গল্পঃ তৃপ্তি (সত্য ঘটনার ভিত্তিতে)
অনেকক্ষন ধরে স্নিগ্ধার জন্য অপেক্ষা করছে রাব্বি,ভার্সিটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না,প্রত্যেকটা দিন সে দেরি করবেই ,সেটা দশ মিনিট হোক অথবা আধা ঘন্টাই হোক। রাসেল রাগে গজগজ করছে। এর মধ্যে আরেকবার কলেজ বাস এসেছে ছাত্রছাত্রীদের নিতে।রাব্বীর আরেক ক্লোজ ফ্রেন রাসেল রাব্বীকে বললঃ
-ঐ ব্যাটা চলতো ,ঐ ঢংগীর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নাই। ওনার সাজুগুজু করতেই একঘন্টা লাগে আর আমরা স্যারের ফাও গ্যাজানী শুনি.....
রাব্বী রাসেলের দিকে একবার মুখ তুলে তাকালো। হঠাত্ করেই চুপ হয়ে গেলো রাসেল। নাহ ,রাসেলের কথাগুলো সম্পূর্ন ভুল। স্নিগ্ধার জীবনটা ওদের মত এতোটা রঙ্গিন নয় ,অনেকটা সাদাকালো ফ্রেমে বাধানো ঝাপসা ,ধুসর ওর পৃথিবীটা।
স্নিগ্ধা এসে পরেছে।
রাব্বী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলঃ
--কিরে এতো দেরি করলি কেন ,দশ মিনিট আগে বাস ছেড়ে গেলো ,আরেকটু আগে আসলে তো পারতি !!
--ধুরর , টিউশনি থেকে বাসায় আসতেই একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। পথে একটু কাজ ছিল..
--এহেম ,মিনিট দশেকের ডেটিং কারো সাথে ??
ভেংচি কাটল স্নিগ্ধা
--থাকতেও পারে ! তোকে বলব কেন ??
আবার বাস এসেছে ,ওরা তাড়াহুড়া করে বাসে উঠতে গিয়ে স্নিগ্ধা পা পিছলে পরে যাচ্ছিল,রাব্বী ধরে ফেলল।
স্নিগ্ধাকে টেনেটুনে বাসে উঠিয়ে এক ঝাড়ি মারল রাব্বী।
-তোরে দিয়ে কি হবে বলতো ?? এখনি তো মরতে ধরছিলি !
স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বললঃ
-পরলে সমস্যা কি ?? সব ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা ভাল ।
-তোর ভেতরের ওনার কি হবে ??
এবার স্নিগ্ধা চুপচাপ হয়ে গেলো । রাব্বীও আর কথা বাড়ালো না। স্নিগ্ধাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে নিজেই ওর পাশে বসল।
[২]
বাস থেকে নেমে প্রথমে রাব্বী যা দেখল সত্যিই তা সে আশা করেনি। অমৃতা রূঢ় মূর্তি ধারন করে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা পাশ থেকে খোঁচা মারল রাব্বীকে
-যাহ,তুই তোর রানীকে সামলা । আমি ক্লাসে গেলাম,তোর ফার্স্ট ক্লাস করা লাগবে না।
-তুই আবার ঘোড়ার মত হাটিস না,আস্তে আস্তে হেটে ক্লাসে যা
স্নিগ্ধা ক্লাসে যাওয়ার পর রাব্বী কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অমৃতার দিকে এগিয়ে গেলো ।
-কি হয়েছে ?? ক্লাসে যাস না কেন??
-হয়েছে তো অনেক কিছু !! আপনি আগে চিপায় চলেন ।
-এতো টাইম নাই ,ক্লাসে যাব । তাড়াতাড়ি বল
অমৃতা গম্ভীর একটা রূপ ধারন করল। স্নিগ্ধাকে নিয়ে কিছু কথা আছে। স্নিগ্ধার কথা বললেই রাব্বী শান্ত হয়ে যায় । মাঠের একপাশে সবুজ ঘাসের চাদরের উপর বসল ওরা।
-কি বলবি বল !
-ওর অবস্থা কেমন এখন ??
