রহস্য গল্পঃ আফনান ও পড়শীর শেষ পরিণতি!

মধ্যবিত্ত অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে আফনান। যেহেতু বড় ভাই আছে একজন ইনকাম করার মত সেহেতু মধ্যবিত্ত বলা যায় আর কি। ভাই সহ ছোট তিন বোন এবং বৃদ্ধ বাবা-মা নিয়ে সাত সদস্যের পরিবার। আফনান মাধ্যমিক শেষ করে সদ্য কলেজে পা দিয়েছে। ও দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনই বেশি চঞ্চল। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সব সময় মাতোআরা। সাংসারিক কোনো প্রভাব এখনো পড়েনি ওর উপর। প্রফুল্ল মনে মহাবিদ্যালয়ের বিদ্যা চর্চা করছে। স্কুল-কলেজে ওর অনেক বন্ধু। বন্ধুদের মাঝে প্রায়'ই নানান ধরনের প্রতিযোগিতা হয়, বাজি হয় ইত্যাদি। একদিন কলেজ ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিল আফনানের সাথে অনেক ফ্রি এবং অত্যন্ত কাছের। আড্ডা শেষে আফনানকে ঐ বন্ধুটা বলতেছে,- "আমার কাছে একটা মেয়ের নাম্বার আছে, মেয়েটা অত্যন্ত জেদি, কারও সাথে কথা বলে না, নাম পড়শী। আমাদের কলেজেই পড়ে। তুই তো অনেক স্মার্ট, পারবি ঐ মেয়েটাকে পটাতে? যদি পটাতে পারিস, তকে ফুল পেট খাওয়াবো।" এই কথা শুনে আফনান মনে মনে ভাবলো, যদি ওর চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট না করি, ও আমাকে ভীতু ভাববে। আফনান এসব চিন্তা করে একটু ইতস্ততবোধ করে এবং শেষে নাম্বারটা নিয়ে নেয়। নাম্বার দিয়ে ওর বন্ধু বলে,- "যদি না পারিস আমাকে খাওয়াতে হবে কিন্তু।"

নাম্বার আনার পর থেকে আফনানের মাথায় এই বিষয়টা ঘুরঘুর করতেছে। মেয়েলি ফাংশানে ও তেমন জড়ায়নি, কিন্তু নিজের স্মার্টনেসের কথা চিন্তা করে আফনান এই বিষয়ে মনোনিবেশ করলো। মনে মনে ভাবতেছে, যে করেই হোক ঐ মেয়ের সাথে প্রেম করতে হবে। এসব ভেবে ফোনে রিচার্জ করে, রাতে মেয়েকে ফোন দিবে। কিন্তু হঠাৎ ফোন দিয়ে মেয়েকে কি বলবে? কিছু খুঁজে না পেয়ে ঐ দিন রাতে আর ফোন দেওয়া হলো না। সকালে কলেজে যাওয়ার পরই ওর বন্ধু খোঁচা দিয়ে জিঙ্গেস করলো, "কিরে! ফোন দিসিলি?" আফনান বলে- না, কাল দেবো। কিন্তু ওর বন্ধু ওকে হিট লাগানোর জন্য বলে, "তোর শুধু মুখে মুখে চাপাবাজি, তরে দিয়ে হবে না।" এই কথা শুনে আফনান কলেজেই সিদ্ধান্ত নেয়, বাড়িতে এসেই ওকে ফোন দিবে।

