গল্পঃ বউ সাজিয়ে দিবি আমায় বউ

আমারে বউ সাজিয়ে দিবা বউ!
"
হঠাৎ করেই কানে আসলো মিশমির কন্ঠ। দৌরে ছুটে গেলাম মিশমির কাছে। পাশের বাসার মেয়েটিকে বলছিলো এতোক্ষণ। এখনো বলছে।
"
"
আমাকে বউ সাজিয়ে দিবা বউ?
"
"
মিশমি আর এসব বলো না মা।
-কেন আম্মু?
-এসব বলতে নেই কেমন।
-আচ্ছা।
"
"
ভিতরটা একদম যেন কেপে কেপে উঠছে।বার বার মনে পরে যাচ্ছে সেই মানুষটির কথা। যা চাইলে ও মন থেকে কখনো দূরে
যায় না।
"
"

তখন কতোই বা বয়স ছিলো আমার? এইতো সবে ক্লাস ফোরে উঠেছি। আমার আপুর সাথে প্রতিদিন নিয়ম করে পুতুল খেলা কখনো মিস যেতো না। যদিও সে আমার ৫ বছরের বড়। পুতুল খেলার ছলে কতোই না বউ সাজিয়েছি পুতুল কে। যখনই দেখতাম আপুর পুতুল গুলো কে সুন্দর লাগছে তখন খুব মন খারাপ হতো। ছোট্ট করে বলতাম!
"
"
-আপু তোর যখন বিয়ে হবে পুতুল গুলো শুধু আমাকে দিবা আর কাউকে না।
"
"
হাসতে হাসতে আপু লুটিয়ে পরতো। ইসসস কি সুন্দর সেই হাসি। অপলক ভাবে চেয়ে থাকতাম আমি। হঠাৎ করে আপু বলে ফেলতো।
"
"
-হ্যা রে মিতু দিয়ে দিবো সব তোকে। তুই যত্ন করে রেখে দিস কিন্তু। আর জানিস আমাকে তোরা কেউ সত্যিকারের বউ সাজতে দেখবি না। যদি মন চায় এখনি সাজিয়ে দেখে নে।
-কেন আপু এমন বললা কেন?
-এমনি!
"
"
আবার আপু সেই ভাবে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরতো।
"
"
একদিন বিকেলে এক ছুটে মাঠে উপর দিয়ে দৌরাচ্ছি। গন্তব্য বড়ই গাছ থেকে বড়ই পারবো। হঠাৎ করেই আপু বলে উঠলো।
"
"
-মিতু আমি খুব শিঘ্রই ইশানের কাছে যাবো রে। আমার পুতুল গুলো সব তোকে দিয়ে দিলাম। বাসায় গিয়ে বুঝে নিস কিন্তু।
-কি বলো এসব আপু? ইশান কে?
-তোর দুলাভাই!
"
"
আবার সেই হাসি শুরু হলো। তখন এতো বোধগম্য হয়ে উঠেনি কি বললো না বললো। পুতুল পাওয়ার আনন্দে বড়ই পেরে খেয়ে সব ভুলেই গেলাম। বাসায় এসেই পুতুল নিয়ে নিলাম আমি। তবুও আপু আমার সাথে নিয়ম করে পুতুল খেলে।
"
"
৩ দিন পর স্কুল থেকে এসে শুনলাম আপু স্কুল থেকে বাসায় ফেরেনি। কারো সাথে চলে গেছে। কে সে তা আমার পরিবারের সবাই জানে। সবাই যেনে ও গেলো উর্মি ইশানের সাথে পালিয়েছে। রাতের মধ্যেই জানতে পারলাম বিয়ে করে নিয়েছে এক নোয়াখালীর ছেলেকে। আর বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন বড় ফুপি। ঢাকাতেই তাদের বিয়ে হয়। আমরা গ্রামে থাকি। বাড়ির কেউ মেনে নেয়নি এই ছেলেকে। ঢাকা থেকে কিভাবে সম্ভব মেয়েকে এক অন্য বিভাগের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া?
"
"
খুব কান্না করলাম আমি। নিজে না বোঝার জন্য। সেদিন যদি আপুর কথার মানে বুঝতাম আজ হতো এমন না ও হতে পারতো! আমি আর পুতুল ধরলাম না। খেলতে ইচ্ছে হয়নি আর। যত্ন করে রেখে দিয়েছি আপুর পুতুল গুলো।
"
"
সময় চলতেছে সময়ের মতো। আমরা ও কিছুটা স্বাভাবিক। বড় ফুপির সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। আম্মু আপুকে নিয়েই আসবে পণ করলেন। সে কিছুতেই আপুকে অন্য বিভাগে যেতে দিবে না। ভয় করে যদি কিছু হয়ে যায়। কতো কিছুই তো ঘটছে প্রতিনিয়ত ।
"
"
২৯ দিনের দিন আপু কে নিয়ে বাসায় আসলো আম্মু। ছুটে গিয়ে আপু জড়িয়ে ধরলাম। খেয়াল করে দেখলাম আপু আগের চেয়ে ও অনেক ফর্সা হয়েছে মোটা হয়েছে । আপুকে আগের থেকে ও বেশি সুন্দর লাগছে। হয়তো আপু ভালোই ছিলো ভাইয়ার কাছে! কিন্তু অবাক হলাম একটা বিষয়ে আপু আগের মতো হাটছে না। গ্রীল ধরে আস্তে আস্তে হাটছে। ভাবলাম হয়তো ক্লান্ত তাই।
