গল্পঃ ব্যথা ( ইতি ও অপু )

 আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ইতি যখন বলল,

"কাউকে খুন করে সরি বললে বুঝি সবকিছু মিটে যায়?" তখন মনের মধ্যে এক বিশাল ঝড় বয়ে গেলো।

আমি আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে একটু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, আমি তো কারো খুন করি নি ইতু।

- ইতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, অপু ছুরি বা গুলির আঘাতের মৃত্যুটা বা খুনটা আলাদা। মানুষের দেহের ভেতরের মনটারও একটা প্রাণ আছে। সেও অনেক কিছু আশা রাখে স্বপ্ন দেখে। সেই মনটাই যদি মরে যায় তাহলে বাইরের দেহের বাঁচাটা শুধু নামমাত্র! তুমি যদি সেটাকেই মেরে ফেলো তাহলে বেঁচে থাকাটা খুব দুষ্কর হয়ে যায়।

আমার কাছে বলার মতো আর কোন শব্দ ছিলো না। মাঝে মাঝে মানুষ এমন কঠিন কথা বলে যার প্রতিত্তরে নিরবতা ছাড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।

ইতির দুধ চা পছন্দ আর আমার রং চা। বিরক্তিকর বিষয় হচ্ছে আমরা এখন যেখানে বসে আছি সেখানে কফি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। 

কফিশপের চার নাম্বার টেবিলে দুটো ব্ল্যাক কফি নিয়ে মুখোমুখি বসে আছি আমি আর ইতি। আধঘন্টা হয়ে গেছে আর একটাও শব্দ করে নি ইতি। নিচের দিকে তাকিয়ে আপন মনে মোবাইল টিপছে। কফি এসে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,কফিতে চুমুক দিব নাকি দিব না সেটাও বুঝতে পারছি না। কয়েকবার জিজ্ঞেসও করলাম কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নেও। আর কোন উত্তরই নেই। আর সহ্য করতে না পেরে বললাম,


- ওই ইতি কথা বলবা নাকি না? কষ্ট হচ্ছে যে আমার। এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যায়?

- আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

- ফাঁকা পকেটের কষ্ট থেকেও সবচেয়ে বড় কষ্টদায়ক হচ্ছে তোমার এই কথাটি৷ এটা শোনার পর আর কথা বলতেই ইচ্ছে করে না।

- তাহলে বলিয়েন না আর কথা,দিয়েন না কল, মেসেজ। ( ইতির আজ ভীষণ মন খারাপ,বেশ রাগ জমে আছে মনের মধ্যে। ইচ্ছে করছে অপুকে এখানেই দু'টো থাপ্পড় দিয়ে মনের সব রাগ উজার করে দিতে।)

- যদি অন্য কেউ হতো তাহলে নিশ্চয়ই দিতাম না। কিন্তু যাকে ভালবাসি তার দেওয়া অবহেলা,দুঃখ কষ্ট সব সহ্য করতে হয়। আর তুমি ছাড়া আমার আপন কেউ নেই তাই তো তোমার সাথে কথা না বলে থাকতেও পারি না। ( আবহাওয়া গরম দেখে অপু বেশ নরম সুরেই বলল।)


- আমি কারো আপন কেউ না।


- কে কার কি সেটা নাহয় নিজেদের মধ্যে থাকুক।ওসব বাদ দেও। কি হয়েছে তোমার সেটা বলো না। কতদিন হয়ে গেছে ঠিকঠাক করে কথা বলো না, মেসেজ দিলে ইগনোর করো।

- কিছুই হয়নি, আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। তাছাড়া আমি কথা না বললেও আপনার কিচ্ছু যায় আসে না, আপনার কথা বলার মানুষের অভাব নাই। যান আপনার সখীদের সাথে গিয়ে কথা বলুন।

- তুমি ছাড়া আমার আর কে সখী হবে? আর তোমাকে ছাড়া অন্যকিছু ভালোই লাগে না।

- আগেই তো বললাম আমি কারোরই কেউ না। এসব তেল লাগিয়ে লাভ নাই। তাছাড়া আমার মধ্যে এমন কিছু নাই যে আপনাকে মোহিত করবে।

