গল্পঃ আনিকা তুমি এমন কেন

আম্মু হঠাৎ করেই কল করে বললো, আগামী সপ্তাহে আনিকার বিয়ে। তুই কাল কিংবা পরশুর মধ্যে বাড়ি চলে আয়।
আমি বললাম, আনিকা কে?
- তোর বড় মামার মেয়ে।
- ঐ পিচ্চি মেয়েটা?
- পিচ্চি মেয়েটা আর পিচ্চি নেই। সে তোর থেকেও বড় হয়ে গেছে।
- বললেই হলো নাকি? সেদিনও তাকে পুতুল নিয়ে খেলতে দেখলাম।
- অত কথা বাদ দিয়ে বাড়ি আসতে বলেছি, বাড়ি আয়।
- আসতেই হবে?
- তোর মামাতো বোনের বিয়ে। আর তুই আসবি না?
- ওকে কাল সন্ধ্যায় আমাকে বাড়িতে পাবে।





আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আম্মু কী বললো এসব? আনিকার বিয়ে মানে কী? তার বিয়ে হয়ে গেলে আমার কী হবে? আনিকা কি এই বিয়েতে রাজি? না না, সে রাজি হতে যাবে কেন? পাঁচ বছরের রিলেশন আমাদের। তার তো রাজি হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর আনিকা এ সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলেনি কেন? নাকি আম্মু আমাকে মিথ্যা বললো? নাহ, আমার মাথা কাজ করছে না। আমি আনিকাকে কল করলাম। সম্প্রতি করোনার ভাইরাসের কারণে কাউকে কল করলে সরাসরি কল না ঢুকে আগে অফিস থেকে করোনার সতর্কবাণী এবং করণীয় সম্বন্ধণীয় কথা বলে। তারপর কল ঢোকে। করোনার আলাপ শেষ হতেই শুনতে পেলাম, আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। একটু পরে আবার ডায়াল করুন।

এখন রাত এগারোটা বাজে। আমি বারান্দায় পায়চারি করছি। নাঈম ভাই আমাকে রাতের খাবার খেতে ডেকেছেন। আমি ভাইয়ের ডাক শুনেছি। টেনশনের কারণে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই আর রুমে যাইনি। খানিকপর নাঈম ভাই বারান্দায় এসে বললেন, কোনো প্রবলেম?
আমি বললাম, না না ভাই। কোনো প্রবলেম না।
- আমার সাথে আবার কবে থেকে মিথ্যা কথা বলা শুরু করলে।
- ভাই আনিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আম্মু কেবল কল করে জানালো।
- হাহাহা, এ তো খুশির খবর।
- ভাই আমি টেনশনে মারা যাচ্ছি। আর আপনি হাসছেন?
- আরে হাসবো না? কারণ বিয়েটা তোমার সাথেই হচ্ছে।
- মানে?
- আনিকাকে কল করো।
- করেছিলাম।
- তার ফোন বন্ধ, তাইনা?
- হ্যাঁ। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
- পুরোনো অভিজ্ঞতা শ্রাবণ।
- ভাই আমার প্রচুর টেনশন হচ্ছে। যদি এমনটা না হয়?
- আরে কিচ্ছু হবে না। আসো, ভেতরে আসো। খেয়ে নাও।
- জ্বী ভাই।
- আরে এত মন খারাপ করার কী আছে? বললাম তো কিছুই হবে না।

আমি ভাতের মধ্যে আঙ্গুল নাড়াচ্ছি। নাঈম ভাই বললেন, বাড়ি যাচ্ছো কখন?
আমি বললাম, সকালে রওনা দেবো।
- গুড। এখন খাওয়া দাওয়া করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে লম্বা একটা ঘুম দাও। আর অযথা টেনশন করার কিছু নেই।
- জ্বী ভাই।
- শোনো, বিয়ে একটা সম্পর্কের বাঁধন। আর এটা কোনো ছেলেখেলা নয় যে, যখন যে যা খুশি তাই করতে পারবে।
- ভাই।
- ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আজকের তরকারিটা কেমন হয়েছে?
- ভালো।
- নতুন খালা রান্না করে গিয়েছেন।
- হুম।
- আগের খালা বলেছেন উনি নাকি আর আসতে পারবেন না। উনি গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। তাই নতুন একটা খালাকে দিয়ে গিয়েছেন।
- বেশ তো!
- হ্যাঁ, এবার দ্রুত খেয়ে ওঠো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আনিকার সাথে শেষ কথা হয়েছে গতকাল। সে তো তখন কিছু বলেনি আমাকে। নাকি গতকাল সে জানতোই না যে আজ তার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করবে! তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বাড়ি থেকে ঢাকা আসার সময়। মেয়েটা সেদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তার টোল পড়া গাল দু'টির কথা বারবার মনে পড়ছে। আমি তার ঠোঁটে চুমু না খেয়ে তার সেই টোলের উপরে চুমু খেতাম। এতে মেয়েটা হাসতো। বলতো, সবাই তার প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু খায়। আর তুমি আমার টোল পড়া জায়গাতে চুমু খাও কেন? উত্তরে আমি হাসতাম। কিছু বলতাম না।

রাত একটা বাজে। চোখে ঘুম নেই আমার। কখন সকাল হবে, কখন আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো? ভাবছি আম্মুকে আরেকবার কল করে আনিকার বিয়ের ব্যাপারে আরেকটু ভালো করে জেনে নেই। কিন্তু আম্মু যদি প্রশ্ন করে বসে, ওর বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন? তখন কী করবো? এসব ভাবতে ভাবতেই আম্মুকে কল করলাম। রিং হচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। গ্রাম তো আর ঢাকা শহর না যে, সেখানে মানুষ অনেক রাত অব্দি জেগে থাকবে। হঠাৎই নাঈম ভাই বলে উঠলেন, কী ব্যাপার শ্রাবণ? এখনো ঘুমাওনি?
আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই। এইতো ঘুমাচ্ছি।
- হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার আবার কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।
- জ্বী ভাই।

রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নেই। বারবার আনিকার মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ঐ মুখের দিকে তাকিয়েই আমি সারাটাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। ভোর রাতের দিকে চোখে ঘুম ঘুম ভাব এলো। শরীর পুরো ছেড়ে দিয়েছে। চোখ দু'টো লেগে আসছে। তাকিয়ে থাকা বড় দায় হয়ে গিয়েছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল সাতটার দিকে নাঈম ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। আমি ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সকাল হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তাইনা?
- কিভাবে বুঝলেন ভাই?
- তোমার চোখ দু'টো লাল হয়ে আছে।
আমি বিছানা থেকে উঠে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর বড় আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যই চোখ দু'টো ভীষণ রকম লাল হয়ে রয়েছে।

আমি ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে থাকলাম। নাঈম ভাই বললেন, একটু পরে যাও। রান্না হচ্ছে। খেয়ে তারপরে যাও। এতে জার্নি ভালো হবে। আমাদের মেসে তিনটা রুম। পূর্ব দিকের রুমটাতে আমি আর নাঈম ভাই থাকি। বাকি দুইটা রুমের এক রুম খালি পড়ে রয়েছে। আর আরেক রুমে দুইটা বড় ভাই থাকেন। অবশ্য মেসটা প্রথমে আমি আর নাঈম ভাই-ই ভাড়া নেই। সুতরাং মেসের মালিক আমি আর নাঈম ভাই। মেসে যারাই উঠুক, তারা সবাই আমাদের করা নিয়ম কানুন মানতে বাধ্য। ফাঁকা রুমটার জন্য কিছু টু-লেটও লাগানো হয়েছে। এই মাসের মধ্যে ঐ রুমটাও ভরাট হয়ে যাবে আশা করা যায়। তখন মেসের ভাড়াটাও অনেকটা কমে আসবে।

সাবস্ক্রাইব করুন:

রান্না শেষ হতে হতে আটটা বেজে গেল। আমি দ্রুত খেয়ে নিয়ে নাঈম ভাইকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় তিনি বললেন, দেখেশুনে যেও। আর ওখানে কী হয় জানাইও। ছয় ঘণ্টার পথ। রোডে কোনো জ্যামও নেই। তবুও আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন এই পথ শেষ হবার নয়। আমি আম্মুকে কল করলাম। আম্মু কল রিসিভ করে বললো, রওনা দিয়েছিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ আম্মু রওনা দিয়েছি। আম্মু একটা কথা বলার ছিল।
- বল।
- ছেলে কী করে?
- কোন ছেলে?
- যার সাথে আনিকার বিয়ে হচ্ছে!
- পড়ালেখা করে।
- তাহলে একটা বেকার ছেলের সাথে মামা তার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন কেন?
- এতে তোর সমস্যা কোথায়? আর তাছাড়া ছেলেটা বেশ নম্র, ভদ্র একটা ছেলে। পরিবারও খুব ভালো।
- ছাই ভালো। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো ওদের পরিবারে ঝামেলা আছে।
- কী?
- না না, কিছু না।
- হুম। আয় তুই। কল রাখলাম।

আম্মু কল রেখে দিলো। ছেলেটা নম্র, ভদ্র, পরিবার ভালো, তার মানে সত্যই কি আনিকা অন্যের হয়ে যাচ্ছে? না এ হতে পারে না। প্রয়োজনে আমি মামাকে গিয়ে আমাদের সম্পর্কের কথাটা বলবো। মামা রাজি না হলে দু'জনে পালিয়ে যাবো। তবুও আমি আনিকাকে হারাতে পারবো না।
.
পূর্বের মতোই আনিকার ফোন বন্ধ। তার কি আমার কথা একবারও মনে পড়ছে না? নাকি সে আমাকে কল করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না? না, এমনটা তো হওয়ার কথা না। যত যাই হয়ে যাক সে তার ফোনটা অন্তত অন রাখে। কিন্তু আজ বন্ধ কেন? সেই কখন থেকে বাস চলছে। তবু যেন রাস্তা ফুরাচ্ছে না। মনের মধ্যে আমার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আম্মুকে ছাড়া কাউকে কল করতেও পারছি না। কেননা যাকে কল করে আনিকার কথা জিজ্ঞেস করবো। সেই উল্টাপাল্টা ভেবে বসতে পারে।

বিকেল গড়ালে বাড়ি পৌঁছালাম। বাড়ি গেটে ইয়া বড় একটা তালা ঝুলানো। আমি আম্মুকে কল করতেই আম্মু বললো, বাড়ি এসেছিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
- তোর বড় মামার বাড়িতে চলে আয়।
- কিন্তু আম্মু আমার তো ফ্রেশ হতে হবে।
- এখানে এসে ফ্রেশ হয়ে নিস।
- পারবো না। তুমি কাউকে দিয়ে চাবিটা পাঠিয়ে দাও।