"
"
আবার শুরু হয়ে আপুর আর আমার নিয়ম করে পুতুল খেলা। ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই আপুর মন খারাপ হয়ে যেত। যতদূর জানতাম আপুকে আর ভাইয়ার কাছে দিবে না। ভাইয়া ও ফোন করেনি আর তাই আমরা ও আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম।
"
"
এক বছর যেতে না যেতেই আপু অসুস্থ হয়ে পরলো। আমার আপু একা হাটতে পারে না। সবসময় কারো না কারো সাহাজ্য লাগতো। আপু কষ্ট পেতো খুব আমরা ও পেয়েছি। কিছু করার ছিলো না। আমরা হয়ে যাই আপুর হাটা চলার পা। আপুর এই অবস্থাতেই তিশা নিশু আর আমি আপুকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতাম। পুতুল খেলা ঠিক আগের নিয়মেই চলে। তবে স্কুলে যাওয়ার পর আপু একা একা খেলতো।
"
"
৩ টা বছর কেটে গেলো আরো। ক্লাস এইটে উঠলাম। মোটামুটি পড়াশোনার চাপ ভালোই সামনেই জেএসসি পরিক্ষা। সারাদিন স্কুল প্রাইভেট নিয়েই দিন কেটে যেত। আপুর অবস্থার উন্নতির থেকে অবনতি হয়েছে। অল্পেই রেগে যায়৷ সারাদিন পর স্কুল থেকে আসলেই আপু ডাকতো বাইরে বের হবে। একটু দেরী হলেই বসে কান্না জুড়ে দিতো বাচ্চাদের মতো। তবে কষ্টটা ছিলো প্রখর।
"
".
-আমি তোদের অনেক কষ্ট দেই তাই নারে মিতু। আল্লাহ কেন আমাকে বাচিয়ে রাখছে? এর চেয়ে মৃত্যু ভালো। তোরা ও ভালো থাকতি। একটা পঙ্গু মানুষ বিরক্ত করতো না তোদের।
"
"
আপুর মুখে পঙ্গু শব্দ টি শুনে রাগ উঠে গেলো। আজ অবদি কেউ এমন কথা আমরা বলি নি। বাইরের কেউ বললেও ছেড়ে দেয়নি। আপুকে ও বলতে লাগলাম।
"
"
-আপু উল্টা পালটা কিছু বলবা না। কখনো বলছি তুমি বিরক্ত করো? মাত্র স্কুল থেকে আসছি দেখো ড্রেস ও গায়ে আছে। এতো রাগ করো কেন? একটু তো দেরী হতেই পারে। আর কি বলো এসব? পঙ্গু কি হ্যা? এসব আর বলবা না।
-যা সত্যি তাই। যা তুই, আমার কাছে আর আসতে হবে না।
"
"
আপুকে জড়িয়ে ধরলাম তার চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে কান্নায়। ব্যর্থতার কান্না। হাটতে না পারার ব্যর্থতা কতো টা কষ্টের পুরো টা না বুঝলে ও ৮০% বুঝে গেছি আমার আপুকে দেখে।
"
"
কেটে যায় আরো একটি বছর। এতোদিন ভাইয়ার কথা অল্প বললেও এখন ঘন ঘন বলে। সেই আগের নাম্বার আপুর এখনো মুখস্ত। বার বার কল দেয়। নাহ নাম্বারটি অফ। আমি ও ক্লাস নাইনে ভর্তি হই। আপু আরো অসুস্থ একটু পর পর বলতে থাকে।
"
"
-মিতু ইশান কে আমি অনেক ভালোবাসিরে। আমার অনেক ইচ্ছে করে ইশানের সাথে কথা বলতে। আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিবি।
-আপু এতোই ভালোবাসো যখন কেন ভাইকে রেখে চলে আসলা?
-আম্মু নিয়ে আসলো। আমি তো আর জানতাম না আমি আর যেতে পারবো না।
-আপু তুমি যখন ভাইয়ার কাছে ছিলে কি সুন্দর হয়েছিলা। এখন কেমন রোগা হয়ে গেছো ভাইয়ার দেওয়া ড্রেস তো লাগেই না। ভাইয়া তোমাকে ভালোই রেখেছিলো তাই না?
-হুম। জানিস মিতু ও বড্ড ভয় পেতো আমায় নিয়ে। আমি তো রান্না জানতাম না। আমাকে রান্না করে খাওয়াতো। কোনো ছেলে ফ্রেন্ড কে বাসায় নিয়ে আসতো না। যদি কেউ আমার দিকে তাকায়। জানিস মিতু আমি জেদ ধরতাম অনেক। মাঝে মাঝে তোর ভাইয়াকে আমার রুমেই আসতে দিতাম না। তবুও ইশান আমাকে খুব ভালোবাসতো। এখনো হয়তো
- কচু ভালবাসে এখন।
"
"
রাগ করে বললাম। আপু ভালবাসে বলার আগেই।

