দশটি টাকা ও একটি বিশেষ দিন
ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছি। মেজাজ কিঞ্চিত খারাপ। ভর দুপুর, খিদেও লেগেছে প্রচণ্ড। ভুল হয়েছে, আম্মার সাথে ঝগড়া করে বাসা থেকে বেরোবার আগে খেয়ে নেওয়া উচিৎ ছিলো। পকেটে আছে মাত্র ১০ টাকা।বেকার মানুষ, চাকরি বাকরি নাই, যখন তখন বাসায় টাকাও চাওয়া যায়না।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি, মোবাইলটাও রেখে এসেছি। ভালো হয়েছে, আজকে ফোন করে কারো আর পাওয়া লাগবে না আমাকে। এটা ভেবে একটু ভালো লাগছে। মাঝে মাঝেই ভাবি ডুব দিবো, কিন্তু হয়ে ওঠেনা। আজ একটা সুযোগ এসেছে।
অবশ্য আমি জানি, কিছুক্ষন পরেই একজন আমাকে একটা গরুখোঁজা দিবে। দিলে দিক, আমার কি?
আমি তো আর গরু না ।তাই খুঁজে পাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না ।
মোবাইল না থাকারও বিশেষ কিছু সুবিধা আছে ।অসময়ে বেজে উঠে বিব্রত হওয়ার ভয় নেই ।তার চেয়েও বড় কথা বারবার পকেট থেকে বের করে দেখার ঝামেলা নেই ,কোন ফোন এসেছিল কিনা ।শুধু একটা কথা ভেবেই খারাপ লাগছে ।আজকের এই বিশেষ দিনটাতেই এমন না হলেও মনে হয় ভাল হত ।ওর সাথে দেখা করতে ভীষণ ইচ্ছা করছে ।পকেটে ১০ টাকা নিয়ে দেখা করতেও আবার বাধছে ।প্রতিদিন তার ঘাড়ে সব খরচের ভার চাপিয়ে দিলেও কি আর আজকের দিনে দেয়া যায় ।না কিছু একটা এবার করতেই হবে ।কতদিন আর বেকার বসে থাকব ?
কি করা যায় এই গুরুগম্ভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যখন চিপা গলিটা দিয়ে হাঁটছি তখন একদল যুবক হঠাত্ বেড়িয়ে এল তাদের পেশার এডভের্টাইজমেন্ট করতে ।সবাই মিলে প্রথমে আমাকে ঘিরে ধরল । শুটকি মাছের মত চিকন চাকন দলের একজন আমার দিকে এগিয়ে এল ।চাকুটার ওজন মনে হয় বেচারার শরীরের তুলনায় একটু বেশিই হয়ে গেছে ।অনেক কষ্টে আমার দিকে সেটা উঁচু করে ধরে, বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মত গলা অপ্রয়োজনীয়ভাবে গম্ভীর করে বলল, "যা আছে দিয়া দেন ।"
এত সম্মান করে আপনি করে বলল, আমি কী আর দেরী করতে পারি? বিনা বাক্যব্যয়ে দ্রুত আমার শার্টের বোতাম খোলা শুরু করে দিলাম । শুটকি ভাইজান হৈ হৈ করে উঠলেন, "আরে আরে কি করেন?!"
