সেদিন দুজনে

২৭শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৬ - দিনটি আজও স্মৃতির পাতায় কড়া নারে, আমি আজও ভুলতে পারি না ।চোখের পলক আজও পরতে দেই না, ঐ স্মৃতিগুলো ভুলতে দেই না, আজও এ হৃদয়ে ধারণ করে আছি সেই স্পর্শকাতর মূহুর্তগুলো- যা ভুললেও যায় না ভুলা, শত-সহস্র বার চেষ্টা করেছি মুছে ফেলতে কিন্তু পারিনি ।

তুমি আজ অনেক দূরে। জানি, আমার এই কথাগুলোর আজ তোমার কাছে কোন মূল্য নেই ।তাও বলতে চাই, আমি আজও সেই ক্ষণে বাঁচার চেষ্টা করি, হারিয়ে যাই যেন সেই স্বপ্নলোকে ।না গো সেই স্মৃতি-চারণায় তোমায় হারানোর কষ্ট আমি একদম বোধ করি না, আমি নতুন এক উল্লাস, এক অপরিমেয় সুখ খুঁজে পাই আজও, ভিন্ন এক আনন্দ খুঁজে পাই ।তাই হারাতে দেই না, আজও যত্ন করে রেখেছি ।

তোমার মনে আছে দিনটার কথা ? সেদিন আকাশ জুড়ে মেঘ ছিল, দখিনা হাওয়া বইছিল সর্বএ,কতোই রোমান্ঞ্চকরই না ছিল আবহাওয়া টা ।আমি ঐ নদীতীরের কদম গাছটার তলায় বসে তোমার অপেক্ষা করছিলাম ।প্রকৃতির কতোই না রূপ, আমি তখন পর্যবেক্ষণ করি ।মেঘে পূর্ণ আকাশ টাতে যেন কেউ গর্ত করে দিয়ছিল, আর সেই গর্ত থেকে এক পসলা ঝলকানি আলো বিচ্ছুরন হচ্ছিল, এমন সৌন্দর্য্য যা কখনোই দেখিতে পাইনি, নদী-তীরবর্তী সেই পরিচিত মাঝি তার বধূকে নিয়ে জীবন যাত্রার ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল ।কতো শত পাখি জোড়ায় জোড়ায় উড়ে যাচ্ছিল গগন ঘেষে, ঘাসফড়িং গুলোও জোড়া বেঁধে যেন একে অপরে ঘাসফুল গুলোতে মিশে যাচ্ছিল ।কি বলব গো, আমি সেই মূহুর্তের প্রতিটা দৃশ্যে, প্রতিটা চিত্রে তোমায় অনুভব করতে থাকি।তুমি কেন এত দেরি করছ ? তুমি কি আসবে না ? যেন খুব একা হয়ে গিয়ছিলাম প্রকৃতির এই লীলা নিকতনে ।

শহুরে পরিবেশের বাহিরের সেই নদীতীরটি এখনও কি মনে আছে তোমার ? সেইদিন কতোই নাদিবা স্বপ্নের ভেলায় ভেসে গিয়েছিলাম, নদীর কলতান,পালতোলা নৌকার সুদূরে গিয়েসেই ভ্রমণের পথে হারিয়ে যাওয়া,ওপারের সবুজ সীমা,সেই পরিবেশের অপরূপ আভা-গন্ধ-জড়াজীর্ণতা কিছুই আজও ভুলতে পারি নি ।

আমার আর তর সইছিল না, তোমাকে কাছে পাওয়ার এক অকুল আবদেন খেলা করছিল মনে। হঠাত্‍ তোমার নূপুরের সেই রুনুঝুন শব্দ কানে এসে বাজল, মগজটা ঘুরানোর আগেই তোমার হাতদুটোয় চোখদুটো দিবা-নিদ্রাদেবীর দরজায় যেন কড়া নাড়ল ।তোমার সেই স্পর্শ আজও অনুভব করি ।

তোমার মনে আছে তুমি বলেছিলে চোখটা বন্ধ রাখতে, তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে তুমি সামনে এসে দাড়ালে ।তোমার কথামতো চোখেরপলক খুলতেই আমি স্তব্দ বনে যাই, নীল শাড়িতে অনন্যময়ী অনন্যা রূপে তোমায় দেখে, আরও বেশি ভালবেসে ফেলি তোমাকে ।তোমার মনে আছে আমি কবিতার পংতিতে বলেছিলাম,
'নয়নাভিরাম অপরূপা হে পরমা
নওকি কোন কারিগরের তৈরি প্রতিমা
অশ্রু-মতিময় চোখের ঐ কাজল মায়া
চুলগুলো যেন ভোরবেলার সেই শিশির রাঙা ।
রূপে হয়েছি ভাবলেশহীন আনমনা
এ যেন স্বপ্ন নয় সত্যি
তুমি সেই স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ' ।
- তুমি অপলক দূষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে, মুগ্ধ বদনে পাশে এসে বসেছিলে,হাতে হাত রেখেছিলে, আমার কাধে মাথা রেখেছিলে, হারিয়েগিয়েছিলাম দুজন এই পৃথিবীর অদ্ভূত মায়াতে, এটাই হয়তো ছিল আমাদের বন্ধন, আমাদের ভালবাসার বন্ধন ।