সাবস্ক্রাইব করুন:

"
"
-এভাবে বলছিস কেন?
-তোমায় যদি ভালোইবাসতো আপু ও আসতো তোমায় নিতে। কারন এখনো তুমি ওর বউ। ডিভোর্স হয়নি তোমাদের।
-ও তো বাসা চিনে না।
-স্কুল থেকে নিয়ে যেতে পেরেছে। এখানে আসতে পারবে না? গ্রামের নাম তো অজানা নয়?
-ভয় পায় আম্মু ওরে হুমকি দিছে।
-আপু আম্মু এতোটা ও খারাপ না। কি করতো বকা ঝকাই করতো বেশি করলে। মেরে তো ফেলতো না। একা না আসুক কয়েকজন নিয়ে এসে যদি বলে তার বউ সে নিয়ে যাবে আমাদের কি কোনো কথা থাকতো? থাকতো না।
-অনেক বুঝে গেছিস।
-এতোটা অবুঝ নেই আর আপু। তোমার কষ্ট দেখতে দেখতে বুঝে তো গেছি অনেক। ৫ বছরের ছোট হলেও আমারা বন্ধুর মতোই থাকি।
-মিতু কোনো একদিন ইশানের খোজ পেলে বলে দিস তার উর্মি তাকে অনেক ভালবাসে অনেক কথা বলতে চেয়েছে।
-আপু এভাবে কেন বলো? ভাগ্যে থাকলে ভাইয়া আসতে ও পারে।
"
"
এভাবে গল্পে পুতুল খেলায় কাটতো আমার আর আপুর জীবন। মাঝে মাঝে হাসি পেতো ক্লাস নাইনে এসেও আমি পুতুল খেলছি। কিছুক্ষন পরেই আবার একাই বলতাম আপু তো কবেই বড় হয়ে গেছে তবুও তো আপু খেলে আমার সাথে আরো ছোট বোনদের সাথে।
"
'
দেখতে দেখতে রোজা এসে গেলো ২০১৪ সাল । আপুর অবস্থা অনেক খারাপ। সারাদিন কান্না করে। কাছে গেলেই রেগে যায়।
"
"
রহমতের ৬ রোজা। আমি রোজা রেখেছি। আপু অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। তবুও সে রোজা থাকবে। ডাক না দেওয়ায় কিচ্ছু খাবে না। অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে।
"
"
-আপু কিছু খেয়ে নাও।
-আমার ধারের কাছেও আসবি না তোরা কেউ।
"
"
হাসতে হাসতে বললাম।
"
"
-১০০ বার আসবো। তাতে তোমার ইশানের কি?
"
"
আপু বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিলো। আমার চোখেও পানি এসে গেলো। আর কিছু বললাম না।
"
"
৮ রোজা আপু ২ দিন যাবত কিছুই খাইতে পারছে না। পানি ও খাচ্ছে না। আমি জোর করেই আপুকে জুস খাওয়ালাম। আপু আস্তে করব বললো। যেন গলার স্বর আটকে আসছে।
"
"
-আমায় বউ সাজিয়ে দিবি বউ? এই মিতু আমায় বউ সাজিয়ে দিবি? আজ আমাকে সাজিয়ে দে মিতু। আমাকে যে আজ আর রাখতে পারবি না তোরা।
-আপু কি বলো এইসব? এসব কথা বন্ধ করো।
-আমাকে চুপ থাকতে বলিস না মিতু একবারে চুপ হয়ে যাবো। বলতে দে কথা।
-আপু চুপ থাকো।
"
"
