গল্পঃ অপরিচিত

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকায় লোকটা। আমার ঠিক সামনের সিটেই বসেছে সে। বয়স পঁচিশের এপাশে ওপাশে হবে,মধ্যবিত্ত বোঝা যায়। চেহারায় সরলতা থাকলেই পোশাকে নিতান্তই শহুরে লাগছে। মানুষের সাথে মিশার ক্ষমতা আছে,হয়ত ছা-পোষা কোন চাকরী করে। আমি যাচ্ছি ঢাকা। রাতের ট্রেন,সবেমাত্র যশোর জংশন থেকে উঠলাম। লোকটির সাথে পূর্ব পরিচয় নেই,তবু এরকম হঠাত প্রশ্ন সন্দিগ্ন করে আমাকে। চুপ করে সিটে গা এলিয়ে দেই আমি,মনটা আজ ভাল নেই। বুকের মধ্যে এক শুন্যতা অনুভব করছি কোথায়,শুধু আজকের রাতটাই আছে। তারপর সব শেষ।
-ভাই কি কিছু ভাবেন??
লোকটা আবার প্রশ্ন করে,এক ধরনের গায়ে পড়া স্বভাবের মনে হচ্ছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই আমি,
-আমাকে বলছেন?
-জ্বি ভাই,রাগ করছেন?আসেন গল্প করি,রাতটা দেখবেন এক নিমিষেই শেষ।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে তার নাম জিজ্ঞাস করি আমি।
-ভাই,আমার নাম মো: আব্দুল হাই।
-ও।

দৃষ্টি সরিয়ে নেই আমি,একমনে তাঁকিয়ে থাকি কাচের জানালায়। আস্তে আস্তে সব পিছনে চলে যাচ্ছে,রাতের জার্নি অনেক রোমাঞ্চকর লাগে আমার কাছে। ঘুমন্ত শহরের মাঝে গুটি কয়েক মানুষের ব্যস্ততা দেখেই ভাল লাগে আমার।
-ভাইয়ের কি মন খারাপ?
লোকটির দিকে আবারো বিষদৃষ্টি দেই আমি,সে দৃষ্টিতে প্রশ্রয় নেই,কিন্তু বিরক্তির ছাপ প্রকট।
-কোথায় যাবেন আপনি হাই সাহেব?
-জ্বী ভাই,আমি সিরাজগঞ্জের পরেই নেমে যাব। আপনি কোথায় যাবেন?
-ঢাকা।
নির্লিপ্ত হয়ে জবাব দেই আমি।এক প্রস্থ দীর্ঘশ্বাসও বেরুয়,কাল ঢাকায় পৌছানোর পরই শেষ হয়ে যাবে আমাদের সম্পর্কটা। আমার,মিথিলা আর আমাদের সম্পর্ক। তিন বছর ভালবাসার পর বিয়ে হয় আমাদের্। কিন্তু বিয়ের এই দুই বছরের মধ্যেই বড় পানসে লাগছে সম্পর্কটা। ব্যস্ততা আর দায়িত্বের চাপে ভালবাসাটা মরেই গেছে হয়ত। পাগলামীর সেই সময়গুলোতে তাইত আজ একগাদা দীর্ঘশ্বাস,মুঠোফোনের বকুনীতে আজ শুধুই হু হা। ডিভোর্স লেটার নিয়েই যাচ্ছি ঢাকা,কালকের পর হয়ত আমার মিথিলা বলার অধিকারটার স্থানেও বড় কোন দেয়াল উঠে যাবে। তাইত মিথিলাকে দেখার শেষ সুযোগটাও নষ্ট করতে চাইনি। আমাকে আনমনা দেখেই হয়ত বিরক্তি উপেক্ষা করে কথা চালিয়ে যান লোকটা।
-ভাই,মন খারাপের চেয়ে আসেন গল্প করি। আসলে সিরয়াজগঞ্জ যাচ্ছি জরুরী খবরে,স্ত্রীর বাচ্চা হবে হাসপাতালে। তাই একটু নার্ভাস লাগছে।
হঠাত করেই উনার সাথে আমার দেখা,তারপরও কত অকপটে কথা গুলা বলে যাচ্ছেন। আমিই পারিনা সবকিছু মুঠো থেকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। প্রচুর ঘামছেন হাই সাহেব,হয়ত দুশ্চিন্তা থেকেই। আমারো মনে হয় কিছুটা সময় মন খারাপের কপাটে তালা ঝুলিয়ে দিতে। তাইত কাচের বাইরের এক ফালি চাঁদ থেকে মনযোগ তার দিকে দেই। একা একাই কথা বলছেন তিনি,হয়ত চাপ কমাতে হরবর করছেন।