জানিনা ,কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব । দোয়া কর যাতে কোন সমস্যা না ধরা পরে ।
অমৃতা রাব্বীর হাতটা নিজের কোলে উপর টেনে নিলো। খুব বেশি খারাপ লাগে অমৃতার। আজকে হয়ত স্নিগ্ধার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। এইতো মাস ছয়েক আগের কথা । তখন ওরা তিনজন তুখর বন্ধু। হঠাত্ করেই স্নিগ্ধার বিয়ের প্রস্তাব আসল। ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরী করে ,মিশনে যাবার আগে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাঁটাতে । বাবা মা তখনই ছেলেকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন । মা মরা মেয়ের দরিদ্র পিতা এমন ভাল ছেলে হাত ছাড়া করতে চান নি ।
খুব ধুমধাম করে বিয়েটা হয়েছিল। শশুড়বাড়িতে থেকেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধা। জীবনে পরম সুখ বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তখন পরম সুখেই ছিল স্নিগ্ধা। কিন্তু সৌভাগ্যের দিন স্থায়ী হয় না ।
একদিন টিভির নিচে বড় করে শিরোনাম আসল "জঙ্গীদের গুলিতে নিহত জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশী সাত সেনাবাহিনী কর্মকর্তা"...বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল মাসুদুর রহমান রাকিবের নামটাও।
সেদিন প্রচন্ড কেঁদেছিল স্নিগ্ধা।পৃথিবীটাও সেদিন নিঃস্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিল। সেই ধাক্কায় জীবনটা পাল্টে গিয়েছে স্নিগ্ধার।
কিছুদিন পর স্নিগ্ধা বুঝতে পারে ওর ভেতরে জন্ম নিয়েছে আরেকটি সত্বা , কিন্তু এই খুশির সংবাদটা অনেকটা দুঃসংবাদ মনে হয় স্নিগ্ধার জন্য। শাশুড়ীর অবজ্ঞা আর হাড় ভাঙা খাটুনি অসহ্য হয়ে ওঠে ওর কাছে । শশুড়বাড়ি থেকে চলে আসার পর জীবনটা অনেক জটিল হয়ে উঠছিল কিন্তু সেই জটিলতার স্বীকার হতে হয়নি শুধুমাত্র রাব্বীর কারনে । ওকে দুটো টিউশনি ঠিক করে দিয়েছে রাব্বী ।রাব্বী আর অমৃতা না থাকলে আজ হয়ত স্নিগ্ধার বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়াতো।
-চল ক্লাসে যাই
অমৃতার কথায় নিরবতা ভাঙল ওদের। রাব্বী চোখ মুছে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো ।
[৩]
তিনমাস পর.....
স্নিগ্ধার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে ,ছাড়তে হয়েছে টিউশনি । এসব রাব্বী আর অমৃতার পাগলামী । ওদের ভাষ্যমতে আগামী ছয় মাস ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাসা থেকে এক পা বাহিরে ফেলা যাবে না । অমৃতা বইপত্র নিয়ে স্নিগ্ধার কাছে চলে এসেছে ।
ডাক্তার বলেছেন স্নিগ্ধার অবস্থা যতটুকু ভাল হওয়া দরকার তারচেয়ে বেশি আশংকাজনক। রাব্বী ওর টিউশনির টাকা সম্পূর্নটাই স্নিগ্ধার পেছনে খরচ করে..নিজে আট কিলোমিটার পায়ে হেটে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করে ,বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায় ফলে বাবা মায়ের কাছ থেকে ওকে শুনতে হয় অখাদ্য বকাবকি । এতে কষ্ট হয় না ওর ,বন্ধুর মুখের একটু হাসির জন্য এটুকু কষ্ট করা ব্যাপার না ।
স্নিগ্ধাকে কোন কাজ করতে দেয়না অমৃতা । নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দেয় । ও রাতে না ঘুমানো পর্যন্ত জেগে থাকে । স্নিগ্ধাকে বাচ্চা শিশুর মত দেখাশুনা করে ওরা।
[৪]
-আপেল খাবি ?
-না ইচ্ছে করছে না
-খাবি না কেন ?? খেতে হবে।
-তোরা কি আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছস !!