আমি সবকটা দাঁত বের করে জবাব দিলাম ,"শার্ট, প্যান্ট, আণ্ডারওয়্যার আর পকেটে দশটা টাকা এই আছে আমার কাছে ।আপনি সব চাইলেন তাই. . "
ফিল্মী স্টাইলে উল্টা দিকে ক্যাপ পরা একজন এতক্ষণ কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন ।আর বারবার ভ্রু কুঞ্চিত করে মুখ থেকে বের করে আনা খালি কাঠিটাকে দেখছিলেন ।কাঠিটারই যেন সব দোষ কেন এবারও সে কিছু বের করে আনতে পারল না । বুঝতে পারলাম ইনিই পালের গোদা ।শুটকি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন ,"খোঁজ দ্য সার্চ "।
শুটকী ভাই যো হুকুম জাহাপনা টাইপ লুক দিয়ে আমার সারা শরীরে সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করলেন ।আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে ঘটনার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করলাম ।কিছুক্ষণ পরে শুটকি ভাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেন, "ওস্তাদ এনার পকেটে তো দশ টাকাটা ছাড়া আর কিছু নাই ।তাও টেপ মারা ।"
ওস্তাদ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে আর একবার লজ্জা পেলাম পকেটে মাত্র দশ টাকা নিয়ে ঘোরার জন্য ।যাই হোক ওস্তাদকে আমি এই আশ্বাস দিলাম যে পরবর্তীতে অবশ্যই বেশি টাকা রাখব ।ওস্তাদ শুটকি ভাইকে হুকুম দিলেন টাকাটা ফিরিয়ে দেবার জন্য ।আর আমাকে বললেন "ললিপপ কিন্যা খাইয়েন ।" !!
ললিপপে কি আর পেট ভরে? ওখান থেকে প্রস্থানের পর তাই একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম ।বেয়ারাকে বললাম দশ টাকার ভিতর কী হয় তা দিয়ে যেতে ।খানিক পর বেয়ারা আমার টেবিলে দু গ্লাস পানি রেখে বলল ,"শুধু এইটাই আছে দশ টাকার ভিতর ।একদম ফ্রি!"
কি আর করা? পানি খেয়ে আবার রাস্তায় নামলাম ।ওয়াসার পানির স্বাদ খুব একটা খারাপ না ।এই চিন্তা করতে করতে যখন হাঁটছি তখন পাশ থেকে কে জানি একটা হাত বাড়িয়ে দিল ।একটু পরেই একটা কন্ঠ ভেসে এল,"ভাইজান, কয়ডা ট্যাকা দেন ।সকাল থাইকা কিছু খাই নাই ।"
আমিও তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাত পেতে দিয়ে বললাম, "ভাইজান, কয়ডা ট্যাকা দেন ।সকাল থাইকা কিছু খাই নাই ।"
ভাইজান রাগত দৃষ্টিপাত করতেই আমি আমার টেপ মারা দশ টাকাটা তাকে দেখিয়ে যোগ করলাম "এটাই সকাল থেকে আমার একমাত্র সম্বল ।"
ভাইজান বলল, "ভিক্ষা করতে পারেন নাই?"
আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম "শিখায় দেন ।"
ভাইজানের হৃদয়টা খুব বড় ।বললেন, "কাপড় চোপড়ে তো মনে হয় বড় ঘরেরই আছিলেন ।এই দশা ক্যান? ঠিক আছে হিস্ট্রি পরে শুনুম নে আগে কাম বুঝায় দেই ।আমার এলাকায় আমি নতুন কাউরে ঢুকবার দেই না ।তয় আপনেরে দেইখা মায়া লাগছে তাই আমার এসিস্ট্যানট কইরা রাখুম ।"
আমি চেহারাটা আরও মায়াময় করার চেষ্টা করলাম ।দুইজনে হাঁইটা হাঁইটা ভিক্ষা করলে নাকি খারাপ দেখায় ! তাই কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলাম ভাইজান তার এসিস্ট্যান্ট নিয়া রাস্তায় বসে পড়েছেন ।এসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুবাদে ভাইজানের ক্যাশবাক্সটা দেখারও সৌভাগ্য হল ।চারশত একুশ টাকার সঞ্চয় দেখে না মেনে পারলাম না ভিক্ষা করাটা পেশা হিসেবে খারাপ না ।
ভাইজানের সুললিত কণ্ঠের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন পেরে উঠছিলাম না তখন মুখ যথাসম্ভব করুণ করে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।এতেই মনে হয় কাজ হল বেশি ।জনগণ দেখি আমার দিকে দেখে হাসতে হাসতে যাওয়ার পথে দু এক টাকা করে দিয়ে যেতে লাগলেন ।আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম ।আমার চেহারা কী দিন দিন ক্লাউনের মত হয়ে যাচ্ছে ?