রাস্তা দিয়ে আসার সময় মনে মনে অনেক কথা চিন্তা করে, ফোন দিয়ে বলার জন্য। বাড়ি এসে ফোন হাতে নিয়েই টকটাইম কিনে চল্লিশ মিনিট। এবং কল দেয় পড়শীকে। রিং এর সাথে আফনানের বুকের হৃদস্পন্দনও বাজতেছে। প্রথম রিংটা রিসিভ হয়নি। দ্বিতীয়বার দেবার পর ঐ পাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়। আফনান সালাম দিয়ে কথা শুরু করে। আফনান পরিচয় দেবার আগেই পড়শী বলে- "কে আপনি? নাম্বার কোথায় পেলেন? আমি অচেনা কারও সাথে কথা বলি না।" আফনান বলে প্লীজ ফোনটা রাখবেন না, আমি আপনার পরিচিতই, সব বলবো, কাইন্ডলি আমায় একটু সময় দেন। আফনান খুবই বিনয়ী হওয়ায় ফোনটা ও রাখতে পারেনি। এইভাবে প্রথমে দুজনের মাঝে পরিচয় লেনদেন হয়। আফনান যেহেতু অপরিচিত, পড়শী ফোন রেখে দিতে চাইলো, কিন্তু আফনান পড়শীকে বিনীতভাবে রিকোয়েস্ট করলো একটু কথা বলার জন্য। পড়শী অনেক কর্কশ স্বরে কথা বলে ছেলেদের সাথে। কিন্তু ঐ দিন আফনানের রিকোয়েস্ট শুনার পর পড়শী একটু নরম স্বরের হয়ে পড়ে। কথা বলতে রাজি হয়। যখন বুঝতে পারে দুজন একই কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে দুজনের বাড়ি তখন তাদের সম্পর্কটা আরেকটু ইজি হয়ে পড়ে। ঐ দিন অনেক্ষণ কথা হয়। রাতে দুজনের মনেই একই রকম ভাবনা। প্রথম কথাতেই কেমন জানি নতুন কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছে দুজনই। আফনান বাজির কথা ভুলে যায়, পড়শীর প্রতি হৃদয় থেকে একটা টান অনুভব করে। আফনান ওর কাছের বন্ধুকে পরে আর কিছুই জানায়নি। পর দিন একই সময়ে কথা বলার জন্য দুজনই রেডি। পড়শী মনে মনে ভাবছে- কল আসছে না কেন এখনো? আফনানও কল দেবার জন্য বার বার ফোন হাতে নিচ্ছে, কিন্তু একটা ভয় কাজ করছে ওর মাঝে, ভাবছে- "যদি অন্য কিছু মনে করে, কথা না বলে!... ও তো অত্যন্ত জেদি। কাল তো ভালোভাবেই কথা বললো। আজ কি কথা বলবে না?!!!"
এসব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে কল দিয়েই দিল। সাথে সাথে ফোনের বিপরীত পাশ থেকে নরম কণ্ঠস্বরের সাড়া পেল আফনান। প্রথম পরিচয়'ই যে তাদের আকর্ষিত করেছে সেটা দুজনই বুঝতে পেরেছে। এইভাবে রেগুলার কথা হয় আফনান আর পড়শীর মাঝে। কথা বলার জন্য একটা সময়'ই নির্ধারিত ছিল। ঐ সময়টাতে দুজনই কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতো। কিন্তু এই ব্যাপারটা তাঁরা একে অপরকে বুঝতে দিত না। একটা সময় পর দেখা গেল তাঁদের প্রতিটা দিনের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে কথা বলা। কথা বলতে বলতে ফোনের মাঝেই যে মনের লেনাদেনা হয়ে গেছে তাঁরা নিজেরাই তা বুঝতে পারেনি।