-তুই মর ,আমি খালা হইতে পারলেই হবে । তোরে দরকার নেই ।
-যদি সত্যি মরে যাই !!
স্নিগ্ধার করুন চাহুনিতে অমৃতা কিছুটা থমকে যায় ।
ধুর্পাগলি তোর কিছু হবে না । আমরা আছিতো । তুই ভয় পাস না।
স্নিগ্ধাকে অভয় দিলেও অমৃতার মনের ভেতর একটা ভয় থেকে যায়। স্নিগ্ধার কিছু একটা হয়ে গে+লে অমৃতার বেচে থাকাটা অর্থহীন মনে হবে। এই বান্ধবীটাকে যে কোন মূল্যে হারাতে চায় না অমৃতা। অন্যদিকে যদি বাচ্চাটার কোন সমস্যা হয়!! তাহলে স্নিগ্ধাকে বাচানো অসম্ভব হয়ে যাবে । রাব্বি কত খেলনা কিনে রেখেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। স্নিগ্ধা আর অনাগত বাবুটাকে ঘিরে ওদের
অনেকগুলো ছোট ছোট স্বপ্ন জমা হয়েছে ।স্বপ্নগুলো বাস্তব অথবা অবস্তাবতায় রূপ নিতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি ।
[৫]
স্নিগ্ধার ডেলিভারীর মাসখানেক বাকি। ডাক্তার আগে থেকে জানিয়ে রেখেছেন অপারেশন করতে হবে । হাজার বিশেক টাকা তো লাগবেই...কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবে !! রাব্বীর মাথা ঘুরতে লাগল। অমৃতার কাছে উপায় জানতে চাইলে অমৃতাও কিছু বলতে পারল না। তবে কি অনাদরেই ওদের স্বপ্ন লুটিয়ে পরবে !!!
হাতে আছে সেকেন্ড ইয়ারে এডমিশনের জন্য জমানো ১১ হাজার পাচশ টাকা। অমৃতাকে রাত দুটো বাজে ফোন করল রাব্বি ।
-এতো রাতে ফোন দিলি যে ??
-স্নিগ্ধা ঘুমিয়েছে ??
সাবস্ক্রাইব করুন:
-হুম
-একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ,পারবি ?? বন্ধুর জন্য জীবন থেকে একটা বছর পিছিয়ে পরতে হবে..পারবি ??
-হেয়ালি করিস না ,সোজাসুজি বল
-একটা ইয়ার গ্যাপ দিতে হবে,আমাদের ভর্তির টাকা দিয়ে স্নিগ্ধার অপারেশন করাবো । আর কোন পথ খোলা নেই
-তোর মাথা ঠিকাছে তো !!
-ঠিক না থাকার কিছু নেই ,পারবি কিনা বল ?? স্নিগ্ধাকে ব্যাপারটা জানানো যাবে না..
অমৃতার গলা জরিয়ে আসে । চাপা স্বরে শুধু বলে..
-টাকাটা সকালে স্নিগ্ধা ঘুম থেকে ওঠার আগে নিয়ে যাস!
অমৃতা ফোনটা রেখে দিলো । স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে আছে ,ওর চেহারায় কেমন একটা মা মা ছাপ পরে গেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে,ওর কপালে একটা চুমু খেল অমৃতা। স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো ।
-কাঁদছিস কেন অমৃ ??
-নারে ,এমনি । তুই ঘুমা
ভয় পাস না ,তোরা থাকতে আমার কিছু হবে না।
স্নিগ্ধাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল অমৃতা। যেন কিছুতেই হারাতে দেবে না স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা বাচ্চা মেয়ের মত চুপটি করে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে ।
[৬]
অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারী করছে অমৃতা আর রাব্বি । কি হবে ,কি হবে !! বিধাতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া ওদের আর কিছুই করা নেই। অমৃতা বারবার কান্নায় ভেঙে পরছিল । ডাক্তার শেষ মুহুর্তেও নিশ্চয়তা দিয়ে কি বলেন নি ।
হঠাত্ করে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খোলার শব্দ !! বুকের কম্পন বন্ধ হয়ে এলো ওদের !!
নার্সের মুখে মুচকি হাসি !!