এদিকে ভাইজান আয়ের ঊর্ধগতি দেখে আমার চাকরিটা পাকাও করে দিলেন ।
হঠাত্ আমার একেবারে সামনে একজোড়া হিল এসে দাঁড়াল ।আমি আস্তে আস্তে উপরের দিকে তাকালাম ।স্লো মোশনে দেখতে পেলাম কালো পায়জামা ,লাল জামা, কালো ওড়না আর তার ভেতরে থাকা সুন্দরী এক রমনীকে ।কোমরে হাত দিয়ে, ভ্রু কুঁচকে উনি আমাকে বললেন "চল, রিকশায় ওঠ"
আমি একটা ভ্যাবদা মার্কা হাসি দিয়ে সুবোধ বালকের মত তার সাথে রিকশায় উঠে পড়লাম ।আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম গুগল আমাকে খুঁজে না পেলেও এ রমনী আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে ।কারণ আমাকে একদিন না দেখে থাকাও নাকি তার পক্ষে সম্ভব নয় ।
যা হোক, রিকশায় উঠে কোন পেশাই যে ছোট নয় এ মহান কথা তাকে কিছুক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম ।বিনিময়ে ঝারি খেয়ে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই হল না ।আমি চুপ, ও চুপ ,রিকশাওয়ালা মামা চুপ ।রিকশা চলতে থাকল ।
হঠাত্ দেখি ফুটপাথের ধারে একটা ফুলের দোকান । তার পাশেই দেয়াল ঘেষে ফুটপাথে যেমনটি হয় ঠিক তেমনটি অবস্থা ।হাঁটতে হাঁটতে কেউ না কেউ দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে আর ইউরিয়া দিয়ে দেয়াল ধুয়ে দিচ্ছে ।ফুলের গন্ধ আর ঝাঁঝালো প্রস্রাবের গন্ধ যেন পাল্লা দিয়ে চলেছে কার শক্তি বেশি ।এসব দেখে আমার অনেক কিছু মনে পড়ে গেল ।আমি বলে উঠলাম,
"মামা রিকশা থামাও"
মামা রিকশা থামালেন ।
ও আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন মানুষ খুন করার মত অপরাধ করেছি ।
আমি ওকে আমার কনিষ্টাঙ্গুলি প্রদর্শন করলাম সাথে মুখটাকেও যথাসম্ভব করুণ করে তুললাম ।ও আরেকবার বিরক্তিভরা দৃষ্টি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল ।বোঝা গেল কোন কারণে খুব খেপে আছে ।
প্রকৃতি আমায় ডাক দিয়েছে আমার কি আর কারও রাগ দেখার সময় আছে ! আমি নেমে মনের সুখে দেয়াল ভেজালাম আর অন্য একখানা কাজও করলাম ।
রিকশায় ওঠার পর ও যেন আমায় আজকে প্রথমবার দেখল এমনভাবে বলল,
"কী ব্যাপার তোমার মুখ এত শুকিয়ে আছে কেন ?"
মনে মনে বললাম যাক এতক্ষণে লাইনে আসছে ।মুখে বললাম, "সকাল থেকে কিছু খাই নি তো তাই হয়তো এমন লাগছে ।"
ও আর কোন কথা না বলে রিকশাকে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড় করাল ।
খাওয়া দাওয়া শেষ ।দুজন পাশাপাশি বসে আছি চুপচাপ ।খাওয়ার সময়ও চামুচ আর প্লেটের বাড়ি লাগার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না ।বুঝতে পারছিলাম না কি এমন ভুল করলাম যে তার শাস্তি চলছে ।হঠাত্ করে সব কিছু পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল ।ও বলল, "আচ্ছা, তুমি ভুলে গেছ তাই না ?"
