গল্পঃ অবশেষে অমাবস্যাতিথি

১.
টিউশন থেকে ফিরেই গোসল সেরে নেওয়াটা প্রিয়ার সপ্তাহিক ৪ দিনের কাজ।
আজও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।
এমনিতেই হলে গোসল করার জন্যে লাইন ধরতে হয়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে গোসল খানা গুলো খালিই থাকে।

গোসল সেরে প্রিয়া চুলের পানি মুছছে হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
ফোনের শব্দে সে রুমের ভিতরে চলে গেল।
এক হাতে চুলের পানি মুছছে, আরেক হাতে ফোনটা উঠালো সে।
অপিরিচিত একটি নাম্বার। ধরতে ইচ্ছে হল না তার। ফোনটা রেখে দিল সে।
পঞ্চমবারে সে ফোনটা রিসিভ করল।
হ্যালো বলে কিছু বলার আগেই সে থ হয়ে গেল।
১ মিনিট সে নিঃশব্দ ছিল।
"হ্যালো" হ্যালো" আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি প্রিয়া দি বলছেন?
"হ্যালো" হ্যালো"...
ফোনটা না কেটেই বিছানায় রেখে দিল সে।
মাটিতে বসে পড়ল। ভেজা চুল চুঁয়ে চুঁয়ে পানি মেঝেতে পড়তে লাগল। সে সাথে অবিরাম ধারায় চোখের জল।



২.
একটা ছেলে খুব করে আরেকটা ছেলেকে শাসাচ্ছে।
"তোকে যদি আর কখনও দেখেছি কোন মেয়েকে টিজ করতে, একদম ইন্টারমিডিয়েটের সার্টিফিকেট ধরিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেব! তুই আমার পার্টির ছেলে হয়েছিস কী হয়েছে? আমি কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না যতদিন এই ক্যাম্পাসে থাকি। মাফ চা আপুটার কাছে?"
ছেলেটা প্রিয়ার কাছে "স্যরি" বলে চলে গেল। যাবার আগে বারবার পিছন ফিরে ফিরে দেখছিল সে।
- ধন্যবাদ আপনাকে।

- না, ইট'স ওকে। আজ ওকে কষিয়ে দিতাম দু চার ঘা। আমি আবার মেয়ে মানুষের সামনে কাউকে মারি না।
- আমি প্রিয়া। প্রিয়া সাহা।

- আমি পলক। পলক মজুমদার।

পলক ক্ষমতাসীন দলের ভালো একজন নেতা। ছ' ফিট মত লম্বা ছেলেটাকে দেখতে ছোটখাট একটা দানবের মতই লাগে।
বক্তৃতায় বেশ পটু। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। এতে যদি কোন সিনিওর নেতাকে অপমানিত হতে হয়, তাতে তার কিচ্ছু আসে যায় না।
জুনিওর অনেক ছেলে তাকে ভবিষ্যত নেতা বলে মানে। জুনিওরদের প্রতি তার কড়া নির্দেশ, আগে পড়াশোনা, তারপর রাজনীতি।
তার এইসব ইথিকসের জন্যে পার্টির অনেকের চক্ষুশুল হয়ে উঠছে সে। কিন্তু পলক কিচ্ছুর পরোয়া করে না।
৩.
- এই যে শুনছেন?
- ও! আপনি? কেমন আছেন?
- আপনাকে তো অনেক্ষন ধরে ডাকছি, কানেই নিচ্ছেন না।
- স্যরি, আমি না শুনতে পাই নি। তো কেন ডেকেছেন জানতে পারি?
- না, এমনি। আপনি ঐদিকে যাচ্ছেন, আমিও ঐদিকে যাচ্ছি। ভাবলাম একসাথেই যাই।
- ও তাই বলেন। কি যেন আপনার নাম। প দিয়ে হবে কিছু একটা।
- এর মধ্যে নামটা ভুলে গেলেন!
- আরে না, আসলে আমার নাম মনে রাখতে খুব অসুবিধে হয়।
- থাক আর জানতে হবে না নাম।
- কি যেন কি যেন নামটা... পেয়েছি! প্রিয়া? সঠিক?
- হুঁ, সঠিক। চলেন না, ঐ আম গাছটার নিচে গিয়ে একটু বসি। যদি আপনার হাতে কোন কাজ না থাকে।