[৭]
অমৃতা বললঃ
-দেখছিস একদম আমার মত হয়েছে
-তুইতো পেত্নী আর ওতো হয়ে পরী ,স্নিগ্ধার মত হয়েছে মুখটা আর হাত পা গুলা আমার মত । তোর কিছুই পায়নি..
রাব্বী হো হো করে হেসে উঠল,স্নিগ্ধাও মিষ্টি করে একটা হাসি দিল ।
-আচ্ছা স্নিগ্ধা তুই বল কেমন হয়েছে দেখতে ?? আমার মত সুইট না ??
স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বললঃ
-ওতো তোদেরই মেয়ে । তোদের মতই হয়েছে । তা এখন মেয়ের নাম রাখবি না ??
-ওর নাম হবে টুকি
বলল রাব্বি
-টুকি পচা নাম ,ওর নাম হবে জেসমিন
প্রতিবাদ করল অমৃতা
-ধুর ,জেসমিন বুড়ির নাম ।
-তাইলে সালমা ??
-এটা খালা খালা লাগে
-সাদিয়া ??
-হুর ,এইটা ফুপ্পি ফুপ্পি লাগে
-সুষমা ??
-তোর কোন পছন্দ আছে ?? এইটাতো জেঠী জেঠী লাগে
রাব্বি চটে গেলো..
-বুঝিতো আমার কোন কিছু আপনার পছন্দ হবে না । স্নিগ্ধা তুই বলতো একটা নাম....
-তৃপ্তি
আনমনেই বলে উঠল স্নিগ্ধা। রাব্বি আর অমৃতার নিরবতাই বলে দিল ওদের কোন আপত্তি নেই।
তৃপ্তিকে ওর মায়ের কোলে তুলে দিল অমৃতা । স্নিগ্ধার মুখে তৃপ্তির হাসি । সব কষ্ট ভুলে যায় রাব্বি ,অমৃতাও ভুলে যায় রাতের পর রাত স্নিগ্ধার মাথার পাশে বসে কাঁটানোর কষ্ট । ওরাতো এতটুকুই চেয়েছিল ,ওদের প্রিয় বন্ধুটার মুখে একটু খানি তৃপ্তির হাসি ।
বন্ধুত্ব অমর হয়ে থাক ।
অন্তরে অন্তঃস্থল থেকে ভালবাসা জানাই সকল বন্ধুদের ।
সাবস্ক্রাইব করুন:
By Bbc Sukh Tara
-ঐ ব্যাটা চলতো ,ঐ ঢংগীর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নাই। ওনার সাজুগুজু করতেই একঘন্টা লাগে আর আমরা স্যারের ফাও গ্যাজানী শুনি.....
রাব্বী রাসেলের দিকে একবার মুখ তুলে তাকালো। হঠাত্ করেই চুপ হয়ে গেলো রাসেল। নাহ ,রাসেলের কথাগুলো সম্পূর্ন ভুল। স্নিগ্ধার জীবনটা ওদের মত এতোটা রঙ্গিন নয় ,অনেকটা সাদাকালো ফ্রেমে বাধানো ঝাপসা ,ধুসর ওর পৃথিবীটা।
স্নিগ্ধা এসে পরেছে।
রাব্বী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলঃ
--কিরে এতো দেরি করলি কেন ,দশ মিনিট আগে বাস ছেড়ে গেলো ,আরেকটু আগে আসলে তো পারতি !!
--ধুরর , টিউশনি থেকে বাসায় আসতেই একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। পথে একটু কাজ ছিল..
--এহেম ,মিনিট দশেকের ডেটিং কারো সাথে ??
ভেংচি কাটল স্নিগ্ধা
--থাকতেও পারে ! তোকে বলব কেন ??
আবার বাস এসেছে ,ওরা তাড়াহুড়া করে বাসে উঠতে গিয়ে স্নিগ্ধা পা পিছলে পরে যাচ্ছিল,রাব্বী ধরে ফেলল।
স্নিগ্ধাকে টেনেটুনে বাসে উঠিয়ে এক ঝাড়ি মারল রাব্বী।
-তোরে দিয়ে কি হবে বলতো ?? এখনি তো মরতে ধরছিলি !
