গল্পঃ সুন্দর, অসুন্দর ও একটি অদেখা ভালোবাসা....

রেহানের বিয়েতে হেব্বি মজা করলো ওর বন্ধুরা।
এত এত শালি ওর। কেউ কারো চেয়ে কম না।
অবশ্য হবার ও কথা, রিনি ভাবিও কম যান না।
রেহানের বিয়ের পর ওরা বর-বউ কোথাও ঘুরতে গেলে একা যেতো না। রিনি ফোন করে ইনভাইট করে বোন আর কাজিনদের, আর রেহানের বন্ধুরাও দল বেধে হাজির।
বেশ মজা হয়। একসাথে ঘুরে বেড়ানো, কথায় কথায় ঝগড়া বেধে যাওয়া।
আর আড় চোখে চাওয়া।

এভাবে ২/৩ বার বেড়াতে যাওয়ার পর ই এদের মধ্য থেকে ৪ টা কাপল হয়ে গেল।
ফেবুতে তুমুল ভাবে নতুন নতুন এড আর রিলেশানশিপ স্ট্যাটাস চেইন্জের নোটিফিকেশন এ ভরে যাচ্ছিল আবিদের ফেবু ওয়াল।
মনটা খুব খারাপ লাগছে। তনুর জন্য।
মেয়েটা এ গভীর ভাবে তাকায়, আর প্রতিবারই আবিদ বাধ্য হয় চোখ সরিয়ে নিতে।এত সুন্দর হয় কিভাবে মানুষ??? চোখ জলে যায়।
চোখ না সরিয়ে নিলে, কবেই ডুবে যেত। পুড়ে যেত সেই আগুনে।
কিন্তু, মেয়েটা আবিদের ভালোবাসাটা ধরতে পারে না।
সবচেয়ে বেশি রূপসি হওয়ায়, কনফিডেন্স টা অনেক বেশি ছিল। ভেবেছিল সবাই তনুকেই প্রোপোজ করবে। কিন্তু, কেউ ওর ভাব দেখে সাহসই করে নি।
তনুর কাছে আবিদ ছেলেটাকে বোকা বোকা লাগে। সবাই মিলে দুষ্টুমি করে কথা বলছে আর হা হা করে হাসছে। আর সে কিনা, মুচকি হাসি দিয়েই চুপ।
এত লাজুক ভাব যেন সদ্য বিবাহিত কনে।

প্রথম প্রথম খুব বিরক্তিকর মনে হয়েছে ছেলেটাকে। কিন্তু, ঐদিন কাপ্তাইর ট্যুরে যখন তনু পানিতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন কই থেকে যেন ছুটে আসলো।
মনে যে মায়া দরদ আছে বুঝা যায়।
তনু ওর কাজিনের নতুন বয়ফ্রেন্ড মানে, আবিদের বন্ধুর কাছ থেকে আবিদের নাম্বার চাইলো।
পেয়েও গেলো।
আবিদ তখন বসে বসে ৮ম বারের মত রেহান-রিনির বিয়ের ছবি গুলো দেখছিল। তনু কে ছবি গুলোতে খঁজে বেড়ায়। ফাকে ফোকরে।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।
-আবিদ??
--জি। কে বলছেন?
-তোমার গার্ল ফ্রেন্ড।
--মানে??
- প্রেম করবে?
--নাহ্।
-কেনো?
--একজনকে পছন্দ করি।
-তো? ভালো তো বাসো না।
-- একই কথা।
-যাকে ভালোবাসো তার কোন দিকটার কারনে ওকে ভালোবাসো তুমি?
--ও সুন্দর। ওর চোখগুলো খুব টানে আমাকে।
- কিন্তু, ওর মনটা কি সুন্দর?
--জানি না।
-সে তোমাকে পছন্দ করে?
--জানি না।
-তো??? আচ্ছা শোনো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে ভালোবাসবে?
--কেনো? আমি তো চিনিই না আপনাকে।
-চিনে নেবে আস্তে আস্তে। আমি দেখতে সুন্দর না হলেও আমার মনটা খারাপ না।