- কাজ একটা ছিল যদিও। আচ্ছা থাক। পরে সারাবো।
- না না, আপনার জুরুরী কাজ হলে আসতে পারেন।
- একজন সুন্দরী রমনীর পাশে হাঁটার চাইতে ঐ কাজটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। হা হা হা...
- রাগ করলাম কিন্তু!
- আপনি কি শাড়িই পড়েন সবসময়? ঐদিনও দেখলাম। আজও দেখছি।
- শাড়ি আমার খুব পছন্দের। ক্যাম্পাসে সবাই তো সালোয়ার-কামিজ, জিন্স-টপস পড়ে আসে। আমি না হয় শাড়ি পড়ে আসলাম। কেন আপনার কি ভালো লাগে না?
- না না, তা হবে কেন? আমার বেশ ভালোই লাগছে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। কপালে মেঘ কালো টিপ। এক কথায় অসাধারন। হা হা হা...
- থাক! আর এভাবে বলতে হবে না।

সাবস্ক্রাইব করুন:


৪.
আকাশটা আজ ভিষণ কালো হয়ে আছে।
বৃষ্টি হওয়া একরকম নিশ্চিত। এমন ওয়েদারে প্রিয়ার আবার মনটা উড়ু উড়ু করে।'
ছোটবেলা থেকেই সে এমন। বৃষ্টি হলেই কেমন জানি হয়ে যায় সে।
ইচ্ছে করে ডানা মেলে আকাশে উড়ে যেতে। তারপর মেঘের সাথে বৃষ্টি বৃষ্টি খেলতে।
আজও তার ইচ্ছে করছে এমন কিছু একটা করতে।
ফোনটা হাতে নিয়ে পলককে ফোন দিল
- হ্যালো পলক, কই তুমি?

- এই তো আমি স্টেশন এরিয়ায়। কেন?
- স্টেশন এরিয়ায় কি করছ? এখ্যুনি আমার হলের গেইটের সামনে আস।
- এখন হলের গেইটের সামনে গিয়ে কি করব? আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে।
- তোমাকে যা বলছি তাই কর। এখ্যুনি আস। আর শুনো, রিক্সা নিয়ে আসবা না, হেঁটে হেঁটে আসবা। বায়।

ফোনটা রেখে দিয়ে প্রিয়া হলের গেইটের সামনে চলে গেল।
এর মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে আকাশটা ফেটে পড়তে চাইছে।
হুট করে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওর ইচ্ছে করছিল এখ্যুনি বৃষ্টিতে ধাপাধাপি করতে। কিন্তু পলকের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

প্রায় আধা ঘন্টা পর দূর থেকে পলককে দেখল প্রিয়া। দেখেই দৌঁড়।
পলকের হাত ধরে দৌড়াতে দৌঁড়াতে পোস্ট অফিস এরিয়ায় চলে গেল।

- কি হচ্ছে এসব প্রিয়া?
- চুপ! দেখছ না বৃষ্টি হচ্ছে।
- হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
- আচ্ছা, তুমি ঐ গানটা পার?
- কোনটা?
- আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে।

- পারি তো। একটু।
- ঐ একটুই গাও।
"আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়ল তোমায়
অশ্রু ভারা দুটি চোখ,
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়ে ছিলে মুখ।
বেদনাকে সাথি করে
পাখা মেলে দিয়েছ তুমি
কত দূরে যাবে বল,
কত দূরে যাবে বল
তোমার চলার সাথী হব আমি
একাকিনি আছ বসে..."
-আর পারছি না। কথা ভুলে গেছি।

প্রিয়া পলকের হাত চেপে ধরে বলল, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না বল? কখনও আমার চোখে বৃষ্টির ধারা বইয়ে দেবে না তো বল?
ধূর পাগলি বলে প্রিয়ার হাত ধরে পলক হেঁটে যেতে লাগল।