স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বললঃ
-পরলে সমস্যা কি ?? সব ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা ভাল ।
-তোর ভেতরের ওনার কি হবে ??
এবার স্নিগ্ধা চুপচাপ হয়ে গেলো । রাব্বীও আর কথা বাড়ালো না। স্নিগ্ধাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে নিজেই ওর পাশে বসল।
[২]
বাস থেকে নেমে প্রথমে রাব্বী যা দেখল সত্যিই তা সে আশা করেনি। অমৃতা রূঢ় মূর্তি ধারন করে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা পাশ থেকে খোঁচা মারল রাব্বীকে
-যাহ,তুই তোর রানীকে সামলা । আমি ক্লাসে গেলাম,তোর ফার্স্ট ক্লাস করা লাগবে না।
-তুই আবার ঘোড়ার মত হাটিস না,আস্তে আস্তে হেটে ক্লাসে যা
স্নিগ্ধা ক্লাসে যাওয়ার পর রাব্বী কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অমৃতার দিকে এগিয়ে গেলো ।
-কি হয়েছে ?? ক্লাসে যাস না কেন??
-হয়েছে তো অনেক কিছু !! আপনি আগে চিপায় চলেন ।
-এতো টাইম নাই ,ক্লাসে যাব । তাড়াতাড়ি বল
অমৃতা গম্ভীর একটা রূপ ধারন করল। স্নিগ্ধাকে নিয়ে কিছু কথা আছে। স্নিগ্ধার কথা বললেই রাব্বী শান্ত হয়ে যায় । মাঠের একপাশে সবুজ ঘাসের চাদরের উপর বসল ওরা।
-কি বলবি বল !
-ওর অবস্থা কেমন এখন ??
জানিনা ,কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব । দোয়া কর যাতে কোন সমস্যা না ধরা পরে ।
অমৃতা রাব্বীর হাতটা নিজের কোলে উপর টেনে নিলো। খুব বেশি খারাপ লাগে অমৃতার। আজকে হয়ত স্নিগ্ধার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। এইতো মাস ছয়েক আগের কথা । তখন ওরা তিনজন তুখর বন্ধু। হঠাত্ করেই স্নিগ্ধার বিয়ের প্রস্তাব আসল। ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরী করে ,মিশনে যাবার আগে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাঁটাতে । বাবা মা তখনই ছেলেকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন । মা মরা মেয়ের দরিদ্র পিতা এমন ভাল ছেলে হাত ছাড়া করতে চান নি ।
খুব ধুমধাম করে বিয়েটা হয়েছিল। শশুড়বাড়িতে থেকেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধা। জীবনে পরম সুখ বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তখন পরম সুখেই ছিল স্নিগ্ধা। কিন্তু সৌভাগ্যের দিন স্থায়ী হয় না ।
একদিন টিভির নিচে বড় করে শিরোনাম আসল "জঙ্গীদের গুলিতে নিহত জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশী সাত সেনাবাহিনী কর্মকর্তা"...বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল মাসুদুর রহমান রাকিবের নামটাও।
সেদিন প্রচন্ড কেঁদেছিল স্নিগ্ধা।পৃথিবীটাও সেদিন নিঃস্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিল। সেই ধাক্কায় জীবনটা পাল্টে গিয়েছে স্নিগ্ধার।
কিছুদিন পর স্নিগ্ধা বুঝতে পারে ওর ভেতরে জন্ম নিয়েছে আরেকটি সত্বা , কিন্তু এই খুশির সংবাদটা অনেকটা দুঃসংবাদ মনে হয় স্নিগ্ধার জন্য। শাশুড়ীর অবজ্ঞা আর হাড় ভাঙা খাটুনি অসহ্য হয়ে ওঠে ওর কাছে । শশুড়বাড়ি থেকে চলে আসার পর জীবনটা অনেক জটিল হয়ে উঠছিল কিন্তু সেই জটিলতার স্বীকার হতে হয়নি শুধুমাত্র রাব্বীর কারনে । ওকে দুটো টিউশনি ঠিক করে দিয়েছে রাব্বী ।রাব্বী আর অমৃতা না থাকলে আজ হয়ত স্নিগ্ধার বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়াতো।
-চল ক্লাসে যাই
অমৃতার কথায় নিরবতা ভাঙল ওদের। রাব্বী চোখ মুছে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো ।
[৩]
তিনমাস পর.....