সাবস্ক্রাইব করুন:
•°•
-জ্বী ভাই বলেন,তারপর প্রথম বাচ্চা আপনাদের?
-হুম,এবারই প্রথম। এর আগে অবশ্য একবার মিসক্যারেজ হয়েছে। তারপর আর কি।
-লাভ ম্যারিজ নাকি আপনাদের?
-বলতে পারেন। আসলে আমি খুলনা ব্রাক ব্যাংকের মেইন শাখায় চাকরী করি,বড় কোন পদ না। ছোটখাটো,পরিবার চলে আর কি।
তাড়াতাড়ি কথা বলছেন উনি,বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর চাপে আছেন। হয়ত ভালবাসা থেকেই এই দুশ্চিন্তা। হাসি পায় আমার,আবার মায়াও হয় উনার দৃষ্টি দেখে। সাহস দেয়ার মত করে বলি আমি,
-টেনশন করেন নাহ,একবার দূর্ঘটনা হতেই পারে,আর সমস্যা হবেনা দেখবেন। তারপর কিভাবে হল আপনাদের বিয়ে বলেন শুনি?
-আসলে ভাই ও আর আমি একসাথেই চাকরী করতাম।চাকরী করতে গিয়েই পরিচয় তারপর পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে। বিয়ের আগে অবশ্য এক বছর সম্পর্ক ছিল আমাদের,সেটা কি ভালবাসা নাকি নির্ভরশীলতা তা ঠিক এখনো বুঝিনি আমি।
অবাক লাগে আমার,কত সহজেই না সব বলে দিলেন উনি। আমারো ইচ্ছে হয় উনাকে সব বলতে,আমার,মিথিলার,আমাদের প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি খুনসুটির গল্প শুনাতে।চেপে রেখে প্রশ্ন করি আমি,
-তারপর?
-তারপর বিয়ের পর কিছুদিনের মধ্যেই মা মারা যায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই ছিলাম বড়,বাবা,মেঝ ভাই,ভাইয়ের বউ,ছোট ভাই সবার দায়িত্বই ছিল আমার উপর। হঠাত করে চাকরীটাও ছেড়ে দিতে হয় তখন। এর মাঝে অভাব আসলে যা হয়।
উনার গল্প শুনতে ভালই লাগে আমার,খুব সাধারন একটা জীবনের গল্পই অসাধারন লাগছে উনার মুখে শুনতে। আমার বাবা মাও গত হয়েছেন এক বছর আগেই,তারপরই ভাইয়েরা সবাই আলাদা আলাদা। বড় ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে শুনেছি,যাওয়া হয়নি এখনো। আসলে ব্যাস্ততার অজুহাতের সদব্যবহার আর কি। সম্পর্কের পিছুটানগুলো কিভাবে যেন সব হারিয়ে গেছে। এক সময় প্রয়োজন ছিল বলেই হয়ত কাছে থাকা ছিল,আজকি প্রয়োজন শেষ?মনে হয়।
-কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আপনি?
কথা পাল্টাতেই প্রশ্ন করি,পরিবারের একান্ত নিজের কথাগুলো শুনতে ভাল লাগেনা আমার্। মানুষের মন অনেকটা গুহার মত,আলো জ্বালালেই আলোকিত নতুবা অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। গুমোট সেই পরিবেশটাতে নিজেকেই মানিয়ে নিতে হয়,কেও আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেনা। একান্ত সেইসব কথাগুলার পীড়াও একি,শুধু নিজেই অনুভব করা যায়,কাওকে বললে হয়ত সেই আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার মত হয়ে যায় ব্যাপারটা।
-আমি এস এস সি পাস ভাই,আসলে পরিবারে সেসময় পড়ার মত সামর্থ্য ছিলনা। কিন্তু এইচ এস সির সার্টিফিকেট করা আছে,কম্পিউটারে।
বলেই হেসে উঠেন হাই সাহেব। এই প্রথম তিনি হাসলেন। আমিও হাসি তার সাথে,তার হাসির মধ্যে যে উচ্ছলতা দেখতে পাই তা এই এম বি এ করা আমার মধ্যে নেই। আমার হাসির শব্দ কেমন যেন শুকনো শোনায়,অবাস্তব লাগে নিজের কানেই ।