কেউ কাউকে এখনো দেখেনি। পড়শী তেমন কলেজেও যেত না। তাই দেখাটাও হয়নি। ওদের মাঝে মনের আকর্ষণ ছিল, দেহের না। না দেখেই দু'জন প্রেমের পাগল-পাগলী হয়ে গেছে। এইভাবে অনেক দিন হয়ে গেলো।... আফনান একদিন পড়শীকে দেখা করার কথা বললো, পড়শী প্রথমে ইতোস্তত করে কিন্তু পরে রাজি হয়; কেননা আফনানের কথার মূল্য ছিল অনেক। দেখা করার জন্য পড়শী তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে যায়। ওখানে তেমন কোনো মানুষ নেই। নিরিবিলি একটা বাড়ি। পড়শীর এক আন্টি সেখানে থাকে। সেখানে আফনানকে আসতে বলে। আফনান আজ তাঁর স্বপ্নের মানুষের সাথে দেখা করবে। মনে মনে ওর অনেক আনন্দ উপভোগ হয়, আবার অনেকটা ভয়ও কাজ করছে ওর মাঝে। প্রকৃত প্রেমের যে ভয় থাকে। এমনটা যে ওর লাইফে প্রথম। সময় নির্ধারিত হলো, বিকালে পড়শীর আত্মীয়ের বাড়িতে যাবে আফনান। কিন্তু একা যেতে সাহস পেল না। ওর আত্মীয়ের বাড়ির পাশে আফনানের এক বন্ধু ছিল, ওকে সাথে নিয়ে গেল। ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে ওদের বাড়িতে গেল। পড়শী ছিল অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। আফনানকে দেখে আফনানের প্রতি ভরসা আর ভালোবাসাটা আরও বেড়ে গেল পড়শীর। যেমনটা মনে মনে ভেবেছিল তার চেয়েও অনেক বেশি অমায়িক ও সুন্দর আফনান। পড়শীকে এত প্রফুল্ল দেখে আফনান নিজেও অনেক খুশি হয়।
পড়শী ছিল স্বাস্থবান এবং পরিপাটি একটা মেয়ে। গ্রামের মেয়ে তো, একটু বড় হয়েই স্কুলে গিয়েছিল, তাই বয়সটা আফনানের কাছাকাছি একদম। প্রথম সাক্ষাতটা ওদের এমন ছিল, যেনো হাজার বছরের বেশি ওরা পরিচিত। আফনানের বন্ধুটা একটু অবাক হয়! ও মনে মনে ভাবে কত ভালোবাসা ওদের মাঝে। ওরা সত্যিই প্রকৃত একটা জুটি। আফনান তাঁর বন্ধুকে নিয়ে পড়শীর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে গোধূলি লগ্নে বের হয়। পড়শী পিছন পিছন আসে। যতক্ষণ আফনানকে দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ পড়শী তাকিয়ে ছিল আফনানের দিকে। ওদের দেখা হওয়ার পর থেকে ওদের সম্পর্কটা এত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়, দুজন আলাদা বাঁচার কথা চিন্তাই করতে পারে না। পড়শীর পৃথিবীটা জুড়ে শুধু আফনান। আফনানও পড়শীকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। ফিরে আসার সময় আফনানের বন্ধু বলতেছে,- মেয়েটা তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসে। ওর চোখ মুখ তার প্রমাণ। আফনান এই কথা শুনে বলে- হুম, ওর মত এত ভালো আমায় আর কেউ বাসতে পারবে না। আফনানের বন্ধু বলে, পড়শীকে কোন দিন ঠকিও না। তোমরা দুজন অনেক সুখি হবে। ঠকানোর কথা বলার কারণ হলো, আফনান অনেক সুদর্শন। এমন ছেলেরা যে কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারে। আর আফনানের কথা বলার ধরণও ছিল সুন্দর। তাই এমন কথাটা বলে ওর বন্ধু। কথাটা শুনার পর আফনান বলে, "আরে নাহ্! আমিও ওকে কোনদিন হারাতে চাই না।"

সন্ধ্যা হয়ে যায়, বাড়ি চলে আসে আফনান। ঐ দিন রাতে দুজনের আর ঘুম হয়নি। চোখে সুখের রঙিন স্বপন। মধ্যরাত পর্যন্ত দুজন কথা বলে ফোনে। ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়ায় লাইন কেটে যায়। আফনান একটু ঘুমালেও পড়শী সারা রাত সজাগ। পড়শীর চোখে শুধু আফনানকে আপন করে পাওয়ার কৌতুহল। দেখা হওয়ার পর থেকে দিনের বেশিরভাগ সময়'ই ওরা কথা বলে কাটায়। আফনানের সব খোঁজ খবর রাখে পড়শী। একবেলা যদি না খেয়ে থাকে, পড়শী কান্নাকাটি করে, নিজেও কিছু খায় না, এত ভালোবাসে। পড়শীর সব আবদার বাচ্চাদের মত। কিছু হলেই ও ছেলেমানুষি করতো। আফনানের কাছে এই ব্যাপারটা ভালোই লাগতো। প্রতি রাতেই ঘুমুতে যাওয়ার আগে দুজনে কথা বলতো। আফনানের খোঁজ না নিয়ে পড়শী ঘুমুতোই না। আফনানও পড়শীর খোঁজ নিতো। পড়শীর কিছু হলে আফনান পড়শীর চেয়ে বেশি কষ্ট পেত। পাগলের মত এটা সেটা করতো, ওকে ভালো করার জন্য। আফনান কোথাও গেলে পড়শী মন খারাপ করে থাকতো। বলতো,- "তুমি বাড়ি থেকে কোথাও গেলে আমার কষ্ট হয়। তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে ধম বন্ধ হয়ে আসে আমার।" পড়শী দূরে থাকলেও আফনান যদি দেরি করে বাসায় যেত অনেক রাগ করতো। অর্ধাঙ্গিনীর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। বউ নিজের স্বামীর এত খোঁজ রাখে না, পড়শী যেমন রাখে।