মনে মনে বললাম আজকের দিন কি আমি কখনও ভুলতে পারি ? চার বছর আগে আজকের এই দিনেই তো আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা পেয়েছিলাম ।তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছিলে ।দিনটা ভালভাবে উদযাপন করব বলেই তো বাবার কাছে হাজার খানেক টাকা চাইলাম ।আর বাবা ৭ ই মার্চের ভাষণ শুরু করে দিলেন ।অন্য সময় সারাদিন দুজনে ঝগরা করে অথচ তখন মা এসেও যোগ দিলেন ।বেকার বলে যেন আমার কোন শখ আহ্লাদ নেই ।
যা হোক মুখে এত কিছু বললাম না ।শুধু বললাম ,"কিসের কথা বলছ?"
দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে ।মুখটাও অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল ।পকেটে থেকে এতক্ষণ যে খোঁচা দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল এবার তাকে বেড় করে আনলাম ।ওর দিকে গোলাপটা বাড়িয়ে দিলাম হাঁটু গেড়ে ।আর বললাম, "আমার হাতটা কী ধরবে সারা জীবনের জন্য ?"
কোন কথা না বলে ও শুধু গোলাপটা হাত বাড়িয়ে নিল আর মাথাটা উপর নীচে ঝাঁকাল ।ঠোঁটে হাসি ,চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে ।কিযে সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে! পকেটে থেকে গোলাপটা যেন একটু শুকিয়ে গিয়েছিল ।ওর চোখের পানি তাকে আবার সতেজ করে তুলল।
আমি ওর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললাম,"পাগলী, আমি এই দিনটার কথা ভুলতে পারি? চার বছর আগে তোমায় এভাবেই চেয়েছিলাম, আজও চাইলাম ।যতদিন বেঁচে থাকি এভাবে চেয়ে যাব ।আমি যে চিরকাল তোমার ভালবাসার কাঙ্গাল থেকে যাব ।"
ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখল ।প্রায় ফিসফিস করে বলল, "আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি,সারা জীবন বাসব ।"
বুঝতে পারলাম উষ্ণ চোখের জল আমার শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে ।
না মানতেই হবে দশ টাকার মূল্য কম না ।দশ টাকায় এখনো একটা গোলাপ পাওয়া যায় ।আর একটা গোলাপ দিয়ে কেনা যায় এক পৃথিবী ভালবাসা . . . .
সাবস্ক্রাইব করুন:
By-Mahmudul Hasan
পকেটে হাত দিয়ে দেখি, মোবাইলটাও রেখে এসেছি। ভালো হয়েছে, আজকে ফোন করে কারো আর পাওয়া লাগবে না আমাকে। এটা ভেবে একটু ভালো লাগছে। মাঝে মাঝেই ভাবি ডুব দিবো, কিন্তু হয়ে ওঠেনা। আজ একটা সুযোগ এসেছে।
অবশ্য আমি জানি, কিছুক্ষন পরেই একজন আমাকে একটা গরুখোঁজা দিবে। দিলে দিক, আমার কি?
আমি তো আর গরু না ।তাই খুঁজে পাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না ।
মোবাইল না থাকারও বিশেষ কিছু সুবিধা আছে ।অসময়ে বেজে উঠে বিব্রত হওয়ার ভয় নেই ।তার চেয়েও বড় কথা বারবার পকেট থেকে বের করে দেখার ঝামেলা নেই ,কোন ফোন এসেছিল কিনা ।শুধু একটা কথা ভেবেই খারাপ লাগছে ।আজকের এই বিশেষ দিনটাতেই এমন না হলেও মনে হয় ভাল হত ।ওর সাথে দেখা করতে ভীষণ ইচ্ছা করছে ।পকেটে ১০ টাকা নিয়ে দেখা করতেও আবার বাধছে ।প্রতিদিন তার ঘাড়ে সব খরচের ভার চাপিয়ে দিলেও কি আর আজকের দিনে দেয়া যায় ।না কিছু একটা এবার করতেই হবে ।কতদিন আর বেকার বসে থাকব ?
