গল্পঃ দ্য রিভাইভ্যাল চেইন

কয়েক সেকেন্ড পর মাটিতে পড়লো শরীরটা। মগজ বেরিয়ে এসেছে মাথার ডান পাশের প্রায় অর্ধেকটা থেতলে গিয়ে। বুকের সবকটা হার ভেঙ্গে গেছে সম্ভবত রাহার। মাথার বাম পাশটা অবশ্য এখনো আক্ষত। রাস্তাটা কোন ব্যাস্ত এলাকার না, বেশ নির্জন, লোকজন খুব একটা আসে না। তখন এলে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ দেখতে পেত রাহাকে। দেখতে পেত একটা অসহায় মেয়ের বাম চোখের কোণ টলমল করছে জলে। অশ্রুকণাটুকু কি গড়িয়ে পড়বে কপোল বেয়ে নাকি শুকিয়ে যাবে তার আগেই ?

(২)
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ব্যবহৃত হলেও রুমটা ঠিক রিমান্ড রুমের মত নয়। রিমান্ডে নেয়ার পর যে রকম রুমে নেয়ার কথা আমারা ভাবি, মানে অন্ধকার রুমের মাঝখানে ঠিক টেবিল থেকে একটু উপরে একশ অথবা দুশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে, তবে বাল্বের আলোর দ্বারা পুরো রুমের অন্ধকার দূর হয় না। পুরো রুমের কোথাও কোন ছিদ্র নেই, আলো-বাতাস ঢোকার পথ নেই, এমন একটা ছবিই ভাসে আমাদের মনে। আসলে এই ছবিটা গেঁথে গেছে আমাদের মনে বিভিন্ন মুভিতে দেখানো রিমান্ড রুমের বদৌলতে।
এই রুমটা মোটেও তেমন নয়। কৃত্তিম হলেও যথেষ্ট আলো-বাতাস রয়েছে চারপাশে, বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। পর্যাপ্ত আলোয় রুমটা অন্য আট-দশটা রুমের মত ই লাগছে।
তবে রুমের পরিবেশ সচ্ছ থাকলেও ধরে নেয়া যায়, যে কারণে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে তা খুব একটা সরল-সোজা না। কারণ এখানে রনিত হাসানের মত চৌকষ ইনভেস্টিগেশন অফিসার উপস্থিত, সাধারণ কেস গুলোতে তিনি খুব একটা হাত লাগান না, জুনিয়রদের ডিরেকশন দিয়েই কাজ সেরে নেন। তাই তার উপস্থিতি মানে ধরে নেয়া যায় খুবই জটিল ব্যাপার। তবে তার জীবনে এখন পর্যন্ত কোন ব্যার্থতা নেই, যে কেসেই হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। ধারালো মেধার জোরে অল্প বয়সেই নিজের ক্যারিয়ারে ঘটিয়েছেন অসম্ভব উন্নতি। নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়।

এই কেসের অভিযোগ হচ্ছে, আত্মহত্যা প্ররোচনা অথবা খুন ও লাশ গুম করে ফেলা। নিহতের বাবা-মায়েরই অভিযোগ।
তবে রনিত এই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি এখন পর্যন্ত। কারণ কেসটা এখনো ভালো করে স্টাডি করতে পারেনি। আজ রাতে গিয়ে বসবে ফাইলটা নিয়ে। তাই অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করেই সময় কাটাচ্ছে রনিত। বিদায় নিয়ে যখন বেরিয়ে আসবে, তখন ইকবালের ঠোঁটের কোণে একটা কেমন ভয়ংকর হাসি দেখল রনিত, অস্পষ্ট কিন্তু বুকে কাপন ধরিয়ে দেয় যেন। রনিতের হঠাতই মনে হলো, ইকবাল হয়তো সত্যিই দোষী, এবং খুনই করেছে। খুনীদের ঠোঁটেই এমন হাসি মানায়। অশুভ কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে সে। কি সেটা?!