সাবস্ক্রাইব করুন:

এভাবে তনুর সাথে আবিদের প্রথম কথা হলো। অপরিচিত একটা মায়াবি মেয়ে হিসেবে।
আবিদ প্রথম দিকে এই অপরিচিত মেয়েটাকে এভোয়েড করলেও, ৭/৮ বার ফোনালাপে মেয়েটার কথায় আকৃষ্ট হতে লাগলো।
আবিদ আর তনুর প্রেম চলতে থাকলো।
তনু আবিদকে শুরুতেই কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়,
★কখনো ওরা দেখা করবে না।
★কখনো ওর নাম বা অন্য কিছু জানতে চাইবে না।
★সম্পর্কটাকে ধরে রাখতে, দুজনি নিজ নিজ জায়গায় স্টাবলিশ হবে।
★পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হবে।
এবং...........আরো অনেক কিছু।

এত শর্ত মনেই থাকতো না আবিদের। প্রায়ই দেখা করতে বলতো।
তনু খুব মেপে মেপে কথা বলতো যেন সম্পর্কটা কে একেবারে বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারে।
এভাবে ওদের ৭ বছর প্রেম।
ওদের সাথে ৪ কাপলের সম্পর্কের অপমৃত্যু ঘটেছে কবেই।
আর আবিদ ও তনুকে একেবারে ভুলে গেছে।
তবে, অপরিচিত যে মেয়েটা তার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছে, যাকে সে ভালোবাসে, যার নামটাও সে জানে না, নিজের দেয়া সুস্মিতা নামটাই যার একমাত্র পরিচয়, সে মেয়েটার চেহারা আবিদের কল্পনায় খানিকটা তনুর সাথে মিলে যায়।
ফোনে তনুর খিল খিল হাসিটার জন্যই আবিদ ওকে সুস্মিতা ডাকে।

আবিদ এম বি এ শেষে ভালো চাকরি পেলো. তনু ও প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলো।
এবার ওদের বিয়ের পালা।

তনুই দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনা করিয়ে দেয়া, বিয়ের আয়োজন সব করলো। আবিদের অফিস থেকে কাজের প্রেসার থাকায় কিছুই করতে পারে নি। তাই, তনুর বেশ সুবিধা ই হয়েছিল।
দেখতে দেখতে, সময় এগিয়ে এলো, দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে।
আজ আবিদের হলুদ, গতকাল সুস্মিতার ছিল।
অনেক চেষ্টা করেও, ওর কোনো ছবি দেখতে পারে নি।
কেমন হবে দেখতে ও???

নানা জল্পনা কল্পনার পর বিয়ের সময় এসে গেলো।
দুপুরেই আক্দ সম্পন্ন হয়ে গেলো, রাতে অনুষ্ঠান।
রাতে যথাসময়ে বর হাজির। নিজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে আছে জোকারের মত। ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হতেই বন্ধুরা ওয়াশরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
জামাই মানুষ, একা একা ওয়াশরুমে যাওয়া খারাপ দেখায়।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই, পাশের লেডিসরুমে কিসে যেন চোখ আটকে গেলো আবিদের। আরে তনু?!!
তনু বসে আছে?? ও দাওয়াত পেলো কিভাবে?? যে সাজ দিয়েছে, মনে হয় কোনো পয়সাওয়ালার সাথে বিয়ে হয়েছে।
তবে এখনো তেমন সুন্দরই আছে।
তনুর চোখে পড়ার আগেই আবিদ কেটে পড়ল এখান থেকে।
আবিদ স্টেজে জোকারের মত হাসি হাসি চেহারা নিয়ে বসে আছে।
কিন্তু, মনে টর্নেডো হচ্ছে। তনুর সেই আগের চেহারা, হাসি, চাহনি সব মনে পড়ছে।