কি করা যায় এই গুরুগম্ভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যখন চিপা গলিটা দিয়ে হাঁটছি তখন একদল যুবক হঠাত্ বেড়িয়ে এল তাদের পেশার এডভের্টাইজমেন্ট করতে ।সবাই মিলে প্রথমে আমাকে ঘিরে ধরল । শুটকি মাছের মত চিকন চাকন দলের একজন আমার দিকে এগিয়ে এল ।চাকুটার ওজন মনে হয় বেচারার শরীরের তুলনায় একটু বেশিই হয়ে গেছে ।অনেক কষ্টে আমার দিকে সেটা উঁচু করে ধরে, বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মত গলা অপ্রয়োজনীয়ভাবে গম্ভীর করে বলল, "যা আছে দিয়া দেন ।"
এত সম্মান করে আপনি করে বলল, আমি কী আর দেরী করতে পারি? বিনা বাক্যব্যয়ে দ্রুত আমার শার্টের বোতাম খোলা শুরু করে দিলাম । শুটকি ভাইজান হৈ হৈ করে উঠলেন, "আরে আরে কি করেন?!"
আমি সবকটা দাঁত বের করে জবাব দিলাম ,"শার্ট, প্যান্ট, আণ্ডারওয়্যার আর পকেটে দশটা টাকা এই আছে আমার কাছে ।আপনি সব চাইলেন তাই. . "
ফিল্মী স্টাইলে উল্টা দিকে ক্যাপ পরা একজন এতক্ষণ কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন ।আর বারবার ভ্রু কুঞ্চিত করে মুখ থেকে বের করে আনা খালি কাঠিটাকে দেখছিলেন ।কাঠিটারই যেন সব দোষ কেন এবারও সে কিছু বের করে আনতে পারল না । বুঝতে পারলাম ইনিই পালের গোদা ।শুটকি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন ,"খোঁজ দ্য সার্চ "।
শুটকী ভাই যো হুকুম জাহাপনা টাইপ লুক দিয়ে আমার সারা শরীরে সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করলেন ।আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে ঘটনার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করলাম ।কিছুক্ষণ পরে শুটকি ভাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেন, "ওস্তাদ এনার পকেটে তো দশ টাকাটা ছাড়া আর কিছু নাই ।তাও টেপ মারা ।"
ওস্তাদ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে আর একবার লজ্জা পেলাম পকেটে মাত্র দশ টাকা নিয়ে ঘোরার জন্য ।যাই হোক ওস্তাদকে আমি এই আশ্বাস দিলাম যে পরবর্তীতে অবশ্যই বেশি টাকা রাখব ।ওস্তাদ শুটকি ভাইকে হুকুম দিলেন টাকাটা ফিরিয়ে দেবার জন্য ।আর আমাকে বললেন "ললিপপ কিন্যা খাইয়েন ।" !!
ললিপপে কি আর পেট ভরে? ওখান থেকে প্রস্থানের পর তাই একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম ।বেয়ারাকে বললাম দশ টাকার ভিতর কী হয় তা দিয়ে যেতে ।খানিক পর বেয়ারা আমার টেবিলে দু গ্লাস পানি রেখে বলল ,"শুধু এইটাই আছে দশ টাকার ভিতর ।একদম ফ্রি!"
কি আর করা? পানি খেয়ে আবার রাস্তায় নামলাম ।ওয়াসার পানির স্বাদ খুব একটা খারাপ না ।এই চিন্তা করতে করতে যখন হাঁটছি তখন পাশ থেকে কে জানি একটা হাত বাড়িয়ে দিল ।একটু পরেই একটা কন্ঠ ভেসে এল,"ভাইজান, কয়ডা ট্যাকা দেন ।সকাল থাইকা কিছু খাই নাই ।"
আমিও তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাত পেতে দিয়ে বললাম, "ভাইজান, কয়ডা ট্যাকা দেন ।সকাল থাইকা কিছু খাই নাই ।"
ভাইজান রাগত দৃষ্টিপাত করতেই আমি আমার টেপ মারা দশ টাকাটা তাকে দেখিয়ে যোগ করলাম "এটাই সকাল থেকে আমার একমাত্র সম্বল ।"
ভাইজান বলল, "ভিক্ষা করতে পারেন নাই?"
আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম "শিখায় দেন ।"
ভাইজানের হৃদয়টা খুব বড় ।বললেন, "কাপড় চোপড়ে তো মনে হয় বড় ঘরেরই আছিলেন ।এই দশা ক্যান? ঠিক আছে হিস্ট্রি পরে শুনুম নে আগে কাম বুঝায় দেই ।আমার এলাকায় আমি নতুন কাউরে ঢুকবার দেই না ।তয় আপনেরে দেইখা মায়া লাগছে তাই আমার এসিস্ট্যানট কইরা রাখুম ।"
আমি চেহারাটা আরও মায়াময় করার চেষ্টা করলাম ।দুইজনে হাঁইটা হাঁইটা ভিক্ষা করলে নাকি খারাপ দেখায় ! তাই কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলাম ভাইজান তার এসিস্ট্যান্ট নিয়া রাস্তায় বসে পড়েছেন ।এসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুবাদে ভাইজানের ক্যাশবাক্সটা দেখারও সৌভাগ্য হল ।চারশত একুশ টাকার সঞ্চয় দেখে না মেনে পারলাম না ভিক্ষা করাটা পেশা হিসেবে খারাপ না ।
ভাইজানের সুললিত কণ্ঠের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন পেরে উঠছিলাম না তখন মুখ যথাসম্ভব করুণ করে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।এতেই মনে হয় কাজ হল বেশি ।জনগণ দেখি আমার দিকে দেখে হাসতে হাসতে যাওয়ার পথে দু এক টাকা করে দিয়ে যেতে লাগলেন ।আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম ।আমার চেহারা কী দিন দিন ক্লাউনের মত হয়ে যাচ্ছে ?
এদিকে ভাইজান আয়ের ঊর্ধগতি দেখে আমার চাকরিটা পাকাও করে দিলেন ।
হঠাত্ আমার একেবারে সামনে একজোড়া হিল এসে দাঁড়াল ।আমি আস্তে আস্তে উপরের দিকে তাকালাম ।স্লো মোশনে দেখতে পেলাম কালো পায়জামা ,লাল জামা, কালো ওড়না আর তার ভেতরে থাকা সুন্দরী এক রমনীকে ।কোমরে হাত দিয়ে, ভ্রু কুঁচকে উনি আমাকে বললেন "চল, রিকশায় ওঠ"
আমি একটা ভ্যাবদা মার্কা হাসি দিয়ে সুবোধ বালকের মত তার সাথে রিকশায় উঠে পড়লাম ।আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম গুগল আমাকে খুঁজে না পেলেও এ রমনী আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে ।কারণ আমাকে একদিন না দেখে থাকাও নাকি তার পক্ষে সম্ভব নয় ।
যা হোক, রিকশায় উঠে কোন পেশাই যে ছোট নয় এ মহান কথা তাকে কিছুক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম ।বিনিময়ে ঝারি খেয়ে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই হল না ।আমি চুপ, ও চুপ ,রিকশাওয়ালা মামা চুপ ।রিকশা চলতে থাকল ।
হঠাত্ দেখি ফুটপাথের ধারে একটা ফুলের দোকান । তার পাশেই দেয়াল ঘেষে ফুটপাথে যেমনটি হয় ঠিক তেমনটি অবস্থা ।হাঁটতে হাঁটতে কেউ না কেউ দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে আর ইউরিয়া দিয়ে দেয়াল ধুয়ে দিচ্ছে ।ফুলের গন্ধ আর ঝাঁঝালো প্রস্রাবের গন্ধ যেন পাল্লা দিয়ে চলেছে কার শক্তি বেশি ।এসব দেখে আমার অনেক কিছু মনে পড়ে গেল ।আমি বলে উঠলাম,
"মামা রিকশা থামাও"
মামা রিকশা থামালেন ।
ও আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন মানুষ খুন করার মত অপরাধ করেছি ।
আমি ওকে আমার কনিষ্টাঙ্গুলি প্রদর্শন করলাম সাথে মুখটাকেও যথাসম্ভব করুণ করে তুললাম ।ও আরেকবার বিরক্তিভরা দৃষ্টি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল ।বোঝা গেল কোন কারণে খুব খেপে আছে ।
প্রকৃতি আমায় ডাক দিয়েছে আমার কি আর কারও রাগ দেখার সময় আছে ! আমি নেমে মনের সুখে দেয়াল ভেজালাম আর অন্য একখানা কাজও করলাম ।
রিকশায় ওঠার পর ও যেন আমায় আজকে প্রথমবার দেখল এমনভাবে বলল,
"কী ব্যাপার তোমার মুখ এত শুকিয়ে আছে কেন ?"