স্নিগ্ধার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে ,ছাড়তে হয়েছে টিউশনি । এসব রাব্বী আর অমৃতার পাগলামী । ওদের ভাষ্যমতে আগামী ছয় মাস ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাসা থেকে এক পা বাহিরে ফেলা যাবে না । অমৃতা বইপত্র নিয়ে স্নিগ্ধার কাছে চলে এসেছে ।
ডাক্তার বলেছেন স্নিগ্ধার অবস্থা যতটুকু ভাল হওয়া দরকার তারচেয়ে বেশি আশংকাজনক। রাব্বী ওর টিউশনির টাকা সম্পূর্নটাই স্নিগ্ধার পেছনে খরচ করে..নিজে আট কিলোমিটার পায়ে হেটে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করে ,বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায় ফলে বাবা মায়ের কাছ থেকে ওকে শুনতে হয় অখাদ্য বকাবকি । এতে কষ্ট হয় না ওর ,বন্ধুর মুখের একটু হাসির জন্য এটুকু কষ্ট করা ব্যাপার না ।
স্নিগ্ধাকে কোন কাজ করতে দেয়না অমৃতা । নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দেয় । ও রাতে না ঘুমানো পর্যন্ত জেগে থাকে । স্নিগ্ধাকে বাচ্চা শিশুর মত দেখাশুনা করে ওরা।
[৪]
-আপেল খাবি ?
-না ইচ্ছে করছে না
-খাবি না কেন ?? খেতে হবে।
-তোরা কি আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছস !!
-তুই মর ,আমি খালা হইতে পারলেই হবে । তোরে দরকার নেই ।
-যদি সত্যি মরে যাই !!
স্নিগ্ধার করুন চাহুনিতে অমৃতা কিছুটা থমকে যায় ।
ধুর্পাগলি তোর কিছু হবে না । আমরা আছিতো । তুই ভয় পাস না।
স্নিগ্ধাকে অভয় দিলেও অমৃতার মনের ভেতর একটা ভয় থেকে যায়। স্নিগ্ধার কিছু একটা হয়ে গে+লে অমৃতার বেচে থাকাটা অর্থহীন মনে হবে। এই বান্ধবীটাকে যে কোন মূল্যে হারাতে চায় না অমৃতা। অন্যদিকে যদি বাচ্চাটার কোন সমস্যা হয়!! তাহলে স্নিগ্ধাকে বাচানো অসম্ভব হয়ে যাবে । রাব্বি কত খেলনা কিনে রেখেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। স্নিগ্ধা আর অনাগত বাবুটাকে ঘিরে ওদের
অনেকগুলো ছোট ছোট স্বপ্ন জমা হয়েছে ।স্বপ্নগুলো বাস্তব অথবা অবস্তাবতায় রূপ নিতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি ।
[৫]
স্নিগ্ধার ডেলিভারীর মাসখানেক বাকি। ডাক্তার আগে থেকে জানিয়ে রেখেছেন অপারেশন করতে হবে । হাজার বিশেক টাকা তো লাগবেই...কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবে !! রাব্বীর মাথা ঘুরতে লাগল। অমৃতার কাছে উপায় জানতে চাইলে অমৃতাও কিছু বলতে পারল না। তবে কি অনাদরেই ওদের স্বপ্ন লুটিয়ে পরবে !!!
হাতে আছে সেকেন্ড ইয়ারে এডমিশনের জন্য জমানো ১১ হাজার পাচশ টাকা। অমৃতাকে রাত দুটো বাজে ফোন করল রাব্বি ।
-এতো রাতে ফোন দিলি যে ??
-স্নিগ্ধা ঘুমিয়েছে ??
সাবস্ক্রাইব করুন:
-একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ,পারবি ?? বন্ধুর জন্য জীবন থেকে একটা বছর পিছিয়ে পরতে হবে..পারবি ??