তোমার কি মনে আছে ঐ দিন বৃষ্টি হয়েছিল, মায়াবী তোমার ঐ রূপের সাক্ষাত পাই তখন ।তোমার নূপুরের রুনুঝুন ধ্বনিতে, হাতের চুড়ির ছন ছন শব্দে তুমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলে ।মনেতে ভাবছিলাম, 'হে নারী কতোই না রূপ তোমার, আমি তোমাতে মুগ্ধ' ।এরপর আমার হাত ধরে আমাকেও সঙ্গী করলে ।মনে আছে তুমি ঐ চিএ দেখিয়েছিলে, 'বরষার ছোয়ায় ঐ কদম গাছটা যেন এক নব্য রূপে, গন্ধে -প্রাচুর্যে- ফুলের সমাগমে এক বিচিত্র সৌন্দর্য্যে মূর্তিময় হয়েছিল, পুরো সবুজ শ্যামলিমাছিল প্রাণবন্ত, নদীর এ কুল ও কুল বৃষ্টির জলের থমথম শব্দে মুখরিত ছিল, অপারের সুবজ খেত, মাঠ, পাহাড় সবই যেন এই বিচিএ লীলার অপেক্ষায় ছিল'- হ্যা গো তুমি এও বলেছিলে, 'সবই যেন তোমার স্বপ্নে দেখা সেই স্বপ্ন লোক ।' হ্যা, তুমি সত্যি বলেছিলে এটা যেন এক বাস্তব স্বপ্নলোক ছিল, আর তুমি ছিলে তার স্বপ্ন পরী । উফ ! তোমার সেই ভুবন রাঙানো হাসি, তোমার সেই চান্ঞ্চল্যপণা, তোমার খোলা সেই ভিজা চুল, বৃষ্টির প্রতিটা ফোটার পরশে পেয়ে তোমার ঐ মায়াবী চেহারা- আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, দেখতে থাকি তোমাকে, আরও হারিয়ে ফেলি নিজেকে ।আজও পারিনি সেই মূহুর্ত কে ভুলতে ।

তোমার কি মনে আছে তুমি মিষ্টি গলায় রবি ঠাকুরের সেই গানটি ধরেছিল,
'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলোডরে বাঁধা ঝুলনা
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে,
ফুলোডরে বাঁধা ঝুলনা ।
সেই স্মৃতিটুকু কভু ক্ষণে ক্ষণে যেন জাগে মনে
ভুলোনা ভুলোনা ভুলোনা ।'
চোখ বন্ধ করে একে অপরের হাত ধরে আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার স্পর্শ নিতে থাকি, আর তোমার গান মধুর বাণীর মতো আমার কানে বাজতে থাকে ।
'আজই হৃদয়ে ভালবেসে
লিখদিলে নাম তুমি এসে ।'
সত্যি কিশোর কুমারের গানের ঐ কথার মতো তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, এক অদ্ভুত ম্যাজিক টাচে পুরো জীবনটা যেন সুন্দর লাগতে লাগল, জীবনটাকে তোমার নাম দিয়ে বাঁচার ইচ্ছে হল । আমার পুরো পৃথিবীটাতে শুধু তুমি ছিলে, শুধু তুমি ।
ঐ দিনটাতে তোমার বলা ঐ কথাগুলো আজও ভুলতে পারি নি, 'কত্তো ভালবাসি, অনেক বেশি ভালবাসি তোমায় ।'
-ওগো তোমার কি একবারও মনে পড়ে না ? কথা বলছ না কেন ? এতোই যখন ভালবাসতে তাহলে ছেড়ে কেন চলে গেলে ?

অশ্রুভরা চোখ নিয়ে অনিন্দ এক অদ্ভূত মায়ায় তাকিয়ে থাকে জয়ীতার ছবির দিকে আর তার ডায়েরীর পৃষ্ঠাগুলো অশ্রুজলে বিন্দু বিন্দু আকারে স্থান নেয় ।জয়ীতাআজ এই পৃথিবীতে নেই ।প্রায় একবছর আগে রোড এক্সিডেন্টে জয়ীতা মারা যায় ।অনিন্দ, জয়ীতার স্বামী ।রিমঝিম, তাদের একমাত্র মেয়ে, তাদের বিয়ের দেড়বছরের মাথায় রিমঝিমের জন্ম হয় ।আড়াই বছরের মাথায় রিমঝিম তার মা কে হারায় ।কিন্তু অনিন্দ তার মেয়েকে কখনোকিছুই বুঝতেই দেয় নি,মেয়েকে খুব আদর যত্ন ও ভালবাসা দিয়ে বড় করছে ।আজ সে একানয়, এখন তার জীবন বলতে রিমঝিম।কিন্তু এখনও তার জীবনের প্রতিটি স্পর্শে, প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়ীতা রয়ে গেছে ।যখনই জয়ীতার স্মৃতি তাকে তাড়া করে তখনই অনিন্দ ডায়েরীর লেখনীর সেই লেখাগুলো পড়ে জয়ীতাকে নিয়েসেই মুহুর্তগুলোতে আবার বাঁচতে চেষ্টা করে, আবার হারিয়ে খুঁজে নিজেকে ।

সাবস্ক্রাইব করুন:

By দেবরাজ অংকন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url