এইভাবে পড়শী-আফনানের ভালোবাসা আরও গভীর হতে থাকে। দুটো জীবন একই সূতোয় গেঁথে যায়। একটা যেন আরেকটার আত্মা। দেখতে দেখতে এইভাবে ভালোবাসার ঘোরে ওদের কলেজ জীবন প্রায় শেষের দিকে। পড়শীর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বলতে গেলে বিয়ের উপযুক্ত সময় ওর। মা বাবা বিয়ে দেবার চেষ্টাও করে কিন্তু পড়শী এগুলোকে পাত্তা দেয় না। ওর মনে শুধু আফনান। মা বাবার চাপের কথাও আফনানকে মুখ ফুটে বলতে পারে না, কেননা আফনানের যে আরও অনেকদূর যেতে হবে। সব কিছু পড়শী নিরবে সহ্য করে। এইভাবে আরও একটা বছর কেটে যায়। পড়শী সব প্রতিকূলতার মাঝেও আফনানকে পাগলের মত ভালোবাসে। আফনানও বুঝতে পারে পড়শীর সমস্যা গুলো। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। হিমশিমের পরিবার। আফনানের বড় ভাই এখনো অবিবাহিত, ছোট তিনটা বোন বিয়ে দেবার বাকি, এখানে আফনানের বিয়ের কথা দুরূহ ব্যাপার ছাড়া কিছুই না। এই দিকে পড়শীর বয়স একুশ-বাইশ পার হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিতে গ্রামাঞ্চলে অনেক সমস্যা হয়। লোকে কানাঘুষা করে। পড়শীর মা বাবাও পড়শীর সম্পর্কের কথা বুঝতে পেরেছে। তাঁরা এটাও বুঝতে পারে, পড়শী এই ছেলেকে ছাড়া জীবন দিয়ে দিবে তবুও অন্য কাউকে সঙ্গী বানাবে না। তাই তাঁরা বিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। আফনান কলেজ জীবনের শেষের দিকে একটু বেশি মাতামাতি করতেছে। পড়শীর এই সমস্যা গুলো ওর চোখেই পড়ছে না। পড়শীর বয়সের সাথে ওর গায়ের রংটাও একটু কালো। তাই বোধহয় মেয়েটা প্রকৃত ভালোবাসা দিয়েও অসহায় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! দিনটা ছিল শনিবার। আফনানের বড় ভাই শহর থেকে কাজ করে বাড়ি আসতেছিল, হঠাৎ সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। সেই দূর্ঘটনায় আফনানের ভাই এক হাত ও পা হারিয়ে ফেলে। ভাগ্য ভালো ছিল সরকারী অর্থায়নে চিকিৎসা হয় দূর্ঘটনায় আহত সব রোগীর।

সাবস্ক্রাইব করুন:

আফনানের জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়। ভাই ছিল একমাত্র ইনকামদার। এখন জীবিকার তাগিদ এসে পড়লো আফনানের উপর। অন্যদিকে পড়শীর নাজেহাল অবস্থা। সব মিলিয়ে আফনান মানসিকভাবে অনেক বেশি আঘাতপ্রাপ্ত। ভাইয়ের ঔষধ এবং সাংসারিক খরচ মিটানোর তাগিদে আফনান পড়াশোনা বাদ দিয়ে বের হয় জীবিকার তাগিদে। শহর একমাত্র উপায়। গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে আফনান, সিদ্ধান্ত নেয়।৷ যে কোনো দিন দুই টাকা আয় করেনি৷ সে এখন সম্পূর্ণ সংসার চালাবে। তিনঘণ্টা একটানা কাজের অবিজ্ঞতাও আফনানের নেই, সে শহরে যাচ্ছে সারাবছর কাজ করতে। না গেলে যে অসুস্থ ভাই, বাবা-মা আর বোন তিনটা না খেয়ে মারা যাবে। পড়শীর কথাও তাঁর বার বার মনে পড়ছে। আফনানের বড় ভাই অসুস্থ হওয়াতে যতটা জল ঝড়িয়েছে আফনান তাঁর চেয়ে শতগুণ বেশি জল ঝড়েছে পড়শীর। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লাল হয়ে পড়ছে, চোখের পাতাগুলো ফুলে গেছে পড়শীর।

কাল সকালেই রওয়ানা হবে আফনান, ঢাকার উদ্দেশ্যে, এক দূরসম্পর্কের চাচার কাছে। পড়শীকে ফোনে সব বিস্তারিত বলে আফনান। পড়শী সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ যেভাবে কাঁদে সেরকম কান্না কাঁদে আফনানের সাথে। আফনানেরও বুক ফাঁটা কান্না আসে। ফোনটা কেটে দেয়। রাতে যায় পড়শীর সাথে শেষ দেখা করতে, একটা পিচ্চিকে দিয়ে পড়শীকে খবর দেয় বাড়ির পেছনে আসতে, পড়শী খবর পেয়ে খালি পায়ে পাগলের মত ছুটে যায় আফনানের কাছে। ঝোপঝাড়ের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পায়ে কাটা বিঁধে অনেক। একটু ইশ শব্দও করেনি পড়শী। দৌড়ে গিয়ে আফনানকে জড়িয়ে ধরে। অনেকটা সময় দুজন কোনো কথা বলতে পারেনি, শুধু কান্নার রোল পড়ে দুজনের মাঝে। আফনান নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে। পড়শীর চোখের জলে আফনানের বুক ভিজে যায়। আফনান শক্ত হয়ে বলে, শান্ত হও, আমি তো মরে যাচ্ছি না। এমন তো না যে আর কোনো দিন আসবো না। দোয়া করো, যেনো ভালো একটা কাজ পাই, তাড়াতাড়ি যেনো তোমার কাছে ফিরে আসতে পারি। পড়শী বলে, আমি কি করে বাঁচবো? তুমি এত দূরে গেলে আমার ধমটা বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহ কেন এত নিষ্ঠুর হলো? কি ভুল করেছি আমরা?

আফনান পড়শীকে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু পড়শী এমনভাবে আফনানকে জড়িয়ে ধরেছে, যেনো আফনান ওর পৃথিবী, ছেড়ে গেলে হয় তো ও মরেই যাবে।৷ আফনান বলবো কেউ দেখলে সমস্যা হবে, কেঁদ না, ঘরে যাও।। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো তোমার কাছে। আফনান জোর করে পড়শীকে ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে, পড়শী আবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো; ধরে বলতেছে- আমি হয়তো মরেই যাবো, তুমি আরেকটু থাকো আমার কাছে। এত কান্না আফনান আগে কখনো দেখিনি। জোর করে ওকে ছাড়িয়ে আফনান চলে যায়। পড়শী তখন জোরে জোরে কাঁদছিল। পায়ে অনেক কাটা বিঁধেছে, রক্ত বের হয়েছে অনেক। আফনান চলে যাওয়ার পরও অনেক্ষণ কাঁদে বাড়ির পিছনে পড়ে। হঠাৎ পড়শীর মা গিয়ে পড়শীকে ঘরে আনে। পড়শীর মা'ও কাঁদে পড়শীও কাঁদে। সব কষ্ট যেন নিয়তি ওদেরকেই দিয়েছে।