আম্মু আর কিছু না বলে কল রাখলো। গেটের সামনে পায়চারি করছি। দশ মিনিট যায়, বিশি মিনিট যায়। কারো আসার কোনো নামগন্ধও নাই। একবার ভাবছি মামার ওখানে চলে যাই। আবার ভাবছি, নাহ! আরেকটু দেখি না, কেউ আসে কিনা। ঘড়ির কাঁটাতে সময় পঁয়ত্রিশ মিনিট অতিক্রম করলে অয়নকে দেখতে পেলাম। অয়ন আনিকার ছোট ভাই। এবার নাইন কিংবা টেনে পড়ে। হেলেদুলে গান গাইতে গাইতে আসছে। আমাকে দেখেই সে গান গাওয়া বন্ধ করে দিলো। তারপর কাছে এসে সালাম দিয়ে বললো, ভাইয়া আপনার চাবি।
- এতক্ষণ লাগলো তোর?
- ব্যস্ত ছিলাম ভাইয়া, তাই দেরি হয়ে গেল।
- কিসের ব্যস্ত?
- আপনি জানেন না?
- না।
- শুক্রবারে আপুর বিয়ে।
ছেলেটার মুখে দারুণ একটা হাসি ফুটে উঠলো। হাসি ফুটে উঠাই স্বাভাবিক। বোনের বিয়ে মানেই তো মজা। সে কি আর প্রেম ভালোবাসা বোঝে? যে, তার বোনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আপু তোর কাউকে পছন্দ থাকলে আমাকে বলতে পারিস। আমি একটা ব্যবস্থা করবো।
আমি বললাম, সত্যই বিয়ে?
- হ্যাঁ।
- তোর আপু কোথায় এখন?
- রুমে বসে সাজুগুজু করে।
- কী?
- হ্যাঁ।
- বিয়ে তো আরও পাঁচদিন পর। তবে এখনই সাজুগুজু কেন?
- আজ সন্ধ্যায় নাকি ছেলের বাড়ি থেকে কারা আসবে!
- ও।
- ভাইয়া আমি এখন যাই।
- না না, কোথায় যাবি? আয় ভেতরে আয়। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর দু'জন একসাথে যাচ্ছি।

অটোতে বসে আছি দু'জন। আমি অয়নকে বললাম, ভাই মামা এখনই কেন তোর আপুকে বিয়ে দিচ্ছে। ওর তো পড়ালেখাই শেষ হয়নি।
- আমি কী জানি?
- তোর আপু তো একটা পিচ্চি মেয়ে। ও কি বিয়ে সম্বন্ধে কিছু বোঝে?
- তাইতো!
- আচ্ছা তোর আপুর ফোন বন্ধ কেনরে?
- কই? আমি আসার সময়ও তো দেখলাম সে কার সাথে যেন হেসে হেসে কথা বলছে।
- ও। আচ্ছা যেই ছেলের সাথে তোর আপুর বিয়ে হচ্ছে, সেই ছেলেকে দেখেছিস?
- না ভাইয়া। তবে আপু দেখেছে। আব্বা একটা ফটো এনেছিল ঐ ছেলের।
- তোর আপু পছন্দ করে ফেললো?
- ফেলবে না? অনেক সুন্দর দেখতে নাকি ছেলেটা!
- আচ্ছা বলতো, আমি দেখতে কেমন?
অয়ন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, উমমম, আপনিও সুন্দর।
- ঐ ছেলের থেকে কম না বেশি?
- তা কী করে বলবো? আমি কি ঐ ছেলেকে দেখেছি নাকি?

বাড়িটা নানান ধরনের রঙবেরঙের লাইট দিয়ে সাজানো। দেখে মনে হচ্ছে যেন আজই বিয়ে। আমি বাড়িতে ঢুকতেই আম্মু আমাকে বললো, এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো?
আমি বললাম, বিয়ে তো শুক্রবারে। কিন্তু তোমরা আজই কেন চলে এসেছো?
- বা'রে, আনিকা আমার মেয়ে না? আর মেয়ের বিয়েতে মায়েদের থাকতে হয় না?
- মেয়েটা তো পিচ্চি এখনো। তাকে এখনই কেন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
- কে বলেছে তোকে আনিকা পিচ্চি? গিয়ে দেখ কত সুন্দর দেখতে হয়েছে!
- সুন্দর হয়েই কি পিচ্চি মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে?

আম্মু আর কিছু বলল না। আমাকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলল, এটাতে আপাতত তুই থাকবি। লোকজন বেশি হয়ে গেলে তখন বের হয়ে যেতে হবে।
- কেন? লোকজনের থেকে কি আমার দাম কম?
- তুই নিজের লোক। আর লোকজন বলতে আনিকার বান্ধবীরা আসলে তখন তারা কোথায় থাকবে?
আম্মু আমাকে রুম দেখিয়ে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই আমি বললাম, আম্মু।
আম্মু পেছন ফিরে বললো, হ্যাঁ। কিছু বলবি?
- ছেলের বাড়ি থেকে নাকি আজ কারা আসবে?
- হ্যাঁ এসেছিল। তুই আসার একটু আগে চলে গিয়েছে।
- ও।

আমি রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এই রুমটাতেই আমি আনিকাকে প্রথম তাকে পছন্দের কথা বলেছিলাম। সেদিন তার হাত ধরতেই সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ভাইয়া আমাকে যেতে দিন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে তার সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। আনিকা এখন অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। আর আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।

চোখে ঘুম প্রচুর। একটু ঘুমানো প্রয়োজন। গতরাতে ঘুম হয়নি। বাসেও ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু তার আগে আনিকার সাথে একবার দেখা করা দরকার। আমি বিছানা থেকে উঠে বসতেই চোখটা আমাকে ডেকে বললো, ভাই এখন একটু ঘুমিয়ে নে। পরে তোর আনিকার সাথে দেখা করিস। অগত্যা আমাকে ঘুমাতে হলো।

রাত ন'টা কি সাড়ে ন'টা বাজে। কেউ রুমের দরজায় নক করলো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম আম্মু দাঁড়িয়ে আছে।
- কিরে এত ঘুমালে চলবে? খেতে হবে না?
- হুম যাও। আসতেছি আমি।
- তাড়াতাড়ি আয়।