(৩)
রাত দুটো, রনিতের বেডরুম। ব্যাচেলর ছেলেদের রুমে ঢুকলেই বোঝা যায়, একটা অগোছালো ভাব থাকে। কিন্তু রনিতের রুমে ঢুকে সেটা বোঝার উপায় নেই। বেশ সাজিয়ে গুছিয়েই রাখে। এখন অবশ্য ওর বিছানা জুড়ে কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেই কেসটা নিয়ে বসেছে রনিত। এখন পর্যন্ত যা বুঝেছে, তা হলো, নিহত অথবা নিখোঁজ নিশম শেখ কিছুদিন আগে থেকেই মানসিক কোন সমস্যায় ভুগছিলেন, যার কারণে তিনি ডাঃ ইকবাল সারোয়ারের কাছে যান। থার্ড আ্যাপোয়েন্টমেন্টের দিন নিশম সাহেব বাসায় একটা সুইসাইড নোট লিখে যান। তারপর থেকে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইকবাল সাহেব বলেছেন, নিশমের সাথে ওইদিন আ্যাপোয়েন্টমেন্ট থাকলেও তিনি ওইদিন আসেননি। আত্মহত্যা সম্পর্কে বলেন, অপরাধবোধ থেকে নিশম এটা করে থাকতে পারে, কারণ তার ভেতরে একটা তীব্র অপরাধবোধ জমেছিল। ডাঃ ইকবালের বিবৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট না রনিত। ওর ধারণ বড়-সড় একটা ঘাপলা আছে এর ভেতর। রনিতের কেবলই মনে হচ্ছিল ইকবালের বিচিত্র হাসিটার কথা। কিন্তু কি মোটিভ থাকতে পারে? অর্থসংক্রান্ত না, এটুকু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। পুরোনো শত্রুতা কিনা তা যাচাই করা হয়নি, দুজনের হিস্ট্রি নিয়েও কিছুটা পড়াশোনা করতে হবে, ভাবে রনিত।
হঠাত করেই মাথায় আসে, ইকবালের চেম্বারটা একটু খুঁজে দেখলে কেমন হয়! ইকবাল তো লকাপে, চেম্বারের চাবি পুলিশের হেফাজতে, চাইলেই পাওয়া যাবে। নাইট ড্রেসেই বেরিয়ে পড়ে রনিত। বেরুবার আগে থ্রি নট থ্রি রিভালভারটা পকেটে রাখতে ভোলে না।

(৪)
অন্ধকারে খুটখাট শব্দ করে ফাইল হাতড়ে যাচ্ছে রনিত। ইলেকট্রিসিটি নেই, তাই বাল্ব জ্বালানো হয়নি। অবশ্য থাকলেও জ্বালাতেন না মনে হয়। রনিত সব সময়্ই একটু রহস্য রাখতে পছন্দ করে। টর্চ জ্বালিয়ে কাজ চলছে। নিশমের ফাইলটা দেখেছেন থানায়। এক ইরকম বেশ অনেকগুলো হলুদ ফাইল রয়েছে টেবিলের উপর। ফাইলগুলোর উপরে পেশেন্টের নাম- ঠিকানা স্টিকার করে লাগানো আছে। ধৈর্য্য সহকারে সবগুলো নাম ঠিকানা মোবাইলের ড্রাফ্টে টুকে নিয়ে পাঠিয়ে দিল রনিতের সব ইনফরমারের কাছে, নির্দেশ দিল, এদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ নিতে, তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে। আসলে রনিত চাইছিল দেখতে, অপরাধবোধ থেকে কেউ কোন আ্যাক্সিডেন্টাল কিছু করেছে কিনা। আরো কিছুক্ষণ খোঁজা খুঁজি করার পর বেরিয়ে এল রনিত।
রনিত খেয়াল করেও দেখলো না, টেবিলের নীচে আরো একটা ফাইল, যার উপরে রনিতের নাম ও ঠিকানা লেখা!!

(৫)
ডাঃ ইকবাল সারোয়ারের চেম্বার, রাত নটা। ইকবাল সাহেবের জামিন হয়ে গেছে। আসলে কেসটায় এত কম এভিডেন্স যে আসামীকে আটকে রাখা মুশকিল। এখন পর্যন্ত কোন সূত্রই আবিষ্কার হয়নি। এই অবস্থায় কেস কোর্টে উঠলে দুদিনও টিকবে না, ক্লোজ্ড হয়ে যাবে এটা শিওর। সবাই হাল ছেড়ে দিলেও রনিত হাসানের মনে এখনো চিলতে একটা সন্দেহ ঝুলে রয়েছে। ইকবাল সারোয়ারের সেই বিচিত্র হাসিটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। রনিত নিশ্চিত, নিশমের নিখোঁজ হওয়ার সাথে ইকবাল কোন না কোন ভাবে জড়িত। কেমন অশুভ একটা গন্ধ পাচ্ছে রনিত। এছাড়া একটা ইগোর ব্যাপারও আছে। ডাঃ ইকবাল একরকম চ্যালেন্জই জানিয়েছিলেন রনিতকে, নাহলে ইকবাল নিজে থেকেই কেন কেসে টানবে তাকে। রনিত হাসান চ্যালেন্জ নিতে পছন্দ করে। এজন্যই এখনো হাল ছাড়েনি। ডাঃ ইকবালের চেম্বারে এসে বসে আছে সন্ধা থেকে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা কথা বলছে ইকবালও রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে কথার জবাব দিচ্ছে। এখন রোগী দেখা শেষ। রনিত হাসান নিজের সন্দেহটা আবার প্রকাশ করলো, 'আচ্ছা, একজনের মনে কিভাবে হঠাত করেই আপনি অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলবেন, তাও এত বেশি যে জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সুইসাইড করতে পারে?' একটা অবজ্ঞার হাসি ঝুলিয়ে রেখেছিল ঠোঁটে, তা রেখেই বললো, অবশ্যই সম্ভব, যদি সে তেমন কোন অপরাধ করে থাকে। '
'আমার ঠিক বিলিভ হচ্ছে না!' রনিতও একটা বিচিত্র হাসি হাসলো, হাসিতে হাসিতে কাটাকাটি। কথার লড়াই যতটা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে মানসিক ঠোকাঠোকি। মানসিক দৃঢ়তার প্রমাণ দিতেই যেন বসেছে এখানে।
হঠাত ডাঃ ইকবাল ঘুরে দাড়িয়ে রনিতের চোখে চোখ রেখে বললো, 'আপনি চান, আপনার অপরাধবোধ আমি জাগিয়ে তুলি? আপনারও তেমন বোধ হওয়ার মত অপরাধ রয়েছে। '
এবার অবাক হলো রনিত, তার আবার কিসের অপরাধ। তবে কৌতুহলও হলো। স্পষ্টতই ইকবাল একটা চ্যালেন্জ জানালো রনিতকে। রনিত চ্যালেন্জটা নিলো।
রনিতের হাতে একটা হলুদ ফাইল দেয়া হলো। ফাইলের উপরে রনিতের নাম-ঠিকানার ট্যাগ লাগানো দেখে বেশ অবাক হলো রনিত। ইকবাল তাহলে অনেক আগে থেকেই কাজ করছে এটা নিয়ে। কোন একটা খেলা খেলতে চাইছে ইকবাল, কী সেটা? জানতে হলে খেলায় নামা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মনের অজান্তেই হাত চলে গেল একবার ব্লেজারের ভেতরের পকেটে রাখা রিভালবারের কাছে।