•°•
-তারপর বলেন?
আবারো জানতে চাই আমি,তার কথাগুলা কিভাবে যেন অনুভুতির জায়গাটায় একটু একটু করে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
-তারপর অভাবের দিনগুলো ছিল সবচেয়ে জঘন্য। ভালবাসা ছিল আমরা বুঝতাম,কিন্তু ঝগড়াও ছিল বাস্তবতার সাথে। কষ্টটা ছিল,তবুও পুরো সংসারটাকে এক সুতায় বেধে নিয়েছিল ও। আমার পুরোটা পরিবারকেই এক হাতেই সামলে নিত। অভাবটা আমিও বুঝতাম,তবুও কোনদিন ভালবাসাটা প্রকাশ করা হয়নি তখন। যখন প্রথমবার মিসক্যারেজ হয়,আমি তখনও কিছু বলিনি ওকে। চিকিতসার টাকাটাই যে ছিলনা তখন। তারপরও অভিযোগ ছিলনা ওর্। অতীতগুলোকে দূরে সরিয়ে এখন ভালই আছি আমরা। নতুন চাকরী,নতুন সন্তান। দোয়া করবেন ভাই,রাতে সিজার করার কথা।
কথাগুলো বলে আমার দিকে তাকান উনি,হয়ত আন্দাজ করেন বিশ্বাস করেছি কিনা তাকে।আমিও একটা শুকনো হাসি ফিরিয়ে দেই।
-নেন,ভাই পিঠা খান,এই পিঠা আমার স্ত্রীর অনেক প্রিয়,ওর জন্যেই নিয়ে যাচ্ছি।
অবাক লাগে আমার উনার প্রস্তাব শুনে। কত সহজেই আপন করে নিতে পারে এই মানুষগুলো,সরল বিশ্বাসেই গুটিকয়েক তুলে নেই আমি। উনিও কেমন যেন রিলাক্স হলেন,হয়ত আমাকে কথাগুলো বলতে পেরেই। আমাদের মাঝেও কি ভালবাসা কম ছিল?মিথিলাকে তো সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ভালবাসতাম আমি,পরিচয়,বন্ধুত্ব,প্রণয়,পরিণয়। সম্পর্কটা কি এতটাই আবেদন হারিয়েছে এই কয়দিনে। হঠাত করেই কেন যেন আমার সামনে বসা লোকটার সাথে নিজেকে তুলনা করতে শুরু করে দিয়েছি আমি,তার অসাধারন ভালবাসার গল্পের সামনে আমার আর মিথিলার অর্ধযুগের ভালবাসাটাকে জাহির করতে লজ্জা লাগে আমার্। অবাক লাগে ভাবতে কত সাধারন একটা পরিচয় আমাকে অসাধারন কিছু উপলদ্ধি করতে শেখাচ্ছে। এইত ঈশ্বরদী পেরুলাম আমরা,কেমন যেন শুন্যতার ভাবটা আরো বেড়ে গেল। সাদা কাগজের স্বাক্ষর কত সহজেই সম্পর্কগুলোকে ঠুনকো করে দেয়। পৃথিবীর সম্পর্কগুলোর রসায়নটা এমন কেন,মানুষ আজীবন চেষ্টা করলেও হয়ত এই জটিলতার কোন কিনারা পাবেনা। আসলেই পৃথিবীতে কিছু জিনিস থাকা উচিত যার অস্তিত্ব শুধু অনুভবেই। ভাবতে ভাল লাগেনা আমার্। মিথিলাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলবেনা,এই মেয়েটিকে ছাড়া চলতে চাইও না আমি।

•°•
বিমানবন্দরের কাছে এসে ঘুম ভাঙ্গে আমার্। অনেকদিন পর প্রশান্তির ঘুম থেকে সুখস্মৃতি নিয়ে জেগে উঠি আমি। আজকের সকালটা বহুদিন পর অনেক উষ্ণ লাগছে,জানালাটা তুলে দেই আমি। কমলাপুর আর একটু দূরেই। সকালের রোদ এসে স্পর্শ করে আমায়,উত্তাপটায় মিথিলার অস্তিত্ব অনুভব করি আমি। ইচ্ছে হয় লোকটাকে বড় করে একটা ধন্যবাদ দেয়ার্। সাধারন এক অপরিচিতই এক রাতেই বদলে দিল আমায়। মুগ্ধতার দৃষ্টি নিয়েই সামনে তাকাই আমি,নেই হাই সাহেব। হয়ত নেমে গেছেন আগেই,ঘুমে বলে জাগান নি। পাশে তাকাই আমি,নাহ আমার ব্যাগটাও নেই। হাসি পায় আমার,ইচ্ছে হয়না লোকটিকে দোষ দেয়ার,ইচ্ছে হয়না তার স্ত্রীর প্রিয় পিঠার উপর সন্দেহ করার। হয়ত তার নেমে যাওয়ার পর কেও কাজটা করেছে। তার বদলে একজন আব্দুল হাই হতে বড্ড ইচ্ছে করে আমার,আদরের সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে ইচ্ছে করে,মিথিলার সাথে একসাথে থাকতে ইচ্ছে করে। হয়ত কোন রাতের যাত্রায় উত্তেজনা কমাতে অচেনা কাওকে গল্প শুনাতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু ইচ্ছে গুলোকে কে যেন দমিয়ে দেয়। ব্যাগটার জন্য দু:খ হয়না আমার,বরং প্রশান্তি ছেয়ে যায়। গল্পটা হয়ত মিথ্যা,হয়ত সত্য। তবে লোকটা প্রভাবিত করতে পারে মানুষকে,বদলাতে পারে। কমলাপুরে যখন আমি নামি তখন প্রায় সকাল আটটা,ব্যস্ততার নগরী ঢাকার কর্মোদ্যমের সূচনালগ্ন। আমিও সুখানুভূতি নিয়ে এগিয়ে যাই,এগিয়ে যাই আমার মিথিলার উদ্দেশ্যে। যে ব্যাগটা নিয়েছে ভালই করেছে,বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের সম্পর্কটাকে। হয়ত সৃষ্টিকর্তাও আড়ালে থেকে এভাবে চাল চালেন,আর মুচকী হেসে যান।

সাবস্ক্রাইব করুন:

By- Escherichia Coli
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url