রুমের সাথেই এটাস্ট বাথরুম। আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম। বাড়িতে লোকজন তেমন নেই। মামার বাড়ির ক'জন, আমার বাড়ির ক'জন। আর খালার বাড়ি থেকে খালা আর রুমকি এসেছে। রুমকি অয়নের সাথেই পড়ে। ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথেই খেতে
বসেছি। স্পেসটা অনেক বড় থাকায় অনেকের একসাথে খেতে কোনো অসুবিধা হয় না। সবাই এসেছে। কিন্তু আনিকাকে দেখছি না। আমি আম্মুর পাশে বসেছি। আম্মুকে বললাম, আনিকা কোথায়?
আম্মু বললো, সে এখানে এতো মানুষের মধ্যে বসে খেতে পারবে না। তার রুমে খাবার দিয়ে আসা হয়েছে।
- আম্মু।
- হু।
- খাওয়ার পরে কিছু কথা আছে। একটু বেলকনিতে এসো।

খাওয়া শেষ হলে আমি আর আম্মু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মুকে বললাম, তোমরা যে আনিকাকে বিয়ে দিচ্ছো। এতে আনিকার মত আছে?
- মত না থাকলে কি এমনিতেই দিচ্ছি নাকি?
- কী?
- হ্যাঁ।
- ছেলের ছবি আছে তোমার কাছে?
- না। তোর মামার কাছে আছে।
- ফোন নাম্বার?
- না।
- আম্মু একটা কথা।
- তাড়াতাড়ি বল। আমার কাজ আছে।
এর মধ্যেই বড় মামি আম্মুকে ডাক দিলেন। আম্মু আমার কথা না শুনেই প্রস্থান করলো।
.
আম্মু বলেছিল আগামী সপ্তাহে বিয়ে। কিন্তু এসে দেখছি এই সপ্তাহের শুক্রবারেই বিয়ে। সবাই ঘুমাতে যাচ্ছে। অয়নকে সামনে পেতেই তাকে ডাক দিলাম। সে কাছে এলে বললাম, পিচ্চি ভাই সেই কখন তোদের এখানে এসেছি। অথচ তোর বোনকেই দেখা হলো না।
- দেখেন রুমে আছে।
- ঘুমিয়ে গিয়েছে?
- না। কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
- ও। ঠিক আছে। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
- আচ্ছা।

অয়ন চলে যেতেই আমি আনিকার রুমে নক করলাম। খানিকপর সে দরজা খুলতেই আমি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আনিকা আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে। আমি দু'হাতে তাকে ধরে বললাম, এসব কী হচ্ছে আনিকা? তোমার বিয়ে মানে কী?
আনিকা চুপ করে আছে। আমি আবারও বললাম, আনিকা আমাদের পাঁচ বছরের রিলেশন। সেটা কি তুমি ভুলে গিয়েছো? আর তোমার ফোন বন্ধ কেন?
- শ্রাবণ আমাকে ছাড়ো।
আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দিতেই সে বললো, দেখো আমি বাবার অমতে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।
- তোমার বাবাকে আমার কথা বলেছো?
- আস্তে কথা বলো। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে তোমার কথা।
- তোমার বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছো?
- না।
- একবার বলতে তো পারতে।
- বাবার রাগ সম্পর্কে তো তুমি জানো। কখন কী করে বসে বলা যায় না।
- আমি মামাকে বলবো।
- না।
- কেন?
- বাবার হার্টের প্রবলেম। ডাক্তার বিশ্রাম করতে বলেছেন।
- আনিকা, এই আনিকা। তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে থাকতে পারবে?
- একসময় সব সয়ে যাবে।
- আমার কী হবে তাহলে?
- তুমিও অন্য কাউকে বিয়ে করে নিও।
- আনিকা।
- এখন যাও। রাত অনেক হলো। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে।
- ছেলের ফোন নাম্বার আছে?
- আছে।
- ছবি?
- হ্যাঁ।
- দেখি।

আনিকা ছেলেটার ছবি বের করে দেখালো আমাকে। দেখতে বেশ সুদর্শন। আনিকার থেকে ছেলেটার ফোন নাম্বার চাইতেই সে বললো, দেখো শ্রাবণ আমি চাচ্ছি না তুমি এর মধ্যে কোনো গণ্ডগোল পাকাও।
- গণ্ডগোল? আনিকা তুমি বুঝতে পারছো, এই বিয়ে মানে তুমি অন্যের হয়ে যাওয়া।
- হ্যাঁ বুঝতে পারছি।
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি আনিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সে নিজেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করলো না। খানিকপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তার রুম থেকে বের হয়ে এলাম।

খানিকপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তার রুম থেকে বের হয়ে এলাম। দেখলাম বাইরে রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে দেখে বললো, ভাইয়া অয়ন কোথায়?
আমি তাকে একদিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নিজের রুমে চলে এলাম। কখনো আনিকাকে হারানোর কথা কল্পনাতেও ভাবিনি। শুধু ভেবেছি সে আমার মামাতো বোন। আম্মুকে কিংবা মামাকে যেমন করেই হোক ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু আজ আমার কাছে সবকিছু বিবর্ণ মনে হচ্ছে। আমি ইচ্ছে করলেই আম্মুকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারছি না। তারা কত হাসিখুশি রয়েছে। এর মধ্যে যদি আমি আনিকা আর আমার সম্পর্কের কথা বলি। তবে নির্ঘাত তাদের মনটা খারাপ হয়ে যাবে। সাথে দারুণ একটা কেলেংকারি হয়ে যেতে পারে।

