গল্পঃ আত্মহত্যা | প্রেমে পড়লে মানুষ কি না করতে পারে

গত বছর এই সময়টাতে একটা ছেলে আত্মহত্যা করবে বলে ঠিক করলো। ছেলেটা আমার পরিচিত। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়তাম। সে পড়তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। আর আমি মার্কেটিংয়ে। ছেলেটা খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। আমাদের বাসাটাও ছিল পাশাপাশি। আমি যেই বাসাতে থাকতাম। তার পাশের বাসাতে সে থাকতো। প্রায়শই তার সাথে ছাঁদে কথা হতো। সে পাশের ছাঁদ থেকে আমার সাথে তার সারাদিনে ঘটে যাওয়া সকল কিছু শেয়ার করতো।




একদিন সন্ধ্যায় ছেলেটা আমাকে ছাঁদে ডাকলো। আমি গেলাম। সেদিন তাকে কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম তার কোনো টাকা পয়সা লাগবে হয়তো। কেননা ছেলেটার পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু না। সে আমাকে বললো, ভাইজান আমি কি খারাপ ছেলে?
আমি হঠাৎ করে তার এমন প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। উত্তরটা আমার কাছে ছিল। আমি বললাম, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
সে উত্তর করলো, আগে বলেন আমি কি খারাপ ছেলে?
আমি বললাম, না। কেন?
- আচ্ছা ভাইজান গরীব হওয়া কি দোষের?
- না তো, কেন?
- টাকা পয়সায় কি সব?

আমি তার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। তার মধ্যে এমন কিছু চলছে, যেটা সে কখনো প্রত্যাশা করেনি। আমি বললাম, না। টাকা পয়সা সব হতে যাবে কেন?
- ভাইজান আপনাকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম। মনে আছে?
- নিধি!
- হ্যাঁ।
- কী বলেছে সে?
- আজ ওর জন্মদিন ছিল। আমি আমার টিউশনীর টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা আলাদা করে রেখে দিতাম। তার জন্মদিনে তাকে কিছু দেবো বলে।
- তারপর?
- তার জন্য একজোড়া রূপার পায়েল কিনেছিলাম।
- দিয়েছো তাকে?
- হ্যাঁ। কিন্তু!

সাবস্ক্রাইব করুন:

ছেলেটা কিন্তু বলে থেমে গেল। কান্না করছে সে। আমি বললাম, কিন্তু?
সে কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে বললো, কিন্তু সে পায়েল জোড়া আমার মুখের উপর ছুড়ে দিয়েছে।
- কেন?
- সে আমাকে ভালোবাসেনি। সে অভিনয় করেছে আমার সাথে।
- এমনটা করার কারণ জিজ্ঞেস করোনি?
- আমি আমার ক্লাসের কারো সাথে তেমন মিশতাম না। মেয়েদের থেকে নির্দিষ্ট দুরুত্ব বজায় রেখে চলতাম। নিধি তার বান্ধবীদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয়টা করে।
- ভাই কান্না করছো কেন তুমি? শান্ত হও। সে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।
- ভাইজান আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। আমি মারা যাবো ভাইজান। আমি মারা যাবো।
- পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি? মারা গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে নাকি? আর ঐ মেয়ের জন্য মারা যাওয়ার কী আছে?
.
ছেলেটা আমার কথা শোনেনি। সে সেই রাতেই গলায় ফাঁস লাগিয়েছিল। পরে তার পাশের রুমের একটা ছেলে তাকে বাঁচায়। বিষও খেয়েছিল। হাসপাতালে তার সাথে আমিও ছিলাম। সে আমাকে কান্না করতে করতে বলেছিল, ভাইজান আমি বোধ হয় আত্মহত্যাও করতে পারবো না। যখন গলায় ফাঁস দিয়েছিলাম। তখন আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমি তখন বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। পরে সোহান ভাই আমাকে বাঁচিয়েছিল। আর আজ বিষ খাওয়ার পর আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। আমি বাঁচার জন্য ছটফট করছিলাম। পরে সেই সোহান ভাই-ই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিন্তু ভাইজান আমি নিধিকে ছাড়া বাঁচতেও পারবো না।

সেদিন ছেলেটার সেই কথার প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলাম, ভাই চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। তুমি মাস খানেক আগে বলেছিলে তোমার এক কাজিন মারা গিয়েছে। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো, তোমার সেই কাজিনের মা পর্যন্ত তোমার সেই কাজিনকে ভুলে গিয়েছে। মৃত্যুর দিনের মতো হাহাকার এখন আর তার মায়ের মধ্যে কাজ করে না। তুমি মারা গেলে তুমিই যাবে। এতে নিধি বলো, আমি বলো, কিংবা তোমার আত্মীয়-স্বজন বলো, কারো কিছু আসবে যাবে না। শুধু তুমিই চলে যাবে। আমরা না হয় তোমার জন্য দু'দিন চোখের জল ফেলবো। কিন্তু কিছুদিন পর আমরা তোমাকে ঠিকই ভুলে যাবো।
.
দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সেদিন হঠাৎ করেই ধানমণ্ডিতে ছেলেটির সাথে দেখা। দেখে বেশ ধনীই মনে হলো। ড্রাইভারকে গাড়িটা সাইডে রাখতে বলে ছেলেটির সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। সে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বললো, আপনি ঠিকই বলেছিলেন ভাইজান। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। আর মারা গেলে কেউ কাউকে মনে রাখে না।
ছেলেটা আমাকে এখনো "ভাইজান" সম্বোধনে সম্বোধন করছে। আমি বললাম, এখনো তুমি আমাকে ভাইজান বলছো?
সে হেসে উত্তর দিলো, একদিনের বড় হলেও সে বড়। আর আপনি তো আমার এক ইয়ারের সিনিয়র।

লেখকঃ শ্রাবণ আহমেদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url