কান্না করে দিলাম আমি। সাথা সাথে ভাইয়াকে কল দিলাম। চাচাতো ভাই ডক্টর।
"
"
মিতু ভাইয়ারে ফোন দিয়ে লাভ নেই। আমাকে সাজিয়ে দে। আমাকে আর রাখতে পারবি না।
"
"
মনের ভেতর একটা কথা বলতে লাগলো আপু আর বাচবে না। বার বার কে যেন মন থেকে বলে উঠে মিতু তোর উর্মি আপু আর বাচবে না। আজকেই তার শেষ দিন পৃথিবীতে। মনকে যা ইচ্ছে তাই বলে বকে দিলাম আমি। সব কিছু বাদ দিলে ও এই কথাটাই মন বলতেছে।ভয় পেলাম আমি।
"
"
ভাইয়া আসলো। স্যালাইন দিবে৷ আমাকে বললো।
"
"
-মিতু উর্মিকে একটু উঠিয়ে বসা তো।
-আচ্ছা ভাইয়া।
"
"
আপুকে উঠিয়ে বসালাম। প্রতিদিন যেমন বসাই। আপু বসা মাত্রই আমি টেবিল থেকে কিছু একটা আনতে যাবো আপু বসা অবস্থায় পরে গেলো। আমার বুকটা যেন কেমন করে উঠলো। চোখ পানি সব কিছু ভার ভার লাগছে। ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো।
-এমন ভাবে পরে যায় সবসময়।
-না।বসেই তো থাকে।
"
"
ভাইয়া কিছু বললো না। আপু বললো।
-মিতু আমায় একটু উঠা।
"
"
উঠালাম আমি। আপু আমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। সারাক্ষন বুকে করে রাখলাম আপুকে। শুয়ে দিয়ে স্যালাইন দিলো আপুকে। আপু হাত পা কেমন ছটফট করতে লাগলো। আবার আপুকে বুকে নিয়ে রইলাম অনেকক্ষন। মাঝে মাঝে বাড়ির সবাই দেখতে আসছে। ঘড়িতে ৩ঃ২৫ বাজে। রোজা থাকার কারনে বড় আপু কে বললাম। আপু তুমি একটু বসো আমি খুব তারা তারি গোসল করে আসছি।
"
"

তিশা ও ছিলো তখন। নিশু ছিলো না। সে বেড়াতে গিয়েছে। জানে না আপুর এই অবস্থা। আমাকে আর নিশুকে আপু সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতো।
"
"
আপুকে বুকে থেকে নামিয়ে বালিসে মাথা রাখলাম আপুর। আপু করুন চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে।
"
!
আমি ঝটপট গসল করলাম ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে কান্নার আওয়াজ কানে আসতে চমকে গেলাম আমি। হাত পা কেমন যেন কাপছে আমার। দৌরে গেলাম আমার আপুর কাছে। নিথর দেহ পরে আছে আমার আপুর। কতো সুন্দর দেখাচ্ছে আমার আপুর।বার বার কানে এসে বাজতে লাগলো আমার আপুর সেই কথাটি।
"
"
"বউ সাজিয়ে দিবি আমায় বউ। এই মিতু বউ সাজিয়ে দিবি আমায় বউ"

সাবস্ক্রাইব করুন:

#অর্থিয়া_অর্থী(মিতু)
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url