রুমের সাথে বারান্দা নেই। এত রাতে ছাঁদে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। স্বাধীন ভাই বলেছিলেন স্মোক করলে কষ্ট কমে। স্বাধীন ভাই হলেন মেসের পাশের রুমের বড় ভাই। বর্তমানে আনোয়ার ইস্পাতে আছেন। মাস ছয়েক হলো বিয়ে করেছেন। প্রেমের বিয়ে। ফেসবুক প্রেম। কী অদ্ভুত তার প্রেমের কাহিনী! একদিন কী কারণে যেন তিনি আমাকে তার প্রেমের কাহিনীগুলো বলেছিলেন। তাকে কখনো সিগারেট খেতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন দেখেছিলাম। প্রথম টান দিতেই প্রচুর কাঁশি হচ্ছিলো তার। হাজার ঝড় হয়ে গেলেও আমার সিগারেট খাওয়ার প্রতি কোনো ইচ্ছে নেই।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাঁদে গেলাম। বেশ খানিকটা সময় রাতের অন্ধকারে সাথে আলাপ করলাম। আকাশে জ্যোৎস্না নেই। তারারাও লুকিয়ে ফেলেছে নিজেদের। নাকি তারা উঠেইনি আজ? ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা সময় এই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে আনিকা আমাকে বলতো, শ্রাবণ ঝিঁঝিঁ পোকার এই ডাকগুলো দারুণ না?
উত্তরে আমি বলতাম, আমার এই ঝিঁঝিঁটার 'কথার' চেয়ে বেশি না।
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে লাল বর্ণ ধারণ করতো। আমি অনিমেষ নেত্রে তার পানে চেয়ে থাকতাম। কিন্তু আজ! আজ আমি একলা একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছি। একা একা ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছি। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার আনিকা ছাঁদে আসবে। এসে বলবে, শ্রাবণ ঝিঁঝি পোকার ডাকগুলো সুন্দর না?
কিন্তু সে আসলো না। রাত গভীর হলে নিচে নেমে এলাম। রুমে ঢুকতে যাবো, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে ডাক দিলো। পেছনে ঘুরে দেখলাম আম্মু।
- কিরে এত রাতে ছাঁদে কী করছিলি?
- অনেকদিন গ্রামের এই রাতের পরিবেশটার সাথে আলাপ করা হয় না।
- তাই বলে এতরাতে?
- হুম।
- যা, ঘুমাতে যা।
- হুম।

সকল মা-ই তার সন্তানদের মনের কথা বোঝে। তাহলে আমার আম্মু কেন আমার মনের কথা বোঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে? রুমে এসে আনিকার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা ভাবতে থাকলাম। যত ভাবছি, ততই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আচ্ছা এই ভাবার সাথে চোখের জলের সম্পর্ক কী? নাকি তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারে না? হবে হয়তো! এই মুহুর্তে আনিকার সাথে কথা বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তার ফোন নাম্বারও চেন্জ। ইচ্ছে করলেই কল করতে পারছি না। সামনের রুমেই রয়েছে সে। অথচ মনে হচ্ছে সে আমার থেকে লক্ষ যোজন দূরে।

সকাল হয়ে গিয়েছে। সারারাত ঘুম হয়নি। ভোর রাতেও ঘুম আসেনি। জেগেই আছি। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। গতকালের মতো আজও চোখ দু'টো লাল হয়ে আছে। রুমেই বসে আছি। হঠাৎই আম্মু রুমের দরজায় নক করে বললো, নিরব উঠেছিস?
আম্মু আমাকে নিরব ডাকে। বাড়ির সবাই নিরব ডাকে। বড় মামা, বড় মামি, সবাই ডাকে। শুধু আনিকা শ্রাবণ ডাকে। তার নাকি শ্রাবণ নামটা বেশ ভালো লাগে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বললাম, হুম। কিছু বলবে?
- ছেলেপক্ষ জানিয়েছে করোনা না কী জানি এক রোগ বের হয়েছে। সেই জন্য তারা অল্পলোক আসবে।
- তো আমাকে বলছো কেন? আর বিয়ে তো আজ না।
- তোকে বলছি কারণ, বিয়ের সকল কাজ তোকে করতে হবে। তাদের আপ্যায়ন থেকে শুরে করে সব।
- পারবো না। আর অল্পলোককে তো তোমরাই খাওয়াতে পারো।
- রাতে ঘুমাসনি?
- কেন?
- চোখ লাল হয়ে আছে?
- ঘুমিয়েছি। সকালে হঠাৎ করেই চোখে কী যেন পড়লো!
- দুই চোখেই পড়েছে?
- হুম।
- মিথ্যেটাও গুছিয়ে বলতে পারিস না। আর কবে পারবি বল?
শুধু মিথ্যে নয় আম্মু। নিজের পছন্দের কথাগুলোও তোমাকে গুছিয়ে বলতে পারি না। অথচ দেখো, আব্বার চেয়ে তোমার সাথেই আমি বেশি ফ্রী।
- কিরে, কী ভাবিস?
- না, কিছু না।
- আনিকার জন্য শপিংয়ে যেতে হবে।
- যাও।
- তুইও যাবি।
- আমি কেন?
- তোর কিছু লাগলে নিবি।
- আমার কিছুই লাগবে না।
- না লাগলেও যেতে হবে। শহর বাজারে মেয়ে মানুষ একলা যায় নাকি? তুই সাথে থাকলে ভালো হবে।
- অয়নকে নিয়ে যেও।
- ও ছোট মানুষ। ও যেতে পারবে না।
- পারবো না আমি।
- রেডি হয়ে নে। খানিকপর বের হতে হবে।

আমি ড্রাইভারের পাশে বসেছি। ভেতরে আম্মু, আনিকা, মামি, অয়ন আর রুমকি। গাড়িতে উঠার সময় আনিকার চোখের দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিলো না। পরনে শাড়ি, কাজল নেই চোখে। তবুও কেমন যেন ঘোর লাগানো একটা চাহনি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনি

মার্কেটি গিয়ে সবাই সবকিছু নিলো। বিপত্তি বাঁধলো আনিকার শাড়ি কিনতে গিয়ে। শেষে আম্মু আমাকে বললো, দেখতো কোন শাড়িটা নেওয়া যায়?
আমি আবার এসবে আনাড়ি। তবে মাঝে মাঝে যখন আনিকার সাথে মার্কেটে আসতাম। তখন তার জিনিসগুলো আমিই পছন্দ করে দিতাম। কিন্তু এর আগে শাড়ি কেনা হয়নি কখনো। সামনে একটা লাল শাড়ি ছিল। আমি বললাম, এটা নাও।
আম্মু দোকানদারকে শাড়িটা প্যাকেট করতে বললো। বিল দিতে গিয়ে আম্মু বললো, বিলটা দিয়ে আয়।
আমি বললাম, আমি কেন বিল দেবো?
- আসার সময় টাকা নিয়ে আসিনি।
- তাহলে মার্কেটে এসেছো কেন?
- এত কথা বাদ দিয়ে বিল দে।
- টাকা নেই আমার কাছে।
- কার্ডে আছে?
- হুম।
- তুলে দে।
অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বিলটা দিতে হলো।

বাসায় ফিরে আনিকাকে একটু একা পেয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, তাহলে সত্য সত্যই বিয়েটা করছো?
আনিকা অবলীলায় বলে দিলো, হুম।
- আনিকা, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
- থাকতে হবে।
- তুমি কি আদৌ আমাকে ভালোবেসেছিলে? নাকি....
- শ্রাবণ এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দও। এসব আমার একদম ভালো লাগে না।
- ও।
- আর আমার আশেপাশে বেশি ঘুরঘুর করো না। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।
- তোমার ফোন নাম্বারটা দাও।
- নাও।
- আচ্ছা আনিকা তুমি না বলেছিলে আমরা দু'জন গভীর সিন্ধু মাঝে একটি রঙিন নৌকা?
- হু।
- তুমি বলেছিলে আমি লোহা। আর তুমি কাঠ। দুইটার সংমিশ্রনে নৌকা তৈরি হয় এবং সিন্ধু মাঝে ভেসে রয়।
- এসব কথা এখন বাদ দাও। প্রেমের সময় মানুষ অনেক কিছুই বলে। বাস্তব এর বিপরীত।
- তবে কেন ভালোবেসেছিলে?
- আমি তো বাসতে চাইনি। বরং তুমি বাসতে বাধ্য করেছিলে।
- আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে কেন?
- ভালো লাগতো তখন।
- এখন লাগে না?
- শ্রাবণ আমার মাথা ব্যথা করছে। আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও। তুমি আসো এখন।
- এই কয়টা দিনই না হয় বিরক্ত করলাম। তারপরে আর করবো না। আর আসাও হবে এই বাড়িতে।
- কাঁদছো কেন তুমি?
আমি চোখ মুছে বললাম, কাঁদলে তোমার কী?
- আমার সামনে কাঁদবে না। নিজের রুমে গিয়ে কাঁদো। এসব আমার সহ্য হয় না।
- ভালোবাসো আমাকে?
আনিকা আর কোনো উত্তর না দিয়ে তার রুমে চলে গেল।

সাবস্ক্রাইব করুন:

আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। মনে চাচ্ছে আনিকাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলি, ভালোবাসি আনিকা। তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলবে না।
এর মাঝে অয়ন এসে বললো, ভাইয়া রুমকিকে দেখেছেন?
এই পিচ্চি দুইটাও বোধ হয় একে অপরকে ভালোবাসে। না না, ভালোবাসে বললে ভুল হবে। পছন্দ করে। এরাও বোধ হয় একে অপরকে পছন্দ করে।
আমি বললাম, দেখো ছাঁদে গিয়েছে।
সে দৌঁড়ে ছাঁদে চলে গেল।
.
কাল বিয়ে। আনিকার তিনজন বান্ধবী এসেছে মাত্র। দু'জনকে চিনি। বাকি একজনকে চিনি না। ছাঁদ এখন তাদের দখলে। অবশ্য আমি তেমন একটা ছাঁদে যাইও না। আর গেলেও অল্প কিছুক্ষণ থাকি। কিন্তু এখন আর সেটাও হবে না। রুম থেকে বের হয়ে আম্মুর কাছে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে অর্পা আর জান্নাতের মুখোমুখি হতেই তারা হেসে বললো, ভাইয়া কেমন আছেন?
আমি "ভালো" বললাম। তারা আর কিছু বললো না। অপরিচিত বান্ধবীটা বললো, ভাইয়া আজ রাতে ছাঁদে আইসেন। একসাথে আড্ডা দেওয়া যাবে।
মেয়েটা দেখতে সুন্দর। কথাও বলে সুন্দর করে। নাহ, তার কথার দিকে নজর দিলে আনিকার কথা মনে পড়বে। তখন আনিকার সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করবে।

রাতে ছাঁদে যাওয়ার আগে অর্পা, জান্নাত আর ঐ অপরিচিত মেয়েটা বললো, ভাইয়া ছাঁদে যাচ্ছি। আসতে পারেন।
আমি বললাম, তোমরা যাও।
তারা চলে গেল। আনিকার রুমের দিকে উঁকি দিতেই বড় মামি ডেকে বললেন, নিরব বাবা একটু এদিকে আসো তো!
আমি কাছে যেতেই তিনি বললেন, বাবা আমার একটা মাত্র মেয়ে। তুমি কাল বিয়ের সময়টাতে একটু সাহায্য করবে। দেখছোই তো বাড়িতে বড় ছেলে বলতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েটার বিয়ে নিয়ে তোমার মামার খুব চিন্তা ছিল। ভালো মতো বিয়েটা হয়ে গেলেই হয়। তুমি একটু খেয়াল রেখো সবকিছু।
- জ্বী মামি।
- খাবার খেয়েছো?
- জ্বী।