আফনান যেতে যেতে হঠাৎ তাঁর জামার দিকে তাঁকিয়ে দেখে, পুরা জামাটাই ভেজা। পড়শীর চোখের জলে ভিজে গেছে। দেখে আফনান আরও কান্না শুরু করে। একা একা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে। সারা রাত কেউ ঘুমায়নি। সকালে গোসল করে আফনান রেডি হয়। মা ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। বোন তিনটা অঝরে কাঁদে ভাইয়ের জন্য। তিনটা বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বলে মা বাবা দেখে রাখিস। আফনান মনে হয় এই মুহূর্তটা আর বেশি নিতে পারছিল না। তাই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। আফনানের মা কেমন জানি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আদরের সন্তান অভাবের তাড়নায় শহরে যাচ্ছে। কষ্ট যেন এর চেয়ে বেশি আর হয় না।

আফনান বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় অটোতে উঠে বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার জন্য, পিছনে মা বোন সবাই চোখের পানি ফেলতেছে আর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসস্ট্যান্ডে আফনান পৌছায়। বাসে উঠার আগে দেখে বোরকা পড়া একটা মেয়ে একটা ঠিফিন বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতেছে, চোখ দেখে আর বুঝার বাকি রইলো না এই মেয়েটা পড়শী। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আফনান মেয়েটার কাছে যায়। গিয়ে বলে- "দূর পাগলি কাঁদিস না। আমার জন্য দোয়া করিস। পড়শীর চোখের পানি ঝরঝরিয়ে পড়তেছে। কথা বলতে পারে না। শুধু এইটুকু বলছে, নিজের খেয়াল রেখো, আমার সাথে একটু কথা বইলো। নইলে আমি মরে যাবো। এই কথা বলে টিফিন বক্সটা হাতে ধরিয়ে দেয় পড়শী। আফনান পড়শীর কপালে একটা চুমু দিয়ে পড়শীকে বুকে জড়িয়ো নেয়। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, ওদের কান্না দেখে পাশের মানুষ গুলো চুপ হয়ে গেছে। গাড়ির হেল্পারের ডাক শুনে, পড়শীকে ছেড়ে গাড়িতে উঠে যায় আফনান। যতদূর গাড়ি দেখা যায় ততদূর পড়শী এক পলকে তাকিয়ে থাকে।

আফনান চলে যায় শহরে। পড়শী বড় একা হয়ে পড়ে। দিন রাত সব এক হয়ে যায় পড়শীর। আফনান শহরে একটা কম্পানিতে অল্প বেতনে একটা চাকরী পায়। খাওয়া-দাওয়া এবং বাসা ভাড়া বাবদ যা বাড়িতে পাঠায় তা দিয়ে আফনানের মা বাবার তিন বেলা খাবারেই জুটে না। ফোনে টাকা রিচার্জ করার মত পয়সা আফনানের কাছে থাকে না। পড়শী এই দিকে সারাক্ষণ আফনানের একটা ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকে, কিন্তু কোনো ফোন তো আর আসে না। পড়শী খাওয়া দাওয়াও সব বন্ধ করে দেয় আস্তে আস্তে। এই অবস্থা দেখে পড়শীর মা অঝরে কাঁদে। এত হাসিখুশি থাকা মেয়েটা একদম চুপ হয়ে গেছে। সবাই আফনান আর পড়শীর ভালোবাসার কথা জেনে গেছে। আফনান সকাল ছয়টায় কাজে যায় রাত বারোটায় বাসায় ফিরে। টাকার বিনিময়ে শ্রম বেঁচে কিন্তু ন্যায্য মূল্য পায় না। ব্যস্ততার মাঝে আফনানের সময় কাটলেও পড়শির দিন তো যেতেই চায় না। নিজের ফোনে টাকা নেই, চাচার ফোন থেকে একবার আফনান পড়শীকে ফোন দেয়, আফনানের কণ্ঠ পেয়েই পড়শী কেমন পাগলের মত কান্না শুরু করে, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যায়, আফনান আর কিছুই বলতে পারে নাই। চাচা দেখে আফনানের চোখে পানি, কি নিষ্ঠুর মানুষ! একটু সান্ত্বনা না দিয়ে, বলে- "এত মায়া রেখে শহরে কাজ করতে পারবি না। ফোন দে, আর কখনো ধরিস না।" আফনান কষ্ট পায় অনেক কিন্তু উত্তরে কিছু বলে নাই। পড়শী যেহেতু এইভাবে কাঁদে, আর এই কান্না আফনান সহ্যও করতে পারে না, তাই আর ফোন দেয় না।

