের একটা সঠিক পরিচয় দিতে।

 লেখিকাঃ সোনিয়া শেখ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url