আমি রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ফোন বের করে আনিকাকে কল করলাম। রিং হচ্ছে রিসিভ হচ্ছে না। এই বিয়েতে যদি তার অমত থাকতো। তবুও আমরা পালিয়ে যেতে পারতাম না। মামি ঠিকই বলেছেন, অত্র বাড়িতে সকল কাজের জন্য আমি ছাড়া আর কোনো ছেলে নেই। বেশ কয়েকবার কল করলাম। সে রিসিভ করলো না। রাতটা পেরোলেই তার বিয়ে। কালকের মধ্যেই সে অন্যের হয়ে যাবে। নাহ, তার বিয়ের সময়টাতে আমি থাকতে পারবো না। থাকলে আমি তার বিয়েটা মেনে নিতে পারবো না। সহ্য হবে না আমার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি মারা যাবো। ও প্রেম, প্রেম গো, তুমি এমন কেন গো প্রেম? তোমাতে এত জ্বালা কেন প্রেম? যদি আগে জানতাম, তবে তোমাতে মিশতাম না গো প্রেম। তুমি সুখের তরীতে ভাসিয়ে নিয়ে দুখের কূলে নাও বাও। তুমি বড্ড চতুর গো প্রেম, বড্ড চতুর।

সকাল হতেই বাড়ির ভেতরটা সাজানো থেকে শুরু করে সকল কাজকর্ম আমাকেই করতে হচ্ছে। দুঃখ কষ্ট সকল চেপে রেখে আমি নিঃশব্দে সবকিছু করে যাচ্ছি। কেউ কিছু বললে শুধু হ্যাঁ হু উত্তর করছি। আনিকার সাথে দুইবার দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল বলতে আমি তাকে দেখেছিলাম। সে আমাকে দেখেনি। তাকেও কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছিল। হয়তো এই বিয়েতে তারও মত নেই। কিন্তু মামা মামির কথা চিন্তা করে সে তাদের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না।

আম্মুর সাথে দেখা হলে মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু মায়ের মন! সে সবকিছুই বোঝে। দুপুরে আম্মুর মুখোমুখি হতেই আম্মু বললো, কিরে তোর যে কোনো খোঁজই নেই। কোথায় থাকিস?
বললাম, কোথায় আর থাকবো? আমার একটা মাত্র বোনের বিয়ে। তার বিয়ের সকল কাজের দায়িত্ব তো আমার, তাইনা?
- তোর মন খারাপ?
- মন খারাপ হতে যাবে কেন?
- আনিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেজন্য!
- তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এটা তো আরও খুশির খবর। এতে মন খারাপের কী আছে?
- ছেলেপক্ষের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
- হুম।
- আনিকাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত তোর কাজ। এরপরে তুই স্বাধীন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। বাড়িতে বিয়ের আয়োজন বাড়তে থাকলো। সবাই সবার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আমি সকলের চোখ এড়িয়ে আনিকার রুমের দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আয়।
সে ভেবেছে, তার বান্ধবীরা বোধ হয় দরজায় নক করেছে। আমি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আনিকা আমাকে দেখে বলে উঠলো, তুমি?
- চুপ, একদম চুপ।
- তুমি এখানে কী করছো? বের হয়ে যাও শ্রাবণ। কেউ এসে পড়লে কেলেংকারি হয়ে যাবে।
- কেউ আসবে না।
- তুমি যাও প্লিজ।
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে বোধ হয় ভয় পাচ্ছে আমাকে। চোখ দু'টো তার সেটাই বলছে। সে বললো, কিছু করো না আমাকে। প্লিজ শ্রাবণ।
আমি খানিক হেসে বললাম, আমার প্রতি তোমার এতটুকুও বিশ্বাস নেই আনিকা? যেই আমি তোমার টোল ছাড়া ঠোঁটটা অব্দি কোনোদিন স্পর্শ করিনি। তুমি ভাবলে কী করে সেই আমি আজ তোমার সাথে!
আনিকা চুপ হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, আমি তোমায় ভালোবাসি আনিকা। আর আমি চাই না আমার ভালোবাসা কখনো কষ্ট পাক। তোমার কাছে আমি একটা শেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি। বলো রাখবে, বলো!
- কী?
- একটু বউয়ের সাজে সেজে আমার সামনে দাঁড়াবে? বড্ড ইচ্ছে ছিল তোমাকে বউয়ের সাজে দেখার। প্লিজ!
- কিন্তু.....
- আর তো কখনো বলবো না। প্লিজ আনিকা।

সে একটু তড়িঘড়ি করেই সেদিনের সেই লাল শাড়িটা পড়লো। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কী অপরূপ গো আমার আনিকার মুখ! কেউ দেখলেই তার সুপ্ত মনে প্রেম জেগে উঠবে। আমি অপলক চেয়ে রইলাম তার দিকে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে শাড়ির কুচিটাও ঠিকমতো দিতে পারেনি সে। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিলো কুচিটা ঠিক করে দিতে। কিন্তু আমার সেই অধিকারটা নেই। আমি বললাম, আনিকা।
সে 'হু' বললো।
- একটাবার জড়িয়ে ধরতে দেবে আনিকা?
- না।
- একটাবার।
সে চুপ করে রইলো। চুপ করে থাকা সম্মতির লক্ষণ। তবে সব ক্ষেত্রেই নয়। আমি বললাম, আসি আনিকা। তোমাকে বউয়ের সাজে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল। দেখা হয়ে গিয়েছে। আসি এখন।
আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই সে বললো, ধরো।
আমি দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছে। আনিকা আমাকে জড়িয়ে ধরেনি। শুধু আমিই ধরেছি। মনে হচ্ছে তাকে ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আমার চোখ দু'টো জলে ছলছল করছে। সেটা তার চক্ষু এড়ালো না। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হতেই আম্মুর সামনে পড়ে গেলাম। আমার এখন একদম ভয় করছে না। আমি চোখ দু'টো মুছে আম্মুর পাশ কাটিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে চলে এলাম।
.
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সূর্যের আলো পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি আধো ভাঙা পিচঢালা পথ ধরে গন্তব্যহীন হেঁটে চলেছি। দু'টো ছেলে আমার পিছু নিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ছিনতাইকারী। বয়স আনুমানিক সতের কি আঠারো হবে। আমি তাদের ডাক দিলাম। তারা এগিয়ে এলো। আমি বললাম, ভাই আমার কাছে তেমন কিছু নেই। একটা মোবাইল, একটা ঘড়ি, কিছু খুচরা টাকা। আর কিছু নেই। চাইলে নিয়ে যেতে পারো। আমি হাত থেকে ঘড়িটা খুলে তাদের দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
ছেলে দু'টো অবাক হলো। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই আপনে কাঁদতেছেন ক্যান?
- আজ আমার অতি মূল্যবান জিনিসটাই ছিনতাই হয়ে যাচ্ছেরে। তার কাছে এসব কিছুই না।
ছেলে দু'টো আমার থেকে কিছু না নিয়ে প্রস্থান করলো।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলাম আম্মু কল করেছে। রিসিভ করলাম।
- কোথায় তুই?
- জানি না।
- তোর মামার এখানে আয় তাড়াতাড়ি।
- বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
- হ্যাঁ।
আমি কল রাখলাম। ধীরে ধীরে মামার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম। পা দু'টো অবশ হয়ে আসছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দু'টোও ঝাপসা হয়ে আসছে।

রাত ন'টা নাগাদ মামার বাড়িতে পৌঁছালাম। এর মাঝে ফোনটা অনেকবার বেজে উঠেছে। কিন্তু আমি রিসিভ করিনি। বের করে দেখিওনি কে কল করেছে। বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখলাম সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আনিকাও দাঁড়িয়ে আছে। আনিকার চোখ দু'টো ছলছল করছে। টিপটাপ লাইটের আলোয় তার চোখের জলগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আমাকে দেখেই মেয়েটা দৌঁড়ে এসে সকলের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

বড় মামি আম্মুর হাতে একটা শেরওয়ানি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নিরবকে পড়ে আসতে বলো।
আম্মু আমাকে শেরওয়ানিটা দিয়ে বললো, এখন ঝটপট এটা পড়ে আয়। এই ক'টা দিন অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোকে। আরে বোকা বিয়েটা তোর সাথেই হচ্ছিলো। তোর মামা, মামি, আমি আর আনিকা যুক্তি করেই এই ক'দিন তোর সাথে এই অভিনয়টা করলাম। দেখলি না মার্কেটে গিয়ে তোর টাকাতে কেনাকাটা করলাম?
আমার চোখের সামনে সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এ জল যে সুখের জল। আনিকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি দ্রুত শেরওয়ানিটা নিয়ে রুমে এলাম। রাতে আনিকার খবর আছে। আমাকে কষ্ট দেওয়ার সাধটা মিটিয়ে দেবো।

সেই রাতেই আনিকাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়িতে এসে দেখি আমাদের বাড়িটাও সাজানো হয়ে গিয়েছে। সোহান, সাকিব, রুহান সবাই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই আমাকে আমার নিজের বাড়িতে স্বাগতম জানালো। আর বললো, বেটা তোর বিয়ে আর তুই কিনা আমাদের দাওয়াত দিলি না। তবুও দেখ বিনা দাওয়াতেই কেমন চলে এলাম!

রাত একটা বাজে। আমি আর আনিকা বাসর ঘরে বসে আছি। সে হাসছে। তার হাসি যেন থামছেই না। আমি বললাম, হাসছো কেন?
সে বললো, আমি সরি শ্রাবণ। দেখো, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু কী করবো বলো? ফুফু আমাকে এই অভিনয়টা করতে বললো।
- সরি বলছো। আবার হাসছো। এটা কী ধরনের সরি?
সে হাসতে হাসতেই বললো, জানি না। তবে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।
- কেন?
- জানি না।
- তাহলে জানোটা কী?
- তাও জানি না।
- ঐ ছবিটা কার ছিল?
- জানি না। ফুফু ছবিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল যদি তুমি কখনো ছেলের ছবি দেখতে চাও। তবে যেন তোমাকে ঐ ছবিটা দেখাই।
আমি চুপ করে আছি। আমার ভেতরে সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার সুখ।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আনিকা বললো, এখন দেখো আমাকে। যত খুশি মন ভরে দেখো। আর এই দেখো শাড়ির কুচিটা ইচ্ছে করেই এমন করে পড়েছি। নাও, ঠিক করে দাও।
- ওটা আর ঠিক করতে হবে না।
- কেন?
- আচ্ছা তুমি এমন কেন বলো তো?
- কেমন?
- এইযে এত সুন্দর!
সে হেসে বললো, আজও কি আমার টোল পড়া জায়গাতে চুমু খাবে? নাকি ঠোঁটে?
- এই দাঁড়াও, একটু দাঁড়াও। নাঈম ভাইকে কল করে নেই।
- নাঈম ভাই কে?
- আমার রুমমেট। তিনি বলেছিলেন, শ্রাবণ তুমি একদম চিন্তা করো না। বিয়েটা তোমার সাথেই হবে।

লেখক: Srabon Ahmed
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url