পড়শী আগের চেয়ে অনেক কুৎসিত হয়ে গেছে। স্বাস্থবান মেয়েটা এখন অনেক বেশি রোগাটে। কেউ কেউ বুড়ি ডাকে। পড়শী কারও কথায় কোনো কান দেয় না। ওর মনে শুধু আফনানের চিন্তা। কবে আসবে? কখন একটা ফোন দিবে? সারাক্ষণ ফোনটা নিয়ে বসে থাকে। ইচ্ছে হলে দুই এক লোকমা খায়, আবার না খেয়েও প্রায় দিন কেটে যায়।

আফনানও দিন দিন অনেক হালকা হয়ে পড়ে। পড়শীর কথা অনেক মনে পড়ে, কিন্তু ফোনে একটু কথা বলার সামর্থটুকু তাঁর নেই। প্রায় সময়ই পড়শীকে ভেবে ভেবে কাজের ফাঁকে কাঁদে। মনে মনে ভাবে- ও বোধহয় কাঁদতে কাঁদতেই মরে যাবে, আমার ভালোবাসার একটা সমুদ্র হারিয়ে যাবে।

আফনানের চিন্তা ভুল নয়। না খেয়ে থাকতে থাকতে পড়শীর খাদ্যনালী শুকিয়ে যায়। একটা সময় পর পড়শী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডক্টরের কাছে নিলে ওর আলসার ধরা পড়ে। শরীর এতটা দুর্বল হয়, ঔষধ হজম করার মত শক্তিও ওর দেহে নেই। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় ওকে। মা বাবা সবাই পাগলমের মত চেষ্টা করে পড়শীকে সুস্থ করতে, কিন্তু পড়শী যে খাবার খেতে ভুলে গেছে। কোনো কিছুই ওকে খাওয়ানো যায় না। সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মনে চিন্তা একটাই, আফনান ওকে ফোন দিবে। এইভাবে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় থাকে একমাসের মত। হঠাৎ একদিন ডক্টর বলে, ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তখন সবাই বুঝতে পারে, পড়শীর জীবনের অন্তিম সময় চলে আসছে। পড়শীর মা বলে আফনানকে একটা খবর দাও, আফনানকে বার বার ফোন করা হলেও সে ফোন তুলেনি। ফোন তুলার সুযোগ যে তাঁর নেই। সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত সে।
কোনো রকম বেঁচে আছে শুধু, মা বাবা আর ভাই বোনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। রাতে ফেরার পথে দেখা যায় একটা নাম্বার থেকে অনেক গুলো ফোন আসছে। আফনান ভয় পেয়ে যায় এত গুলো কল দেখে, তাড়াতাড়ি সে ধার করে কিছু টাকা নিয়ে রিচার্জ করে। কল বেক করে ঐ নাম্বারে, ফোনটা রিসিভ হতেই ঐ পাশ থেকে একটা চিৎকারের আওয়াজ আসে। আফনান বুঝতে পারলো এটা পড়শীর মায়ের কণ্ঠ। আফনান বার বার হ্যালো হ্যালো করতেছে। কিন্তু ঐ পাশ থেকে অনেক মানুষের আওয়াজ আসতেছে, কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে। আফনান বুঝতে পারলো তাঁর কলিজার টুকরা পড়শী আর নেই। আফনান আর বাসায় ফিরে যায়নি। ওখান থেকে এক দৌড় দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুদূর দৌড়ানোর পর পড়ে যায় হোঁচট খেয়ে। খালি পেটে আর কত দৌড়াবে সে! এইভাবে গাড়ির কাছে আসে। দুচোখের পানি শেষ হয়ে গেছে মনে হয়, কাঁদতে পারতেছে না। গাড়িতে উঠার পর কেউ ভাড়া চায়নি ওর কাছে। সবাই ওকে দেখেই বুঝতে পারছে, ও এমন কিছু হারিয়েছে, যা ওর জীবনের চাইতে বেশি মূল্যবান। শহর থেকে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। সরাসরী