মনে মনে বললাম যাক এতক্ষণে লাইনে আসছে ।মুখে বললাম, "সকাল থেকে কিছু খাই নি তো তাই হয়তো এমন লাগছে ।"
ও আর কোন কথা না বলে রিকশাকে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড় করাল ।
খাওয়া দাওয়া শেষ ।দুজন পাশাপাশি বসে আছি চুপচাপ ।খাওয়ার সময়ও চামুচ আর প্লেটের বাড়ি লাগার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না ।বুঝতে পারছিলাম না কি এমন ভুল করলাম যে তার শাস্তি চলছে ।হঠাত্ করে সব কিছু পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল ।ও বলল, "আচ্ছা, তুমি ভুলে গেছ তাই না ?"
মনে মনে বললাম আজকের দিন কি আমি কখনও ভুলতে পারি ? চার বছর আগে আজকের এই দিনেই তো আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা পেয়েছিলাম ।তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছিলে ।দিনটা ভালভাবে উদযাপন করব বলেই তো বাবার কাছে হাজার খানেক টাকা চাইলাম ।আর বাবা ৭ ই মার্চের ভাষণ শুরু করে দিলেন ।অন্য সময় সারাদিন দুজনে ঝগরা করে অথচ তখন মা এসেও যোগ দিলেন ।বেকার বলে যেন আমার কোন শখ আহ্লাদ নেই ।
যা হোক মুখে এত কিছু বললাম না ।শুধু বললাম ,"কিসের কথা বলছ?"
দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে ।মুখটাও অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল ।পকেটে থেকে এতক্ষণ যে খোঁচা দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল এবার তাকে বেড় করে আনলাম ।ওর দিকে গোলাপটা বাড়িয়ে দিলাম হাঁটু গেড়ে ।আর বললাম, "আমার হাতটা কী ধরবে সারা জীবনের জন্য ?"
কোন কথা না বলে ও শুধু গোলাপটা হাত বাড়িয়ে নিল আর মাথাটা উপর নীচে ঝাঁকাল ।ঠোঁটে হাসি ,চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে ।কিযে সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে! পকেটে থেকে গোলাপটা যেন একটু শুকিয়ে গিয়েছিল ।ওর চোখের পানি তাকে আবার সতেজ করে তুলল।
আমি ওর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললাম,"পাগলী, আমি এই দিনটার কথা ভুলতে পারি? চার বছর আগে তোমায় এভাবেই চেয়েছিলাম, আজও চাইলাম ।যতদিন বেঁচে থাকি এভাবে চেয়ে যাব ।আমি যে চিরকাল তোমার ভালবাসার কাঙ্গাল থেকে যাব ।"
ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখল ।প্রায় ফিসফিস করে বলল, "আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি,সারা জীবন বাসব ।"
বুঝতে পারলাম উষ্ণ চোখের জল আমার শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে ।
না মানতেই হবে দশ টাকার মূল্য কম না ।দশ টাকায় এখনো একটা গোলাপ পাওয়া যায় ।আর একটা গোলাপ দিয়ে কেনা যায় এক পৃথিবী ভালবাসা . . . .
সাবস্ক্রাইব করুন: