গল্পঃ তুমি আসবে বলে, আবার ফিরে পাবো বলে

ফালতু পোলাপান।রাগে কটমট করতে থাকে সে...!
কিন্তু কিছুক্ষন পর আদিলার রাগ আপনিতেই নেমে যায় যখন দেখলো যে সেই ছেলেটা আর ফোন করছেনা।নাহ বেচারাকে কি যা তা বলছিলাম এতক্ষন।ছেলেটা তো আর অন্য সব ছেলেদের মত না।যারা রাত বিরাতে মেয়েদের ফোনে ডিস্টার্ব করে আনন্দ পায়।ধুর ছেলেটা যেমন ইচ্ছা তেমন হোক আমার কি?তাই মাথা থেকে ছেলেটার চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমের রাজ্যে ডুব দেয় আদিলা।

এস এস সি পরীক্ষা শেষ করে সবে মাত্র কলেজ জীবনে প্রবেশ করেছে।আর এই টিনেজ বয়সে অচেনা অজানা কেও ফোন করলে আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।আদিলাও এর ব্যতীক্রম নয়।তাইতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই নম্বরটা বের করে তাকিয়ে থাকে।ফোনটা কে করতে পারে ?আর কিইবা বলতে চেয়েছিলো?কেন যে শুনলাম না তাই কথা টা?শুনলেই বা কি এমন হত?হাজারও চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে।


কিরে কলেজে যাবিনা??? আর কত বেলা পর্যন্ত ঘুমাবি...??? মায়ের ডাকাডাকিতে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।লাফ দিয়ে উঠে তাড়াহুড়া করে রেডি হওয়া শুরু করে।প্রথম ক্লাসে কোন ভাবেই লেট করা যাবে না।তাই তো তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে কলেজের দিকে রওয়ানা দেয় আদিলা...

রাতে আবারো সেই নম্বর থেকে ফোন আসে।ঠিক একই সময়ে।রাত ১২টা। আদিলা ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই বলে
-জ্বী বলুন আজ কয়টা কথা বলতে চান?

-আরে বাহ! আপনি বুঝি আমার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন?
বোকার মত কথা বলায় নিজের উপরই খুব রাগ উঠে যায় আদিলার।কিন্তু রাগটাকে দমিয়ে সে প্রতিউত্তরে বলে...

-কেন?আমি কি আর কোন কাজ নেই যে আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবো?

-আচ্ছা আচ্ছা রাগ করতে হবে না। ওকে যান অপেক্ষা করছিলেন না।তো আমি যদি বলি আমি আপনার সাথে ১০০টা কথা বলতে চাই শুনবেন?

-১০০টা?ওকে শুনতে পারি।তবে ১০০ এর শেষে যে দুটো শূন্য আছে ওগুলো বাদ দিয়ে যত সংখ্যা থাকবে ততোটা কথা বললেই খুশি হব।
আদিলার এমন অদ্ভুত কথা শুনে ওপাশ থেকে সেই অচেনা কন্ঠস্বর হা হা করে হেসে উঠলো।
ছেলেটার হাসির শব্দে আদিলা পুরাই স্তব্ধ হয়ে যায়।এত সুন্দর হাসির শব্দ বুঝি কারও হতে পারে?এত সুন্দর করেও বুঝি কেও হাসতে পারে??কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করে ছেলেটাকে।এই দিন তারা অনেক সময় নিয়ে কথা বলে...

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলতে থাকে তারা। কিন্তু আদিলা শর্ত দিয়ে দেয় যে রাত ১২টার আগে একটা বারের জন্যও ফোন করা যাবেনা।কারন আর কিছুই না।রাগী মা বাবা যদি কিছু টের পায় তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবে তাই। বাধ্য হয়ে সেও শর্ত মেনে নেয়। আদিলা ভাবে কি আছে ছেলেটার মাঝে? কেন এমন ভালো লাগায় ভরে যায় তার সাথে কথা বললে...কেন এমন উদগ্রীব হয়ে থাকি তার একটু কন্ঠস্বর শোনার আশায়?আদিলার কাছে কয়েকদিনেই কেন যেন খুব বেশি আপন মনে হতে থাকে ছেলেটাকে।কেনে এমন মনে হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারেনা...

প্রতিদিনই ফোনালাপের মাঝে কেটে যেতে থাকে।কখনও ৩০ মিনিট কখনও ৪০ মিনিট আবার কখনও বা১০ মিনিটেই কথা শেষ।কিন্তু কারও আর নাম জানা হয়না।কারন একদিন কথায় কথায় ছেলেটা আদিলাকে জিগেশ করেছিলো

-তোমার কি বৃষ্টি ভালো লাগে নাকি মেঘলা আকাশ?

-উত্তরে সে বলে-আমি বৃষ্টির মাঝে হারাতে খুব বেশি পছন্দ করি।আর আপনার?

উত্তরে ছেলেটি বলে-নীলাকাশের মাঝে যখন মেঘেদের আগমন ঘটে সেই মেঘেদের মাঝে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয়।

-মেঘলা আকাশ আপনার অনেক পছন্দ রাইট?

-হুম এবসোলুটলী রাইট। শোন শোন দুটা কবিতার লাইন মাথায় এসেছে।শোন।
"আমার মনের আকাশে আজ মেঘেদের আনাগোনা...
বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে যাবে যতসব দুঃখ যাতনা..."

-বাহ...আপনার তো ভক্ত হয়ে যাচ্ছি......

- হা হা হা...আচ্ছা শোন মেয়ে আজ থেকে তোমাকে বৃষ্টি বলেই ডাকবো।যদি রাগ না কর।

-বৃষ্টি????বৃষ্টি ডাকবেন ??ওকে ডাকতে পারেন তবে আমিও আপনাকে মেঘ বলে ডাকবো?রাজি?

-হা হা হা...ওকে..
রাত বাড়তে থাকে অথচ তাদের কথার যেন আর শেষ হয়না..কথার পিঠে কথা বলা চলতেই থাকে....!!!


সাবস্ক্রাইব করুন:

এভাবে প্রায় ৩ মাসের মত কেটে যায়েই কয়েক মাসে তারা যেন অনেক কাছের হয়ে যায়।সারাদিনের জমিয়ে রাখা কথার ফুলঝুড়ি ফোটা শুরু হয় সেই রাত ১২টার পর থেকে।কথা যেন শেষ হবার নয়।মাঝে মাঝে মেঘ তার বৃষ্টিকে গান শুনায় কবিতা আবৃতি করে শুনায়।আর বৃষ্টিও মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে।এরই মাঝে তাদের দুবার দেখাও করে।কোন প্ল্যান ছাড়াই রাতে রাতে মেঘ অফার করে দেখা করার জন্য আর পরদিনই তারা মিট করে।দেখা হওয়ার পর থেকে যেন ভালো লাগার পরিমানটা বেড়ে যায়।হয়তো তাকে ভালোবাসাও বলা যায়।কিন্তু আগ থেকে কেও কাউকে বলেনা এই লুকানো ভালোবাসার কথা।মেঘ ভাবে বৃষ্টিকে মনের কথাটা বললে সে যদি সেটা মেনে না নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়?এর চেয়ে নীরবে ভালোবাসাটাই শ্রেয়।আর আদিলা ভাবে তার ফ্যামেলী যদি এই ছেলেকে মেনে না নেয় তখন তার কিছুই করার থাকবেনা।কারন সে মা বাবার কথার বাইরে কিছুই করতে পারবেনা।তারপচেয়ে বরং যেমন আছে তেমন থাকাটাই ভালো।এভাবে বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি দাবি নিয়ে তাদের দিনগুলো কেটে যেতে থাকে।


সেই রাতের কথা আদিলা এক দিনের জন্যও ভুলতে পারেনাই।যেদিন রাতে মেঘ তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়।আর অন্যান্য দিনের মত ঐ রাতেও আদিলা মেঘের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলো।কিন্তু সময় বাড়তে থাকে অথচ কোন ফোনই আর আসেনা।শেষে বাধ্য হয়ে সেই ফোন দেয়।আর ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় আদিলার বকাঝকা...

-কি...কি হয়েছে হু??কটা বাজে দেখেছো?ফোন করনি কেন???নাকি আর কথা বলার ইচ্ছা হয়না??শোন আমার সাথে যদি কথা বলতে ইচ্ছা না হয় তাহলে বলে দিবা আমি আর কখনও তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করবো না...
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর কেন যেন আদিলার মনে হতে থাকে যে মেঘ কাঁদছে...অজানা আশংকা ভর করে।
ব্যকুল হয়ে জিগেস করে-কি হয়েছে মেঘ?তুমি কি কাঁদছো?কি হয়েছে বল প্লিজ?
কিছুক্ষন চুপ থেকে এরপর মেঘ বলা শুরু করে...


-বৃষ্টি তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও।পারলে আমায় ভুলে যেও।পারলে না তোমাকে পারতেই হবে।
আকাশ থেকে পড়ে আদিলা।রাগ আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়...
-এসবের মানে কি?কি করেছো তুমি?ভুলে যাবো কেন তোমাকে?কি হয়েছে বল?
-চাইনি তোমাকে কিছু বলতে...কিছু শোনাতে।কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে... শোন,আগে ভাবতাম ফ্যামিলীর ছোট সন্তানরা বুঝি খুব আদরের হয়।যা চায় তাই পেয়ে যায়।অথচ দেখো আমার ক্ষেত্রে সব উলটো হয়েছে। ছোট বলে সবার জোরাজোরিতে আজ রাতেই আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হচ্ছে।তোমাকে এতদিন বলিনি ভেবেছিলাম হয়তো তাঁদের মানাতে পারবো।কিন্তু আমি ব্যর্থ।তাদের বুঝাতে পারিনি।তুমি কি জানো অভিমান জিনিসটা যে খুব খারাপ?তাইতো এক বুক অভিমান বুকে নিয়ে আজ রাতেই চলে যাবো।আমার জন্যে অপেক্ষায় থাকতে বলবোনা।কারন দেশে আবার কবে ফিরে আসবো জানিনা...অথবা আর কোনওদিন নাও আসতে পারি...
-তাই বলে এভাবে...... গলা ধরে আসে আদিলার।চুপ হয়ে যায় সে...
আদিলার থেমে যাওয়া দেখে মেঘ প্রতিউত্তরে বলে -বৃষ্টি তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে...অনেক ভালো থেকো তুমি...