- আহা ঝাল দেখাচ্ছো কেনো? জানো আমার কতকালের ইচ্ছে ছিল আমার বউ আমাকে আপনি করে বলবে। আমার প্রচন্ড ভাল্লাগে এটা শুনতে। হে ঈশ্বর অশেষ ধন্যবাদ, আমার মনের আশা পূর্ণ করার জন্য। (উপরের দিকে তাকিয়ে বলল অপু। মনে মনে বলছে আজকে কপালে শনির প্রভাব বেশিই মনে হচ্ছে।)


- ওই আমি তোর কোন কালের বউ রে? মুখ মুচঁড়ে দিব একদম আবার বউ বললে। বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠলল ইতি।

- আজকে কি নাগা মরিচ খেয়েছো কোথাও? এত ঝাল বেরোচ্ছে যে। দেখো চারদিকে সবাই তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।

- তুই খা, আমি ওসব খাই না। যে নিজে মিষ্টিভাবে কথা বলতে পারে না তার সাথে ঝাল দেখানোটই উচিত। যে মানুষ খোঁচা দিয়ে কথা বলতে পারে, কথায় কথায় কষ্ট দেয় তার সাথে আবার কিসের কথা। তুই কথা বলতেই জানিস না বাল, আমি কেনো তোর সাথে কথা বলব।

- বাপরে, বেশ রেগে আছেন যে দেবী। কিন্তু দেবী, মানুষ তার প্রিয় মানুষটাকেই তো সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। ইতির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বলুন দেবী কি করিলে আপনি তুষ্ট হইবেন?


- ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে লজ্জা করে না? সে প্রিয় হয় কীভাবে যাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দেওয়া যায়?

- "ইচ্ছে করে কষ্ট দেওয়া হয় শত্রুকে, প্রিয় মানুষকে অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলে মানুষ।" ইচ্ছে করে কষ্ট দেওয়াটা কঠিন অনেক।

ইতি কিছু বলল না, ঠান্ডা হওয়া কফিতে এক চুমুক দিলো।

- আচ্ছা ইতি আমার দিকে তাকাও, তোমার সাথে আমার কি নিয়ে ঝগড়া হয় বলো তো।

- ইতি অপুর দিকে না তাকিয়েই বলল,তোমার সন্দেহ প্রবণতা অনেক বেশি। আমাকে শুধু সন্দেহ করো, দিনদিন এটা শুধু বেড়েই চলেছে। আর যার কারণে তুমি কথা শুনাতে দ্বিধাবোধ করো না। কষ্ট কি হয় তা জানো না তুমি।


- সন্দেহটা আসে কোথা থেকে বলো তো। সন্দেহের মতো কাজ না করলে তো কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না। সম্পর্কটাকে স্বচ্ছ রাখতে হয়, তুমি যাকে ভালবাসবে দেখবে তাকেই তোমার পৃথিবী মনে হবে। তার সাথে কথা বলতে না পারলে দিনটা বিষাদময় লাগবে। আচ্ছা তুমিই বলো, আমি যখন ৫ মিনিট পরে রিপ্লাই দেই তোমার নিশ্চয়ই তখন খারাপ লাগে, সন্দেহ হয়? ঠিক তেমনি আমারও হয়। তুমিতো শুরু থেকেই জানো আমি এক অধৈর্য্যবান ব্যক্তি, অল্পতেই মেজাজ গরম হয়ে যায়,রাগ উঠে। তুমি আমাকে ইগনোর করে অন্য দের সাথে কথা বলো আর আমার সন্দেহ করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু?

- কিন্তু তুমি আবার......


- ওয়েট, আমাকে বলতে দেও এখন। হ্যাঁ আমি তো তোমাকে কখনো এটা বলিনি যে আমার জন্য তোমার বন্ধু বান্ধবীদের ছেড়ে দেও। তাছাড়া মাঝে মাঝে কিছু সমস্যা তো থাকতেই পারে কিন্তু সেগুলো আমরা নিজেরা কথা বলেও তো সমাধান করতে পারি৷ তোমার মনে আছে? তুমি বলেছিলে,আমার অন্য কারো সাথে কথা বলা তোমার পছন্দ হয় না। আমি নিজেকে বদলে ফেললাম সবকিছু বাদ দিলাম এখন দেখি তুমি গুরুত্বহীন হয়ে পরেছো। সম্পর্কে গুরুত্ব অনেক মূল্যবান হয়।