(৬)
রনিতকে পাশের একটা রুমে ঢুকিয়ে দেয়া হলো, ফাইলটা পড়তে বললো ইকবাল মনোযোগ দিয়ে। কফি মেশিন আর হুইস্কির বোতল দুটোই আছে রুমে, ইচ্ছে হলে নিতে পারেন জানিয়ে বাইরের রুমে ল্যাপটপ খুলে বসলো ইকবাল।
রনিত সেদিকে একবার তাকিয়ে এক পেগ হুইস্কি ঢেলে রুমের একমাত্র চেয়ারটায় বসলো। রাত হলে একটু ড্রিংকের অভ্যাস আছে রনিতের। তাছাড়া এখন কফি খেয়ে ঘুম নষ্ট করার চেয়ে হুইস্কি ই প্রেফার করলো। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ফাইলটা খুলে পড়তে শুরু করলো। বেশ বড় ফাইকম কিন্তু দুটো পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। দুই পেগে রনিতের কখনোই নেশা হয়না। কিন্তু আজ? ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিল না, সে কি মাতাল হয়ে গেছে।
ডাঃ ইকবাল দাড়িয়ে আছে রনিতের সামনে। লোকটা সম্ভবত থট রিডিং জানে, রনিত না জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল, 'নাহ, মিঃ রনিত, এত কম ড্রিংকে নেশা হয়না, যদি না তাতে খুব অল্প পরিমাণে সায়ানাইড মেশানো থাকে, আর আপনি ড্রাংক না, এটুকু নিশ্চিত করতে পারি। এখন আপনি মৃত্যুপথযাত্রী। '
রনিতের বিষ্ফোরিত চোখের সামনে ঘৃণা মিশ্রিত হাসি হাসলো ইকবাল।
এমন সময় রুমে ঢুকলো একটা ছেলে, রনিত অবাক হয়ে দেখলো, এ সেই ছেলেটা, নিশম শেখ, যার মৃত্যুর ইনভেস্টিগেশন করতেই এখানে আসা। নিজের অজান্তেই কি মারাত্বক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে ভেবে শিউরে উঠলো শরীর। ব্লেজারের পকেটে রাখা রিভালভারের দিকে হাত বাড়াতে চাইলো রনিত, কিন্তু সে শক্তিটুকুও তার আর অবশিষ্ট নেই।
নিশন উদ্বিগ্ন চোখে ইকবালের দিকে তাকিয়ে বললো, 'কাজ হবে তো ইকবাল ভাই?' হাসল ইকবাল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, 'এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে!' হঠাত রনিতের মুখের সামনে ঝুকে ফিসফিস করে বললো, 'এত সহজেই কি সবার অপরাধবোধ জাগে? তোর মত বেঈমান জানোয়ারের বাচ্চার এত সহজে অপরাধবোধ জাগলে পৃথিবীতে এত অপরাধ রোজ ঘটতো না। পৃথিবীর অপরাধ কমাতে তাই তোদের সরিয়েই দিতে হয়!'
রনিতের পালস পরীক্ষা করে নিশমের দিকে তাকালো ইকবাল, মৃদুস্বরে বললো, 'ডান!' মাথা ঝাকালো নিশম। তারপর বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। নিশম-ইকবাল দুজনের চোখেই তখন বিষাদের ছায়া। পুরোনো স্মৃতি, অপূর্ণতা, না পাওয়াগুলো আবার খোঁচাচ্ছে তাদের।
নিজের প্যাডে খসখস করে লিখছে ইকবাল,
'রাহা,
পরের জন্মের পথে যাচ্ছি। সেখানেও কি তুমি ভুল লোকটাকেই বেছে নেবে? যে বেঈমানী করবে শেষত্বক তোমার ভালোবাসার সাথে? আশা করি, এবার তোমার আর আমার সত্যিকারের ভালোবাসা চিনতে ভুল হবে না। ''
রনিতের রিভালভারটা নিজের কপালের বাম পাশে ঠেকিয়ে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখলো ইকবাল। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় ঢপ করে ছোট্ট একটা শব্দ হলো, যে শব্দ ডাঃ ইকবাল সারোয়ারের খুলি এফোড়-ওফোড় করে দিলো মুহূর্তে, নিয়ে গেল মৃত্যুর ওপারে, পরজন্মের পথে, যেখানে ঘুমিয়ে আছে তার প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পাবার আশা।
একই আশাতেই হয়তো নিশম শেখও, নিজের দেহটাকে সপে দিলো চলন্ত ট্রেইনের নীচে।
কিন্তু তারা কেউই জানতে পারলো না, ঠিক একই আশা নিয়ে তারা পৃথিবী ছেড়েছিল পূর্বজন্মেও, একইভাবে, সেচ্ছায়। একই ঘটনাগুলো ঘটেছিল পূর্বজন্মেও। ঘটবে পরের জন্মে, যদিও তাদের আর মনে থাকবে না। চলতেই থাকবে এই চক্র। পূনর্জন্মচক্র, দ্য রিভাইভ্যাল চেইন!