অদেখা সেই সুস্মিতা যেন তার কাছে মলিন হয়ে গেছে। কিছুটা অসুন্দর একজন না দেখা সুস্মিতাকে আর দেখতেও ইচ্ছে করছে না।
তনু!! উফ্,তনু!!
তনু কে না পাক, তবে অজানা সুস্মিতাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না আবিদ। কখনো না।
সাত পাঁচ না ভেবে মা কে ডেকে সব হড়বড় করে বলে ফেলে। আবিদ মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বলতে চায়।
মেয়েটা লেডিসরুমে বসা। পেছনদিক টা দেখা যাচ্ছে। মাথায় ওড়না দেয়া। তাই চেহারার কিছুই বোঝা ঝাচ্ছে না। যাক্, অত কিছু চিন্তার সময় নেই!!
--সুস্মিতা?
-হা, আবিদ, বলো কি বলবে?এত তাড়া কেনো তোমার? আর কিছুক্ষন পরই তো দেখা হচ্ছে আমাদের।
-- দেখো, আমি কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
-বলো।
-- দেখো। তোমার সাথে আমার প্রথম যেদিন কথা হলো সেদিন আমার ভালো লাগা মেয়েটার কথা বলেছিলাম তোমাকে। মনে আছে?
-হুম। আছে। তো?
--আসলে ওকে ভুলতে পারিনি। মানে সাময়িক ভাবে ভুলে গেলেও, মন থেকে সরাতে পারি নি।
সুস্মিতা, শুনছো??
-হুমমমম।
--আসলে তোমাকে আপন করে নিতে পারবো না আমি। সরি।
-কিন্তু, আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এসব তো আগে বল্লে ও পারতে!আমাদের ৭ বছরের সসম্পর্কে কখনো বলো নি??!
--আগে বুঝতে পারি নি। আর বিয়ে মানে, কেবল সাইন আর কবুলই তো, ওভাবেই শেষ হয়ে যাবে। প্লিজ,ভুলে যেও অদেখা মানুষটার ভালোবাসা।
-ঠিক আছে।

আবিদ বুঝতে পারে মেয়েটা ফুপিয়ে কাঁদছে।
বেরিয়ে আসছে আবিদ, এমন সময় পেছন থেকে ডাকলো সুস্মিতা।
পেছন ফিরতেই যেনো কারেন্টের শক খেল আবিদ।
--তনু!!
-হুমম। তোমার সুস্মিতা। যার হাসি তোমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শব্দ। যার ভালোবাসা ছাড়া তুমি অপূর্ন।।যে অদেখা মেয়েটা তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছিলো।
আবিদ তোমাকে আমি আমার মত করে গুছিয়েছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে এত গুলো বছর কষ্ট করেছি।

রুপের কাছে আমার সব পরিশ্রম মাটি হয়ে গেলো!??
-কিন্তু, তনু শোনো...
--না আবিদ, নিজের সৌন্দর্য এখন আমার নিজের ই কাল হয়ে দাঁড়ালো।
আবিদ ভালো থেকো। তোমাকে এমন ভাবি নি। কিন্তু, ভুল ছিলাম আমি। ভুল।
আবিদের কথা আর শুনলো না তনু।নিজেকে এতদিন পারফেক্ট মেয়ে মনে হতো, এখন মনে হয়, লুযার।
হেরে গেছে নিজের কাছে নিজেই।

এরপর তনু অস্ট্রেলিয়ায় পি এইচ ডি করতে গেছে। ওখানেই সেটেল হবে। কখনো ফিরবে না আর এখানে। সব স্বপ্নই ভেঙ্গে গেছে ওর।
আবিদ তার প্রথম বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পরের মাসেই এক রুপসিকে বিয়ে করেছে।
তনুকে আবারও ভুলে গেছে সে।
সুস্মিতার হাসি আর তার কানে বাজে না।

সাবস্ক্রাইব করুন:

লিখেছেন Tahmina Mahveen

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url