একটা কথা শুনো, যে তোমাকে সন্দেহ করবে না সে তোমাকে কখনো ভালবাসতে পারে না। কারণ যে তোমাকে নিয়ে বেশি ভাবে তোমাতেই যে বিভোর থাকে সে সন্দেহ করবেই। সন্দেহীন ব্যাক্তি ভালবাসার অযোগ্য। তাছাড়া সম্পর্কে সন্দেহ ঝগড়া থাকবেই তাই বলে পিছুপা হয়ে নয় দুজনকে একসাথে হয়েই সবকিছুর সমাধান করতে হয়।


- কি বলব তোমায়, যাই বলব তুমি সেটাকে উল্টোভাবে নিবে। তোমার সন্দেহ বাড়বেই। তার থেকে চুপ থাকাটা ভালো না? আর তুমি আমার কাছে কতটা মূল্যবান সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। ( এমন সময় ইতির মোবাইলটা বেজে উঠল, বাসা থেকে কল এসেছে। ইতি সেটাকে সাইলেন্ট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।)

- না চুপ থাকাটা কোন সমাধান নয়। তুমিই বলতে, কথার মাধ্যমে অনেক কিছুই সমাধান করা যায়। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়ে দিলে আমিও বুঝে নিতে পারতাম সব। কারণ আমরা দুজনে নিশ্চয়ই বাচ্চা নই। বুঝিয়ে বললে বা ভুলটা সংশোধন করে দিলে সবকিছুই তো মিটে যায়।


- আমারও তো রাগ হয় তাই না? আমি কি করব তখন? তোমার উপর ছাড়া কার উপর রাগ দেখাব?

- আচ্ছা তুমিই তো বলো তোমার বাবা বলেছেন, যে মানুষ প্রতিশোধের চিন্তায় থাকে সে কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। তাহলে তুমি কীভাবে এই প্রতিশোধ নিচ্ছো!

- তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে। আমি এমনটা কিছু করতে চাইনি তোমার সাথে। কিন্তু তুমি আমাকে এই খারাপ বিহেভিয়ার গুলো করাতে বাধ্য করেছো। আমি কোন প্রতিশোধ নিচ্ছি না। আমার মন ভেঙে গেছে। কষ্ট পেতে পেতে নিজেকে হারিয়েছি। তাই তোমার প্রতি ঘৃণা বেড়েছে আমার। ( ইতির গলাটা ধীরে ধীরে নিচু হয়ে এলো)


- শোন এভাবে কথা বলতে থাকলে ঝগড়া কমবে না বরং বাড়বে। মানছি তো,আমিই সবকিছুর নাটের গুরু। কিন্তু কেউ ক্ষমা চাইলে সেগুলো তো ক্ষমা করে দেওয়া যায় তাই না। সরি বলছি আমি,সবকিছু মিটিয়ে দেও প্লিজ। বাম হাত দিয়ে নিজের কান ধরে অপু বলল, এই নাও কানও ধরে ফেললাম।

- আমাকে একটু সময় দেও। অনেক রাগ জমে গেছে, সময় লাগবে সামলাতে। তুমি সন্দেহ করাটা কমাও।

- আচ্ছা ঠিকাছে, পাপ যখন করেছি শাস্তি তো পেতেই হবে। অপেক্ষাই করব। (অপু বেশ অভিমানের সুরেই বলল।)

- উঠি এখন, দেরী হয়ে গেছে অনেক। বাবা বকবে আমার। বলেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠল ইতি।

- শোন না ও ইতু, অনেক দিন ধরে কিছু পাই নি। সেই যে বন্ধ করলে এখনও সেই নিরামিষেই কাটছে। একটা কিস পাওয়া যাবে?

- ইতি হাত তুলে বলল, মাইর খাবা?

- না, মাইর তুমিই খেয়ে নেও আমার পেট ভরা।

- হিহিহি...বেড জোক। ইতি আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল, শোন পরের বার তুমি দাঁড়ি একেবারে ছোট্ট করে আসবা নাহয় শেইভ করবা। আমার গালের দাড়িতে খোঁচা লাগে অনেক।

- হাহাহাহা... যথাজ্ঞা মহারাণী! আবার কবে দেখা হবে?

- হুট করে হয়ে যাবে একদিন। সময় আসুক..

- আচ্ছা সাবধানে যেও।


লেখকঃ অর্জুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url