সাবস্ক্রাইব করুন:

**পরবর্তী জন্মে**
(১)
একটা একটা করে সিড়ি টপকে উপরে উঠছে রাহা টলমল করা পায়ে। এখন আর ভেবে লাভ নাই। তবু ভাবনাগুলো ফিরে ফিরে আসছে বারবার। ভাবনার উপর তো আর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই যখন ইচ্ছে জেকে বসে মাথায়। এইতো আর কিছুক্ষণ, তারপরই তো ওদের অস্তিত্ব শেষ। ভাবনাগুলোকে তাই আপন রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে সস্তি দিতে চাইলো, নিজেও পেতে চাইলো। সব ভাবনার শেষ অবশ্য এক জায়গাতেই। এই সিড়িগুলো যেমন, বিভিন্ন ফ্ল্যাটে যাওয়া গেলেও শেষ ঠিকানা তো ছাদেই।
ছাদের রেলিঙের উপর দাড়ালো রাহা। শরীরটা সামান্য দুলছে। 'ইশ, এখনো যদি একবার রনিত আসতো, একটাবার মানা করতো, একটাবার!'' বিড়বিড় করে বলছিল রাহা।
নাহ, রনিত কখনোই আসবে না। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। যাকে এতটা ভালোবাসতো, সে যে তার সমস্ত অনুভূতিকে এভাবে অপমান করবে, কখনো চিন্তাও করেনি রাহা। আ্যাবোরশন করানোর পর একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল রনিত, “আমার পক্ষে রিলেশন রাখা আর পসিবল না, তুমি আসলে আমার টাইপ না, ভালো থেকো!”
এতদিনের সম্পর্ক যে এত সহজে একটা মেসেজ পাঠিয়েই ভেঙ্গে দেয়া যায়, কখনো ভাবতেও পারেনি রাহা। প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকেই বিয়েটা করে ফেলার জন্য বলছিল রাহা। ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে রাজি হচ্ছিল না রনিত। বরং আ্যাবোরশন করতে বাধ্য করেছিল। রনিতের প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহা, না হলে নিজের অনাগত সন্তানকে খুন করার মত ঘৃণ্য কাজ কী করে করতে পারলো।
তারপর অনেকবার রনিতের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছে রাহা, পারেনি। ভীষণ ধূর্ত তায় এড়িয়ে গেছে রাহাকে। রনিতের তখন একমাত্র নেশা ক্যারিয়ারে উন্নতি।
এমন না যে রাহা কোন অংশে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল। অনেক ছেলেই তার জন্য পাগল ছিল। চকিতেই দুজনের মুখ ভেসে ওঠে রাহার মনে।
একজন নিশম, স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুলের শেষভাগে পড়ার সময়ই প্রপোজ করেছিল ছেলেটা। শুধু এই কারণেই ওদের এত ভালো বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওর মত বন্ধুকে সত্যিই মিস করতো রাহা।
আর একজন ইকবাল ভাই। চার বছরের সিনিয়র। কখনো রাহাকে সরাসরি না বললেও ক্যাম্পাসের সবাই জানতো রাহাকে পছন্দ করে ইকবাল। পত্রিকায় প্রায়ই কবিতা ছাপতো ইকবাল ভাইয়ের। ইকবাল সারোয়ার নামে ছাপা কবিতাগুলোর নায়িকা যে রাহা তা পরিচিতজনরা সহজেই বুঝে যেত। দিন দিন কেমন বিষাদে ডুবে যাচ্ছিল লোকটা।
সে বিষাদের দিকে তাকানোর অবসর ছিল না রাহার। ভীষণ রকম স্মার্ট ড্যাশিং গাই রনিতের সাথে উন্মত্ত প্রেম চলছে তখন দূর্বার গতিতে। কারো বিষন্ন দৃষ্টির অর্থ খোঁজার সময় কোথায়!
আচ্ছা, নিশম কিংবা ইকবাল ভাইয়ের কারো সাথে যদি কিছু হতো রাহার, তাহলে কি ওরাও রনিতের মত ই শেষবেলায় ছেড়ে যেত, ওদের জন্যও কি সুইসাইডের ডিসিসান নিতে হতো রাহাকে, নাকি অন্যরকম হতো জীবনটা! জানা হবে না কখনো এর উত্তর!!
আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখটা বন্ধ করে রাহা। তারপর চিরশান্তির উদ্দেশ্যে শরীরটাকে ছেড়ে দিলো নিচে, রাহার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে গড়িয়ে পড়লো শরীরটা রেলিঙ থেকে…………………… কয়েক সেকেন্ড পরে মাটিতে পড়লো শরীরটা। মগজ…………

[এরপরের কাহিনী কেউ জানতে চাইলে গল্পের প্রথমে থেকে আবার পড়তে পারেন।]

সাবস্ক্রাইব করুন:
by- মারুফ মুক্তাদীর খান
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url