বলেই লাইন কেটে দেয়...

হঠাত করেই যেন সব কিছু থেকে যায় আদিলার।ফোনটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে নির্বাক আর অশ্রুভেজা নয়নে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে ঘন কালো আকাশের দিকে...


এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটে যায়।মেঘের কথা ভাবতে ভাবতে তার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়।সিন্ধান্ত নেয় সব ভুলে যাবে।কিছু সময়ের কথা ভুলে গেলে এমন কিছুই হবে না।তাই তো বার বার মেঘের কথা ভুলার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে...এর বছর খানেক পর আদিলার বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।সবার বড় সন্তানের যে কি বিশাল দায়িত্ব বহন করতে হয় সেটা আদিলা বুঝতে শুরু করে।বাস্তবতার কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়ে সে এক পর্যায়ে মেঘের কথা ভুলেই গিয়েছিলো।কিন্তু আজ এতটা বছর পর মেঘের মেসেজ পেয়ে এক নিমিষেই ফেলে আসা দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে।

মেঘের কথা ভাবতে ভাবতেই এক পর্যায়ে আদিলা ফেসবুক ওপেন করে দেখে...হুম যা ভেবেছিলো তাই...মেঘ মেসেজ দিয়েছে...

'তোমাকে ছেড়ে চলে আসার পর বুঝতে পেরেছি তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম অন্ধের মত।তাই তো হাজার বার ভুলতে চেষ্টা করেও এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি।ফেসবুকে প্রোফাইল পিকে তোমার ছবি দেখেই চিনে ফেলেছিলাম এটা তুমি ছাড়া আর কেও না।অবশেষে খুজে পেলাম তোমাকে।আর হারাতে দেবোনা।আমি জানি বিধাতা আমার জন্যই তোমাকে বানিয়েছেন।তাহলে কিভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া বল?জানি আমার উপর তোমার খুব বেশি রাগ।হয়তো অভিমানী মন নিয়ে আমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছো... সব ভুলে আমাকে ক্ষমা কর।আমাকে ফিরিয়ে দিওনা...আর কখনই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা...কথা দিলাম...কোথাও যাবো না...কোথাও না...'


মেঘের দেয়া মেসেজটা আদিলা পড়তে থাকে আর দু চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে থাকে...হয়তো সেই অশ্রু মেঘকে খুজে পাওয়ার কারনে আনন্দাশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে অথবা জমে থাকা কষ্ট কিংবা অভিমানগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিস্তার পেতে চাইছে...!!!!


উৎসর্গঃ যখন থেকে স্কুল জীবন শুরু করেছি তখন থেকেই এই মানুষটার সাথে আমার বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে একসাথে পথ চলা শুরু হয়েছে।সেই পথচলা আজ অবধি টিকে আছে।যতদিন বেঁচে থাকবো এই বন্ধত্বের বাঁধনে বাঁধা থাকবো চিরদিন।জীবনে বন্ধুর মত বন্ধু না থাকলে আসলেই জীবনটা বৃথা হয়ে যেত।এই দোস্তটা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমার অনেক বেশি উপকার করেছে।যেটা একটা বন্ধু আরেকটা বন্ধুর জন্য খুব কমই করে থাকে।যাই হোক আজ আমার সেই দোস্তের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী।কিন্তু বেচারী আজ এক দেশে আর তার জামাই আরেক দেশে।তারা যেভাবে দুজন দুজনকে পেয়েছে এই ব্যাপারটা আমার কাছে একদম গল্পের মত মনে হয়েছিল।তাইতো একদিন তারে ফাইজলামী করে বলেছিলাম 'তোদের লাইফ নিয়ে একটা গল্প লিখতে ইচ্ছা করছে...'যেই বললাম এরপর শুরু হল প্রতিদিন ফোন করে খবর নেয়া লেখা হয়েছে কিনা... আমিও নানা অজুহাত দেখিয়ে কখনও বলতাম শুরু করেছি, কখনও বলতাম অর্ধেক হয়েছে আবার কখনও বা অর্ধেকের বেশি হয়েছে।অনেক ঝামেলায় থাকায় লেখা হয়ে উঠছিলনা।কিন্তু সবচেয়ে কাছের মানূষটার জন্য একটা গল্প লিখতে পারবোনা?এটা কোন কথা?তাই এক বসায় লিখে ফেললাম আমার দোস্তের জীবনের কিছু চরম সত্য কাহিনী।

সাবস্ক্রাইব করুন:

সবশেষে একটাই কথা বলতে চাই 'দোস্ত তোরা অনেক অনেক ভালো থাকিস...আর খবরদার ভাইয়ার সাথে বেশি ঝগড়া করবিনা...ভাইয়াটা অনেক বেশি ভালোবাসে তোকে...বুঝলি???"

by Salma Ahmed
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url