৫.
হল টিউটরদের কাছ থেকে স্পেশাল অনুমতি নিয়ে প্রিয়া ও তার বান্ধবী নুসরাত বেরিয়ে পড়ল।
গন্তব্য মেট্রোপলিটন হসপিটাল। যেখানে পলককে গুরুতর আহত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রিয়া হাসপাতালের করিডরে ছোটাছোটি করছে।

পলকের কিছু শুভানুধ্যায়ী বন্ধু প্রিয়াকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু প্রিয়ার মন কিছুতেই মানছে না। ও শুধু বারবার পলককে দেখতে চাইছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছটার দিকে কারা যেন পলককে একা পেয়ে কুপিয়ে জখম করে দিয়েছে। অনেক ব্লিডিং হয়েছে।

অপারেশন থিয়েটারে আছে এখনো। ডাক্তাররা বলেছে অনেক রক্ত লাগবে।
পার্টির কিছু ছেলে আর পলকের ফ্রেন্ডেরা মিলে ব্লাড ডোনার জোগাড় করতে গেছে।
প্রিয়া নুসরাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

"আমি ওকে কতবার বলেছি পলিটিক্স কর না। এইসব নোংরা পলিটিক্সে তোমার মত ন্যায়পরায়ন মানুষের ঠাঁই হবে না। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও অন্তত পলিটিক্স ছেড়ে দাও। কে শুনে কার কথা। ও আমার কথা শুনে নি।

বলত দেশটাকে ভালোবাসি বলেই রাজনীতি করি। আমরা ছাত্ররা রাজনীতি না করলে দেশকে ভালো রাখার মত তো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরও কত কি কথা বলত...''
প্রিয়া কাঁদছে আর এসব বলছে।

সারা রাত সবাই হসপিটালেই ছিল।
ব্লাড ডোনাররা এসে ব্লাড দিয়ে গেছে। দু একজন নেতা এসে খোঁজ খবর নিয়েছে।
ডাক্তার বলেছে, ১২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। মাথার আঘাতটাও মারাত্মক। বেশ কয়েকটা জায়গায় কেটে গিয়েছে।

সকাল ধরেই প্রিয়া পলকের পাশে ফ্লোরে বসে ছিল।
সারারাত কিচ্ছুই খায় নি। সকালেও না। নুসরাত অনেক করে বলার পরেও কিচ্ছুই মুখে দেয় নি।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। তবুও পলকের জ্ঞান ফিরল না।
এর মাঝে ডাক্তররা দুবার এসে দেখে গেছে। দুবারই প্রিয়া ডাক্তারদের কাকুতি মিনতি করেছে।
"ডাক্তার সাহেব আমার পলক বাঁচবে তো, ডাক্তার সাহেব বলুন আমার পলক কবে চোখ খুলবে?"
সৃষ্টিকর্তাকে স্মরন করতে বলেছে ডাক্তাররা।

ভগবানের কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করেছে প্রিয়া। পলক যেন সুস্থ হয়ে উঠে।
রাত নয়টার দিকে পলক একটু নড়ে উঠল।
চোখটাকে একটু নিভু নিভু করে মেলতে চেষ্টা করল।

প্রিয়া পাগলের মত হয়ে ওকে বলতে লাগল, তোমার কিচ্ছু হবে না পলক। তুমি অবশ্যই ভালো হয়ে যাবে। আমরা আবার আগের মত জারুল তলায় বসব, বৃষ্টিতে ভিজব, তুমি ঐ গানটা গাইবে, ঐ যে আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে...
কিছু একটা বলার জন্যে পলকের ঠোঁট একটু নড়ে উঠল।

মুহুর্তের মধ্যে পালস মিটারের বিপ টোন বেজে উঠল। লাইন গুলো সব সমান্তরাল হয়ে গেল।
প্রিয়া চিৎকার দিয়ে ডাক্তারদের ডাকতে লাগল। পলকের কিছু ফ্রেন্ড রুমে ঢুকল চিৎকার শুনে।
ডিউটি ডাক্তার এসে পলকের পালস চেক করে বলল, আই এম স্যরি, হি ইজ নো মোর...
প্রিয়ার গগন বিদারী কান্নায় আশে পাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল।
"হে ভগবান, তুমি একি করলে..."

সাবস্ক্রাইব করুন:

by- Mmhb Razu

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url