-হেয়ালি করিস না ,সোজাসুজি বল
-একটা ইয়ার গ্যাপ দিতে হবে,আমাদের ভর্তির টাকা দিয়ে স্নিগ্ধার অপারেশন করাবো । আর কোন পথ খোলা নেই
-তোর মাথা ঠিকাছে তো !!
-ঠিক না থাকার কিছু নেই ,পারবি কিনা বল ?? স্নিগ্ধাকে ব্যাপারটা জানানো যাবে না..
অমৃতার গলা জরিয়ে আসে । চাপা স্বরে শুধু বলে..
-টাকাটা সকালে স্নিগ্ধা ঘুম থেকে ওঠার আগে নিয়ে যাস!
অমৃতা ফোনটা রেখে দিলো । স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে আছে ,ওর চেহারায় কেমন একটা মা মা ছাপ পরে গেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে,ওর কপালে একটা চুমু খেল অমৃতা। স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো ।
-কাঁদছিস কেন অমৃ ??
-নারে ,এমনি । তুই ঘুমা
ভয় পাস না ,তোরা থাকতে আমার কিছু হবে না।
স্নিগ্ধাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল অমৃতা। যেন কিছুতেই হারাতে দেবে না স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা বাচ্চা মেয়ের মত চুপটি করে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে ।
[৬]
অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারী করছে অমৃতা আর রাব্বি । কি হবে ,কি হবে !! বিধাতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া ওদের আর কিছুই করা নেই। অমৃতা বারবার কান্নায় ভেঙে পরছিল । ডাক্তার শেষ মুহুর্তেও নিশ্চয়তা দিয়ে কি বলেন নি ।
হঠাত্ করে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খোলার শব্দ !! বুকের কম্পন বন্ধ হয়ে এলো ওদের !!
নার্সের মুখে মুচকি হাসি !!
[৭]
অমৃতা বললঃ
-দেখছিস একদম আমার মত হয়েছে
-তুইতো পেত্নী আর ওতো হয়ে পরী ,স্নিগ্ধার মত হয়েছে মুখটা আর হাত পা গুলা আমার মত । তোর কিছুই পায়নি..
রাব্বী হো হো করে হেসে উঠল,স্নিগ্ধাও মিষ্টি করে একটা হাসি দিল ।
-আচ্ছা স্নিগ্ধা তুই বল কেমন হয়েছে দেখতে ?? আমার মত সুইট না ??
স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বললঃ
-ওতো তোদেরই মেয়ে । তোদের মতই হয়েছে । তা এখন মেয়ের নাম রাখবি না ??
-ওর নাম হবে টুকি
বলল রাব্বি
-টুকি পচা নাম ,ওর নাম হবে জেসমিন
প্রতিবাদ করল অমৃতা
-ধুর ,জেসমিন বুড়ির নাম ।
-তাইলে সালমা ??
-এটা খালা খালা লাগে
-সাদিয়া ??
-হুর ,এইটা ফুপ্পি ফুপ্পি লাগে
-সুষমা ??
-তোর কোন পছন্দ আছে ?? এইটাতো জেঠী জেঠী লাগে
রাব্বি চটে গেলো..
-বুঝিতো আমার কোন কিছু আপনার পছন্দ হবে না । স্নিগ্ধা তুই বলতো একটা নাম....
-তৃপ্তি
আনমনেই বলে উঠল স্নিগ্ধা। রাব্বি আর অমৃতার নিরবতাই বলে দিল ওদের কোন আপত্তি নেই।
তৃপ্তিকে ওর মায়ের কোলে তুলে দিল অমৃতা । স্নিগ্ধার মুখে তৃপ্তির হাসি । সব কষ্ট ভুলে যায় রাব্বি ,অমৃতাও ভুলে যায় রাতের পর রাত স্নিগ্ধার মাথার পাশে বসে কাঁটানোর কষ্ট । ওরাতো এতটুকুই চেয়েছিল ,ওদের প্রিয় বন্ধুটার মুখে একটু খানি তৃপ্তির হাসি ।
বন্ধুত্ব অমর হয়ে থাক ।
অন্তরে অন্তঃস্থল থেকে ভালবাসা জানাই সকল বন্ধুদের ।
সাবস্ক্রাইব করুন:
By Bbc Sukh Tara