গল্পঃ স্মৃতির নীল ডায়েরী

"বাবা , বাবা ওঠ । রেডি হবে না ? তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো । ওঠ বাবা । দেরি হলে কিন্তু তোমার মিস তোমাকে খুব বকবে ।" অনিক চোখ খুলে তাকায় । তার ৫ বছরের ছেলে আবীর এখনো বলে চলেছে -"ওঠ বাবা । তোমার মিস কিন্তু খুব বকা দিবে তোমাকে ।" ঘুম জড়ানো কন্ঠে অনিক বলে -"কি ব্যাপার আবীর , আজ এত সকালে ওঠে গেছ ! তোমাকে কে বলল যে আমার মিস আমাকে বকবে ?" "তুমি তো প্রতিদিন সকালে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বল আমার স্কুলে যেতে দেরি হলে আমাকে মিস বকবে । তাহলে তোমার অফিসে যেতে দেরি হলে তোমার মিস তোমাকে বকবে না ?" একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় অনিক । খুব দুষ্ট হয়েছে ছেলেটা । "যাও ,ব্রাশ করতে যাও । আমি তোমার টিফিন আর ব্রেকফাস্ট রেডি করছি ।" বলেই আবীরকে বাথরুমে দিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় সে ।
আজ অনেক কাজ অনিকের । বুয়া বলে গেছে ২ দিন আসবে না । এই ২ দিন যে কিভাবে সবদিক সামলাবে এটাই সে চিন্তা করে পাচ্ছে না । ৮ টায় আবীরের স্কুল । তাকে স্কুলে পাঠিয়ে অফিসে যাবে অনিক । তিনটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে ১টা টিফিন বক্সে ভরে দেয় । সাথে একটা কলা । যদিও সে ভাল করেই জানে এই কলা আবার টিফিন বক্সে করেই ফিরে আসবে । একদম খেতে চায়না ছেলেটা । ইমা থাকলে হয়ত ছেলেটাকে সামলাতে পারত । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিক ।

"বাবা , তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি ।" - বলতে বলতে রান্নাঘরে ছুটে আসে আবীর । তার হাতে একটা নীল রঙের ডায়েরী । ডায়েরীটা পরিচিত মনে হয় অনিকের । হঠাত্‍ মনে পড়ে ২ বছর আগে এই ডায়রীটাই অনিক দেখেছিল ইমার হাতে । কিন্তু ইমা অনিককে দেখতে দেয়নি । "এটা কোথায় পেলে বাবা ?" আবীরকে জিজ্ঞেস করে সে । "আলমারীতে যেখানে আমার খেলনাগুলো থাকে , তার পিছনে পেয়েছি । এটা তুমি নিয়ে নাও । আমি এটা দিয়ে খেলব না ।" বলেই দৌড়ে চলে গেল সে । ডায়রীটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনিক । তারপর অফিসের ব্যাগে রেখে দেয় ।

আবীরকে স্কুলে পৌঁছিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যায় অনিক । কেন জানি খুব অস্থির লাগছে তার । কোন কাজে মন বসাতে পারছে না । আজ ইমার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে ।হঠাত্‍ ডায়েরীটার কথা মনে পড়ল অনিকের । ব্যাগ থেকে বের করে পাতা উল্টায় সে । সেই অতিপরিচিত হাতের লেখা। পড়তে শুরু করে অনিক -

15.10.2005
মার শরীরটা আরো খারাপ হয়ে গেছে । বাবা চলে যাওয়ার পর সেই যে মা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল , এখনো ভাল হয় নি । ডাক্তারও ঠিক করে কিছু বলতে পারছে না । কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না । হাতে তেমন টাকাও নেই যে একজন ভাল ডাক্তার দেখাব ।

20.10.2005
আজকে অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটেছে । আমার এক কলিগের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলাম মার কিছু ওষুধ কেনার জন্য ।বাসায় ফেরার পথে হঠাত্‍ এক ছিনতাইকারী আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল । গলির ভেতরে তেমন মানুষও ছিল না । আমি চিত্‍কার করছি । কয়েকজন দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল । হঠাত্‍ একটা ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল -
"কি ব্যাপার , এভাবে রাস্তায় চিত্‍কার করছেন কেন ? আমি তো কোন ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছি না এখানে ।"

-মানে ?

-না , মানে যেভাবে চিত্‍কার করছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি কোন সিনেমার শুট্যিং করছেন । কিন্তু কোন ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছি না তো , তাই বলছিলাম আরকি...

-আমার ব্যাগটা ছিনতাই হয়ে গেছে , আর আপনি এখানে মজা করছেন ?

-ওহ্ সরি । তা আপনার চিত্‍কার শুনে ছিনতাইকারী ব্যাগ দিয়ে গেল ?

-আজব তো । পাগল নাকি আপনি ?

-আমার তো তাই মনে হয় । আসলে আমি বলতে চাচ্ছি যে চিত্‍কার করে কোন লাভ নেই ।এই গলিতে এমন কোন মহত্‍ মানুষ নেই যে আপনাকে আপনার ব্যাগটা ফিরিয়ে এনে দেবে । তবে সিনেমা হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত । দেখা যেত নায়িকার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে , আর নায়ক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ছিনতাইকারীকে দৌড়ে হারিয়েনায়িকার ব্যাগ উদ্ধার করে এনেছে । হা.... হা.... হা....

-ওই ব্যাগে আমার মায়ের ওষুধ কেনার টাকা ছিল । আমি আমার কলিগের কাছ থেকে ধার করে এনেছিলাম । আর আপনি কিনা সিনেমার গল্প শোনাচ্ছেন আমাকে !

একথা বলেই আমি হাঁটতে শুরু করলাম । রাগে দুঃখে কাদঁতে ইচ্ছে করছিল । পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম -

"এই যে শুনছেন , আই এম সরি । আমি বুঝতে পারিনি । একটু দাঁড়ান প্লিজ ।"

উনি দৌঁড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন । তারপর বললেন
-আমি কি আপনাকে হেল্প করতে পারি ?

-নো , থ্যাংকস ।

-আরে একটু দাঁড়ান তো....

-আপনি আমার সাথে সাথে হাঁটছেন কেন ?

-আমার মনে হয় ওষুধের প্রেসক্রিপশনটাও আপনার ব্যাগে ছিল । তাই না ?

-হুম

-আমার একজন ফ্রেন্ড আছে ,খুব ভাল ডাক্তার । আপনি চাইলে আপনার মাকে নিয়ে তার কাছে যেতে পারেন । আমিও সাথে যাব ।

-কিন্তু আপনি আমার জন্য এত কিছু কেন করবেন ?

-নেক্সট দুই দিন আমার অফিস বন্ধ তো । তাই যদি আপনাকে হেল্প করি তাহলে আপনিও উপকৃত হবেন , আর আমাকেও বাসায় বসে বসে বোর হতে হবে না ।

-বড় অদ্ভূত মানুষ তো আপনি !
-হয়তবা । এই নিন আমার কার্ড । কালকে আমাকে একটা কল করবেন । আমি সব বলে দেব । ওকে , দেন সি ইউ এগেইন । বাই ।

একথা বলেই লোকটা হনহন করে হেঁটে চলে গেল । কি অদ্ভূত মানুষ রে বাবা ! সত্যিই , পৃথিবীতে কত রকমের মানুষই না আছে ! কার্ডের দিকে তাকালাম । সেখানে নাম লেখা -"Anik Ahmed"

22.10.2005
মার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল । শ্বাসকষ্টটাও খুব বেড়ে গিয়েছিল । ডাক্তারকে ফোন দিয়ে দেখি মোবাইল বন্ধ । কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । মাথা কাজ করছিল না । শেষে কিছু বুঝতে না পেরে ওই অদ্ভূত মানুষটাকেই ফোন দিলাম । বাসার ঠিকানা বললাম । উনি এসেমাকে হসপিটাল নিয়ে গেলেন । সেখানে উনার বন্ধুকে দেখানোর পর বললেন যে মাকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে । আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই মাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দিলেন অনিক ।

25.10.2005
মার অপারেশন করাতে হবে । কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না । যা যা করা দরকার সব অনিকই করছে । লোকটা একটু বেশিই ভাল ।

02.12.2005
এই একমাসে আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেছে । মার অপারেশন এর পর মাকে বাচাঁনো যায় নি । মা চলে যাওয়ার পর পুরোপুরি একা হয়ে গিয়েছিলাম । বাঁচার ইচ্ছাটাই হারিয়ে গিয়েছিল । এর ২ দিন পর হঠাত্‍ অনিক ফোন করে , দেখা করতে বলে । দেখা করতে যাই । দেখা হওয়ার পর ওর প্রথম কথাটা ছিল-

-আমি কি বিয়ের জন্য খুবই অযোগ্য ?

-মানে ?

-মানে তুমি আমাকে বিয়ে করবে ?

সেদিন থেকে আজ । অনিক আমাকে নতুন করে বাচঁতে শিখিয়েছে । নতুন জীবন দিয়েছে । আজ আমাদের বিয়ের ১ মাস পূর্ণ হল । আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী । মনে হচ্ছে এ পৃথিবীতে আমার মত সুখী আর কেউ নেই ।

05.04.2006
আমি কি স্বপ্ন দেখছি ? কেন জানি মনে হয় এটা বাস্তব হতে পারে না । বাস্তব এত সুখের হতে পারে না । আমি মা হতে চলেছি । আমি জানি আমার একটা সুন্দর ছেলে হবে । তার নাম রাখব আবীর ।

07.02.2007
খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছি । দুইজনকে সামলাতে সামলাতে আমার সময় চলে যায় । যেমন ছেলে , তেমন বাবা । অনিকটা একটা পাগল । অফিসেও এখন তাকে জোর করে পাঠাতে হয় । আর অফিস থেকে প্রতিদিন অন্তত ৬-৭ বার ফোন করে জিজ্ঞেস করে আবীর কি করছে । ছেলেটাও বাবার মত হবে । সারাদিন কান্না করে আর বাবার কোলে উঠেই চুপ । কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এমন সুখের দিন আসবে ।

19.09.2007
কয়েকদিন ধরে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে । কেন জানি খুব দুর্বল লাগে । জ্বর আর সাথে মাথাব্যাথাও আছে । প্যারাসিটামল খেয়েও কোন কাজ হচ্ছে না । অনিককে কিছু বলিনি । কিন্তু ও বুঝে গেছে । ওর কাছ থেকে কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারি না ।

23.09.2007
শরীরটা এখনো ভাল হয় নি । জ্বর আমার পিছু ছাড়ছে না । কিছু খেতেও পারছি না । প্রায়ই রাতে প্রচুর ঘামি । অনিক আজকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল । ডাক্তার CBC না কি যেন একটা টেস্ট করাতে বললেন ।

26.09.2007
টেস্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তারকে খুব চিন্তিত মনে হল । তিনি তেমন কিছু বললেন না । কিছু ওষুধ দিলেন । অনিককে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিছু কথাও বললেন । আসার সময় অনিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম ডাক্তার কি বলেছে । ও বলল - তেমন কিছু না । রেস্ট নিতে বলেছে । কিন্তু এই প্রথম অনিকের কথা বলার ভঙ্গিমা আমার অচেনা লাগল । আমি কিছু বললাম না । কেন জানি হঠাত্‍ খুব ভয় লাগল । ও কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে ?

30.09.2007
সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে । অনিকটা কেমন যেন হয়ে গেছে । অফিস টাইমের অনেক আগেই বাসা থেকে বের হয়ে যায় । খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মত করে না । আমার শরীরও খুব খারাপ । ইদানিং একদম খেতে পারছি না । কেন জানি মাঝে মাঝে খুব ভয় লাগে ।রাতে ঘুমাতে পারি না ।

05.10.2007
আমার কোন একটা কঠিন অসুখ হয়েছে বুঝতে পারছিলাম । কিন্তু কি হয়েছে তা বুঝতে পারছিলাম না । আজকে অনিক অফিসে যাওয়ারপর সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে আমার টেস্টের রিপোর্টটা খুজেঁছি । তুমি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারনি অনিক । আমি রিপোর্টটা পেয়ে গেছি । কি ভেবেছিলে তুমি ? তুমি একা একা কষ্ট পাবে ? আমাকে কিছুই বুঝতে দেবে না ? আমার সামনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারনা বলে আমার কাছ থেকে এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছ তুমি , তাই না ? হেরে গেছ তুমি অনিক । আমি সত্যটা জেনে গেছি । আমার লিউকেমিয়া হয়েছে । যাকে বলে ব্লাড ক্যান্সার । এ মরণব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেধেঁছে । এটা জানার পর কেমন যেনপাথরের মত হয়ে গেছি । এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে একটুও কষ্ট হবে না আমার । কিন্তু তোমাকে আর আবীরকে ছেড়ে কিভাবে চলে যাব আমি ? আচ্ছা , আর কতদিন আমি তোমাদের সাথে থাকতে পারব ? ছয় মাস ? দুই মাস ? এক মাস ? নাকি আরো কম ? কি স্বার্থপর আমি , শুধু নিজের কথা ভাবছি । তুমি কিভাবে থাকবে আমাকে ছাড়া ?

কিন্তু তোমাকে পারতে হবে অনিক । আবীর না থাকলে হয়ত তোমাকে কিছু বলতাম না । কিন্তু এখন তো তোমাকে শক্ত হতেই হবে ।আমি চলে যাওয়ার পর তুমি হবে ওর সব । ওকে কোনদিন কষ্ট পেতে দিও না । জানি তোমার খুব কষ্ট হবে । কিন্তু তবুও যে তোমায় পারতে হবে । আমি জানি তুমি পারবে । কারণ , তোমার কাছে আমার সবচেয়ে বড় স্মৃতি হল আবীর । আমার কথা মনে হলে ওর দিকে তাকিও । দেখো , তোমার সব কষ্ট চলে যাবে ।

হয়ত আর বেশিদিন তোমার সাথে থাকতে পারবনা । কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর কখনো নিজেকে একা ভেবো না । আমি সবসময় তোমার সাথে আছি , তোমার সাথেই থাকব ।

ডায়েরীটা বন্ধ করে ফেলে অনিক । চোখের জলে শার্টের একাংশ ভিজে গেছে । মনের গভীরের বিশাল শূণ্যতাটা আবার অনুভব করে সে । সত্যিই সে পেরেছে । ইমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা তার কাছে অসম্ভব ছিল । অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সে । কারণ সে জানে , ইমা তার সাথেই আছে , সবসময় তার সাথেই থাকবে । মনের ভেতর থেকে সেই প্রিয় কন্ঠ শুনতে পায় অনিক -

"আমি আছি অনিক , আমি তোমার সাথেই আছি , তোমার সাথেই থাকব ।"

সাবস্ক্রাইব করুন:

By- অনিন্দিতা অনুশ্রী
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url