পড়শীদের বাড়িতে চলে যায় আফনান। দূর থেকে দেখে পড়শীরা বাড়ির মধ্যে মানুষের সমাগম অনেক বেশি। তা দেখে ও আরও দ্রুত আসতে থাকে। অনেকেই আফনানকে পাগল মনে করে কিছু বলতেছে না। দেখতে যে পুরা পাগলের মত ও। দৌড়ে আসার চেষ্টা করতেছে কিন্তু দৌড়াতে পারছে না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখে উঠানের মাঝে একটা মৃত লাশ কাটগেড়ায় রাখা। আফনান দৌড়ে গিয়ে লাশের মুখটা খুলে। খুলে দেখে তাঁর পড়শী সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে।
আফনান চিৎকার দিয়ে পড়শীকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে, আমি ফিরে আসছি, তুই কথা বল আমার সাথে! আমি কখনো যাবো না আর শহরে। তোর কাছে থাকবো। তুই আবার আমায় একটু জড়িয়ে ধরে কাঁদ। তুই ঘুমিয়ে থাকিস না। এই বলে পড়শীর চোখে মুখে পাগলের মত চুমু দিতে থাকে আর ডাকে। কিন্তু পড়শী তো আর সাড়া দেয় না। আফনানের কান্না দেখে সবাই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। চিৎকার করে কেঁদে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আফনান। পানি ঢালার পরও আফনানের জ্ঞান ফিরেনি। কি করে ফিরবে? খিদায় যে তাঁরও খাদ্য নালি শুকিয়ে গেছে। বেলা দশটার দিকে পড়শীর লাশ দাফন হয়। আফনানের জ্ঞান ফিরেনি। নামাজের যানাজায়ও অংশ নিতে পারেনি। জ্ঞান থাকলেও নামাজ পড়তে পারতো না। পাগলামিই করতো। বিকাল বেলায় গ্রামের ডক্টর এসে স্যালাইন করার পর আফনানের জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই পড়শীকে খোঁজে। কিন্তু পড়শী তো আর ইহজনমে নেই। পড়শীকে দেখানোর কথা বলে আফনানকে পড়শীর কবরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কবর দেখে আফনান কবরের উপর শুয়ে অঝরে কাঁদে। ওর কান্না দেখে কেউ চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি। আফনান কাঁদে আর বলে,- আমি আর তোমাকে ছেড়ে যাবো না। ছেড়ে গেলে আবার তুমি ঘুমিয়ে যাবে, তুমি উঠো প্লীজ!। পড়শীর কবরের মাটি আফনানের বিছানা হয়ে পড়ে। আফনান বার বার বলতে থাকে, "পড়শী, এই পড়শী! একবার উঠো, আরেকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদো। আমার বুকের ভেতর অনেত যন্ত্রণা। তোমার কান্না দিয়ে একটু নিভিয়ে দাও! দাও না! এভাবে আর থেকো না। আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তুমি আমাকেও নিয়ে যাও! আমাকেও নিয়ে যাও প্লীজ! এইভাবে কবরের উপর পড়ে থাকে।

পড়শীর কবরই আফনানের শেষ বাড়ি। আফননানের মা বাবা অনেক চেষ্টা করে আফনানকে বাড়ি নিয়ে যেতে, কিন্তু আফনান আর পড়শীকে ছেড়ে যেতে রাজি নয়।
এই কবরেই পড়ে থাকে আফনান। মাঝে মাঝে পড়শীর মা, অন্যান্য আত্মীয় স্বজন আফনানকে খাবার দিয়ে যায়। কখনো খায় কখনো খায় না। অনেক সময় দেখা যায়, আফনান পড়শীর সাথে কবরের পাশে বসে কথা বলে। হাসে, মাঝে মাঝে কাঁদে!....

সাবস্ক্রাইব করুন:

লেখকঃ শাহ্আলম
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url